তোমরা কুঞ্জ সাজাও গো………….
পর্ব: ৭
রুনির আলমারিতে একটা ব্যাগ আছে। ব্যাগের মধ্যে রুনির সমস্ত পুরনো জিনিস আছে।স্মৃতির ডালা খূলে বসেছে আজ রুনি।ছোটবেলার কিছু পুরনো পুতুল আছে।একটা ছবি আঁকার খাতা আছে। ভাল ছবি আঁকতে পারত রুনি।বাদলদের বাসায় একটা ছবি আছে রুনির আঁকা। চারজনের একসাথে। বাদলের বায়োলজির ছবিগুলো এঁকে দিয়েছিল রুনি।
বাদলকে লেখা কতগুলো চিঠি আছে।না, এই চিঠিগুলো বাদলকে কখনও দেয়া হয়নি।যখনই বাদল কোন কারনে রুনিকে বকেছে তখনি চিঠিগুলো লেখা হয়েছিলো।ছোটবেলার দেনা-পাওনার হিসেবটা অনেক সহজ ছিল। বড় হতে হতে হিসেবটা জটিল হয়ে গেছে।
একটা গানের খাতা আছে। নিলুফা রুনিকে একবার নতুন কুঁড়ির অডিশানে নিয়ে গিয়েছিল। ছোটদের গ্রুপে। রুনি প্রচণ্ড ভয় পেয়ে যায়। গান গাইতেই পারল না। বড়দের গ্রুপে আরেকবার চেষ্টা করতে বলেচিলেন নিলুফা। রুনির আর গান গাইতে ইচ্ছে করল না। তখন নিলুফা রুনিকে এসো গান শিখির সেটে নিয়ে যায়। ইস্কুলের টিচারদের বার বার করে বলতে লাগলেন পর্বটা দেখার কথা।
একটা বাঁশি আছে ব্যাগের মধ্যে। বাদলের ছিল বাঁশিটা। একবার বৈশাখী মেলা থেকে কিনেছিল বাঁশিটা। এর কয়েকদিন আগে টিভিতে পার্থ বড়ুয়ার গাওয়া “বাঁশি শুনে আর কাজ নেই” গানটা শুনে বাঁশি বাজাতে ইচ্ছে করেছিল বাদলের খুব। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বাদল আর বাঁশি বাজানো শিখতে পারেনি।বাঁশিটা রুনির দখলে চলে আসে।
বাদলকে লেখা চিঠিগুলো আর গানের খাতাটা ছিঁড়ে ফেলে রুনি।সব ফেলে দিবে আজ রুনি। পুরান সব হিসেব শেষ করতে হবে। নতুন স্মৃতির খোঁজে পথ চলা শুরু হবে এবার।ছেঁড়া কাগজগুলির উপর উপুড় হয়ে অনেক্ষন কাঁদল।
গানের ক্যাসেটগুলো সহ আরও কিছু জিনিস ব্যাগের মধ্যে ভরে তিনতলার দিকে গেল।নিলুফা দরজা খুলল।
“কি অবস্থা করেছিস চেহারার? আর হাতে এটা কি?”
মিলি ঘরে আছে। রুনি মিলির দিকে একবার তাকিয়ে বসার ঘরে গিয়ে বসল।নিলুফা এসে বসলেন রুনির পাশে।রুনি মিলির দিকে তাকিয়ে বলল, “এই ব্যাগে কিছু জিনিস আছে।গানের ক্যাসেট সহ আরও কিছু জিনিস। মিলিকে দিতে আসলাম।”
“কেন? মিলি এসব নিয়ে কি করবে?”
“এগুলো তো আর ব্যবহার করা হবে না খালামনি। শুধু শুধু নষ্ট করা হবে।তার চেয়ে মিলির কাছে থাকা ভাল না।”
“খুব বুজতে শিখে গেছিস না? এসব কিছু মিলিকে দিতে হবে না। এসব তোর জিনিষ তোরই থাকবে, তোর কাছেই থাকবে।” মিলি নিজেকে আর ধরে রাখতে পারল না। নিলুফাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল।
নিলুফার মনটা খারাপ হয়ে গেল। মেয়েটা অনেক কষ্ট পাচ্ছে। সইতে পারছে না, কাউকে বলতেও পারছে না। মেয়েটা বাদলকে বড্ড বেশি ভালবেসে ফেলেছে।বিয়ের পর মেয়েটা কি ভুলতে পারবে তো বাদলকে? “কাঁদিস না। মেয়েদের জীবনটাই এমন।সারাজীবন অন্যের ঘর সামলাতে সামলাতে নিজের ঘরটাকেই হারিয়ে ফেলে । যে কয়দিন আছিস মার সাথে সময় কাটা, দেখবি ভাল লাগবে।”
মিলি দূর থেকে সব দেখছিল। কয়েকদিন ধরে মিলির একটা নতুন অভ্যাস হয়েছে।নতুন কোন কথা পেলেই সেটা একটা খাতাতে টুকে রাখা (লেখিকার ছোটবেলায় নিজের এই অভ্যাসটা ছিল)। গানের মধ্যেও তো এমন অনেক কথা আছে। তাই রুনি যখন ওর গানের ক্যাসেটগুলো মিলিকে দিতে চাইল মিলি প্রকারন্তে খুশিই হয়েছিলো। কিন্তু রুনি আপার কাছে সব রবীন্দ্র-নজরুল-ফোক গানের কালেকশন। ব্যান্ড এর গানের এ্যালবাম নেই। সেটা সমস্যা নাই, তুলির কাছে পাওয়া যাবে।কিন্তু নিলুফার কথা শুনে রুনির জন্য মন খারাপ হয়ে গেল। মিলিকে কেউ কিছু না বললেও মিলি জানে ভাইয়া আর রুনি আপা একজন আরেকজনকে খুব পছন্দ করে।মিলি একদিন একটা ঘটনা দেখে ফেলে। রুনি আপা চা এর মধ্যে বিস্কুট ডুবিয়ে একদম খেতে পারে না। বিস্কুট ভিজে নেতিয়ে চা এর মধ্যে পড়ে যাচ্ছিল। আপার মনটা খারাপ হয়ে যাচ্ছিল। মা রান্নাঘরে কাজ করছিল। ভাইয়া এদিক ঐদিক তাকিয়ে কাউকে দেখতে না পেয়ে বিস্কুট ভিজিয়ে রুনি আপাকে খাইয়ে দিচ্ছিল। আড়াল থেকে দৃশ্যটা দেখে মিলির খুব ভাল লাগছিল।ভাইয়া- রুনি আপা দুজনের চোখে একধরনের মুগ্ধতা ছিল। মা চলে আসায় দুজনে সরে যায়।
“রুনি আপা, চল তো আমরা বাইরে থেকে ঘুরে আসি। চল তালতলায় গিয়ে ফুচকা খেয়ে আসি।” মিলি এসে রুনিকে বলল।
“সেই ভাল। যা দুজনে মিলে একটু ঘুরে আয়। দেখবি ভাল লাগবে।”
বাইরে এসে রুনির ভালই লাগছে।রাতের বেলা প্রায়ই হাটতে হাটতে তালতলা মার্কেটে চলে আসে রুনি-বাদল-মিলি ফুচকা খাওয়ার জন্য। বাসার কাছে হওয়ার কারনে নিলুফাও মাঝে মাঝে তাদের সাথে যোগ দিতেন।ঈদের সময় জামা-কাপড় গাউসিয়া-চাঁদনী চক থেকে কেনা হলেও কসমেটিকস,জুতো এগুলো কেনা হত এই মার্কেট থেকে। এই মার্কেটের কথাও খুব মনে পড়বে রুনির। ফুচকার অর্ডার দেয়ার পর হঠাৎই ছেলেটাকে দেখতে পায় মিলি।একটা জুতার দোকানের ভিতর জুতা দেখছে। ছেলেটা কি তাকে ফলো করছে?
“আপা, তুমি একটু বস তো। আমি আসছি।”রুনি কিছু বোঝার আগেই মিলি উঠে গেল।
“এই যে শুনুন।” মিলি ছেলেটার কাছে গিয়ে ডাকল। ছেলেটা পিছন ফিরে তাকাল।
“আরে তুমি, কেমন আছ?” মিলি অবাক হয়ে গেল। ছেলেটা এমনভাবে কথা বলছে মনে হয় কতদিনের পরিচিত।
“আপনি আমাদের বাসার দিকে সারাদিন তাকিয়ে থাকেন কেন?”
“তোমাদের বাসার দিকে না, তোমার দিকে তাকিয়ে থাকি।”
“কেন তাকিয়ে থাকেন জানতে পারি?” মিলি অনেক কষ্ট হচ্ছে রাগ চেপে রাখতে।
“তুমি সুন্দর তাই।” সুন্দরী হওয়ার ঝামেলা এর আগে মিলিকে অনেকবারই পোহাতে হয়েছে।অনেক বখাটে ছেলে রাস্তায় দাঁড় করিয়ে চিঠি দিয়েছে। এমনকি ওর কিছু বান্ধবীর ভাইরাও ছিল এর মধ্যে। ঐসব বান্ধবীদের সাথে পরবর্তীতে সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যায়।মিলিও ইস্কুল থেকে মায়ের সাথে ফিরতে শুরু করে।ফলে বখাটেদের অত্যাচার থেকে কিছুটা হলেও রেহাই পায় মিলি। কিন্তু এই নব্য ঝামেলার কি করবে মিলি?
“এত যখন সুন্দরী দেখার ইচ্ছে তাহলে নায়িকাদের ছবি কিনে সারাদিন ধরে দেখেন। আমার দিকে আর তাকাবেন না।”
“কেন? তাকালে কি হবে?”
রুনি কি বলবে বুজতে পারছে না।“আরেকবার তাকালে আপনার চোখ গেলে দিব। আমাদের বাড়িওয়ালা ডাক্তার। সোজা ওনার কাছে নিয়ে যাব, উনি আপনার চোখ উপরে ফেলে দিবে।”
“তোমার দিকে যেই তাকায় তারই চোখ উপরে ফেলেন ডাক্তার সাহেব?”
মিলির মেজাজ খারাপ হয়ে যাচ্ছে। দোকানের লোকগুলো হাঁ করে তাকিয়ে আছে। মিলি সেদিকে তাকিয়ে বলল, “এখানে নাটক হচ্ছে? আপনাদের কাজ নেই? আর আপনার খবর আছে। দাঁড়ান।”
এই বলে মিলি উলটো হয়ে হাঁটা শুরু করল।“তোমার নামটা তো বলে যাও। ও লাল দোপাটি আলি তেরা নাম তো বাতা।” চোখ দিয়ে আগুন বের হলে ছেলেটা ততক্ষণে কাবাব হয়ে যেত। দুর্ভাগ্যবশত মিলি লাল জামা পরে এসেছে।
রাগে গজগজ করতে করতে মিলি রুনির সামনে গিয়ে বসল।“কিরে কোথায় ছিলি এতক্ষণ? নে ফুচকা নে।”
মিলি কি রুনিকে বলবে ছেলেটার কথা?না, থাক। রুনি আপা এমনিতেই অনেক সমস্যার মধ্যে আছে। এখন এসব বলে কাজ নেই।
মজিদ সাহেব রুনির রুমের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। রুনি বিছানার উপর বসে আছে। মুখটা ভার হয়ে আছে। দরজায় দাঁড়িয়ে ডাকলেন মেয়েকে, “রুনি”। বাবার গলা শুনে রুনি তাকাল। অনেকদিন পর মজিদ সাহেব মেয়ের ঘরে আসলেন। বিছানায় বসে মেয়েকে জিজ্ঞেস করলেন, “ঘুচুপুচু ঘুচুপুচু আমার মায়ের মন খারাপ কেন?” ছোটবেলায় রুনির কোন কারণে মন খারাপ হলে বাবা-মেয়ের মাঝে এভাবে কথা হত।রাবেয়ার এক্সিডেন্ট এর পর কিছুদিন পর্যন্ত রুনির সাথে মজিদ সাহেবের খুব ভাল সময় কাটত। প্রতিদিন হাসপাতাল থেকে ফিরে মেয়েকে গল্প বলে শুনাতে হত। নইলে মেয়ে ঘুম যাবে না। আস্তে আস্তে দূরত্ব বাড়তে থাকে বাবা-মেয়ের মধ্যে।আজ মেয়ের ঘরে এসে মজিদ সাহেবের আগের দিনের কথা মনে পড়ে গেল।
“বাবাকে বলবি না কেন মন খারাপ?”
“ঘুচুপুচু ঘুচুপুচু বাবা আমি তোমাকে একটু জড়িয়ে ধরি?”
মজিদ সাহেব মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। রুনি শক্ত করে বাবাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করল।মজিদ সাহেব মেয়েকে জিজ্ঞেস করলেন, “তোর এই বিয়েতে মত নেই?” রুনি কোন জবাব দিল না। “তোর কি পছন্দের কেউ আছে? থাকলে বল। আমি তোর মাকে বলি।”
“আমার পছন্দের কেউ নেই বাবা।মাকে তোমার কিছু বলতে হবে না।”
মজিদ সাহেব কি বলবেন কিছু বুঝতে পারছেন না।প্রতিদিন এই সময়ে তিনি বিবিসি বাংলা সংবাদ শোনেন রেডিওতে।সংবাদ শুরু হয়ে গেছে। রুনিটা খুব কান্না করছে। মেয়েকে এই অবস্থায় রেখে তিনি যেতে পারছেন না।
মজিদ সাহেব রাবেয়াকে রুনির কথা বললেন।রাবেয়া তখন মনোযোগ দিয়ে বই পড়ছিলেন।“মেয়েরা বিয়ের আগে এক ধরনের Insecurity তে ভুগে।চিন্তা করনা। বিয়ের পর সব ঠিক হয়ে যাবে।”
“আরেকবার চিন্তা করে দেখলে হয় না। মেয়েটা অনেক কান্নাকাটি করছে।”
“আমার উপর বিশ্বাস রাখ ডাক্তারবাবু। তোমার মেয়ের ভালই হবে আখেরে, খারাপ কিছু হবে না।”
মজিদ সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। আর কিছু না বলে চুপচাপ ঘর থেকে বের হয়ে এলেন। রাবেয়া আবার বই পড়ায় মনোযোগ দিলেন।বইয়ের নাম “রাইফেল, রোটি, আওরাত”।লেখকের নাম আনোয়ার পাশা। লেখক ১৯৭১ সালের ১৪ই ডিসেম্বর শহীদ হন। আজকাল মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অনেকে অনেক কিছু বলছেন, লিখছেন।তার মধ্যে কতটুকু সত্যি কতটুকু মিথ্যা বোঝা দায়। এই বইয়ের লেখক যেহেতু একজন শহীদ বুদ্ধিজীবী তাই এই বইয়ের কথাগুলো সত্য বলে ধরে নেয়া যেতে পারে। এই বইটিকে মুক্তিযুদ্ধের একটি প্রামাণ্য দলিল বলা যেতে পারে।
অনেক রাত। রাবেয়া ঘুমিয়ে পড়েছেন। রুনি ঘরে ঢুকল।। রুনি এসে মায়ের বিছানার পাশে বসল। মায়ের গায়ে হাত দিল। রাবেয়ার ঘুম ভেঙে গেল। “কে?”
“মা আমি।”
“তুই এত রাতে এখানে? ঘুমাসনি এখনও?”
“ঘুম আসছে না। মা তোমাকে একটু জড়িয়ে ধরে শুব?”
রাবেয়া অবাক হয়ে গেলেন। অনেক বছর পর মায়ের সাথে ঘুমাতে এল রুনি।রাবেয়ার চোখে পানি চলে এসেছে। “আয়।” রুনি মায়ের পাশে শুয়ে মাকে জড়িয়ে ধরল।রাবেয়া ও মেয়েকে জড়িয়ে ধরলেন।(চলবে)