তোমাকে পর্ব -৮

0
892

#তোমাকে

পর্ব 8.1

আজ অনিমার একটা জব ইন্টারভিউ আছে I এই চাকরিটা হয়ে গেলে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হবে না I অনিমার যা কোয়ালিফিকেশন তাতেও সহজেই চাকরি পেয়ে যায় কিন্তু সমস্যা বাঁধে অন্য জায়গায় I সময় মেলানো যায় না I সেঁজুতির স্কুল ড্রয়িং ক্লাস সবকিছুর সাথে সময় মিলিয়ে ঠিক ব্যাটেবলে হয়ে ওঠে না I অনিমা এখানকার ইউনিভার্সিটি থেকে ব্যাচেলার , মাস্টার্স করেছে I রেজাল্টও ভাল I অনেকদিন ধরে পার্টটাইম ও করছে I ফুলটাইম পাওয়াটা ওর জন্য কঠিন কিছু না I কিন্তু বাসা ম্যানেজ করে কাজ করাটাই মুশকিল I ইন্টারভিউয়ের সময়টা ও উদ্ভট I বিকেল তিনটার সময় যেতে হবে I সাড়ে তিনটায় সেঁজুতি বাসায় ফেরে আবার পাঁচটার সময় ওকে ড্রইং ক্লাস নিতে হয় I মুনির অবশ্য অনেকবার বলেছে এ সময় ও হাঁটতে যায় সেজুতিকে ও ড্রপ করে দিতে পারবে আবার জগিং শেষে নিয়ে আসতে পারবে কিন্তু অনিমা রাজি হয়নি I কি দরকার কারো উপর নির্ভরশীলতা বাড়িয়ে I কদিন পরে তো ও চলেই যাবে I কিন্তু আজকে আর উপায়ন্তর না দেখে অনিমা মনিরকে ফোন দিল I

হ্যালো মনির

অনিমা বল

তুমি কি আজকে বাসায় আছো

হ্যাঁ বাসা থেকেই কাজ করছি I কেন বলতো ?

আমার একটা হেল্প দরকার ছিল

কি করতে হবে বলো

আমার একটা জব ইন্টারভিউ আছে I দুপুর 2 টায় বেরোতে হবে I ফিরতে কয়টা বাজবে জানিনা I তুমি কি একটু সেজুতিকে বাস থেকে পিক করতে পারবে I তুমি জানো তো বাস স্টপ কোথায় তাই না ?

হ্যাঁ জানি তো I কোন সমস্যা নেই I টেক ইওর টাইম I আমি আছি চিন্তা করো না

আমি তাহলে বেরোনোর সময় তোমাকে চাবি দিয়ে যাচ্ছি

আচ্ছা ঠিক আছে

মনির দরজা খুলে অবাক হয়ে গেল I ফরমাল ড্রেসে ও যে কোন মেয়েকে একটা স্নিগ্ধ দেখাতে পারে ওর কোন ধারণা ছিল না I অনিমার পরনে লুজ ফরমাল প্যান্ট তার সাথে গ্রে শার্ট ব্ল্যাক ওভারকোট সঙ্গে ম্যাচিং গ্রে স্কার্ফ দিয়েছে মাথায় I পায়ে ফরমাল সু I দুর্দান্ত স্মার্ট লাগছে ওকে I অনিমা ওর হাতে চাবি দিয়ে বলল

তুমি চাইলে আগে ওপরে যেতে পারো I আমার কতক্ষণ লাগবে জানি না I তোমাদের জন্য খাবার টেবিলে রেখে দিয়েছি I

ঠিক আছে কোন সমস্যা নেই

আসি তাহলে

অনিমা , অল দ্যা বেস্ট

অনিমা একটু হাসলো I তারপর বেরিয়ে গেল I

অনিমার বসার ঘরটা বেশ বড় I হালকা আসবাব দিয়ে সাজানো I সবকিছুই খুব ছিমছাম I মনিরের সবচাইতে যে জিনিসটা ভালো লাগলো সেটা হচ্ছে বসার ঘরে একটা বিশাল বইয়ের আলমারি I কাচ দিয়ে ঘেরা I মনির ঘুরে ঘুরে বইগুলো দেখতে লাগলো I লক না থাকায় আলমারিটা খুলে মনির বইগুলো ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখতে লাগলো I বই পড়তে ওর বরাবরই খুব ভালো লাগে I অনিমা বইয়ের আলমারি খুব সুন্দর করে গুছিয়ে রেখেছে I এটা একান্তই ওর ব্যক্তিগত জগত কারন বাসায় আর কেউ বাংলা বই পড়ে না I দেখতে দেখতে হঠাৎ এক জায়গায় মনিরের চোখ আটকে গেল I কোনার দিকে একটা বই রাখা তার উপর একটা শঙ্খ I শঙ্খটা দেখেই চিনতে পারল মনির I কি আশ্চর্য অনিমা এটা এখনো রেখে দিয়েছে I
মনির শঙ্খটা হাতে নিয়ে দেখল I হ্যাঁ এটাই মনির ওকে দিয়েছিল I তার নিচে একটা বই I হুমায়ূন আহমেদের ‘’ তোমাকে’’ I মনিরের অসম্ভব প্রিয় একটা বই I মনির বইটা হাতে নিয়ে প্রথম পাতা টা খুলল I গোটা গোটা হরফে একটা কবিতা লেখা I পড়ে চিনতে পারলো না মনির I এই কবিতা আগে কখনো পড়ে নি ও I কে দিয়েছে এটা অনিমাকে I এত যত্ন করে রেখেছো ও I আশিক কি ? এটা দিয়ে কি তবে ভালোবাসার কথা জানিয়েছিল ? মনিরের মধ্যে ঈর্ষা হিংসা ব্যাপারগুলি নেই I কিন্তু আজ কেন যেন প্রচন্ড ঈর্ষান্বিত বোধ করল I এই একটা মাত্র বই দিয়ে কয়েকদিনের মধ্যেই অনিমা কে নিয়ে চলে গেল I অথচ এতদিন কাছে থেকেও ও পারল না I কেন যেন বইটা খুব চেনা চেনা লাগছে I ঠিক মনে করতে পারল না মনির I আবার যেমন ছিল আলমারি বন্ধ করে রেখে দিলI

অনিমার ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে গেল I বাসায় ঢুকে দেখল সেঁজুতি আর মনির টেবিলে বসে গল্প করছে I অনিমা ওদের দেখে মৃদু হাসলো I তারপর বলল

থ্যাংক ইউ মুনির I তোমাকে অনেকক্ষণ আটকে রাখলাম I

কোন ব্যাপার না I আমরা খুব ভালো সময় কাটাচ্ছিলাম I আমি সেজুতির কাছে ফ্রেঞ্চ শিখছিলাম

চা খাবে ?

না তুমি টায়ার্ড হয়ে এসেছ রেস্ট নাও আমি আবার পরে আসবো I মনির চলে গেল

অনিমা ও উপরে চলে গেল চেঞ্জ করতে I

গভীর রাত I আকাশ তারায় ভরা I তবে আজ চাঁদ নেই I অনিমা উঠোনের সিঁড়িতে বসে আছে I আজ ওর মন ভালো নেই I আজকের ইন্টারভিউটা খুব ভালো হয়েছিল I ওরা জব অফার ও করেছিল I কিন্তু অনিমে একসেপ্ট করতে পারেনি I কোনভাবেই সময় মেলানো গেল না I এই জবটা করতে গেলে সেজুতির খুব কষ্ট হয়ে যাবে I সেটা অনিমা কিছুতেই মেনে নিতে পারবে না I এই পৃথিবীতে সেঁজুতি ছাড়া ওর আর কেউ নেই I ও কিছুতেই সেজুতিকে কষ্ট দিতে পারবে না I ওকে এতটুকুও অবহেলা করা সম্ভব নয় I অনিমার হঠাৎ করে মনে হল ওর এই জীবনটা একটা অভিশাপ I বহুদিন পর আজকে গান গাইতে ইচ্ছে করছে I অনিমা গান ধরল

আমি চাঁদ নহি, চাঁদ নহি অভিশাপ

শূন্য হৃদয়ে আজো নিরাশায় আকাশে করি বিলাপ।।

শত জনমের অপূর্ণ সাধ ল’য়ে

আমি গগনে কাঁদি গো ভুবনের চাঁদ হয়ে

জোছনা হইয়া ঝরে গো আমার অশ্রু বিরহ-তাপ।।

আমি চাঁদ নহি, চাঁদ নহি অভিশাপ

কলঙ্ক হয়ে বুকে দোলে মোর তোমার স্মৃতির ছায়া

এত জোছনায় ঢাকিতে পারিনি তোমার মধুর মায়া।

কোন সে সাগর মন্থন শেষে মোরে

জড়াইয়া যেন উঠেছিলে প্রেমভরে

হায় তুমি গেছ চলে বুকে তবু দোলে তব অঙ্গের ছাপ।।

আমি চাঁদ নহি, চাঁদ নহি অভিশাপ

কেউ শুনলে ভাববে মেয়েটা হয়ত তার সদ্যপ্রয়াত স্বামীর কথা ভেবে এই গানটা গাইছে I কিন্তু সেটা কেউ জানেনা সেটা হল এমনি গভীর রাতে বসে অনিমা এই গানটা বহু বছর ধরে গায় I শুধু পার্থক্য হল যার যার গায় আজ সে ও এখানে ই আছে I

পর্ব 8.2

আজ শুক্রবার I হলের সবার মধ্যে একটা ঢিলেঢালা ভাব I বেশিরভাগ ছেলেরাই ঘুমাচ্ছে I যদিও সকাল বাজে প্রায় দশটা I মনির সাধারণত ফজরের নামাজ পড়ে হাঁটতে যায় তারপর হলে এসে ক্লাসে যাবার প্রস্তুতি নেয় I আজ ক্লাস নেই তবে ওর মনটা খুব বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে I অনেকক্ষণ ধরে একটা বই খুলে নোটস তৈরি করার চেষ্টা করছে কিন্তু কিছুতেই মন বসাতে পারছেনা I হাসিব রুমে ঢুকে দেখল মনির অন্যমনস্ক হয়ে চেয়ারে বসে আছে I সামনে খোলা বই কিন্তু ঠিক পরছে না I টুর থেকে ফেরার পর থেকে মনিরের এই অন্যমনস্কতা হাসিবের চোখ এড়ায়নি I হাসির বলল

চলো মামু স্টার কাবাব থেইকা নাস্তা খেয়ে আসি

তুই যা আমার যেতে ইচ্ছা করছে না

আর কয়দিন দেবদাস হয়ে বইসা থাকবা ? তোমার ডার্লিং ক্লাসে আসো না কেন ?

চুপ থাক তো , ভালো লাগে না সকাল সকাল

আরে , আমার লগে রাগ দেখাও কেন ?

টুর থেকে ফেরার পর মনির অনিমা কে বাসায় পৌঁছে দিয়েছিল I তারপর থেকে অনিমা আর ক্লাসে আসেনি I মনিরের খুব চিন্তা হচ্ছে I কি হয়েছে ওর I নিশ্চয়ই পানিতে ভিজে জ্বর বাধিয়েছে I কি দরকার ছিল এত পানিতে নামার I নিজের চিন্তায় মনির নিজেই বিরক্ত হয়ে গেল I সবাই তো পানিতে নেমেছে তাহলে ওই বা কেন একজনের জন্য এত চিন্তা করে মরছে I

আরে মামু কই হারাইয়া গেলা I যাইবা না ?

না

কেন মন খারাপ?

তুই যা তো সামনে থেকে

আচ্ছা শোন তোর মন যদি ভালো করে দিতে পারি তাহলে কি দিবি ?

তুই আমার মন ভালো করে দিবি ? কিভাবে?

এটা হইলো হাসিবের ম্যাজিক I দিতে পারলে আমার লগে যাইতে হইবো I রাজি কিনা বল

মনির অধৈর্য হয়ে বলল

দে , আমার মন ভালো করে দে তুই

হাসিব বিজয়ের হাসি হেসে পকেট থেকে একটা ছবি বের করে মনিরের সামনে বইয়ের উপর রাখল I
মনির অবাক হয়ে লক্ষ্য করলো এটা তো অনিমার ওই ছবিটা ইনানী বিচের নীল জামা পরা I মনির আশ্চর্য হয়ে জানতে চাইল

তুই এটা কোথায় পেলি ?

হাসিব ভুরু নাচিয়ে বলল

কি বলছিলাম না I এখন তো স্বীকার করবা I

কিন্তু তুই এটা পেলি কোথায় ?

এটা টুম্পার ক্যামেরায় ছিল I আমি ওরে ভুজং ভাজং দিয়া নিয়া আসছি, বলছি সামনের প্রোগ্রামের জন্য অনিমার একটা পোস্টার করা লাগবে I তাই দিলI নইলে কি আর দিত I

মনির গম্ভীর হয়ে বলল

এটা আমার কাছে থাক আমি ওকে ফেরত দিয়ে দেবো

হাসির ছো মেরে ছবিটা তুলে নিয়ে বলল
কেন? তোমার কাছে থাকবো কেন ?

মনির কেমন যেন মিইয়ে গেল , সত্যিই তো অনিমা ওর এমন কেউ নয় যে এটাও নিজের কাছে রাখবে I হাসির মনিরের ফ্যাকাশে ভাব দেখে বলল

চিল ম্যান I এটা তোমার কাছেই থাকবে I ভাবির ছবি দিয়া আমি কি করবো ?

মনির সুন্দর করে হাসল I তারপর ছবিটা ওর বইয়ের ভিতরে রেখে উঠে দাঁড়িয়ে বলল

চল যাই

কই?

যাবিনা খাইতে I চল আজকে তোরে খাওয়াই

হাসিব মনিরের পিঠ চাপড়ে বলল

এক ছবিতেই এই I

ওরা যখন স্টার কাবাব থেকে বের হলো তখন দুপুর হয়ে গেছে I ফেব্রুয়ারির শুরু তাই চারিদিকে এখনো শীতের আমেজ I দুপুরের রোদ টাও বেশ আরামদায়ক I হাসিব বলল

চলএকটু হাটি’ ধানমন্ডি লেকের মধ্যে

ভূতের মুখে রাম নাম I তোর আজকে হাঁটতে ইচ্ছা হইল

বেশি খাইয়া ফালাইছি মামু

চল যাই

ওরা হাঁটতে হাঁটতে রবীন্দ্র সরোবর এর দিকে চলে গেল I জায়গাটা বেশ ছায়ায় ঘেরা I হাঁটতে হাঁটতে ব্রিজের কাছে যেয়ে মনির ভুত দেখার মত চমকে উঠলোI

চলবে ……
লেখনীতে
অনিমা হাসান

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here