#তোমাতেই_পরিপূর্ণ
লেখিকা-জান্নাতুল ফারিয়া প্রত্যাশা
২১.
~
সাতদিন পর আজ আবার মাহি আর মিথিকে নিয়ে হসপিটালে যাওয়া হলো। আজ তাদের ব্যান্ডেজ খোলা হবে। মাহি ভীষণ ভয় পাচ্ছে সাথে মিথিও। আতাউর সাহেব একাই এলেন তাদের নিয়ে। ওয়েটিং রুমে ওয়েট করতেই সেখানে নেহা আর নৈরিথও এল। নৈরিথকে দেখেও মিথি না দেখার ভান করে বসে রইল। নৈরিথও ইগনোর করলো তাকে। নেহা মিথির পাশে বসলো। নেহার হাত চাপড়ে মিথি তখন ফিসফিসিয়ে বললো,
‘দোস্ত, আমার না ভীষণ ভয় করছে।’
নেহা তাকে আশ্বাস দিয়ে বললো,
‘আরে এত ভয় পাস না। দেখবি একটুও ব্যাথা পাবি না।’
মিথি ঠোঁট উল্টে বসে রইল। অপারেশনের দিন ভাইয়ের টেনশনে ডর ভয় কিছুই ফিল করেনি সে। তবে আজ ভয় করছে। ভয়ে রীতিমতো পেট কামড়াচ্ছে তার। নৈরিথ আড় চোখে একবার মিথির চুপসানো মুখখানা দেখল। তখন তার ইচ্ছে করছিল একবার মিথির পাশে বসে তাকে আশ্বস্ত করবে। কিন্তু এই মুহুর্তে সেটা কোনোভাবেই পসিবল না। তাই সে তার ইচ্ছটাকে নিজের মনের মধ্যেই হজম করে নিল। নৈরিথ এবার মাহির দিকে তাকাল। ছেলেটা খুব মনোযোগ দিয়ে মোবাইলে গেইমস খেলছে। নৈরিথ মুচকি হেসে বললো,
‘মাহি তোমার কি ভয় করছে?’
মাহি নৈরিথের দিকে তাকিয়ে দাঁত কেলিয়ে হেসে বললো,
‘কই না তো।’
নৈরিথ হেসে বললো,
‘এই তো, এই না হলো সাহসী ছেলে। কোনো কিছুকে ভয় পায় না। সাচ অ্যা ব্রেইভ বয়।’
কথাটা বলে নৈরিথ আবারও একবার মিথির দিকে তাকাল। মিথি ব্রু কুঁচকে নৈরিথের দিকে তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিল।
কিছুক্ষন পর,
একজন নার্স এসে মাহিকে কেবিনে নিয়ে গেল। সাথে আতাউর সাহেবও ভেতরে গেলেন। ওয়েটিং রুমে মিথি, নৈরিথ আর নেহা বসে আছে। মিথির ভয়টা ক্ষণে ক্ষণে বেড়ে চলছে। চোখ মুখ মেঘাচ্ছন্ন আকাশের ন্যায় কালো। তার ভয়টা তখন আরো বেড়ে গেল যখন ভেতর থেকে মাহির কান্নার আওয়াজ শুনতে পেল সে। অস্থির হয়ে কেবিনের কাছে গেল সে। পর্দাটা হালকা একটু সরিয়ে দেখল মাহির পেটের সেলাইটা ড্রেসিং করছে কি একটা মেডিসিন দিয়ে। নিশ্চয়ই ও খুব ব্যথা পাচ্ছে। চোখ থেকে অজস্র জল গড়িয়ে পড়ছে মাহির। মিথি অসহায় চোখে কিছুক্ষণ ভাইকে দেখে আবার নিজের জায়গায় গিয়ে বসলো। মিথির এত অস্থিরতা দেখে নৈরিথ এবার ক্ষীণ সুরে বললো,
‘ভয় পেও না, এত ব্যথা পাওয়া যায় না। মাহি ছোট বলে এত কাঁদছে।’
মিথি কাঁদো কাঁদো মুখে নৈরিথের দিকে তাকায়। নৈরিথ মুচকি হেসে বলে,
‘ইশ রে মুখটা পুরো কিসমিসের মতো চুপসে গেছে। এত ভীতু হলে কি করে হবে?’
এইটুকু বলে সে মিথির কিছুটা কাছে এসে ফিসফিসিয়ে বললো,
‘আমার বাচ্চার মা হওয়ার না খুব শখ। মা হতে গেলে কিন্তু এর থেকেও বেশি ব্যথা সহ্য করতে হয়, জানো নিশ্চয়ই?’
মিথি বড়ো বড়ো চোখে নৈরিথের দিকে তাকাল। নৈরিথ মুচকি হেসে দূরে সরে বসলো। নেহা বললো,
‘এই ভাই, মিথির কানে কানে কি বলেছিস আমাকেও বল?’
নৈরিথ মোবাইলের উপর দৃষ্টি রেখে বললো,
‘মিথিকেই জিগ্যেস কর।’
নেহা মিথির দিকে তাকাতেই মিথি চেতে উঠে বললো,
‘কিচ্ছু বলেনি। একটাও প্রশ্ন করবি না। এমনিতেই আমি ভয়ে শেষ আর এখানে দুই ভাই বোন মিলে ঢং শুরু করে দিয়েছে।’
নেহা ঠোঁট গুঁজ করে বসলো। মিথিও অবচেতন মন নিয়ে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইল। একসময় তার ভাইয়ের কান্না থামল। তাকে নিয়ে আতাউর সাহেব বের হলেন। ছেলেটার চোখ মুখ ভয়ানক লাল হয়ে আছে। মিথি তার ভাইয়ের কাছে গিয়ে ভাইকে আদর করে বললো,
‘খুব ব্যথা পেয়েছিস?’
‘হুম।’
মিথি মাহির গালে চুমু খেয়ে বললো,
‘থাক বাবু কান্না করে না। একটু পরই সব ব্যথা চলে যাবে।’
এবার তো মিথির পালা। কিন্তু সে তো তার ভাইয়ের সামনে কেবিনে যেতেও পারছে না। এমনিতেই তার ভাই তাকে সন্দেহ করছে। এখন যদি তার সামনে সে কেবিনে ঢোকে তবে নির্ঘাত সে বুঝে ফেলবে। কিছু একটা করতে হবে। মিথি একটা বুদ্ধি কষল। বাবাকে বললো,
‘বাবা, তুমি মাহিকে নিয়ে বাসায় চলে যাও। আমি নেহাকে নিয়ে একটু শপিং এ যাব। কিছু জিনিস কেনার আছে।’
এই বলে সে বাবাকে ইশারা দিল। কিন্ত আতাউর সাহেব উদ্বিগ্ন কন্ঠে বললো,
‘কিন্তু মা, তুই একা কি করে..?’
মিথি সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল,
‘পারবো বাবা। আর আমি একা কোথায়, নেহা আর নৈরিথ স্যার তো আছেই। আমি ঠিক সামলে নিব। তুমি বিলটা পে করে ভাইকে নিয়ে নিশ্চিন্তে বাড়ি চলে যাও।’
মিথির সাথে নৈরিথ আর নেহাও সুর মেলাল। আতাউর সাহেবের ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও ছেলেকে নিয়ে একাই বাড়ি ফিরলেন। মিথির ভয়টা আবারও এক লাফে আকাশ ছুঁল। নেহা তার সাথে কেবিনের ঢুকলো। পেটের উপর থেকে কাপড়টা সরিয়ে ডক্টর প্রথম ব্যান্ডেজটা খুললেন। তারপর একটা তুলোতে কিছু ঔষধ নিয়ে ক্ষত স্থানে লাগাতেই মিথির মনে হলো সেখানে কেউ আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। প্রচন্ড জ্বলে উঠে মিথির পেট। সে থাকতে না পেরে এক হাতে নেহার হাত চেপে ধরে অন্য হাতে বেড শিটটা খামছে ধরে। কিন্তু জ্বলা কমছে না। ডক্টর যতই ঔষধ লাগাচ্ছে ততই তার জ্বালা বাড়ছে। এক পর্যায়ে মিথি চিৎকার দিয়ে উঠে। মিথির চিৎকার বাইরে থেকে নৈরিথও শুনে। সে বিচলিত হয়ে পড়ে। মিথি কেঁদে কেঁদে বলে,
‘এটা কি লাগিয়েছেন ডক্টর। খুব জ্বলছে।’
ডক্টর বললো,
‘এখন একটু কষ্ট করে সহ্য করে নিন। একটু পরেই ঠিক হয়ে যাবে।’
কিন্তু বললেই কি আর সব সহ্য করা যায়? মিথিও এবার তার ভাইয়ের মতো কান্না আরাম্ভ করে। নৈরিথ বাইরে আর ওয়েট করতে পারে না। মিথির কান্নার শব্দগুলো বুকে গিয়ে বিঁধছে তার। সে হুট করেই কেবিনে ঢুকে পড়ে। প্রথমেই মিথির উন্মুক্ত উধর দেখে ইতস্তত বোধ করলেও পরক্ষণেই মিথির মুখ দেখে সে ডক্টরকে বলে উঠে,
‘ডক্টর কি হয়েছে? সামান্য ড্রেসিং এ পেশেন্ট এইভাবে কাঁদছে কেন?’
নৈরিথের কন্ঠস্বর পেতেই মিথি ফট করে চোখ মেলে তাকায়। কিছুক্ষণের জন্য ব্যথা ভুলে তার মনে পড়ে তার কামিজের কথা। যেটা উপরে উঠানো আর যার ফলে তার সমস্ত পেট দৃশ্যমান। সঙ্গে সঙ্গে একটানে কামিজ নামিয়ে ফেলে সে।
ডক্টর তখন ব্রু কুঁচকে মিথির দিকে তাকিয়ে বললো,
‘কি হলো? ড্রেসিং করবেন না?’
মিথি কিছু জবাব না দিলেও নৈরিথ বুঝলো মিথি যে তাকে দেখে আনকমফোরটেবল ফিল করছে। তাই সে আর কিছু না বলে কেবিন থেকে বেরিয়ে গেল। নৈরিথ যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই মিথি ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলে কামিজটা আবার উপরে তুললো। তারপর বললো,
‘নিন ড্রেসিং করুন।’
পরেরবার মিথি ব্যথা পেলেও আর কান্নাকাটি করলো না। দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করে নিল সবটা।
ড্রেসিং কমপ্লিট। মিথিকে নিয়ে আস্তে আস্তে নেহা বেরিয়ে এল। নৈরিথ তার কাছে গিয়ে বললো,
‘ঠিক আছো?’
মিথি মাথা নাড়াল। নৈরিথ বললো,
‘ঠিক আছে। চল তবে তোমাকে বাসায় পৌঁছে দেই।’
মিথিকে নিয়ে নৈরিথ আর নেহা তার বাড়িতে গেল। মাহি আর মিথি দুজনের শরীরই দুর্বল হয়ে পড়েছে। মাহি এসেই ঘুম। মিথিও ধীরে ধীরে নিজের রুমে গেল। আমিরা বেগম মিথির হাত মুখ মুছিয়ে দিলেন। তারপর ড্রেসটা চেঞ্জ করিয়ে দিয়ে কপালে ছোট্ট একটা চুমু খেয়ে বললেন,
‘কিছুক্ষণ রেস্ট নে। দেখবি সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।’
মিথি বাধ্য মেয়ের মতো বিছানায় শুয়ে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে রাজ্যের ঘুম এসে হানা দিল তার চোখে।
.
.
আতাউর সাহেব বললেন,
‘তা বাবা, কথা হয়েছে তোমার বাবা মার সঙ্গে।’
নৈরিথ বিরস মুখে বললো,
‘মা আগে থেকেই জানে। আর যেহেতু বিয়েতে একজন গার্জিয়ানের প্রয়োজন সেহেতু আমার মনে হয় আমার মা’ই আমার গার্জিয়ান হিসেবে যথেষ্ট। কিন্তু আমি কোনোভাবেই ঐ বাবা নামক সিল মারা পুরুষটাকে আমি এই ব্যাপারে ইনভলভ করতে চাই না।’
আতাউর সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। বললেন,
‘ঠিক আছে। তবে তোমার মাকে নিয়েই আমাদের বাড়িতে এসো। আর তোমার মায়ের সাথে আজ আমরাও কথা বলবো। শুভ কাজ যত শীঘ্র সম্পন্ন করা যায় ততই ভালো।’
নৈরিথ তৃপ্তির নিশ্বাস ছেড়ে বললো,
‘ঠিক আছে আংকেল, এখন তাহলে আমরা আসি?’
নেহা, নৈরিথ মিথির বাসা থেকে বেরিয়ে পড়ল। নেহার খুশি দেখে কে? সে তো আগে থেকেই সবকিছু জানে। কিন্তু ভাই না করাতে মিথিকে কিচ্ছু বলেনি সে। মিথির জন্য একটা বিগ সারপ্রাইজ থাকবে। মিথি যখন শুনবে ভাইয়ের সাথে তার বিয়ে ঠিক হয়ে গিয়েছে, তখন সে কি খুশিটাই না হবে। নেহার তো ভাবতেই আনন্দ লাগছে। সে অস্থির হয়ে নৈরিথকে বললো,
‘ভাই, সবই তো ঠিক আছে। তবে তুই ওকে প্রপোজ করবি কবে বলতো? একেবারে বিয়ের পর?’
নৈরিথ বাঁকা হেসে বললো,
‘সময় হোক তারপর।’
নেহা ভেংচি কেটে বললো,
‘এ তোমার সময় হতে হতে তুমি বুড়োই হয়ে যাবা।’
নৈরিথ হেসে বলে,
‘সমস্যা নেই। তখন না হয় বুড়ি বুড়োর প্রেম দেখবি।’
চলবে..