#তোমাতেই_পরিপূর্ণ
লেখিকা-জান্নাতুল ফারিয়া প্রত্যাশা
১৭.
~
দুদিন পর মাহি আর মিথিকে নিয়ে তাদের মা বাবা বাড়ি ফিরল। সাথে নিয়ে এল একগাদা ঔষধ আর ডক্টরের কড়া প্রেসকিপশন। অনেক কিছু মেনে এখন চলতে হবে তাদের। হুট হাট যা ইচ্ছে তাই খেয়ে ফেলা যাবে না। সবসময় সতর্ক থাকতে হবে। বাসায় এসে মিথি তার রুমে গেল। চোখ বুজে বিছানায় শুয়ে পড়ল সে। বুক চিরে বেরিয়ে এল দীর্ঘশ্বাস। অল্প কিছু সময়ের ব্যবধানে কত কিছু হয়ে গিয়েছে। পেটের উপর থেকে কাপড়টা সরিয়ে ব্যান্ডেজটার উপর হাত রাখল সে। ডক্টর বলেছে এক সপ্তাহ পর ব্যান্ডেজ খুলবে। এর আগে গোসল টোসল সব বন্ধ তাদের।
কিছুক্ষণ পর মিথির রুমে আমিরা বেগম এলেন। একটা প্লেটে একগাদা ফল কেটে নিয়ে এলেন। মিথির পাশে বসে তিনি বললেন,
‘এই ফলগুলো খেয়ে নে মা।’
মিথির বরাবরই ফল অপছন্দ। পছন্দ বলতে একমাত্র আমই সে খায়। আর কোনো ফল ছুঁয়েও দেখে না। কিন্তু ডক্টর তাকে এখন আম খেতে সাফ বারণ করে দিয়েছে। ইনফেক্ট সাইট্রাস যুক্ত কোনো টক ফলই সে খেতে পারবে না। তাই মা তার জন্য সেসব ফল বাদে অন্য ফলগুলো কেটে এনেছেন। আর শরীর সুস্থ রাখতে এখন ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও তাকে এসব খেতে হবে। মিথি আস্তে আস্তে উঠে বসল। এক পিস আপেল হাতে নিতে নিতে বললো,
‘মাহি খেয়েছে, মা?’
‘না, এত সহজে কি খেয়ে ফেলার ছেলে ও। তোর বাবা বুঝিয়ে টুঝিয়ে খাওয়াচ্ছে।’
মিথির অল্প কিছু ফল খেল। আমিরা বেগম নাক মুখ কুঁচকে তাকে জোর করে আরও কিছুটা খাওয়ালো। তারপর তিনি মিথিকে শুইয়ে দিয়ে বললেন,
‘এবার একটু রেস্ট নে। একটু পর এসে স্যুপটা দিয়ে যাবো।’
মিথি মুচকি হেসে মাথা নাড়াল। ফলের প্লেটটা হাতে নিয়ে আমিরা বেগম রান্নাঘরে চলে গেলেন।
দুপুরে মাহিকে খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিলেন আতাউর সাহেব। আর মিথিকে তার মা এক টুকরো মাছ দিয়ে অল্প কিছু ভাত খাইয়ে দিয়েছে। মিথি তখন খাবারের মাঝে মাঝে মুচকি হেসে বলেছিল,
‘মা, তুমি এমন করে আমায় খাওয়াচ্ছো যেন আমি দু বছরের ছোট্ট একটা বাচ্চা।’
আমিরা বেগম ভাত মাখাতে মাখাতে বলেছিল,
‘বাচ্চাই তো। তুই তো আমার বুড়ো বাচ্চা।’
মিথি তখন ফট করে মাকে জড়িয়ে ধরে তার গালে চুমু দিয়ে দিয়েছিল। আমিরা বেগম প্রথমে বড়ো বড়ো চোখ করে মিথির দিকে তাকালেও পরে তিনি হেসে দেন। মিথিও মায়ের হাসি দেখে হেসে ফেলে।
.
.
সবাই এখন ঘুমাচ্ছে। আর মিথি শুয়ে শুয়ে ভাবছে। তার ভাবনা জুড়ে শুধু একজন পুরুষেরই আনাগোনা। বাসায় আসার আগে নেহা হসপিটালে গেলেও নৈরিথ যায়নি। সে নাকি খুব ইম্পোরটেন্ট একটা মিটিং এ আটকে গেছে। তাই মিথির একটু মন খারাপ হয়েছিল। তবে সে মানিয়ে নিয়েছিল তখন। তার আগের দুদিন নৈরিথ এক চুলও হসপিটাল থেকে নড়েনি। বরাবর মিথির কেবিনের বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল। যতবারই নৈরিথের চোখে মিথির চোখ পড়েছে ততবারই নৈরিথ মুচকি হেসেছে। ইশ, কি চমৎকার ছিল সেই হাসি। সেই হাসিতেই মিথি আবারও প্রেমে পড়েছিল। লজ্জা পেয়েছিল। ভালোবেসে ছিল। মিথি চোখ বুজে জোরে শ্বাস টানে। মনটা ফুরফুরে হয়ে উঠে তার। বাইরে মৃদু বাতাস। বিকেলের মিষ্টি রোদ। ফোনে বেজে চলছে তাহসানের তীক্ষ্ণ সুর,
তুমি আর তো কারো নও শুধু আমার
যত দূরে সরে যাও রবে আমার
স্তব্ধ সময়টাকে ধরে রেখে,
স্মৃতির পাতায় শুধু
তুমি আমার
কেন আজ এত একা আমি ?
আলো হয়ে দূরে তুমি !
আলো-আলো আমি কখনো খুঁজে পাবনা
চাঁদের আলো তুমি কখনো আমার হবে না
আলো-আলো আমি কখনো খুঁজে পাবনা
চাঁদের আলো তুমি কখনো আমার হবে না, হবে না, হবে না, হবে না,,,,,,,,,
গানের বাকি লাইনগুলো বাজার আগেই মিথির ফোনটা বেজে উঠে। বিরক্ত হয় সে। সুন্দর মুহুর্তটাকে কে নষ্ট করে দিল। পাশ ফিরে মোবাইলটা হাতে নেয়। সঙ্গে সঙ্গে ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠে তার। কলটা রিসিভ করে,
‘হ্যালো!’
‘জ্বি, বলুন!’
‘কেমন আছো?’
‘আপনি যাওয়ার সময় যেমন দেখে গিয়েছিলেন তেমনই।’
‘বাসায় ফিরে মন ভালো হয়নি?’
‘হ্যাঁ হয়েছে। হসপিটালের চেয়ে আমার বাসা আর আমার রুম হাজার গুণে ভালো। এখানে থাকলেই আমি সুস্থ হয়ে যাবো।’
মুচকি হাসে নৈরিথ। বলে,
‘খাওয়া দাওয়া করে ঔষধ খেয়েছো?’
‘জ্বি।’
‘এই তো গুড গার্ল। এবার একটু ঘুমাও।’
মিথির মুখ গোমড়া করে বলে,
‘সারাদিন তো ঘুমের মধ্যেই আছি।’
নৈরিথ হেসে বললো,
‘তাহলে গিয়ে পড়তে বসো।’
মিথি কপট রাগ দেখিয়ে বলে,
‘মাস্টারমশাই এর মাষ্টার গিরি আর যাবে না। রাখছি আমি।’
নৈরিথ সশব্দে হেসে উঠল। নৈরিথের হাসির শব্দ মিথির বুকের কম্পনকে বাড়িয়ে তুললো। মিথি চোখ বুজে একটা নিশ্বাস নিয়ে বললো,
‘আপনি আমাদের বাসায় আসবেন না?’
‘কেন আসবো?’
মিথি মুখ কালো করে বললো,
‘কেন আবার আমাকে দেখতে।’
নৈরিথ খানিক চুপ থেকে বললো,
‘তুমি তো এখন সুস্থই হয়ে গিয়েছো। আর দেখে কি হবে?’
মিথি নাক ফুলিয়ে বললো,
‘দুদিনের কেউ সুস্থ হয়ে যায়?’
‘ওমা হয় না বুঝি? তোমার ভয়েস শুনে তো মনে হচ্ছে না তুমি অসুস্থ। ঝগড়া করতে দিলে তো এখন দিব্যি ফার্স্ট হয়ে যাবে।’
মিথি রাগে ফুঁসে উঠে বললো,
‘মজা করছেন আমাকে নিয়ে? আপনার সাথে কথা বলাই আমার ভুল হয়েছে। রাখছি।’
কল কেটে দেয় মিথি। তার সুন্দর মুডটার বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে। ফোনটা বিছানার এক কোণে ছুঁড়ে মেরে চোখ বুজে সে। সেই চোখ খুলে সন্ধ্যে সাতটায়। বাসায় তখন কেউ এসেছে। খুব পরিচিত এক কন্ঠস্বর শুনতে পায় সে। ঘুমের মাঝেই সে ভাবতে থাকে কোথাও একটা শুনেছে সে এই ভয়েস। খুব পরিচিত তার। কার হতে পারে কার হতে পারে ভাবতে ভাবতেই নৈরিথের কথা মনে পড়ে তার। ফট করেই চোখ মেলে তাকায় সে। নৈরিথ এসেছে নাকি। হ্যাঁ, এটাতো নৈরিথেরই ভয়েস। মিথি আস্তে আস্তে উঠে বসে। দরজার বাইরে উঁকি ঝুঁকি দেয়। সুস্থ থাকলে এতক্ষণে ড্রয়িং রুমে গিয়ে উঁকি ঝুঁকি দেওয়া শুরু হয়ে যেত তার। অসুস্থ বলে পারছে না। অনেকক্ষণ বসে থেকে কাউকে দেখতে না পেয়ে বিরক্ত হয়ে উঠতে নিলেই তার মনে হয় কেউ যেন তার রুমের দিকেই আসছে। সে তাড়াহুড়ো করে বিছানায় শুয়ে পড়ে। তারপর গায়ের ওড়না আর জামাটা ঠিক করে চোখ বুজে ফেলে। মিথির বাবা আর নৈরিথ তার রুমে আসে। আতাউর সাহেব এসে মিথির পাশে বসে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে ডাকলেন,
‘মিথি, ঘুম হয়েছে মা তোর?’
মিথির ঘুমের ভান করে কিছুক্ষণ শুয়ে রইল। আতাউর সাহেব আরও দুবার ডাকতেই মিথি ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকায়। মুচকি হেসে বলে,
‘হ্যাঁ বাবা বলো।’
‘নৈরিথ এসেছে।’
মিথি উপরে তাকিয়ে দেখল দরজার পাশে হেলান দিয়ে নৈরিথ দাঁড়ান। মিথির কিছুটা অস্থির হওয়ার ভান করে উঠে বসলো যেন সে জানেই না নৈরিথ যে এসেছে। মিথিকে অস্থির হতে দেখে নৈরিথ বললো,
‘আস্তে আস্তে এত অস্থির হইও না। ব্যাথা লাগতে পারে।’
মিথি বোকা বোকা হাসল। মিথির পড়ার টেবিলের একটা চেয়ার টেনে নৈরিথ তার সামনে বসে। মিথির বাবা তখন বললেন,
‘তোমরা বসে কথা বলো। আমি মাহির কাছে যাই। ও তখন থেকে ডেকে চলছে।’
মিথির বাবা উঠে চলে গেলেন। মিথি মনে মনে ভাবল,
তার বাবা তো সেই একটা মানুষ। মেয়ে আর মেয়ের হবু জামাইকে কথা বলার জন্য কি সুন্দর সুযোগ করে দিলেন।
কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকার পর মিথি আড়চোখে একবার নৈরিথের দিকে তাকাল। নৈরিথ তার টেবিল থেকে একটা উপন্যাসের বই নিয়ে পাতা উল্টাচ্ছে। অনেকক্ষণ ধরে একই কাজ করছে সে। মিথি বসে বসে বিরক্ত হয়ে হাত কচলাচ্ছে। বেশ সময়ের পর নৈরিথ বলে উঠল,
‘এসব পড়ে পড়েই মাথাটা বিগড়েছে তোমার তাই না?’
মিথি ব্রু কুঁচকে বলে,
‘মানে?’
নৈরিথ তার হাতের বইটা বন্ধ করে সোজা হয়ে বসে। মাথার সামনের চুলগুলোতে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে,
‘মানে, এত প্রেমের উপন্যাস পড়ে পড়েই তোমার মাথায় এত প্রেম ঘুরঘুর করে। এসব বাদ দিয়ে যদি একটু সাধারণ জ্ঞানও পড়তে তাহলে একটু বুদ্ধিমতী হতে পারতে।’
মিথি তাচ্ছিল্যের সুরে বললো,
‘বুদ্ধিমতী হতে পারতাম কিনা জানি না তবে আপনার মতো পানসা মানুষ ঠিকই হতে পারতাম।’
কপাল কুঁচকে নৈরিথ বললো,
‘কি বললে তুমি?’
মিথি কিছু না বোঝার ভান করে বললো,
‘কিছু না তো।’
নৈরিথ কপাল কুঁচকে মিথির দিকে তাকিয়ে রইল। মিথি তাকাতে পারছে না, চোখে চোখ পড়ে যাবে বলে। অনেকক্ষণ এইভাবেই তাকিয়ে থেকে নৈরিথ হঠাৎ বললো,
‘রাদিত স্যারের সঙ্গে নাকি তোমার বিয়ে ঠিক হয়েছিল? তা উনি তো অনেক ভালো মানুষ। বিয়েটা করে নিলেই তো পারতে। না করে দিলে কেন?’
মিথি চোখ মুখ লাল করে নৈরিথের দিকে তাকাল। রাগি গলায় বললো,
‘এত কিছু জানেন। আর কেন বিয়েতে মত দেয়নি সেটা জানেন না তাই না?’
নৈরিথ ঠোঁট দিয়ে জিভ ভিজিয়ে বললো,
‘না তো। আসলেই আমি জানি না।’
মিথির রাগ হয় ভীষণ। সে রেগে উঠে বলে,
‘আমার যে আপনার বাচ্চার মা হওয়ার খুব সখ জেগেছে তাই রাদিত স্যারকে রিজেক্ট করে দিয়েছি। এবার পেয়েছেন আপনার উত্তর?’
রাগের মাথায় কথাটা বলে ফেললেও পরে মিথি বুঝতে পারল সে একটু বেশিই বলে ফেলেছে। এবার লজ্জা লাগছে তার। বাঁকা চোখে একবার নৈরিথের দিকে তাকিয়ে দেখে সে হতভম্ব হয়ে তার দিকে চেয়ে আছে। সে যে তার কথাটা ঠিক হজম করতে পারছে না সেটা তার চোখ মুখের অবস্থা দেখেই বুঝা যাচ্ছে।
চলবে..