তোমরা কুঞ্জ সাজাও গো …………….
পর্ব: ৮
বাদল তার দায়িত্ব শুধু না, অতিরিক্ত দায়িত্বও সঠিকভাবে পালন করেছে।শুধু খাবার বা কাজীর ব্যবস্থাই করেনি, গায়ে হলুদের জন্য কাঁচা হলুদ আর ঘর সাজানোর জন্য ফুল ও এনেছে। সেটা সমস্যা ছিল না রাবেয়ার কাছে, সমস্যা হচ্ছে বাদল ১০০ গোলাপ ফুল এনেছে ।
“এত গোলাপ দিয়ে কি হবে?”
“আসলে রুনি ফুল পছন্দ করে তো, আর গোলাপ রুনির প্রিয় ফুল। তাই আনা।”
“তাই বলে ১০০ গোলাপ? এর থেকে কম আনলে কি ওর পছন্দ কমে যেত?”
বাদল কোন জবাব দিল না। রাবেয়ার সত্যি মেজাজ খারাপ হচ্ছে। এটা তো লালশাক না যতটুকু বেঁচে যাবে তা ভাজি করে খেয়ে ফেলবেন।
“যা টাকা দিয়েছি তাতে তো এতকিছু হওয়ার কথা না। কত লেগেছে আরও?” এই বলে ড্রয়ার থেকে টাকা বের করতে গেলেন।
“টাকা লাগেনি আন্টি। ঐ টাকাতেই হয়ে গেছে।” ছেলেটার কি মাথা-টাথা খারাপ হয়ে গেল নাকি? হতেও পারে। প্রেমিকার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে অন্য জায়গায়, মাথা একটু খারাপ হতেও পারে, তাই বলে ১০০ গোলাপ? বাদল কি এখন ছাদে গিয়ে গান ধরবে “আজকে রাতে তুমি অন্যের হয়ে যাচ্ছ।” গাইলেও হয়তো অবাক হবেন না রাবেয়া আর।
“রুনু” বাদল রুনির রুমের দরজার সামনে গিয়ে ডাকল।রুনি জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিল। রুনি অবাক হয়ে পিছন ফিরে তাকাল। কতদিন পর বাদল এভাবে ডাকল। “বাদলদা তুমি এখানে?”
বাদল রুমে ঢুকল।অনেকদিন পর এই রুমে ঢুকল বাদল।রুনি বেশির ভাগ সময় বাদলদের বাসায় কাটায়, তাই এই রুমে আসার প্রয়োজন পড়েনি তেমন।
“এই ভর সন্ধ্যাবেলা জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?”
“না এমনি বাইরে দেখছিলাম।”
“এক গ্লাস পানি খাওয়াবি?”
“ওমা তুমি বস না। আমি এখনি পানি নিয়ে আসছি।”
এই বলে রুনি ভেতর থকে পানি আনতে যাচ্ছিল। বাদল বাধা দিয়ে বলল, “না থাক, লাগবে না। কাল সকালে একবার ছাদে আসবি? সূর্য ওঠার আগে।”
“আমি আসব বাদলদা।” বাদল ঘুরে চলে যাচ্ছিল। কি মনে করে পেছন ফিরে রুনির মাথায় হাত বুলিয়ে দিল।
বিয়ে হবে, গায়ে হলুদ হবে না তাই কি হয়? সন্ধ্যের পর নিলুফা হলুদবাটা নিয়ে এলেন। রুনি হলুদ শাড়ি পড়ল। রাবেয়ার বিছানার উপরই রুনির হলুদ হল।মিলি আর সপ্না মিলে গান ধরল “লীলাবালি লীলাবালি ভর যুবতী সইগো কি দিয়া সাজাইমু তোরে”।
কাল বিয়ে। প্রতিদিন রাতে একবার করে ছাদে যাওয়া অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল রুনির। রাত ১০টা বাজে। আজ যাওয়া হয়নি। রুনি হলুদের বাটি নিয়ে উপরে গেল।মিলি দরজা খুলল।“বাদলদা কই রে?”
“ভাইয়া তো ছাদে।”
রুনি দৌড়ে ছাদে গেল। সিঁড়িতে পায়ের শব্দ শুনে বাদল পেছনে তাকাল।রুনিকে দেখে অবাক হয়ে গেল বাদল। “তুই এত রাতে ছাদে কেন এসেছিস?”
“বাদলদা নিচে আমার গায়ে হলুদ হয়েছে। তুমি আমায় হলুদ দেবে না?” রুনি বাদলের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। বাদল হলুদবাটা থেকে একটু হলুদ নিয়ে রুনির মুখে মাখিয়ে দিল। রুনির দুই চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। রুনি হঠাৎ করে বাদলকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করল। বাদল অপ্রস্তুত হয়ে গেল। বাদল কোন মুনিঋষি নয়। মাঝে মাঝে রুনিকে কাছে টানতে ইচ্ছে করত, ভালবাসতে ইচ্ছে করত। আজ কি রুনি সেই পথটা তৈরি করে দিতে এল?না,সেই সুযোগ রুনি বাদলকে দেয়নি। বাদলকে একলা করে রুনি নিচে চলে গেল।
রুনি সকালে সূর্য ওঠার আগেই ছাদে এসেছে।বাদল দূর থেকেই হাত বাড়িয়ে দিল “আয়, এদিকে আয়।” রুনি কাছে এসে দেখল নিচে অনেকগুলো পোড়া সিগারেটের টুকরো। “বাদলদা তুমি সারারাত ছাদে ছিলে? ঘুমাওনি?”
“সকালে যদি উঠতে না পারি, তাই।” বাদলের শার্টে হলুদের দাগ।কাল রাতের।
“কেন আসতে বলেছ?”
“আগে এটা নে।” বাদল এক তোড়া গোলাপ ফুল দিল, “তোর বাগানের ফুল না। পুরো ঢাকা শহর ঘুরে দশ জায়গা থেকে দশটা সেরা ফুল এনেছি তোর জন্য।”
“এই জন্য ডেকেছ আমায়?”
বাদল রুনি মুখোমুখি হয়ে বলল, “ডেকেছি সূর্যোদয় দেখার জন্য। একটা নতুন জীবন শুরু করবি। পুরনো জীবনের সূর্যটাকে বিদায় জানাবি না?”
রুনি কান্নায় ভেঙে পড়ল। “বাদলদা চল আমরা এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাই। আমি তোমার সাথে গাছতলায় থাকতেও রাজি আছি।”
বাদল দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “তুই কি করে মনে করলি তোর বাদলদা তোকে গাছতলায় নিয়ে গিয়ে রাখবে? রুনু তোর সাথে আমি আমার পুরো জীবনটা শেয়ার করেছি। কারো কাছে তোকে আমি ছোট করতে পারব না।”
“আমার খুব কষ্ট হচ্ছে বাদলদা।”
“এই রুনি” বাদল রুনির মুখটা দুহাত দিয়ে ধরে বলল, “এত ভেঙ্গে পরলে চলবে? পৃথিবীটা অনেক বড়। তার চাইতেও জীবনটা বড়। আমি চাই না তুই আমাদের ভুলে যা, কিন্তু এই স্মৃতিটুকু তোর জীবনকে যাতে গ্রাস না করে।একদিন যে বিশ্বাস নিয়ে তুই আমাদের পরিবারের সাথে মিশে গিয়েছিলি সেই বিশ্বাসটুকু দিয়ে ভালবেসে নতুন জীবনটাকে গ্রহন কর। দেখবি জীবন সেই ভালবাসা শতগুন করে তোকে ফিরিয়ে দিবে। নতুন শহরে যাবি, নতুন মানুষের কাছে যাবি। মানুষটাকে আপন করে নে, শহরটাকে আপন করে নে। তাদের আঁকড়ে ধরে বাঁচতে শিখ। হয়তবা ঐ মানুষটাও তোকে আঁকড়ে ধরে বাঁচার জন্য অপেক্ষা করে আছে। নতুন করে স্বপ্ন দেখ, স্বপ্নগুলোকে প্রান দে।ঐখানে গিয়ে ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হবি, নতুন মানুষ আসবে সংসারে, দেখবি জীবনের সব কান্না হাসি হয়ে ফিরবে, জীবনটা খুব সুন্দর হয়ে ধরা দিবে।”
“এত সহজ সবকিছু?”
“না, সহজ করে নিতে হয়।জীবনকে ভালোবেসে সবকিছু সহজ করে নিতে হয়।”
“বাদলদা তুমি আমায় কোনদিন ভালবাসনি?”
বাদল কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। “অবশ্যই ভালবাসি। তুই আমার সবচেয়ে ভাল বন্ধু। তোকে ভালবাসব না? ভাল থাকিস” এই বলে সেখান থেকে সরে আসল।
“কোথায় যাচ্ছ? একসাথে সূর্যোদয় দেখবে না?”
“ব্যাচেলর লাইফের শেষ সূর্যোদয় একা একা দেখতে হয়। অন্য কারো সাথে না।”
বাদল চলে আসল। সিঁড়িঘরে নিলুফার সাথে দেখা হল।“মেয়েটা অনেক কাঁদছে। এভাবে কান্নাকাটি করলে ও তো অসুস্থ হয়ে পড়বে।”
“ওকে কাঁদতে দাও মা। এটাই হয়ত ওর জীবনের শেষ কান্না। দোয়া কর এরপর থেকে ওকে যাতে আর কোনদিন এভাবে কাঁদতে না হয়।”
“আমি রাবেয়ার সাথে একবার কথা বলি?”
“তোমাকে কাউকে কিছু বলতে হবে না মা। চল এখান থেকে।”
বাদল অনেকক্ষণ ধরে সিগারেটটা ধরানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু পারছে না। চোখটা বারবার ভিজে যাচ্ছে। ঠিকমত দেখতে পাচ্ছে না।কালের যাত্রার ধ্বনি শুনিতে কি পাও,তারি রথ নিত্যই উধাও, জাগাইছে অন্তরীক্ষে হৃদয়স্পন্দন, চক্রে-পিষ্ট আঁধারের বক্ষফাটা তারার ক্রন্দন।
তৃণার আজকে Electrical Circuit-1 এর ক্লাস টেস্ট।Theorem গুলো রিভাইস দিতে হবে। বারান্দায় তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে হঠাৎ সামনে চোখ পড়ল। সামনের বাসার বাড়িওয়ালার মেয়েটা ছাদের উপরে দাঁড়িয়ে পূর্বদিকে তাকিয়ে কাঁদছে। মেয়েটা বড় মামার বাসায় এসেছিল একদিন, তখন পরিচয় হয়েছিল।ঠিক তার নিচে তিনতলার বারান্দায় ছেলেটা দাঁড়িয়ে আছে।ছেলেটাকে আগেও দেখেছে তৃণা।এত সুন্দর ছেলে তৃণা কোনদিন দেখেনি। ছেলেটা অনেকক্ষণ ধরে সিগারেট ধরানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু পারছে না। তৃণার খুব ইচ্ছে করছে সিগারেটটা ধরিয়ে দিতে। তৃণা কি ওকে বলবে, “দাওত আমি সিগারেটটা ধরিয়ে দি। তোমার যখন যখন সিগারেট খেতে ইচ্ছে করবে আমাকে বলবে আমি ধরিয়ে দিব।” প্রথম আলাপে ছেলেটাকে তুমি বলাটা কি ঠিক হবে?(চলবে)