তোমাকে পর্ব -৩

0
1334

তোমাকে

পর্ব : 3.1

চা খাবে?
চা, এখানে চা কোথায় পাবো ? তোমাদের এখানে কফি শপ গুলোতে চায়ের নামে যেটা পাওয়া যায় সেটা অতি অখাদ্য
অনিমা হাসলো তারপর ব্যাগ থেকে একটা ছোট ফ্লাক্স আর দুইটা কাগজের কাপ বের করল I একটাতে সাবধানে চা ঢেলে মনিরের হাতে দিল I মনির আরেকটা কাপ ধরল , অনিমা সেটাতে চা ঢেলে নিজে নিল I তারপর একটা ছোট প্লাস্টিকের বক্স খুলে দুজনের মাঝখানে রাখল I মনির দেখল তার ভেতর ছোট ছোট সিঙ্গারা I অনিমা বলল
খাও একদিন একটু অস্বাস্থ্যকর খাবার খেলে কিছু হবে নাI তুমি তো বাসায় আসতে চাইলে না, না হলে তোমাকে হোমমেড স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়াতে পারতাম I
– রক্ষা করো I এই ভালো I কাল রাতে সারোয়ার ভাইয়ের বাসায় দাওয়াত ছিল I পোলাও কোরমা করে হুলুস্থুল অবস্থা I আমি এসব রিচ ফুড একেবারেই খেতে পারিনা I
– তুমি তো ভাত ই বেশি খেতে পারো না তার আবার রিচ ফুড I অনিমা হাসল
মনির একটা সিঙ্গারা তুলে মুখে দিল I ভিতরে আলু আর সবজির পুর দেয়া , মচমচে বেশ সুস্বাদু খেতেI
– তুমি এইগুলি বাসায় বানিয়েছে ?
– হ্যাঁ এদেশে তুমি দোকানে সিংগারা কোথায় পাবে ?
– ভালো হয়েছে
– অনিমা হাসলো I মনে আছে ক্যাম্পাসে থাকতে এটা ওদের রেগুলার খাবার ছিল I ক্লাস শেষে চা সিঙ্গারা না খেলে ভালোই লাগতো না I
– তোমার বাসার সবাই কেমন আছেন মনির? তোমার মা বাবা ভালো আছেন ?
– বাবা মারা গেছেন সাত বছর হয়ে গেল I মা এখন আমার সঙ্গেই থাকেন ইউনিভার্সিটি কোয়ার্টারে
– তোমার একটা বোন ছিল না ইংলিশ ডিপার্টমেন্টে পড়তো
– হ্যাঁ ওর বিয়ে হয়ে গেছে হাসব্যান্ড চার্টার্ড একাউন্টেন্ট কাছেই থাকে ফুলার রোডে I আমি যখন দেশে থাকি না মা আর তনুকে ওই দেখে রাখে
– তনু বুঝি তোমার বউ এর নাম ?
– না তনু আমার মেয়ে ভালো নাম তনিমা I অনিমা একটু অবাক হলো
– তোমার মেয়ের নাম তনিমা? কে রেখেছে এই নাম ?
– আমি

অনিমা হঠাৎ অন্যমনস্ক হয়ে গেল I ওর খুব শখ ছিল মেয়ের নাম তনিমা রাখার I সেঁজুতি যখন জন্ম হয় অনিমার তখন অল্প বয়স 21 ও হয়নি I অযত্ন-অবহেলায় শরীরের অবস্থা ভাল ছিল না I ডেলিভারির পর অনিমা অজ্ঞান অবস্থায় ছিল I এদেশে বাচ্চা জন্মানোর সাথে সাথে নাম রেজিস্ট্রি করতে হয় I আশিকের মাথায় কিছুই আসছিল না I পরে ওর বাবা মাকে ফোন করে সেঁজুতির নাম ঠিক করা হয় I অনিমা বলল
– খুব সুন্দর নাম I আর তোমার ছোট ভাই ওর কি ডাক্তারি পড়া হয়েছিল শেষ পর্যন্ত
মনির বেশ অবাক হল অনিমা এত কিছু মনে রেখেছে I আশ্চর্য তোI তারপর বলল
– হ্যাঁ পাবলিকে চান্স পায়নি প্রাইভেট পড়তে হয়েছে I এখন একটা ক্লিনিক করেছে নিজের ভালোই চলছে
– তুমি নিজে পাবলিক মেডিকেলে চান্স পেয়েও পড়োনি খরচের কথা ভেবে আর ভাইকে প্রাইভেটে পড়লে ?
– ওই আর কি I
আকাশে মেঘ জমতে শুরু করেছে I অনিমা একটু চিন্তিত হল I এইরকম খোলা জায়গায় হঠাৎ বৃষ্টি নামলে বিপদI আশেপাশে কোন সেড নেই I পার্কিং পর্যন্ত যেতে হবে অনেকখানি হাঁটতে হবেI যদিও অনিমার কাছে ছাতা আছে কিন্তু এরকম খোলা জায়গায় ছাতায় কাজ হবে না I অনিমা বলল
– চলো যাওয়া যাক I বৃষ্টি নামতে পারে I
– তোমার তো বৃষ্টি খুব পছন্দ ছিল
– এখানকার বৃষ্টির দেশের মত নয় I টেম্পারেচার কমে যায় অনেক I বৃষ্টিতে ভিজে মজা নেই I

মনিরের যেতে ইচ্ছা করছে না I ও চা এর কাপে শেষ চুমুক দিয়ে নামিয়ে রাখল I হঠাৎ করে বহু বছর আগের স্মৃতি মনে পড়ে গেল I সেদিন ও দুজন এভাবেই বসে চা খেয়েছিল I শুধু অনিমা তখনএত দূরের ছিলনা I মনির একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ালো I বলল চলো I

পর্ব 3.2

হেমন্ত প্রায় শেষ হয়ে এসেছে I চারিদিকে শীতের আমেজ I বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে শীত একটু আগেই নামে I কুয়াশার আস্তরণ ভেদ করে ভোরের নরম রোদ কার্জন হলের লাল ভবনগুলোকে আরে মোহময় করে তোলে I ঘাসের উপর শিশিরের আবরণI

ক্লাস শুরু হয়ে গেছে অনেকক্ষণ I অনিমার পৌঁছতে দেরি হয়ে গেছে I আজ অনিমা একটা সাদা পোশাক পড়েছে I গারো নীল একটা শাল জড়িয়ে নিয়েছে উপরে I তারপর ও ওর একটু শীত শীত লাগছেI ক্লাসের মধ্যে হঠাৎ করে ঢুকতে ইচ্ছে করছে না I তাই অনিমা ক্লাসে না ঢুকে ডিপার্টমেন্টের করিডোরে গিয়ে বসলো I জায়গাটা একটু ঠান্ডা কিন্তু সকালের নরম রোদ গায়ে এসে পড়ায় বেশ আরামদায়ক লাগছেI

মনির ক্লাস থেকে বের হয়ে দূর থেকে ওকে দেখল I সেমিনার থেকে স্যার দুটো বই আনতে পাঠিয়েছেন ক্লাসের মধ্যেই I মনিরা আর রতন অনিমার পাশ কাটিয়েই সেমিনারে গেল I অনিমা টের পেল না I বই দুটো খুঁজে বের করে মনির রতনকে বললো
তুই নিয়ে যা আমি একটু পরে আসছি I রতন চলে গেলে মনির গিয়ে অনিমার পাশে বসলো
– কি ব্যাপার ক্লাস করছনা?
– দেরি হয়ে গেছে তাই আর ঢুকলাম না
মনির লক্ষ করল অনিমার মুখটা কেমন ফোলা ফোলা চোখগুলো ভেজাI
– তোমার কি মন খারাপ?
অনিমা ধরা গলায় বলল
– না তেমন কিছু না
কিছুক্ষণ ওরা দুজন চুপ করে বসে রইল I তারপর মনির বলল
– চলো তোমাকে একটা জিনিস দেখিয়ে আনি
– কি?
– চলই না
ওরা দুজন ডিপার্টমেন্টের পিছনের দিকে গেলI এখানে অনেকটা ফাঁকা জায়গাI দেয়াল ঘেঁষে একটা চায়ের দোকানI সামনে কাঠের বেঞ্চি পাতা I মনির ওকে ওইদিকে না নিয়ে গিয়ে তার একটু পাশে নিয়ে গেল I ক্লাস চলছে বলে এখন এখানে কেউ নেই I
– এখানে দাড়াও
– এখানে?
– না, আর একটু এই পাশে
মনির ওকে যে জায়গাটায় দাঁড় করালো সেখানে একটা বিশাল শিউলি ফুলের গাছ I পাশেই একটা গন্ধরাজ ফুলের গাছ ও আছেI জায়গাটা থেকে একটা মিষ্টি গন্ধ ভেশে আসছেI কিসের গন্ধ অনিমা ঠিক ধরতে পারল না I
– দাড়ালাম I এখন?
– এক মিনিট
মনির হাত বারিয়ে গাছের একটা ডাল ধরল I তারপর কয়েকটা ঝাঁকি দিল I অনিমা দেখল উপর থেকে শিউলি ফুল ঝরে পড়ছে I কি অদ্ভুত সুন্দরI ওর চুল, গাল , মুখ বেয়ে সাদা আর কমলা ফুলগুলো পরছেI অনিমা দুই হাত বাড়িয়ে ফুলগুলো ধরার চেষ্টা করল I ওর হাতের ফাঁক গলে পড়ে যাচ্ছে ফুলগুলো I কি আশ্চর্য একটা মুহূর্ত I অনিমা তাকিয়ে দেখল মনির হাসছেI অনিমা বুঝতে পারল না কোনটা বেশী সুন্দর এই হাসিটা নাকি এই সকালটাI

মনির হাত ঝাড়তে ঝাড়তে বলল
– প্রতিদিন সকালে এসে আমি এই কাজটা করিI আজকেই করা হয়নিI ভালোই হলো তোমাকে দেখানো গেলI
তারপর একটু থেমে বলল
শোনো, আমাদের আশেপাশে এমন অনেক সৌন্দর্য অনেক ছোট ছোট আনন্দ লুকিয়ে আছেI তাদের খুঁজে নিতে হয়I এইসব ছোট ছোট আনন্দ গুলো আমাদের অনেক বড় বড় কষ্ট আর না পাওয়াকে ভুলিয়ে রাখতে সাহায্য করেI বুঝলে?
অনিমা মুগ্ধ হয়ে শুনলোI একটা মানুষ কি করে এত সুন্দর করে কথা বলতে পারে ও ভেবে পেল নাI তারপর একটু হেসে বলল
– থ্যাঙ্ক ইউ মনিরI তুমি আমার মনটা ভালো করে দিলে I আজ আমার মায়ের মৃত্যুবার্ষিকীI অনেক চেষ্টা করেও মায়ের কোন স্মৃতি মনে করতে পারছিলাম নাI তাই মনটা খুব খারাপ ছিলI
– তুমি মন খারাপ করে থাকলে কি তোমার মায়ের ভালো লাগতো ? নিশ্চয়ই নাI ক্লাস করছ না এটা দেখলেও কিন্তু ভালো লাগতো না I
অনিমা হাসলো I মনির বলল
– নেক্সট ক্লাসটা কিন্তু খুব ইম্পর্টেন্টI পরীক্ষার আগে এভাবে ক্লাস মিস করো না I
মনির ঘড়ি দেখল ক্লাস শুরু হতে আরও 15 মিনিট বাকিI ও জিজ্ঞেস করল
– তুমি সকালে কিছু খেয়েছো?
– না
– আমিও খাইনিI চলো চা খাইI
– ওরা দুজন গিয়ে চায়ের দোকানের সামনের বেঞ্চিতে বসল মুখোমুখি I মনির চায়ের কাপ আর একটা কাগজের প্যাকেট সিঙ্গারা এনে অনিমার হাতে দিলো I
অনিমা চায়ের কাপে চুমুক দিলI শীতের সকালে চা টা খেতে বেশ লাগছেI হঠাৎ করে অনিমার মনে হল এর চেয়ে সুন্দর সকাল ওর জীবনে আর আসেনি I

চলবে…..

লেখনীতে: অনিমা হাসান

 

প্রথম পর্বের লিংক

https://www.facebook.com/groups/Anyaprokash/permalink/1299859230529101/
দ্বিতীয় পর্বের প্রথম অংশের লিংক
https://www.facebook.com/groups/Anyaprokash/permalink/1303344493513908/

দ্বিতীয় পর্বের দ্বিতীয় অংশের লিংক
https://www.facebook.com/groups/Anyaprokash/permalink/1304718370043187/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here