#তোমাতেই_পরিপূর্ণ
লেখিকা-জান্নাতুল ফারিয়া প্রত্যাশা
২২.
~
আমিরা বেগম সকাল থেকে বেজার হয়ে বসে আছেন। বাড়ির সকলের সাথে সাথে মিথিও ব্যাপারটা খেয়াল করলো। কিছু একটা নিয়ে তার মার মন খারাপ। কিন্তু সেটা কি এটাই কেউ বুঝতে পারছে না। আর আমিরা বেগমও কিছু বলছেন না।
দুপুরের রান্না চলছে। মিথি রান্নাঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে। অনেকক্ষণ ধরে মাকে খেয়াল করছে। কিছু জিগ্যেস করতে গিয়েও করছে না। মা যদি আবার রেগে যায়! আমিরা বেগম ভাতের মার গাললেন। একটা চুলায় ডাল আর অন্যটাতে তরকারি বসালেন। মিথি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে। ভীষণ বিরক্ত হয়ে আমিরা বেগম এবার মেয়ের দিকে তাকালেন। ক্ষিপ্ত কন্ঠে বললেন,
‘কি হয়েছে তোর? এখানে এইভাবে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?’
মিথি শুকনো ঠোঁটে হাসল। বললো,
‘মা, একটা কথা জিগ্যেস করবো?’
আমিরা বেগমের তেল চকচকে কপালের উপর সমান্তরাল ভাজ পড়ল। সেই ভাজটাকে আরো গভীর করে তিনি বললেন,
‘কি কথা?’
মিথি জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে ছোট্ট একটা ঢোক গিলে বললো,
‘মা, তোমার কি হয়েছে? সকাল থেকেই এমন মন মরা হয়ে আছো কেন? কোনো সমস্যা?’
আমিরা বেগম তিক্ত সুরে বললেন,
‘না কোনো সমস্যা না। আর আমি ঠিক আছি। তুই তোর রুমে যা।’
মিথি সহজে মেনে নিতে পারল না। সে তার মায়ের কাছে এসে দাঁড়াল। ঠোঁট উল্টে বাচ্চাদের মতো বললো,
‘বল না মা কি হয়েছে?’
আমিরা বেগম কাঠকাঠ গলায় জবাব দিলেন,
‘বললাম তো কিছু হয়নি। যা তো এখান থেকে, একদম আমাকে বিরক্ত করবি না।’
মিথি জায়গা থেকে নড়ল না। উল্টো মাকে জড়িয়ে ধরলো। মায়ের ঘাড়ে তার থুতনি ঠেকিয়ে বললো,
‘উঁহু, না বললে এক পাও নড়বো না। আগে বলো কি হয়েছে তোমার? বাবাও সকালে জিগ্যেস করেছিল কিন্তু তুমি বাবার কথাও ইগনোর করেছো। এখন তোমাকে বলতেই হবে। না বলা পর্যন্ত আমি তোমাকে ছাড়ব না।’
আমিরা বেগম চোখ বুজে জোরে একটা নিশ্বাস নিলেন। বললেন,
‘আজ সকালে নৈরিথের মার সাথে আমার কথা হয়েছিল।’
মিথি কিছুটা অবাক হয়ে মার দিকে ঘুরে তাকাল। বললো,
‘কি কথা?’
আমিরা বেগম তাচ্ছিল্যের সুরে হাসলেন। তারপর বললেন,
‘এতদিন ও পাগল ছিল তোকে নাকি তার ছেলের বউ বানাবে। কিন্তু আজ ফোন দিয়ে বলেছে ও নাকি রাদিতকে এখনই বিয়ে দিবে না। ওকে নাকি দেশের বাইরে পাঠাবে।(খানিক চুপ থেকে) আমি জানি ও এখন কেন এসব বলছে। তোর অপারেশনের কথা শুনেই ও পিছিয়ে যায়। এখন তো আর সরাসরি বলতে পারছে না তাই হয়তো বাহানা দিচ্ছে।’
আমিরা বেগম ঠোঁট গুঁজ করলেন। চোখ মুখ বিষন্ন তার। মিথি হাসল। বললো,
‘মা, কষ্ট পাচ্ছো কেন? এটা তো হওয়ারই ছিল। শুধু আন্টি কেন, ইনফেক্ট এখন কোনো মানুষই আমার মতো অসুস্থ মেয়েকে তার বাড়ির বউ বানাতে চাইবে না। কে যেচে পড়ে একটা অসুস্থ মেয়ের দায় ভার নিতে চাইবে বলতো? আর তুমি তো জানোই রাদিত স্যারকে আমিও মেনে নিতে পারছিলাম না। এখন যখন ওদের তরফ থেকেই না হয়েছে তখন তো ভালোই হয়েছে। আমি খুশি হয়েছি, খুব খুশি হয়েছি।’
আমিরা বেগম মেয়ের মাথায় হাত রেখে বললেন,
‘বিয়ে হবে তোর। নৈরিথ তোকে বিয়ে করবে।’
মিথি হাসে। বলে,
‘উনি তো আমাকে আগেই পছন্দ করতেন না। এখন আবার আমি অসুস্থ। আমাকে বিয়ে করা মানে তো মাথায় ইয়া বড় এক বোঝা তুলে নেওয়া। কোনো দরকার আছে বলো অযথা এক বোঝা নিয়ে সারাজীবন পাড় করা।’
আমিরা বেগম মুচকি হাসলেন। এখনই কিছু তিনি মিথিকে বলবেন না। তাই তিনি প্রসঙ্গ পাল্টে বললেন,
‘সকালের ঔষধ খেয়েছিস?’
‘হুম খেয়েছি।’
‘ঠিক আছে তাহলে এখন গিয়ে গোসলটা সেরে নে।’
‘আচ্ছা, ঠিক আছে।’
দুপুরের তিক্ত রোদ সবেই তার উত্তাপের পাট চুকিয়েছে। ধীরে ধীরে হলুদ রোদ কমলা রোদের দিকে ধাবিত হচ্ছে। চারদিকে এখন ভ্যাপসা গরম। তার সাথে উষ্ণ বাতাস। মিথি ঘুমাচ্ছে। ঘুমের মাঝে হয়তো কিছু স্বপ্নও দেখছে। বারবার অযথায় ব্রু কুঁচকাচ্ছে। বালিশের নিচে পড়ে থাকা যন্ত্রটা হঠাৎ তার ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায়। মুঠোফোনটা ভো ভো করে বাজতে থাকে। মিথির মাথাটাও সাথে সাথে ভো ভো করতে থাকে। মেজাজ বিগড়ে যায় তার। কোন ভীন গ্রহের প্রাণীটা এসময় তাকে কল দিচ্ছে কে জানে। বিরক্ত আর রাগে উঠে বসল মিথি। ফোনটা বালিশের নিচ থেকে বের করে দেখল সেই ভীন গ্রহের প্রাণীটা আর কেউ না তার প্রাণপ্রিয় বান্ধবী নেহা। মিথি প্রচন্ড রাগ নিয়ে কলটা রিসিভ করে। কিছু বলার আগেই নেহার অস্থির কন্ঠখানা শুনতে পায়,
‘দোস্ত, জানিস কি হয়েছে?’
মিথি দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
‘না বললে জানব কিভাবে?’
‘ভাইয়ের তো বিয়ে ঠিক হয়ে গিয়েছে।’
মিথি যেন আকাশ থেকে পড়ল। সে চেঁচিয়ে উঠে বললো,
‘কিহহহ?’
নেহার ঠোঁট চেপে হাসে। কন্ঠস্বর সিরিয়াস করে বলে,
‘হুম। ভাইয়ের অফিসের এক কলিগের সাথে ভাইয়ের বিয়ে ঠিক হয়েছে।’
মিথি কেঁদে ফেলে। প্রচন্ড কান্না পায় তার। বুক ফেটে যাচ্ছে। কোনো ভাবেই এই কথাটা মেনে নিতে পারছে না সে। সে ফুঁপিয়ে উঠে বলে,
‘এসব কি বলছিস তুই? এইভাবে কিভাবে নৈরিথের বিয়ে ঠিক হয়ে যেতে পারে? তুই কি আমার সাথে মজা করছিস?’
নেহা মেকি কান্নার সুরে বললো,
‘না রে দোস্ত, আমি সিরিয়াস।’
মিথি কিছুক্ষণের জন্য থ মেরে বসে রইল। বুকের ভেতরকার তীব্র ব্যাথায় কুঁকড়ে উঠছে সে। নেহা বুঝল এবার বেশি বেশি হয়ে যাচ্ছে। তাই সে মৃদু সুরে বললো,
‘দোস্ত, তুই কি কাঁদছিস?’
মিথির কানে হয়তো কথাটা পৌঁছায়নি। নেহা মিথির কোনো উত্তর না পেয়ে বললো,
‘আরে বান্ধবী তুই এত সিরিয়াস হচ্ছিস কেন? আমি তো তোর সাথে মজা করেছি।’
মিথি কানে কথাটা পৌঁছাতেই সে রাগে চেঁচিয়ে উঠল।
‘কুত্তি, তোকে আমি খুন করবো। জানে মেরে ফেলবো, একবার খালি পায় তোকে।’
রাগে ফোঁস ফোঁস করতে থাকে মিথি। নেহা দাঁত কেলিয়ে হেসে বলে,
‘তোমার হাতে খুন হতেও আমি রাজি মেরি ভাবিজান। আর শুনো তোমার জন্য একটা দারুণ সারপ্রাইজ আছে। জলদি জলদি রেডি হও সেই সারপ্রাইজের জন্য। এখন রাখছি, টা টা।’
কল কেটে দিল নেহা। মিথির তো সবকিছু মাথার উপর দিয়ে গিয়েছে। নেহা কোন সারপ্রাইজের কথা বলছে? এই মেয়ের মাথায় কি চলছে কে জানে? মিথি বুঝে উঠতে পারেনা। তবে মন হালকা হয় তার। আর যায় হোক নৈরিথের বিয়ের কথাটা তো মিথ্যে। এটাতেই শান্তি।
.
.
পরদিন সকালে ঘুম থেকেই উঠে দেখল তার মা খুব ব্যস্ত। অনেক কিছু রান্নার তোড়জোড় করছেন তিনি। কিন্তু কেন?
মিথি রান্নাঘরের সামনে গিয়ে মাকে জিগ্যেস করে,
‘মা, আজ কি কোনো মেহমান আসবে? হঠাৎ এত রান্না-
বান্না?
আমিরা বেগম মুচকি হেসে বললেন,
‘হ্যাঁ, আজ কিছু স্পেশাল মানুষজন আসবেন।’
মিথি অবাক হয়ে বললো,
‘স্পেশাল মানুষ? কারা?’
‘সেটা তো সময় হলে দেখতেই পাবি। এখন শোন তো মা, টেবিলে খাবার দেওয়া আছে আগে গিয়ে খেয়ে নে। তারপর গিয়ে গোসল করবি। আর তারপর আমি আমার মা’টা কে সুন্দর করে সাজিয়ে দেব।’
মিথি আরো এক দফা অবাক হলো। কৌতুহল নিয়ে বললো,
‘মা, তুমি আমাকে সাজিয়ে দেবে? কিন্তু কেন?’
আমিরা বেগম ব্রু কুঁচকে বললেন,
‘এত প্রশ্ন না করে যা যা করতে বলেছি তাই তাই কর।’
মিথি বোকা বোকা চোখে কিছুক্ষণ মায়ের দিকে চেয়ে থেকে খাবার টেবিলে গেল। কিছু একটা চলছে তার অগোচরে। কাল নেহাও কি সারপ্রাইজের কথা বলছিল, আজ মা আবার বলছে স্পেশাল মেহমান আসবে। ব্যাপার কি? কি চলছে ওদের মাথায়?
চলছে..