তোমাকে বলার ছিল……
ষষ্ঠদশ পর্ব
– তোমার কি মাথা ধরেছে সুজন ?
-না
– তাহলে গলা এরকম শোনাচ্ছে কেন ? নিশ্চয়ই মাথা ধরেছে
– একটু
– ওঠো চলো ওষুধ খাবে
-এখন উঠতে ইচ্ছা করছে না I ওষুধ খেতে ও ইচ্ছা করছে না
-আচ্ছা উঠতে হবে না এস আমি মাথা টিপে দেই
তৃণা সুজনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিল I অনেকক্ষণ কপালের দুই পাশ চেপে ধরে টিপে দিল i রাত তখন প্রায় শেষ হয়ে এসেছে Iদুজনের কেউই ঘুমায়নি I অনেকক্ষণ বাইরে বসে থাকার পর বাতাসে যখন হিম ভাব নেমে এলো তৃণার শীত করছিল i তৃনা বললো
– চলো ভেতরে যাই ঠান্ডা লাগছে
– আমার তো অনেকক্ষণ থেকেই যেতে ইচ্ছা করছে
– তাহলে এতক্ষণ বলনি কেন ?
– তুমি আবার কি মনে করো
– কি মনে করব ? অদ্ভুত তো I চলো
সারারাত ধরে বকবক করেছে সুজন i এই ছেলে যে এত কথা বলতে পারে তৃণার কোনো ধারনাই ছিল না I কত রকমের গল্প I প্রথম বই পড়ার গল্প , প্রথম সাইকেল চালানোর , প্রথম পাহাড় দেখার , প্রথম কবিতা পড়ার গল্প I একটা সময় পর তৃণার মনে হয়েছিল ছেলেটা আসলে খুব একা Iওর সেইরকম কোন বন্ধু নেই I বাবা মা ও নেই এখানে যে নিজের কথা বলবে কাউকে I কিছুক্ষণ পর তৃণা লক্ষ করল সুজনের গলা ভেঙে আসছে I হয়তো এতক্ষণ বকবক করার কারণে অথবা মাথা ধরেছে I অনেকক্ষণ ধরে তৃণা ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিল I চুল টেনে দিল, কপালের দুই পাশ চেপে ধরে টিপে দিল I আরামে তখন ওর চোখ বুজে আসছিল Iএকসময় সুজন বলল
– হয়েছে আর করতে হবে না
– কেন , ভালো লাগছে না ?
– লাগছে আর কষ্ট করতে হবে না
– আমি এটা তোমার জন্য করছি না আমার নিজের জন্য করছি
– মানে ?
– আমি চাই না আমার সঙ্গে তোমার প্রথম স্মৃতিটা মাথাব্যথাময় হোক I পরবর্তীতে আমি তোমার মাথা ব্যাথার কারণ হতে চাই নাI বলতে বলতে তৃণা হেসে ফেললো I
-এ আবার কেমন কথা আর এখন যদি আমি ঘুমিয়ে পড়ি তাহলে তো কোনো স্মৃতিই থাকবে না
– ঘুমিয়ে পড়বে কেন ?
-এত আরাম লাগছে ঘুম এসে যাচ্ছে তো
তৃণা সস্নেহে বললো তাহলে ঘুমিয়ে পড়ো
– আমি ঘুমাতে চাই না I ঘুমিয়ে এই মুহুর্তটা আমি নষ্ট করতে চাইনা
– তুমি তো এমন ভাব করছো যেন সকাল হলেই আমি চলে যাব আর আমাকে পাবে না
সুজন তৃণার মাথাটা নিজের বুকের মধ্যে চেপে ধরে বলল
– আর কখনো এরকম কথা বলবে না I আমি কখনো তোমাকে কোথাও যেতে দিতে চাই না
– আচ্ছা যাও বললাম না I ছাড়ো এখন
– না ছাড়বো না I তুমি এভাবেই শুয়ে থাকবে আমি তোমার চুলে বিলি কেটে দিচ্ছি
তৃণা কিছু বলল না I সুজন আস্তে আস্তে ওর চুলের মধ্যে হাত বুলিয়ে দিতে লাগল I তারপর একসময় বলল
– আমি তিন্নিকে এরকম করে দিতাম I ওর খুব প্রিয় ছিল
– তিন্নি কে ?
– আমার ফুপি I আমাকে খুব ভালোবাসতো আমরা সারাক্ষণ একসঙ্গে খেলতাম
– কোথায় উনি এখন ?
– মারা গেছে
তৃণা একটু চমকালো I তারপর জিজ্ঞেস করলো কিভাবে ?
– ক্যান্সার হয়েছিল I শেষের দিকে আমাকে ওর কাছে যেতে দিত না I এইযে বাড়িটা দেখছো এটা তিন্নির ও আমাকে দিয়ে গেছে I উত্তরায় আমাদের আরেকটা বাড়ি আছে I বাবা মা দেশে থাকতে আমরা ওখানেই থাকতাম I উনারা চলে যাওয়ার পর আমি এখানে শিফট করি I আমার ছোটবেলার অনেক স্মৃতি আছে এই বাড়িতে I তৃণা, তোমাকে আমার মাঝে মাঝে তিন্নির মতো লাগে I তিন্নি ও কি করে যেন বুঝে ফেলতো আমার কখন কি লাগবে I কখন আমার মাথাব্যথা ,কখন জ্বর এসেছে কখন খিদে পেয়েছে I তৃণা একটু হাসলো I ও বুঝলা সুজনের মন খারাপ হয়ে যাচ্ছে I প্রসঙ্গ ঘোরাতে বলল
– কয়টা বাজে ?
– জানিনা
– তোমার ঘরে কোন ঘড়ি নেই কেন ?
– কেনা হয়নি I বুঝতে পারছিলাম না তোমার কেমন ঘড়ি পছন্দ Iপেন্ডুলাম দেয়া না রোমান হরফ কনফিউজড ছিলাম I
– সময় দেখা যায় এমন ঘড়ি হলেই আমার চলবে I আমারও অত বাচবিচার নেই I জিনিসপত্র ও কি কেনোনি আমার কারনে ?
– হ্যাঁ I কালকে একসঙ্গে সব কিনব ঠিক আছে ? গাছ ও কিনে নিয়ে আসব
– আচ্ছা I তোমার মাথা ব্যথা কমেছে ?
– কমেছে একটু I
– কাছে এসে শোও আমি মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি
এবার সুজন আর আপত্তি করল না I খুব কাছে এসে তৃণার গা ঘেঁষে শুয়ে পড়ল I তৃণ আস্তে আস্তে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো I একসময় লক্ষ্য করলো ওর দুচোখে ঘুম নেমে এসেছে I
সুজন ঘুমিয়ে পড়লে তৃণা উঠে ওর ট্রলিব্যাগটা খুলল I সুলতানা আন্টি কি সুন্দর করে গুছিয়ে দিয়েছে I একপাশে কয়েকটা শাড়ি Iকতগুলো ড্রেস সঙ্গে ম্যাচিং এক্সেসরিজ I অন্যপাশে একটা সুন্দর হ্যান্ড ব্যাগI তার পাশে ক্রিম ,লোশন, শ্যাম্পু , ব্রাশ Iহালকা মেকআপ এর সরঞ্জাম I কয়েক জোড়া স্যান্ডেল I তৃণার চোখে পানি এসে গেল I ওর নিজের মা থাকলেও হয়তো এত সুন্দর করে গুছিয়ে দিত না I
তৃণা গোসল করে একটা গোলাপী রঙের শাড়ী পরল I ততক্ষনে ভোর হয়ে গেছে I তৃণা ভিজা চুল আঁচড়ে বাইরে বেরিয়ে এলো I
সুজনের বাসার পাশেই একটা পার্ক I আশেপাশে বেশ অনেকটা খোলা জায়গা I ঠিক সূর্যোদয় দেখতে না পারলেও ভোরের ফুটে ওঠা দেখতে পারল তৃণা I অনেকক্ষণ রেলিঙে ভর দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইল I চা খেতে ইচ্ছা করছে I সুজন নিশ্চয় ঘুমাচ্ছে এখনো I যা বকবক করেছে সারারাত I তৃণা ফোনটা হাতে নিল সময় দেখবে বলে I কাল রাতে ফোনটা সাইলেন্ট করে রেখেছিলো I ফোন হাতে নিয়ে আশ্চর্য হয়ে গেল ও I সুজন ম্যাসেজ পাঠিয়েছে I তারমানে ও জেগে আছে ? আজকের কবিতাটা এত তাড়াতাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে ? আগে ভেতরে যাবে না আগে কবিতাটা পড়বে ঠিক করে উঠতে পারছিল না তৃণা I অবশেষে কবিতার কাছে হার মানলো I কবিতাটা পড়ে অদ্ভুত ভালোলাগায় ভরে গেল মনটা I সুজন লিখেছে
এই একরত্তি জীবনে বলো না কীভাবে সম্ভব ভালোবাসা
তার জন্য চাই আরো দীর্ঘ অনন্ত জীবন,
ভালোবাসা কীভাবে সম্ভব, অতিশয় ছোটো এ জীবন
একবার প্রিয় সম্বোধন করার আগেই
শেষ হয় এই স্বল্প আয়ু-
হয়তো একটি পরিপূর্ণ চুম্বনেরও সময় মেলে না
ভালোবাসি কথাটি বলতেই হয়তোবা কেটে যাবে সমস্ত জীবন,
তোমার সম্মুখে বসে প্রথম একটি শব্দ উচ্চারণ করতেই
শেষ হয়ে যাবে কতো কৈশোর-যৌবন,
ঘনাবে বার্ধক্য, কেশরাজি উড়াবে মাথায়
সেই ধূসর পতাকা;
এইটুকু ছোট্ট জীবন, এখানে সম্ভব নয় ভালোবাসা
তার জন্য চাই আরো অনেক জীবন, অনন্ত সময়
তোমাকে ভালোবাসার জন্য জানি তাও খুবই স্বল্প ও সংক্ষিপ্ত মনে হবে।
তৃণা ঘরে ঢুকে সুজন কে দেখতে পেল না I শাওয়ারের শব্দ শুনে বুঝল ও ওয়াশরুমে I তৃণা বিছানা গুছিয়ে রাখল I অগোছালো কাপড় ভাঁজ করে তুলে রাখলো I বালিশের নিচে থেকে সুজনের ফোনটা বের করে দেখল অনেকবার রিং হয়েছে I ফোনটা তখনও সাইলেন্ট মোডে ভাইব্রেশন হচ্ছে I তৃণা ওয়াশরুম নক করে বলল
– সুজন তোমার ফোন বাজছে অনেকক্ষণ ধরে
– মনে হয় মা ,একটু ধরবে প্লিজ
তৃণা অস্বস্তি নিয়ে ফোনটা ধরল I ও কিছু বলার আগেই অন্য প্রান্ত থেকে উদ্বিগ্ন নারী কন্ঠ শোনা গেল
– সুজন তুই কি ওই মেয়েটাকে বিয়ে করে ফেলেছিস ? আমার কথা শোন I আমাদের কাছে ফোন এসেছিল I আমরা খোঁজ নিয়ে দেখেছি I ওই মেয়ের বাবা ইউএসএ থাকে I ওখানকার কমিউনিটি থেকে খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম I ওখানে ওনার বউ বাচ্চা আছে I দেশে ওনার কোন মেয়ে নেই I আমার তো মনে হয় এই মেয়ের কোন বাবার পরিচয় নেই I এরকম একটা বংশ পরিচয় হীন মেয়েকে তুই বিয়ে করিস না I আমার কথা শুনতে পাচ্ছিস ?
তৃণার মাথাটা ঘুরে উঠলো I এই জীবনে বাবা-মার কারণে ওকে অনেক কথা শুনতে হয়েছে I কিন্তু আজ পর্যন্ত এরকম কুৎসিত কথা ও কখনো শোনেনি I তৃণা আস্তে করে ফোনটা নামিয়ে রাখল I তারপর ধীরে ধীরে হেঁটে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল I
ঘরটার দিকে এক পলক তাকিয়ে সুজনের মনটাই ভালো হয়ে গেল I কি সুন্দর করে সব গুছিয়ে রেখেছে তৃণা I সমস্ত ঘর জুড়ে ওর স্পর্শ লেগে আছে I বের হয়ে ওকে কোথাও দেখতে পেল না I হয়তো চা বানাচ্ছে I রান্নাঘরে ও ওকে পাওয়া গেল না I সুজন পুরোটা ছাদ ঘুরে ওকে খুঁজে এল I কোথাও দেখা গেলোনা I অদ্ভুত তো কোথায় চলে গেল I সুজন ফিরে এসে দেখল দোলনার উপর ওর ফোনটা রাখা I আশ্চর্য ফোন ফেলে কোথায় চলে গেল সকাল সকাল I সুজন ফোনটা হাতে নিতেই দেখল তার নিচে একটা সাদা কাগজ I কাগজটা তুলে পড়তে নিতেই ওর হাত পা ঠান্ডা হয়ে গেল I তৃণা লিখেছে
সুজন
আমি চলে যাচ্ছি I তোমার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে যেতে পারলাম না I এত সাহস নেই আমার I একবার তোমার কাছ থেকে বিদায় নিতে গেলে হয়তো আর তোমাকে ছেড়ে যেতে পারতাম না I যাবার আগে তোমাকে কয়েকটা কথা বলে যেতে চাই I আমার মতন অনেকেই তোমার জীবনে আসবে যাবে কিন্তু তোমার বাবা-মা, তারা তোমার জীবনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ I তাদেরকে কখনো কষ্ট দিওনা I আমি আমার একটা জীবন বাবা মা ছাড়া কাটিয়েছি আমি জানি তাদের কি গুরুত্ব I
আরেকটা কথা আমার জন্য অপেক্ষা করে থেকো না I আমার জন্য নিজের ক্যারিয়ার কিংবা পড়াশোনার কোনো ক্ষতি করো না I কেউ যেন কোনদিন বলতে না পারে যে আমার কারনে তোমার জীবনটা নষ্ট হয়ে গেল I আমি তোমাকে তোমার স্বপ্নের সেই শিখরে দেখতে চাই যেটা তুমি এতদিন মনের মধ্যে লালন করে এসেছে I কখনো ভেবো না আমি তোমার উপর রাগ করে কিংবা তোমাকে ভুল বুঝে চলে যাচ্ছি I আমার এই চলে যাওয়াটাই তোমার জন্য ভালো I
তোমাকে অনেক কথা বলার ছিল I কিছুই বলা হলো না I তোমাকে বলার ছিল কতটা ভালবাসি তোমায় I তোমাকে কতটা ভালবাসি সেটা বলার জন্য হয়তো এই একটা জীবন ও যথেষ্ট ছিল না আর এই এক টুকরো কাগজে কি বা বলতে পারতাম I তাই আর চেষ্টা করলাম না I যদি এই জীবনে আবার কোনদিন দেখা হয় তাহলে হয়তো বলবো I তবে একটা কথা বলে যাই আমাকে খুঁজে সময় নষ্ট করো না I তুমি আমাকে খুঁজে পাবে না I
ভালো থেকোI নিজের যত্ন নিও I
তৃণা
চলবে. ………..
তোমাকে বলার ছিল……
ষষ্ঠদশ পর্ব
লেখনীতে
অনিমা হাসান
এই পর্বে যে কবিতাটা দেয়া হয়েছে তার নাম ‘এই জীবন’ ‘লিখেছেন মহাদেব সাহা
ক’দিন ধরে মাইগ্রেনের ব্যথায় ভীষণ কষ্ট পাচ্ছিলাম I একেবারেই লিখতে পারছিলাম না I এই পর্ব টা দিতে অনেক দেরী করে ফেললাম I যদিও চাইছিলাম সবার কাছে ভাল লাগার অনুভূতিটা থাকুক কিছু দিন I আবার তো সেই মন খারাপের গল্প শুরু হয়ে গেল I