তোমরা কুঞ্জ সাজাও গো……..
পর্বঃ ৪
নিলুফা রুম থেকে বের হয়ে যাচ্ছিলেন। পেছন থেকে রাবেয়া ডাক দিল “চলে যাচ্ছ যে।”
“আমি ভাবলাম ঘুমুচ্ছ।”
“না, চোখটা একটু লেগে এসেছিল। ঘুমুইনি। এসো। কতদিন পর আসলে।”
“আর বোলো না। স্কুল শেষে বাসার কাজ করেই দিন শেষ হয়ে যায়। সময়ই পাইনা। ছোট মাছের তরকারী পাঠিয়েছিলাম। কাঁচা আম দিয়ে রান্না করেছি। খেয়েছ?”
“ হুম খেয়েছি। আজ সপ্নাও কাঁচা আমের সরবত করেছে।কাঁচা আম সেদ্ধ করে আমটুকু নিয়ে তার সাথে কাঁচামরিচ, বিটলবন আর চিনি দিয়ে ব্লেন্ড করা। ভালই লেগেছে। রুনির বাবার খুব টক খাওয়ার নেশা। গরমের দিন এলে কাঁচা আম আর শীতের দিন হলে টমেটো দিয়ে টক রান্না করতে হত।”
“তাই নাকি? তাহলে মিলিকে দিয়ে একটু তরকারি পাঠিয়ে দিব রাতে।”
“আরে না না। এত কষ্ট করতে হবে না, এমনিতেই রাত্রি বেলা টক খাওয়া ঠিক না। তা কোথায় গেল তোমার মেয়ে আর আমার মেয়ে?”
“মিলির এক বান্ধবীর বোনের বিয়ে। ঠিক করেছে হলুদে সবাই মিলে শাড়ি পড়বে। তাই একটু নিউমার্কেটে গেল।”
“নিউমার্কেট কেন? মৌচাকেই তো ভাল শাড়ি পাওয়া যায়। রিক্সায় করে এত দূর যাওয়ার দরকার কি? ওর বাবাকে বললেই তো গাড়ি পাঠিয়ে দিত।”
“কেন এত চিন্তা করছ? রুনিতো প্রতিদিন রিক্সা করে ইউনিভার্সিটি যায়।”
“প্রতিদিনই চিন্তা হয় বুবু। মেয়েটা এতটা পথ রিক্সা করে ইউনিভার্সিটি যায়, পথে কত রকমের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে, তারপর আবার রাস্তায় রাস্তায় বখাটেদের আড্ডা।এই পুলিশ ফাঁড়িতেই তো ভার্সিটির গাড়ি আসে।বলে ভিড় থাকে, উঠতে পারি না।কত বাহানা।”
“থাক না। ওর যেটাতে ভাল লাগে সেটাতেই যাক না।এত রাগ কর না মেয়ের উপর। এমনিতেই তো মেয়েটাকে পর করে দিচ্ছ।”
“ওহ, বাদল বলেছে বুঝি। বাদল কোথায় গো?”
“ও তো টিউশানিতে গেছে। ২টা পড়ানো আছে। আসতে আসতে ৬ টা বাজবে। দরকার আছে? পাঠাব?”
“না, এমনি জিজ্ঞেস করলাম।” যাক রুনিদের সাথে যায়নি তাহলে।মনে মনে ভাবল রাবেয়া।
“কই ছেলের ছবি দেখাও। দেখি কোন রাজপুত্র এসে আমাদের রাজকন্যাকে জয় করে নিল।”
“এই যে নাও।” রাবেয়া বিছানার পাশের ড্রয়ার থেকে খাম বের করে দিল।
“বাহ বেশ তো দেখতে। ছেলের কি করে?”
“সাথে বায়োডাটা আছে। দেখ না।”
বায়োডাটা পড়ে রাবেয়াকে ফেরত দিয়ে বলল, “খুব ভাল।এত দূরে মেয়ের বিয়ে দিচ্ছ রাবু। ভাইজান তো হাসপাতালে সারাটা দিন থাকে। রুনি চলে গেলে তো তুমি তো পুরো একা হয়ে যাবে।”
“মেয়ে এমনিতেও আমার কাছে আসে না বুবু। শুধু কোন কিছুর প্রয়োজন হলে এসে নিয়ে যায়। ওর থাকা- না থাকা আমার কাছে সমান বুবু” রাবেয়ার গলা ধরে আসল।
“হয়ত তোমায় ভয় পায়।”
“কেন? আমি কি বাঘ না ভাল্লুক?”
“ওসব কিছু না। তুমি একটু রাগী তো। তাই হয়ত মেয়ে একটু ভয় পায়।”
কথাটা পুরোপুরি মিথ্যে না। এক্সিডেন্টে ডান পা টা হারানোর পর খুব ভেঙ্গে পড়ে। কাউকে কাছে আসতে দিতেন না।মজিদ সাহেব-রুনি কাউকে না। মাকে এই অবস্থায় দেখে রুনিও ভয় পেয়ে যায়। রাবেয়া নিজেকে স্বামীর উপর বোঝা মনে করতে শুরু করেন। ছোটখাটো বিষয় নিয়ে ঝগড়া শুরু করতেন মজিদ সাহেবের সাথে।রাবেয়া চাইতেন মজিদ সাহেব তাকে ছেড়ে দিয়ে নতুন করে অন্য কারো সাথে সংসার শুরু করুক। ঝগড়াটা অবশ্য একপক্ষে হত। মজিদ সাহেব কখনও উঁচু গলায় কথা বলেনি।এক সময় ক্লান্ত হয়ে রাবেয়া নিজেকে বন্দী করে ফেলে চার দেয়ালের মধ্যে। মা ন্যাওটা রুনির আর ফেরা হয়নি মায়ের কাছে। অবশ্য ওর দোষ ও দেয়া যায় না। ৫ বছরের একটা বাচ্চা যেখানে ভালবাসা পাবে সেখানেই তো ছুটে যাবে। দিনের বেশির ভাগ সময় কাটতো বাদলদের বাসায়। রাবেয়ার এক্সিডেন্টের ছয় মাস আগে রুনিদের বাড়িতে ভাড়াটে হিসেবে আসে বাদলরা। সদ্য বিধবা নিলুফাকে বড় বোনের মত শ্রদ্ধা করত রাবেয়া।নিলুফা না থাকলে হয়ত পাগল হয়ে যেত রাবেয়া। পরম যত্ন দিয়ে নিলুফা সেদিন রাবেয়াকে সামলেছিল, রুনিকে সামলেছিল, আজও সামলাচ্ছে।
“হয়ত” রাবেয়ার উত্তর।
“ভাড়াটা রাখ। দেরী হয়ে গেল এই মাসে। আসলে বাদল সরকারী কিছু জায়গায় অ্যাপ্লাই করেছে তো। ব্যাংক ড্রাফট দিতে হয়েছে। অনেকগুলো টাকা চলে গেল।”
“তাইত করবে সরকারী অফিসগুলো।চাকরি হবে কিনা তার ঠিক নেই, ওনারা পরীক্ষা নিবেন তার জন্য আমাদের টাকা দাও। তবে বাদলের চাকরি হলে তুমি চাকরিটা ছেড়ে দিও বুবু। আর কত কষ্ট করবে বোলো?”
“তাহলে তো সবাই বলবে ছেলের টাকায় খাচ্ছি।”
“যে যাই বলুক তুমি কান না দিলেই তো হয়। ছেলে বড় হয়েছে, চাকরি করবে- মাকে খাওয়াবে। এটাই নিয়ম। কারো এখানে বলার কিছু নেই। তুমি শুধু ওর চাকরি হলে তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে দিবে-এই ব্যস। বাদলের পছন্দের কেউ আছে? জান নাকি?”
“ছেলে তো সব কথাই বলে।কখনও তো বলেনি কোন মেয়ের কথা। পছন্দ আছে কিনা বলতে পারব না। হয়ত মাকে জানাতে চায় না।”
বুবু কি সত্যিই জানেনা বাদল-রুনির কথা। নাকি জেনেও না জানার অভিনয় করছে। বুবু কি তাকে ভয় পায়? রাবেয়া মনে মনে ভাবল।
নিলুফার এখন সত্যি ভয় করছে। প্রচণ্ড ঝড় উঠেছে। রুনি- মিলি এখনও ঘরে ফিরেনি, বাদল ও ফেরেনি।কারেন্ট চলে গেছে। ঘরে মোম ও নেই। বাদল কি জানে? আসার সময় মোম নিয়ে আসবে তো? আজকাল চিকন মোম বের হয়েছে। মোটা মোমগুলো ভাল জ্বলে। চিকন মোমগুলো তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যায়। বাদল কি মোটা মোম আনবে? নিলুফা এক নাগাড়ে দোয়া ইউনুস পড়তে লাগলেন।দরজা ধাক্কানোর আওয়াজ হল। দরজা খুলতেই বাদল এসে ঢুকল।
“শিল পরছে বাইরে। ঘরে তো মোম নেই। এই নাও মোম।” বাদল মোটা মোমই এনেছে। “মিলি কোথায়?”
“মিলি আর রুনি নিউমার্কেটে গেছে। এখনও ফেরেনি।” নিলুফা মোম জ্বালাতে জ্বালাতে বললেন।
“ফেরেনি মানে? প্রেসক্লাবের দিকে তো দুপুরে গণ্ডগোল হয়েছে।রাস্তা বন্ধ।”
“কি বলছিস?আমার খুব ভয় লাগছে।কি করি বলত?”
“তুমি চিন্তা করনা। ছাতাটা দাও। দেখি রাস্তায় গিয়ে।”
বাদল ছাতা নিয়ে বেরুবে এমন সময় মিলি ঘরে ঢুকল। “ওফ মা কি ঝড় বাইরে। এত বড় বড় শিলা পড়ছে।” মিলি হাত দিয়ে যে সাইজ দেখাল তা একটা ফুটবলের সমান।নিলুফা তাড়াতাড়ি গিয়ে তোয়ালে নিয়ে এসে মেয়ের মাথা মুছতে লাগলেন।
“রাস্তা নাকি বন্ধ, তোরা গেলি কিভাবে?”
“আমরা তো নিউমার্কেট যেতে পারিনি। পরে মৌচাক গেলাম। জান মা কাকরাইলে একটা অনেক বড় মার্কেট হচ্ছে। কর্ণফুলী গার্ডেন সিটি। রুনি আপা বলেছে ঐখানে নাকি চলন্ত সিঁড়ি হবে। কি যেন বলে ঐটাকে।”
“Escalator.” বাদল উত্তর দিল।
“হাঁ হাঁ এটাই।”
“ঠিক আছে । গিয়ে কাপড় ছাড়ত। ভেজা জামায় ঠাণ্ডা লেগে যাবে। আর হাতে ঐটা কি?”নিলুফা তাড়া দিলেন।
“রুনি আপা আমাকে ফুচকা খাইয়েছে। তোমাদের জন্য কলিজার সিঙ্গারা পাঠিয়েছে।”
বাদল কলিজার সিঙ্গারা পছন্দ করে। রুনি জানে। মিলি ভেতরের ঘরে চলে গেল। রুনি আপা আজকে অনেকগুলো ভিউকাড কিনে দিয়েছে। সালমান শাহ্, শাহরুখ খান, কাজল আর এক নতুন নায়িকার- ঐশ্বরিয়া রায়। মেয়েটা এত সুন্দর।
দরজা ধাক্কানোর আওয়াজ। বাদল দরজা খুলল। রুনি এসেছে।
“মিলির এই প্যাকেটটা আমার ব্যাগে ছিল। কাল সকালে সোনারগাঁ যাব।”
“তো আমি কি করব?” আগের দিন রোদে দাঁড় করিয়ে রাখায় রাগ দেখাল বাদল।
“আমি ৯ টার দিকে গলির মোড়ে থাকব। চলে এসো।”
বাদল উত্তর দেয়ার আগেই রুনি চলে গেল। পেছন থেকে নিলুফা জিজ্ঞেস করলেন “কে রে?”
“রুনি। মিলির এই প্যাকেটটা ওর কাছে ছিল। দিতে এসেছে।” বাদল প্যাকেটটা নিলুফার হাতে তুলে দিল।(চলবে)