#তোমাতেই_পরিপূর্ণ
লেখিকা-জান্নাতুল ফারিয়া প্রত্যাশা
১৯.
~
আতাউর সাহেব মিথিকে নিয়ে তার কলেজে এলেন। আজ তার প্রেকটিকেল পরীক্ষা। কলেজ গেটের সামনেই নেহা দাঁড়িয়ে আছে। মিথি রিক্সা থেকে আস্তে আস্তে নেমে নেহার কাছে গেল। তারপর দুজন এক সঙ্গে কলেজের ভেতর প্রবেশ করলো। আতাউর সাহেবও রিক্সার ভাড়া মিটিয়ে তাদের পেছন পেছন এলেন। মিথি আর নেহা তাদের প্রেকটিকেল ক্লাসে ঢুকে পড়ল। মিথির বাবা তখন সেই ক্লাসের দায়িত্বে পড়া দুজন টিচারের সঙ্গে কথা বললেন। উনারা তাকে আশ্বাস দিয়ে বললেন, দুশ্চিন্তা না করতে, মিথি শরীরের কন্ডিশনের কথা উনারা মাথায় রাখবেন। মিথির বাবা কিছুটা হলেও নিশ্চিন্ত হলেন। তিনি ওয়েটিং রুমে বসে অপেক্ষা করতে লাগলেন।
এক ঘন্টা পর মিথি আর নেহা বের হলো। বাবাকে নিয়ে মিথি কলেজের গেটের সামনে গেল। রাস্তার ওপারের ফুচকার স্টলটাতে চোখে পড়তেই মিথির মনটা লাফিয়ে উঠল। কিন্তু কিছুক্ষণের মাঝেই মুখ কালো হয়ে গেল তার। ঠোঁট উল্টে কেবল ঐদিকে তাকিয়েই থাকল। ইশ, খালি দেখতেই পারবে খেতে তো আর পারবে না। এই মুহুর্তে তার মনে একটা গানই বাজছে,
‘তোমাকে ছোঁয়ার নেই তো আমার সাধ্য
দেখতে পাওয়া সেই তো বড়োই ভাগ্য..’
নেহা তার পাশে ছিল। সে মিথির কাঁধে হাত রেখে বললো,
‘কি রে দোস্ত? মুখে খেতে পারছিস না বলে কি চোখ দিয়েই ফুচকাগুলো গিলে খাবি?’
মিথি অসহায় ভাবে মাথা নাড়াল। নেহা ফিক করে হেসে দিয়ে বললো,
‘আহারে বেচারা। থাক বাবু কষ্ট পাস না। সত্যি সত্যি খেতে না পারলেও মনে মনে তো খেতে পারবি। আর মনের খাওয়াই আসল খাওয়া বাকি সব তো কেবল বিলাসিতা।’
মিথি রাগ দেখিয়ে বললো,
‘হয়েছে চুপ করতো।’
মিথির বাবা গিয়েছিলেন রিক্সা ঠিক করতে। তার মাঝেই সেখানে নৈরিথ এল। যাকে দেখা মাত্রই মিথির সেদিনের কথাগুলো মনে পড়ে গেল। আর সঙ্গে সঙ্গে লজ্জায় লাল হয়ে উঠল তার গালগুলো। নৈরিথ গাড়ি থেকে নেমে তাদের সামনে এসে দাঁড়াল। মিথির দিকে তাকিয়ে প্রসন্ন হেসে বললো,
‘কেমন আছো?’
মিথি হালকা হেসে বললো,
‘ভালো।’
‘একা এসেছো, নাকি আংকেল সাথে এসেছেন?’
‘না বাবা এসেছেন সাথে। ঐ যে উনি রিক্সা ঠিক করছেন।’
নৈরিথ মিথির বাবার কাছে গেল। সালাম দিয়ে বললো,
‘আংকেল রিক্সা ঠিক করার প্রয়োজন নেই। আমি অফিস থেকে গাড়ি নিয়ে এসেছি। চলুন আপনাদের নামিয়ে দেই।’
‘না না বাবা। তুমি নেহাকে নিয়ে বাড়ি যাও। আমাদের জন্য তোমাকে আবার উল্টা রাস্তায় যেতে হবে।’
‘সমস্যা নেই তো আংকেল। আমি অনুরোধ করছি, প্লীজ চলুন।’
নৈরিথের জোরাজুরিতে আতাউর সাহেব রাজি হলেন। গাড়িতে গিয়ে বসলো সবাই। মিথিদের বাড়িতে যেতে লাগে পনেরো মিনিট। সেই পনেরো মিনিটের রাস্তা ফুরানোর আগেই মিথি চেঁচিয়ে উঠল,
‘গাড়ি থামান, গাড়ি থামান।’
মিথির চিৎকারে ড্রাইভার সঙ্গে সঙ্গে ব্রেক কষলেন। সামনের সিট থেকে নৈরিথ পেছনে ঘুরে তাকিয়ে বললো,
‘কি হয়েছে মিথি?’
মিথি ততক্ষণে অস্থির। সে তার বাবার দিকে তাকিয়ে বলতে লাগল,
‘বাবা, আমি সিফাতকে দেখেছি। ও এক্ষুণি আমার পাশ দিয়ে বাইক নিয়ে গিয়েছি। আমি স্পষ্ট ওকে দেখেছি।’
নেহা আর নৈরিথ দুজনেই অবাক। তাদের মস্তিষ্কের প্রতিটি নিউরনে নিউরনে এখন শুধু একটাই প্রশ্ন ঘুরছে, ‘কে এই সিফাত?’
মিথি অস্থির হয়ে গাড়ি থেকে নামতে নিলেই তার বাবা তাকে আটকে দেয়। তিনি মিথির দুবাহু ধরে বলেন,
‘ওটা সিফাত না। তুই সিফাতকে দেখিসনি অন্য কাউকে হয়তো দেখেছিস মা।’
মিথি অসহায় কন্ঠে বললো,
‘বাবা ওটা সিফাত ছিল। আমি আমার সিফাতকে চিনি বাবা। ঐ সিফাত। আমি দেখেছি ওকে। এক্ষুণি আমার সামনে দিয়ে গেল।’
‘আমার সিফাত’ কথাটা শোনা মাত্রই নৈরিথের মুখটা চুপসে গেল। মনটা অস্থির হয়ে উঠল তার। মিথির মুখে এর আগে কোনোদিনই এই নামটা শোনেনি। কে সে? আর মিথিই বা কেন এই মানুষটার জন্য এত অস্থির হয়ে উঠেছে? তার সাথে মিথির কি সম্পর্ক? নৈরিথের মন বিচলিত হয়ে উঠে। ইচ্ছে করছে এক্ষুণি মিথিকে এই প্রশ্নগুলো করতে। কিন্তু মিথির অবস্থা দেখে সে নিজেকে সামলে নিল। একটা ছোট্ট নিশ্বাস নিয়ে নৈরিথ বললো,
‘গাড়ি স্টার্ট করতে বলবো আংকেল?’
মিথির বাবা মিথিকে শান্ত করলেন। তারপর নৈরিথকে সম্মতি দিতেই গাড়ি আবার চলতে শুরু করলো। মিথি বাবার বুকে মাথা রেখে ঘন ঘন নিশ্বাস ছাড়ছে। তার মন বলছে বাইকের ঐ ছেলেটাই সিফাত। সে তার মুখটা দেখেছিল। কিন্তু এটা তার বাবাকে সে কিভাবে বিশ্বাস করাবে?
গাড়ি তার গন্তব্যে এসে থেমে যায়। মিথি গাড়ি থেকে নেমে সোজা বাসায় চলে যায়। আতাউর সাহেব নৈরিথ আর নেহাকে বিদায় দিয়ে বাসায় প্রবেশ করেন।
‘এই সিফাতটা কে রে নেহা?’
‘আমিও তো জানি না ভাই। মিথি তো আমাকে এই নামের কারো সমন্ধে কিছু বলেনি।’
নৈরিথের মনের অস্থিরতাটা আরও বেশি বেড়ে যায়। মিথির এমন কোনো কথা নেই যেটা নেহা জানে না। অথচ এই সিফাত সম্পর্কে সেও কিছু বলতে পারছে না। আশ্চর্য! চিন্তা হবারই কথা। তার সাথে ভয়ও হচ্ছে। ঠকে যাওয়ার ভয়। কিছু হারিয়ে ফেলার ভয়। নৈরিথ শক্ত হয়ে সিটে হেলান দিয়ে বসে চোখ বুজে। মনে মনে সে বলে,
‘খুব কষ্টে নিজের মনকে বুঝিয়েছি মিথি। আমার বিশ্বাস ভেঙ্গো না।’
.
.
সারাদিন যায় মিথির মন খারাপ। যেদিনই সিফাতের কথা তার মনে মাথা চারা দিয়ে উঠে সেদিনই তার মন খারাপ থাকে। আজও তার ব্যতিক্রম নয়। বিছানায় বসে এক ধ্যানে ফ্যানটার দিকে তাকিয়ে আছে সে। যেন এই ফ্যানের মাঝেই সে কোনো গোপন রহস্য খুঁজে পেয়েছে। তার মাথায় চলছে যতসব আজগুবি চিন্তা ভাবনা। আচ্ছা, এই ফ্যানটা তো এত ঘোরে তার কি মাথা ঘুরায় না? আচ্ছা, তার কি বমি বমি পায় না? শরীর ক্লান্ত হয়না?
একসময় নিজের মনের প্রশ্নে নিজেই বিরক্ত হয়ে উঠে সে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
‘আই মিস ইউ সিফাত।’
কান্না পাচ্ছিল খুব। কিন্তু সে কাঁদল না। কাঁদলেই তো আর সিফাত চলে আসবে না। সুতরাং কেঁদে কেটে অযথা চোখের পানি অপচয় করে কোনো লাভ নেই। এগুলো জমিয়ে রাখতে হবে। বিয়ের দিন কবুল বলার সময় কেঁদে কেটে ভাসাতে হবে। মিথি নাক টানল। বিয়ের কথা মনে হতেই তার নৈরিথের কথা মনে পড়ল। ছেলেটা নিশ্চয়ই এতক্ষণে তাকে নিয়ে অনেক কিছু ভেবে ফেলেছে? আচ্ছা, সিফাতের কথা তো নেহাও জানেনা। মেয়েটাও নিশ্চয়ই চিন্তায় পড়ে গেছে। পড়ুক, মাঝে মধ্যে এমন একটু আধটু চিন্তায় পড়া লাগে তাহলে শরীর মন ভালো থাকে।
ঐদিকের মানুষটা সত্যি সত্যিই চিন্তা করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়ল। আর না পেরে এবার ডিরেক্ট সে কল দিয়ে বসলো। কলটা রিসিভ হতেই নৈরিথ ক্ষিপ্ত কন্ঠে বলে উঠল,
‘সিফাত কে?’
মিথি বুঝে গেল বেচারার মস্তিষ্ক এই এক চিন্তায় এতক্ষণে ঘোলাটে হয়ে উঠেছে যে ‘কে এই সিফাত?’ মিথির ভালো লাগল। এই চিন্তাটাকে দুশ্চিন্তায় পরিণত করার এক জম্পেশ বুদ্ধি আঁটল সে। গলা ঝেড়ে বললো,
চলবে..