#তোমাতেই_পরিপূর্ণ
লেখিকা-জান্নাতুল ফারিয়া প্রত্যাশা
২৩.
~
আমিরা বেগম খুব যত্ন সহকারে মিথিকে সাজিয়ে দিলেন। তার একটা লাল কাতান শাড়ি আছে, যেটা মিথির খুব প্রিয়। সেই শাড়িটাই আজ তিনি মিথিকে পরিয়ে দিয়েছেন। মিথি এখনও কিছু বুঝতে পারছে না তার সাথে কি হচ্ছে। তবে মনের ভেতর একটা সূক্ষ্ণ আতংক কাজ করছে তার। সাধারনত মায়েরা পাত্রপক্ষের সামনে নিয়ে যাওয়ার জন্য মেয়েদের এইভাবে সাজায়। কিন্তু মা তো বলেছেই রাদিত স্যারের মার এই বিয়েতে মত নেই। তারা তো কোনোভাবেই তাকে দেখতে আসতে পারে না। তবে কে? বিরাট এক প্রশ্ন, যেই প্রশ্নের উত্তর এখন হাজার চেষ্টা করেও মিথি খুঁজে পাবে না। মিথি সন্দিহান দৃষ্টিতে মায়ের দিকে তাকায়। তিনি মিথির কুঁচি ঠিক করাতে ব্যস্ত। কুঁচিগুলো ঠিক করে উপরে তাকাতেই দেখলেন মিথি সরু চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। তিনি মুচকি হেসে মিথির গালে হাত রেখে বললেন,
‘কি রে এইভাবে কি দেখছিস?’
মিথি গম্ভীর সুরে বললো,
‘মা, তোমার হাব ভাব আমার ভালো ঠেকছে না। হঠাৎ কি হয়েছে বলতো? আমাকে এত তোড়জোড় করে শাড়ি পরাচ্ছো কেন? কারা আসছে?’
মিথির মা আলতো হেসে শাড়ির আঁচলটা টেনে মিথির মাথায় ঘোমটা দিলেন। তারপর বললেন,
‘এত অধৈর্য হলে কি করে হবে মা? জানো তো সবুরে মেওয়া ফলে। তাই সবুর করো। সময় হলে সব জানতে পারবে।’
কিন্তু এই সবুরটাই যে মিথির মাঝে নেই। মন তো তার অস্থির। হাজারো চিন্তা তার মস্তিষ্কের প্রান্তে প্রান্তে ছড়িয়ে আছে। এই সময় নেহাটাও ফোন ধরছে না। এতে তো তার দুশ্চিন্তা আরো বেড়েছে। কিন্তু করার মতোও কিছু খুঁজে পাচ্ছে না সে। এমন কোনো উপায়ও আওড়াতে পারছে না যেটা দিয়ে নিমিষেই সে সবকিছু বুঝে ফেলবে।
মিথিকে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে আমিরা বেগম গেলেন রান্নাঘরে। মিথি বসে বসে ফোন ঘাটে। অনেকটা সময় পাড় হয়। মিথির গভীর দৃষ্টি তখন মোবাইলের স্ক্রিনে। সেই সময়ই তাদের দরজার বেলটা বেজে উঠে। আতাউর সাহেব গিয়ে দরজা খুললেন। সেই স্পেশাল মেহমান চলে এসেছে। মিথি দরজার সামনে গিয়ে উঁকি দিতে যাবে ঠিক তখনই তার মা তাকে ঠেলে নিয়ে বিছানায় বসিয়ে দেয়। মিথি ব্রু কুঁচকে বলে,
‘মা, কারা এসেছে?’
‘স্পেশাল মেহমান।’
বলেই মুচকি হাসলেন আমিরা বেগম। মিথি বিরক্ত হলো এবার। বললো,
‘কারা এই স্পেশাল মেহমান বলতো? আমিই বরং গিয়ে একটু দেখেই আসি।’
এই বলে মিথি উঠতে নিলেই তার মা তাকে আবারও জোর করে বসিয়ে দেয়। কিছুটা ধমকের সুরে তিনি তখন বলেন,
‘একদম উঠবি না। বললাম তো সব দেখতে পারবি। এত অস্থির হচ্ছিস কেন? চুপচাপ এখানে বসে থাক। আমি এসে তোকে ঐ রুমে নিয়ে যাবো। ততক্ষণে এক চুলও যেন জায়গা থেকে নড়া না হয়।’
এই বলে আমিরা বেগম রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন। আর মিথি অসহায় হয়ে বসেই রইল। কি জানি, তার সাথে কি হতে চলছে?
অনেকক্ষণ পর আমিরা বেগম এলেন। তিনি আস্তে করে মিথির পাশে বসে বললেন,
‘শোন মা ভেতরে গিয়ে আগে সালাম দিবি। তারপর চুপচাপ একটা চেয়ারে বসবি আর উনারা যে যে প্রশ্ন করে তার ঠিক ঠিক জবাব দিবি। কোনো দস্যিপনা যেন না হয়। বুঝেছিস?’
এবার মিথি সিউর হয়ে যায় যে নির্ঘাত তাকে দেখতে এসেছে। ঘাবড়ে যায় সে। কারা এলো? মা তো বলেছিল নৈরিথই আমাকে বিয়ে করবে তবে কি নৈরিথ? কিন্তু এমন হলে তো সে অবশ্যই আগে থেকে সব জানতে পারতো। নেহা তো অবশ্যই তাকে সবকিছু বলতো। তবে? মিথি এবার কাঁদো কাঁদো মুখে বলে,
‘মা, কারা এসেছে বলোনা?’
‘চল, এখনই দেখতে পাবি।’
‘কিন্তু মা..’
‘উম্ম, কোনো কিন্তু না। চুপচাপ আমার সাথে আয়।’
মিথি বুঝে উঠতে পারে না কি করবে? সে ভয়ে ভয়ে মায়ের সাথে সাথে লিভিং রুমে যায়। তার দৃষ্টি নিমজ্জিত। সামনের মানুষগুলোর দিকে তাকানোর সাহস পাচ্ছে না সে। কাঁপা কাঁপা সুরে সালাম দিল। সালামের জবাবের সুরে শুনতে পেল একটা গম্ভীর মহিলা কন্ঠ। আমিরা বেগম মিথিকে একটা চেয়ারে বসালেন। সে এখনও নিচের দিকেই তাকিয়ে আছে। সামনের মানুষগুলোর পা ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ছে না তার। হঠাৎ তার চোখ আটকে যায় এক জোড়া উজ্জ্বল ফরসা রঙের পায়ের উপর। যার কনিষ্ঠা আঙ্গুলটাতে সিলভার রঙের একটা রিং পরা। মিথির মনে হয় সে এই সেইম রিংটা আগে কোথাও দেখেছে অন্য কারোর পায়ে। বেশি সময় নেয়নি এটা মনে হতে যে সে এই সেইম রিংটা নেহার পায়েও দেখেছে। মিথি তখন ফট করেই সে পা জোড়ার অধিকারী মানুষটির দিকে তাকায়। চেঁচিয়ে উঠে বলে,
‘তুই? তুই এইভাবে এখানে..?’
মিথি কথা বলতে বলতে আশে পাশে তাকাল। দেখল নেহার পাশেই নৈরিথ বসা। ফর্মাল ড্রেসআপ তার। আর অন্য একটা সোফাতে নৈরিথের আম্মু বসা। কিছুক্ষণের জন্য যেন মিথির মস্তিষ্ক কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। সে অবাক চোখে মানুষগুলোকে দেখে।
নেহা নাক মুখ কুঁচকে বলে,
‘এই মেয়েকে জীবনেও আমি আমার ভাইয়ের বউ বানাবো না। যার মধ্যে নূন্যতম কোনো ভদ্রতা নেই। প্রথম দেখাতেই নিজের হবু ননদের সাথে তুই তুকারি শুরু করেছে। কি সাংঘাতিক মেয়ে! না, না এই মেয়েকে বাড়ির বউ করা যাবে না। ভাই তুই চিন্তা করিস না। আমরা তোর জন্য আরো ভালো মেয়ে দেখব।(নৈরিথের দিকে তাকিয়ে)’
নেহার কথা শুনে সকলেই হেসে উঠে। মিথি ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে নেহার দিকে তাকায়। নেহা দুই ব্রু নাচিয়ে বলে,
‘কেমন দিলাম সারপ্রাইজটা?’
মিথির এখনও যেন কিছু বিশ্বাস হচ্ছে না। তবে কি নৈরিথের সাথেই তার বিয়ে ঠিক হতে যাচ্ছে? সিরিয়াসলি? মিথি এবার লজ্জায় মাথা নুইয়ে ফেলে। নৈরিথের মা বললেন,
‘আমার তো মিথিকে আগে থেকেই পছন্দ। এখন শুধু বিয়ে পড়ানোই বাকি। এখন আপনারা যা সিদ্ধান্ত নিবেন তাই হবে (মিথির বাবার দিকে তাকিয়ে)’
নেহা বলে উঠল,
‘আরে দাঁড়াও দাঁড়াও মা। এইভাবেই মেয়ে পছন্দ হয়ে গেল কি করে? আমাদের আগে চেক করতে হবে না যে মেয়ে আসলেই সবদিক দিয়ে পারফেক্ট কিনা?’
তারপর সে মিথির দিকে তাকিয়ে বললো,
‘এই মেয়ে তোমার দাঁতগুলো একটু দেখিতো?’
মিথি রাগি লুকে নেহার দিকে তাকাল। নেহা ব্রু কুঁচকে বললো,
‘ওভাবে তাকাচ্ছো কেন? তোমাকে ভাইয়ের বউ বানাবো তো একটু দেখে নিতে হবে না। দেখি দেখি তোমার দাঁত দেখাও। তারপর চুল দেখাবা। তারপর একটু হেঁটে দেখাবা। আর কি কি রান্না জানো বলতো? আদৌ কিছু জানো নাকি একেবারেই অকর্মণ্য?’
মিথি দাঁতে দাঁত চেপে নেহার দিকে তাকায়। অগ্নি চক্ষে তাকে হুমকি দেয় একা পেলেই তার জান শেষ। নেহা তাকে চোখ মারে। মিথি নাকের পাল্লা ফুলিয়ে বলে,
‘এত কিছু দেখে নিয়ে যাওয়ার চেয়ে ভালো অনলাইন থেকে একটা বউ অর্ডার করে ফেলেন। তাহলে আর এত ঝামেলা পোহাতে হবে না।’
‘ওহ ভালো আইডিয়া দিয়েছো তো। এই ভাই অনলাইন থেকে একটা বউ অর্ডার করবো? নাকি এনাকেই হলে চলবে?’
নৈরিথ স্মিত হেসে বলে,
‘ইনি হলেই চলবে।’
নেহা দাঁত কেলিয়ে হাসে। বাকি সবাইও মুচকি হাসে। মিথি মাথা নিচু করে ফেলে। চোখ বুজে একটা নিশ্বাস নেয়। মনটা প্রশান্তিতে ভরপুর। এই তো তার ভালোবাসা তার খুব কাছে। হাত বাড়ালেই ছুঁতে পারবে।
.
.
মিথি আর নৈরিথ অন্য রুমে। লিভিং রুমে বড়োরা কথা বলছে। নৈরিথ মিথির টেবিলটার সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে সেই উপন্যাসের বইটা দেখছে। আর মিথি বিছানায় বসে বসে নৈরিথকে আড়চোখে খেয়াল করছে।
কিছুটা সময় পর নৈরিথ বইটা বন্ধ করলো। তারপর মিথির পাশে গিয়ে বসলো। চুলগুলোতে একটু হাত বুলিয়ে দিয়ে মিথির দিকে তাকাল। হুট করেই বললো,
‘সুন্দর লাগছে।’
মিথির গালগুলো লজ্জায় লাল হলো। লজ্জাবতী গাছের মতো আরো কিছুটা নুইয়ে পড়ল সে। নৈরিথ হাসল। বললো,
‘যেই মেয়ে সামন্য প্রশংসা শুনে এমন লজ্জায় লাল হতে পারে সেই মেয়ে আবার মনে মনে মা হওয়ার প্লেনিংও করে ফেলেছে? হাউ?’
মিথি বাঁকা চোখে নৈরিথের দিকে তাকায়। মারাত্মক অসভ্য ছেলে। এই এক কথা নিয়ে এখনও তাকে জ্বালিয়ে যাচ্ছে। আর হয়তো ভবিষ্যতেও তাকে জ্বালাবে। মিথি চোখ মুখ কুঁচকে নিচের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর হঠাৎ কি ভেবে নৈরিথকে বললো,
‘হঠাৎ আমায় বিয়ে করতে চাইছেন কেন? আমাকে না আপনার পছন্দ না?’
নৈরিথ বাঁকা হেসে বললো,
‘তোমাকে পছন্দ না ঠিকই কিন্তু, তোমার ইচ্ছের কথা শোনার পর থেকেই না শুধু মনে হচ্ছে তোমার এই ইচ্ছেটা আমার পূরণ করা উচিত। বেশি কিছু না তো মা’ই তো হতে চেয়েছো। এটা আর এমন কি বড়ো ব্যাপার? তাই আরকি বলতে পারো এই জন্যই এই বিয়েটাতে মত দিয়েছি?’
সিরিয়াসলি? এই অসভ্য মানুষটা তাকে মা বানানোর জন্য বিয়ে করছে? ও আল্লাহ! মিথি জোরে জোরে নিশ্বাস নিতে থাকে। কবে জানে এর কথা বার্তা শোনে তার দম বেরিয়ে যায় এক আল্লাহই জানেন।
চলবে..