তোমরা কুঞ্জ সাজাও গো…..
পর্বঃ ৩
“তোমার নাম কি?”রাবেয়া সামনে বসা ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করল।
“জি, ইয়াসিন”
“পুরো নাম কি?”
“জি, ইয়াসিন আলী”
“ইয়াসিন আলী তুমি কি কাজ করো?”
“জি আমি একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরী করি। মার্কেটিং অফিসার।” ইয়াসিন খুব ভাব নেওয়ার চেষ্টা করল। লেংরি মহিলা কেন তাকে ডেকেছে বুজতে পারছে না। তবে আনন্দের ব্যাপার সপ্না সামনে আছে। মেয়েটার চেহারায় বেশ চটক আছে। কোনভাবে ফুঁসলিয়ে ওদের ফ্ল্যাটে নিতে পারলেই হল।
“মার্কেটিং অফিসার? কিন্তু তোমাকে তো আমি অফিসে যেতে দেখিনা। সারাক্ষণই তো দেখি বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকতে।”
ইয়াসিন থতমত খেয়ে গেল। “জি মানে সবজায়গায় আমাকে যেতে হয়না। আমার অধীনে লোক আছে। ওরাই যায়। এসে রিপোর্ট করে।ঝামেলা হলে আমি যাই।”
“বাড়ি কোথায়?”
“জি নড়াইল।”
“বাড়িতে কে কে আছে?”
“জি, আমার?”
“হুম তোমার।” রাবেয়ার বিরক্ত লাগছে কথা বলতে। ছেলেটার চেহারায় একটা ধূর্ততার ছাপ রয়েছে। বুদ্ধিমান মানুষ পছন্দ করা যায়, কিন্তু ধূর্ত মানুষ পছন্দ করা যায় না।
“জি আব্বা-আম্মা আর ছোট দুইটা ভাইবোন।” ইয়াসিনের শরীর ঘামছে। মহিলা এত প্রশ্ন জিজ্ঞেস করছে কেন? শালী লেংরি!
“তোমার বাবা কি করেন?”
“জি আমাদের একটা মুদির দোকান আছে। আব্বা দোকানে বসেন। অল্প কিছু জমি আছে বর্গা দেয়া।”
“হুম। শোনো ইয়াসিন। আমি একটা জরুরি কথা বলার জন্য তোমাকে এখানে ডেকেছি। এটা তোমার বাবার সাথে বলা দরকার ছিল। কিন্তু তোমার বাবা যেহেতু এখানে থাকেন না তাই তোমাকেই বলছি। সপ্না আমার মেয়ের মত। আমি জানি তোমরা একজন আরেকজনকে পছন্দ কর।আমার মনে হয় তোমাদের বিয়ে করে নেয়া উচিত। তোমার বাবাকে আসতে বলে দাও। আমি ওনার সাথে কথা বলতে চাই।”
ইয়াসিন হতভম্ব হয়ে গেল। এই লেংরি বলে কি? টোপটা কি ভুল জায়গায় পড়ল? এখান থেকে তাড়াতাড়ি কেটে পরতে হবে।এই মহিলা সাংঘাতিক।
“জি আমার পড়া তো এখনও শেষ হয়নি।”
“তুমি না বললে তুমি চাকরি কর।”
“জি তিতুমীর কলেজে অনার্স পরছি। মার্কেটিং-এ।”
“পড়াশুনা শেষ করার আগেই চাকরি করছ?”ইয়াসিন ঘামতে শুরু করল।
“পানি খাও।”
ইয়াসিনের সামনে পানি রাখা ছিল। তবু সপ্না এসে পানির গ্লাস হাতে তুলে দিল। বেচারা ম্যাডামকে দেখে ভয় পেয়ে গেছে। রাবেয়ার মেজাজ খারাপ হয়ে যাচ্ছে।
এমন সময় ময়নার মা এসে খবর দিল “খালাম্মা, তিনতলার বাদল ভাই আসছেন। আপনের লগে দেহা করতে চায়।”
এই সুযোগে ইয়াসিন বলল “আচ্ছা, আমি যাই। আসসালামু আলাইকুম”
রাবেয়াকে আর কিছু বলার সুযোগ দিল না। সপ্নার মনটা খারাপ হয়ে গেল। বেচারা অনেক ভয় পেয়েছে।
“বাদলকে আসতে বোলো। সপ্না তুমি ও যাও এখান থেকে।”
*****************
ইয়াসিনের সাথে কথা বলে রাবেয়ার যতটা মেজাজ খারাপ হয়েছে বাদলকে দেখে তার চেয়ে অনেক বেশি পরিমানে মন ভাল হয়ে গেছে । বাদলের মত সুন্দর ছেলে রাবেয়া তার জীবনে আর একটিও দেখেনি।ওরা ভাই- বোন দুইজনই দেখতে অনেক সুন্দর, ওদের বাবার মত দেখতে। ওদের পারিবারিক এ্যালবামে বাদলের বাবার ছবি দেখেছে রাবেয়া। সুন্দর ছেলেরা সাধারণত বুদ্ধিমান হয় না। কিন্তু বাদল যথেষ্ট বুদ্ধিমান একটা ছেলে, চিন্তা-ভাবনাও অনেক পরিস্কার। বাদল যখন ইউনিভার্সিটিতে পড়ত তখন বাদলই সব বই এনে দিত রাবেয়াকে। তখন বই নিয়ে অনেক কথা হত বাদলের সাথে। এখন ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার পড় রুনিই বই এনে দেয়।
“আসসালামু আলাইকুম আন্টি।”
“ওয়ালাইকুম আসসালাম। বোসো বাবা। কেমন আছ?”
“জি আন্টি ভাল আছি। আপনার শরীর কেমন? ”
“ শরীর আছে মোটামুটি। শরীর ভাল থাকলেই কি আর সব ভাল থাকে বাবা? বিছানায় পড়ে থেকে কততুকু আর ভাল থাকা যায় বল?”
“ যারা নিয়মিত বই পড়ে তারা কখনও খারাপ থাকে না আন্টি। একটা বই পড়ে মন খারাপ হয়ে গেল, আরেকটা বই হাতে নিল। কিছুক্ষণ পড়ার পড় মন অটোমেটিক্যালি ভাল হয়ে যাবে। তাছাড়া বই পড়ে আপনি কত কম সময়ে কত দূর দেশে যেতে পারছেন চিন্তা করে দেখুন। আপনার গ্রাম বাংলার প্রকৃতি সম্পর্কে জানতে চান বিভূতিভূষণের বই পড়েন। পশ্চিমা দেশ সম্পর্কে জানতে ইচ্ছে করল। Western বই পরুন।আবার রাশিয়া সম্পর্কে জানতে ইচ্ছে করছে, ম্যাক্সিম গোর্কী পড়ুন। কত কম সময়ে আপনার ওয়ার্ল্ড ট্যুর হয়ে গেল দেখুন।”
রাবেয়ার খুব ভাল লাগছে শুনতে। ছেলেটা এত সুন্দর করে কথা বলে ওর সাথে কথা বললে কারো মন খারাপ থাকতেই পারে না।
এই সময়ে সপ্না চা- নাস্তা নিয়ে এল।
“খাও বাবা।”
“না আন্টি, আমি নাস্তা করে এসেছি।”
“তো কি হয়েছে? আন্টির বাসায় এসেছ একটা কিছু নাও।” বাদল চা তুলে নিল।
“তারপর তোমার চাকরী খোঁজার কি হল?”
“এই তো, একটার পর একটা ইন্টারভিউ দিয়ে যাচ্ছি। দেখা যাক কি হয়।”
“তোমার একটা সিভি আমাকে দিয়ো। রুনির বাবাকে দিব। ওর তো অনেকের সাথে যোগাযোগ আছে। দেখি কিছু করা যায় কিনা।”
“জি আন্টি দিব।”
“ তোমার সময় বেশি নষ্ট করব না বাবা। কাজের কথা বলি। রুনি বলেছে কিনা জানিনা, রুনির বিয়ে ঠিক করেছি।”
কথাটা শোনার পর বাদল মনে হল একটু ধাক্কা খেল। বাদল একটু ঢোঁক গিলল মনে হয়। রাবেয়ার চোখ এড়াল না।
“না, রুনি তো কিছু বলেনি।”
“মেয়েরা বিয়ের ব্যাপারে কথা বলতে একটু লজ্জাই পায়।” রাবেয়ার কৌতুক ভরে তাকিয়ে আছে।
“ভাল খবর তো। ছেলে কি করে?”
“ছেলে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। কানাডা থাকে।এম এস সি করে এখন চাকরি করছে। ভাল বেতন পায়। দেশে এসেছে বিয়ে করার জন্য। বিয়ের ৬ মাসের মধ্যে বউকে কানাডা নিয়ে যাবে।”
বাদল চুপ করে শুনছে। “ছেলে অবশ্য রুনিকে দেখেছে।রুনির ইউনিভার্সিটিতে গিয়েছে ওর এক বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে। রুনিকে দূর থেকে দেখেই পছন্দ করেছে।”
গায়ের রঙ দুধে- আলতা না হলেও রুনিকে উজ্জল শ্যামলা বলা যায়। বাদলের অনেক বন্ধু রুনিকে পছন্দ করেছিল। এক বন্ধু তো নিজের রক্ত দিয়ে চিঠি লিখেচিল।
বাদল জিজ্ঞেস করেছিল “তোর রক্তের গ্রুপ কি?”
“বি- নেগেটিভ” বন্ধুটি জবাব দিয়েছিল।
“তুই জানিস তোর রক্ত কতটা রেয়ার। তোর উচিত নিয়মিত ব্লাড ব্যাংকে রক্ত দেয়া। আর তুই এখানে মেয়েদের রক্ত দিয়ে চিঠি লিখে বেড়াচ্ছিস। ফালতু কোথাকার” এই বলে চিঠিটা ছিঁড়ে ফেলেছিল। এই ঘটনার কয়েকদিন পর আরেক বন্ধুর মাধ্যমে জানতে পেরেছিল বাদল রুনিকে পছন্দ করে।
ইউনিভার্সিটি তে ভর্তি হওয়ার পর একবার ইদের সময় বাদল কয়েকজন বন্ধুকে বাসায় দাওয়াত দিয়েছিল। তাদের মধ্যে একজন রুনিকে পছন্দ করে ফেলে। বাদল বলেছিল “ওর বিয়ে ঠিক হয়ে আছে। ওর খালাত ভাইয়ের সাথে। আমেরিকায় থাকে।” মাসখানেক পর বাদল আর রুনিকে একসাথে চারুকলার সামনে রিকসায় যেতে দেখে বন্ধুটি বুঝে গিয়েছিল খালাত ভাইটা আসলে কে। যদিও বাদল কারো কাছে কখনও স্বীকার করেনি রুনিকে পছন্দ করার কথা, এমনকি রুনির কাছে না। তবুও সবাই সবকিছু বুঝতে পেরেছিল।
“ছেলেপক্ষ আগামি বুধবার আসবে রুনিকে দেখতে। ঐদিনই আকদ করে ফেলতে চায়।”রাবেয়া বলল। একটু চুপ থেকে আবার বলল “তুমি তো জানই রুনির বাবা তেমন সংসারী না। হাসপাতাল ছাড়া লোকটা আর কিছুই জানেনা। বড় করেই হোক আর ছোট করেই হোক বিয়ে তো বিয়েই। লোকজন আসবে, খাওয়া-দাওয়া হবে। তোমাকে বাবা একটু সাহায্য করতে হবে আন্টিকে।”
“কি সাহায্য?”বাদলের প্রশ্ন।
“বাড়িতে আর খাবারের ঝামেলা করতে চাই না। বাইরে থেকে খাবার আসবে।ফখরুদ্দিন এর বিরিয়ানি।সাথে মিষ্টি, পান-সুপারির ব্যবস্থা থাকবে। আর একজন কাজি যোগাড় করতে হবে। তোমাকে বাবা এসবের ব্যবস্থা করতে হবে।”
“আপনি চিন্তা করবেন না আন্টি। সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে।”
রাবেয়া একটা খাম এগিয়ে দিয়ে বলল “এখানে টাকা আছে। লাগলে বোলো।”
বাদল উঠে খামটা নিল।“কিছু মনে করো না বাবা। তোমাকে একটু কষ্ট দিলাম।”
“না আন্টি,এ আর এমন কি কষ্ট। রুনির বিয়েতে এইটুকু তো আমি করতেই পারি।” বাদলের গলাটা একটু ভারি মনে মনে হল রাবেয়ার।
“ঠিক আছে আন্টি, আজ আমি আসি।”
“ঠিক আছে বাবা, আবার এসো।”বাদল ঘর থেকে বের হয়ে গেল। দরজার বাইরে রুনির উপস্থিতি টের পেল না।
***********************
রাতে বাদল ছাদে উঠে দেখে রুনি দাঁড়িয়ে আছে। এক দৃষ্টিতে অনেক দূরের উঁচু ঝলমলে দালানগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে। বাদলের উপস্থিতি টের পেল না।
“সকালে আসলি না যে?”
“ইচ্ছে করেনি।”
“তা বিয়েটাও কি নিজের ইচ্ছেতেই করছিস?” বাদল সিগারেট ধরাল। রুনি জবাব দিল না।
“বিয়ে ঠিক হয়েছে বললি না যে?” রুনি নিরুত্তর।
“তা কি করে তোর হবু-বর?”
“মা তো তোমায় সব বলেছে। আবার জানতে চাও কেন?”
“তোর মুখ থেকে শুনতে চাচ্ছিলাম। দেখা হয়েছে? ফোন দেয়?”
“ওইরকম কিছুই হয়নি।” একটু চুপ থেকে প্রশ্ন করল, “বাদলদা তোমাকে একটা প্রশ্ন করব?”
“কি?”
“তুমি কখনও কাউকে ভালবেসেছ?”
কিছুক্ষণের নীরবতা। বাদলদা এত সময় নিচ্ছে কেন প্রশ্নের জবাব দিতে?
“না।”সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে জবাব দিল বাদল “তোর কি পছন্দের কেউ আছে?”
“না।” অনেক বছর ধরে একে অন্যকে চিনেছে- জেনেছে, বাইরে ঘুরেছে, নিজেদের ছোট ছোট কথাগুলো শেয়ার করেছে। দুজনের কারো যদি কোন পছন্দ থাকতো তা অজানা থাকার কথা না। এটা কি শুধু স্বীকারোক্তি ছিল নাকি কোন আহবান ছিল “আমি অনেক কাল ধরে তোমার জন্য অপেক্ষা করছি, তুমি কি আমায় গ্রহন করবে?” (চলবে)