#তোমাতেই_পরিপূর্ণ
লেখিকা-জান্নাতুল ফারিয়া প্রত্যাশা
২.
~
সন্ধ্যার আকাশ ধীরে ধীরে অন্ধকারের চাদরে নিজেকে ঢাকতে লাগল। মাগরিবের আযান হয়েছে সে কবেই। নামাজ শেষে নামাজীরা ব্যতি ব্যস্ত হয়ে বাড়ির দিকে হাঁটা ধরল। কেউ কেউ আবার মসজিদেই বসে রইল। নিজের মনের দুঃখ কষ্টগুলো খোদার দরবারে ব্যক্ত করে চলছে প্রতিনিয়ত।
বাসায় ফিরে নৈরিথ। দরজা খুলেই কপট রাগ দেখিয়ে নেহা বলে উঠে,
‘তুই কোন সাহসে আমার বান্ধবীর গায়ে হাত তুললি ভাই?’
জবাব দেয়ার প্রয়োজন বোধ করলো না নৈরিথ। হাত থেকে ঘড়িটা খুলতে খুলতে নিজের রুমের দিকে পা বাড়াল। নেহা দরজা আটকে নৈরিথের পেছন পেছন তার রুমে গেল। আজ কাল ভীষণ গরম পড়েছে। একেবারে গা জ্বালানো গরম। নৈরিথ ফ্যানটা ছেড়ে ধপাস করে বিছানায় শুয়ে পড়ল। সারাদিনের টিউশনিতে বড্ড ক্লান্ত সে। নেহা এই মুহুর্তে ভীষণ রেগে আছে। ক্ষোভিত গলায় সে প্রশ্ন ছুড়ে,
‘বলছিস না কেন? কেন মারলি মিথিকে?’
নৈরিথ জোরে শ্বাস টানল। উঠে বসে পাঞ্জাবী উপরের বোতাম গুলো খুলে কলারটা একটু পেছন দিকে ঠেলে দিল। তারপর ক্লান্ত কন্ঠে বললো,
‘একটু পানি আন তো।’
তেতে উঠে নেহা। সশব্দে বলে,
‘পারবো না।’
শক্ত হয়ে উঠে নৈরিথের কন্ঠস্বর। ধমকে উঠে সে বলে,
‘আরেকটা থাপ্পড় এখন তুই খাবি অসভ্য। তোর প্রশ্রয় পেয়ে পেয়ে ঐ স্টুপিডটার এত সাহস বেড়েছে। নূন্যতম লজ্জাবোধ নেই ওর। এত কিছু বলেছি, এত বকা দিয়েছি আর আজ বাধ্য হয়ে মেরেছি পর্যন্ত তাও আমি জানি সে সুধরাবে না। শুধুমাত্র তোর জন্য। শোন নেহা, তোকে আমি লাস্ট বারের মতো ওয়ার্ন করে দিচ্ছি টেক্সট টাইম যদি তুই ওকে আর কোনো প্রকার প্রশ্রয় দিবি তাহলে তোর গালগুলো আমি থাপড়াতে থাপড়াতে ফাটাবো।’
রাগে, ক্ষোভে নাকের পাল্লা ফুলাতে থাকে নেহা। নৈরিথ তাকে পাত্তা না দিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়ল ফ্রেশ হতে। নেহার মনক্ষুন্য হয়। তার ভাইয়ের সাথে সে পেরে উঠবে না। ঐদিকে মিথিও যে কিছু বুঝতে চায় না। উফফ, সে পড়েছে মহা বিপাকে। এইদিকে গেলেও ঝামেলা আবার ঐদিকে গেলেও ঝামেলা। এখন কোন দিকে যাবে সে?
.
.
‘মিথি, তুমি কি করেছো? নৈরিথ কেন তোমাকে পড়াতে চাইছে না?’
বাবার এমন শান্ত কঠিন গলার প্রশ্ন শুনে ঢোক গিলল মিথি। ভয়ে রীতিমতো কাঁপাকাঁপি শুরু হয়ে গিয়েছে তার। সব দোষ ঐ নৈরিথের। মিচকা শয়তান একটা। বললে পুরোটা বল। তা না; বলে কিনা, মিথিকেই জিগ্যেস করবেন আংকেল, আমার পড়াতে না চাওয়ার কারণ। আমার চেয়ে ওই ভালো বলতে পারবে। ভালোমতো ফেঁসেছে সে। এখন কি বলবে সেটাই বুঝে উঠতে পারছে না। আমিরা বেগম রেডি হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। মিথি একটা মিথ্যে কথা বললেই তিনি চটাস করে তার গালে একটা চড় বসিয়ে দিবেন। অসহায় দৃষ্টিতে সে মায়ের দিকে তাকায়। চোখ দিয়ে যেন তিনি এখুনি মিথিকে ভস্ম করে দিবেন। মিথি ঢোক গিলল। তারপর কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,
‘ব-বাবা এ-একটু পানি খাবো।’
আক্রোশ নিয়ে বলে উঠলেন আমিরা বেগম,
‘কোনো কিছু খেতে হবে না। যেটা জানতে চেয়েছে সেটার উত্তর দে। নৈরিথ কেন তোকে পড়াতে চাইছে না? কি করেছিস তুই? বল তাড়াতাড়ি। আজকে তোর খবর আছে। এই ঝাড়ু আজকে আমি তোর উপর ভাঙবো।’
কথাটা বলে তিনি বিছানার প্লাস্টিকের ঝাড়ুটা হাতে নিলেন। মিথি এবার কেঁদে ফেলে। বাবার গা ঘেষে দাঁড়িয়ে বলে,
‘বাবা!’
আতাউর সাহেব ব্রু কুটি করলেন। গম্ভীর কন্ঠে বললেন,
‘আহ, রাখো তো এইসব। আমি কথা বলছি তো মিথির সাথে।’
ঘাড় ঘুরিয়ে মিথির দিকে তাকালেন তিনি। উদ্বেলিত কন্ঠে বললেন,
‘কি হয়েছে বলতো মা আমায়? নৈরিথ কেন তোমাকে পড়াতে চাইছে না? কোন সমস্যা হয়েছে কি?’
মিথি জিভ দিয়ে তার শুকনো ঠোঁট জোড়া ভিজিয়ে নিল। তারপর কোমল দৃষ্টিতে তার বাবার দিকে তাকিয়ে বললো,
‘আসলে বাবা হয়েছে টা কি, আমার টেস্টের রেজাল্টটা ভালো আসেনি। তার উপর স্যার আমাকে কাল যা পড়া দিয়েছিলেন আমি তা কিচ্ছু শিখিনি। তাই স্যার আরো বেশি রেগে যান। আর তুমি তো জানোই বাবা উনার কি রাগ! তাই উনি রাগের মাথায় বলেন আমাকে নাকি আর পড়াবেন না। আমি নাকি উনার কোনো কথা শুনি না। আমাকে পড়ালে নাকি উনার মান সম্মান নষ্ট হবে। আরো কত কথা বলেছে। আমি তো..’
কথার মাঝখানেই আমিরা বেগম কর্কশ গলায় বলে উঠলেন,
‘তোকে যে ও কষিয়ে দুইটা চড় মারেনি সেটাই বেশি। ঠিকই তো বলেছে ওর কি ঠেকা পড়েছে নাকি যে তোর মতো অসভ্য মেয়েকে পড়িয়ে পড়িয়ে পাশ করাবে? সারাটা দিন শুধু মোবাইল আর নয়তো টিভি। পড়ার প্রতি তার বিন্দুমাত্র মনোযোগ নেই। খালি এইচ এস সি টা ফেইল কর, ঘাড় ধরে একটা ভুঁড়িওয়ালা লোকের সাথে বিয়ে দিয়ে দিব।’
মিথি সশব্দে চেঁচিয়ে উঠে,
‘মাআআআ, তুমি কিন্তু এবার বেশি বেশি বলছো। আমি বিয়ে করবো না। আর কোনো ভুঁড়িওয়ালাকে তো নয়ই।’
কথাটা বলেই মিথি পায়ের জোর বাড়িয়ে দ্রুত নিজের রুমে চলে গেল।
আমিরা বেগম তখন উদ্বিগ্ন কন্ঠে বললেন,
‘বুঝলে তো মিথির বাবা, মেয়েটা যেন দিন দিন কেমন হয়ে যাচ্ছে? আর আমি বুঝলাম না, নৈরিথেরই বা কি হয়েছে? শুধুমাত্র পরীক্ষায় খারাপ করায় ও আর মিথিকে পড়াতে চাইছে না? এই একটাই কারণে? আমার তো মনের ভেতর কেমন খচখচ করছে বুঝলে? মনে হচ্ছে এর মাঝে অন্যকিছু আছে।’
চোখমুখ কুঁচকে তিনি ভাবতে লাগলেন। আতাউর সাহেব তপ্ত শ্বাস ফেলে বললেন,
‘কেন যে তোমার মা বাবা তোমাকে গোয়েন্দা না বানিয়ে আমার কাঁধে ঝুলিয়ে দিলেন কে জানে?’
চড়াৎ করে জ্বলে উঠল আমিরা বেগম। কাঠ কাঠ গলায় বললো,
‘কি..কি বললে তুমি?’
আতাউর সাহেব তৎক্ষণাৎ বিদ্রুপের সুরে বললেন,
‘বলেছি, তোমাকে আজ খুব সুন্দর লাগছে আমার আমিরা বানু।’
নাক পাল্লা ফুলিয়ে কপট রাগ দেখিয়ে আমিরা বেগম বললেন,
‘একদম ঢং করবে না আমার সাথে। তোমার আস্কারা পেয়ে পেয়ে মেয়েটা মাথায় উঠেছে। মেয়ের জন্য অন্য স্যারের ব্যবস্থা করো নয়তো এবার আর তাকে পাশ করাতে পারবে না।’
.
.
রাতে খাওয়া দাওয়া শেষ করে নিজের রুমে গেল নৈরিথ। দরজাটা আটকে দিয়ে বিছানায় এসে বসলো সে। সে যেদিকে বসেছে তার উল্টোদিকে একটা বিশাল আয়না রাখা। আয়ানার চারপাশে মিটমিট করে চলছে কিছু ফেইরি লাইট। নৈরিথ এক ধ্যানে আয়ানার দিকে চেয়ে রইল। তার ধ্যান ভাঙল ফোনের রিং টোনের বিকট শব্দে। এই আওয়াজটা শুনলেই মাথা ধরে তার। এই জন্যই দিনের প্রায় অর্ধেকটা সময় তার ফোনটা সাইলেন্ট মুডে থাকে। বিছানা হাতলে ফোনটা হাতে নেই সে। ফোনের স্ক্রিনের নাম্বারটা ফোনবুকে সেইভ না করা থাকলেও এই নাম্বারটা সে চেনে। ফোনটা রিসিভ না করেই সাইলেন্ট করে ফেলে রাখল। তাতেও খুব একটা লাভ হলো না। সাইলেন্টের ভো ভো শব্দে যেন ভূমিকম্প হচ্ছে বিছানার উপর। চোয়াল শক্ত হয়ে আসে নৈরিথের। কলটা রিসিভ করে ফোনটা কানে ধরে।
‘স্যার জানেন, আমার মা বাবা অন্য টিচার ঠিক করেছে আমার জন্য। কিন্তু আমি আপনাকে ছাড়া অন্য কারোর কাছে পড়ব না। প্লীজ স্যার, লাস্ট বারের মতো আমাকে ক্ষমা করে দিন। আমি আর জীবনেও আপনার সাথে এমন কিছু করবো না। প্লীজ স্যার, আমাকে কালকে থেকে পড়াতে আসবেন। আমি আপনাকে ছাড়া অন্য কারোর পড়া বুঝি না। এখন আমার পাশ ফেইল আপনার হাতে স্যার। আমি যদি ফেইল করি না স্যার, তাহলে কিন্তু মরা ছাড়া আমার আর কোনো উপায় থাকবে না। আর একমাত্র আপনিই পারেন আমাকে পাশ করাতে। শুধুমাত্র আপনি। আশা করছি আমার শেষ আবদারটা আপনি রাখবেন। এখন রাখছি তাহলে, ঘুমিয়ে পড়ুন। শুভ রাত্রি।’
ফট করেই কলটা কেটে দেয় মিথি। মুখে তার বিশ্বজয়ের হাসি। ব্যস কাজ হয়ে গিয়েছে। যে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করেছে না, না এসে বেটার আর উপায়ই নেই। মিথি ধপাস করে হাত পা ছড়িয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ে। তারপর চোখ বুঝে মিনমিনিয়ে বলে,
‘জলদি চলে এসো জানেমান। আমি তোমার অপেক্ষায় থাকবো।’
চলবে..