#তোমাতেই_পরিপূর্ণ
লেখিকা-জান্নাতুল ফারিয়া প্রত্যাশা
২৫.
~
রাত অনেক। আকাশে মিটি মিটি তারা। চাঁদের ম্লান আলো। দূরের রাস্তাটা থেকে কিছু কুকুরের আর্তনাদ শোনা যাচ্ছে। গুমোট পরিবেশ। চারদিক নীরব, নিস্তব্ধ। পুরো শহর এখন ঘুমে ব্যস্ত। কিন্তু ঠিক এই সময়ই কেউ একজন মনের কষ্ট মেটাতে সিগারেটে সুখ খুঁজছে। মানুষটা কঠিন। সিগারেটের প্রতিটা টান তাকে আরও কঠিনতর করে তুলছে। ঈগল চক্ষুগুলো দিয়ে ফোনের স্ক্রিনে খুব মনোযোগ দিয়ে সে কাউকে দেখছে। অনেকক্ষণ যাবত দেখে গেল। বুক চিরে বেরিয়ে এল দীর্ঘশ্বাস। মানুষটি ক্ষীণ সুরে বললো,
‘আই মিস ইউ, মিঠু। আই মিস ইউ সো মাচ।’
.
.
আজ সকালটা সুন্দর। খুব সুন্দর। শুভ্রতায় ছেয়ে আছে আকাশ। তার সাথে একরাশ কোমল শুভ্রতায় ভরপুর মিথির মন। খুশিতে তার প্রাণ পাখি উড়ে বেড়াচ্ছে। সকাল হতে না হতেই নৈরিথের ম্যাসেজ। লেখা ছিল, ‘শুভ সকাল’। মিথি ম্যাসেজটা সিন করেছিল অনেক সময় পর। কিন্তু যখনই সে ম্যাসেজটা দেখে তখনই সে লাফিয়ে উঠে। সঙ্গে সঙ্গে রিপ্লাই দেয়, ‘শুভ সকাল।’
নৈরিথ মিথির ম্যাসেজ সিন করলেও পরে আর কোনো উত্তর দেয় না। মিথি কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে নৈরিথের ম্যাসেজের কিন্তু সে আর কোনো ম্যাসেজ পায় না। তাই সে দুঃখি দুঃখি মন নিয়ে উঠে ওয়াশরুমে যায় ফ্রেশ হতে।
ফ্রেশ হয়ে এসে সোজা যায় ডাইনিং রুমে। দেখে তার মা মাহিকে স্যুপ খাইয়ে দিচ্ছে। মিথি একটা চেয়ার টেনে বসলো। তারপর জগ থেকে পানি ঢেলে পানি পান করলো। আমিরা বেগম ততক্ষণে আরেকটা বাটিতে মিথিকে স্যুপ বেড়ে দিলেন। মিথি এক চামচ স্যুপ মুখে দিয়ে বললো,
‘উমম মা, খুব টেস্টি হয়েছে।’
সে আস্তে আস্তে স্যুপটা খেতে লাগল। মাহির খাবার ততক্ষণে শেষ। মাহি খাবার শেষ করেও সেখানে বসে রইল। তাকিয়ে রইল মিথির দিকে। মিথি খাওয়ার মাঝখানেই খেয়াল করলো ব্যাপারটা যে মাহি তাকে খুব মনোযোগ দিয়ে দেখছে। মিথি ব্রু কুঁচকে বললো,
‘কি রে কি দেখছিস?’
মাহি টেবলের উপর দুহাত রেখে মাথাটা কিছুটা এগিয়ে এনে বললো,
‘এই স্যুপটা তুমি কেন খাচ্ছো বুবু? এটাতো মা আমার জন্য বানিয়েছে।’
মিথির হঠাৎ সব মনে পড়ল। তার ভাই তো কিছু জানে না। এখনই সে যদি মাহিকে কিছু একটা বলে বুঝাতে না পারে তবে নির্ঘাত সে ধরা পড়ে যাবে। তাই সে আমতা আমতা করে বললো,
‘ত তো কি হয়েছে? আমি কি খেতে পারি না? ভেজিটেবল স্যুপ শরীরের জন্য অনেক উপকারী, তাই খাচ্ছি। আর একটু পর তো পা রুটি আর জ্যাম খাবো। এখন এটা খেতে ইচ্ছে করেছে তাই খাচ্ছি।
মাহির সন্দেহ মিটল না। সে সরু চোখে কিছুক্ষণ মিথির দিকে তাকিয়ে থেকে আস্তে আস্তে চেয়ার থেকে নেমে লিভিং রুমে চলে গেল। মাহি চলে যেতেই মিথি যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। সে জোরে একটা নিশ্বাস ছেড়ে বললো,
‘উফফ মা, তোমার ছেলেটা যা শুরু করেছে আমি মনে হয় বেশিদিন আর এই সত্যিটা লুকিয়ে রাখতে পারবো না।’
আমিরা বেগম বললেন,
‘ওর সেই প্রথম থেকেই তোকে সন্দেহ হচ্ছে। আর ও তোর সবকিছু ইদানিং খুব খেয়াল করছে, তুই কি খাচ্ছিস, কি করছিস, সবকিছুই ও নজরে নজরে রাখছে। তাই আমারও মনে হয় তুই খুব তাড়াতাড়িই ধরা পড়ে যাবি।’
মিথিরও তাই মনে হচ্ছে। ভয় হচ্ছে, ছেলেটা সব সত্যি শোনার পর না জানি কিভাবে রিয়েক্ট করে?
খাবার শেষ হলে মিথি রান্নাঘরে গেল। আমিরা বেগম তখন তাক থেকে কি যেন বের করছিলেন। মিথি কাঁচুমাচু করছে কিছু বলার জন্য। কিন্তু পারছে না। মিথি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঠোঁট কামড়ায়। আমিরা বেগম ঘুরে তাকিয়ে মিথিকে দেখে বললেন,
‘কিরে কিছু লাগবে?’
মিথি মাথা নাড়িয়ে না বলে। তিনি তখন জিগ্যেস করেন,
‘তাহলে এখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?’
মিথি হাত কঁচলাতে কঁচলাতে ইতস্তত কন্ঠে বললো,
‘মা, আমাকে একটু রান্না শেখাবে?’
আমিরা বেগম বড়ো বড়ো চোখে মেয়ের দিকে তাকালেন। মিথি তাতে আরো লজ্জা পেয়ে গেল। আমিরা বেগম হেসে বললেন,
‘আরে লজ্জা পাওয়ার কি আছে? এখন তো আমার মেয়ে একজনের বাড়ির বউ। তাকে তো রান্না শিখতেই হবে। শ্বশুর বাড়িতে গিয়ে রান্না করতে হবে না?’
মিথি মুচকি হেসে মাথা নাড়াল। আমিরা বেগমও হাসলেন।বললেন,
‘ঠিক আছে, আজ তাহলে তোকে আমি মুরগী রান্না করাটা শেখাবো কেমন?’
মিথি খুশিতে ঝলমলিয়ে উঠে বললো,
‘ঠিক আছে মা।’
.
আজকাল নেহার নাম্বারটা প্রায়ই ওয়েটিং এ থাকে। ব্যাপার কি? মেয়েটা আবার প্রেম ট্রেম করছে না তো। করতেও পারে, সন্দেহ রাখা যাবে না। মিথি লাগাতার নেহাকে কল দিতে থাকে। সে আজ মুরগী রান্না করেছে এই খবরটা নেহাকে দেওয়া না পর্যন্ত তার পেটের ভাত হজম হচ্ছে না। কিন্তু এই পাকিস্তানি বান্দরটা তার কল রিসিভ করছে না। কোন প্রাণীর সাথে যে এতক্ষণ ধরে কথা বলছে তা এক আল্লাহই জানেন। মিথি বিরক্ত হয়ে ফোনটা রেখে দেয়। ধুর, আর কলই দেবে না। মিথি কথাটা ভাবতে ভাবতেই তার ফোনটা তখন বেজে উঠে। নেহা কল দিয়েছে ভেবে হাতে নিতেই দেখে নৈরিথ। বিনা কারণেই মিথির বুকের কম্পন বেড়ে যায়। মনে পড়ে এই মানুষটা তার স্বামী। তার একমাত্র বন্ধু। তার ভালোবাসা। মিথি তৃপ্তি মনে কলটা রিসিভ করে। প্রথমে সালাম দিতেই নৈরিথ তার সালামের জবাব দিয়ে জিগ্যেস করে,
‘খাওয়া দাওয়া হয়েছে?’
মিথি ক্ষীণ সুরে জবাব দেয়,
‘জ্বি, আপনার?’
‘হুম, মাত্রই শেষ হলো। ঔষধ খেয়েছো?’
‘না খাবো এখন।’
‘আচ্ছা খেয়ে নাও।’
ব্যাস চুপ। মিথিও চুপ। কি বলবে? কি বলা যায়? উফফ তারা না স্বামী স্ত্রী তবে তারা চুপ করে বসে আছে কেন? আরেহ, কোনো কথাই তো কেউ খুঁজে পাচ্ছে না। মিথি অনেকক্ষণ ভেবে ভেবে হঠাৎ বলে উঠল,
‘আপনার অফিসের সবাই বিয়ের কথা জানে?’
‘না, আমি বলেনি। এখন বললেই ট্রিট ট্রিট বলে মাথা খাবে।’
‘তো কি হয়েছে, না হয় দিবেন ট্রিট। তাই বলে কাউকে বলবেন না আপনি যে বিবাহিত?’
নৈরিথ ব্রু উঁচিয়ে বললো,
‘এটা বলাটা কি খুব জরুরি?’
মিথি নাক মুখ কুঁচকে বললো,
‘অবশ্যই জরুরি। আচ্ছা বাই দ্যা ওয়ে, আপনার নিশ্চয়ই অনেক মেয়ে কলিগ আছে?’
‘হ্যাঁ আছে, তো?’
মিথি গলা ঝেড়ে বললো,
‘শুনোন কাল ওদের জন্য মিষ্টি কিনে নিয়ে যাবেন। তারপর ওদের মিষ্টি খাইয়ে বলবেন, এটা আপনার বিয়ের মিষ্টি। ছেলেদের খাওয়ানোটা বাধ্যতামূলক নয় তবে মেয়েদের অবশ্যই খাওয়াতে হবে। প্রত্যেকটা মেয়ে কলিগকে খাওয়াবেন বুঝেছেন?’
নৈরিথ ঠোঁট কামড়ে হাসল। বললো,
‘কি যে বলো, তোমার কথা শুনলে তো আমি আমার ঐ সুন্দরী কলিগদের হারাবো। তারা যখন জানবে আমি বিবাহিত তখন কি তারা আমার ধারে কাছে ঘেঁষবে বলো? ঘেঁষবে না। তাই এই কথাটা ভুলেও ওদের কানে দেওয়া যাবে না, বুঝেছো?’
মিথি জ্বলে উঠল। চেঁচিয়ে উঠে বললো,
‘অফিসে যান কি সুন্দরী কলিগদের সাথে ঘেঁষা ঘেঁষি করার জন্য? বের করছি আপনার এই ঘেঁষা ঘেঁষি। জাস্ট ওয়েট এন্ড ওয়াচ।’
কথাটা বলেই মিথি কল কেটে দিল। রাগে কান দিয়ে তার গরম ধোঁয়া বের হচ্ছে। যদিও সে জানে নৈরিথ তাকে রাগানোর জন্য এসব বলেছে। কিন্তু তাও সে বলবে কেন? কেন বলবে? আর তার উপর ছেলেদের মন। বিশ্বাস নেই। আগে থেকেই তাকে সাবধান থাকতে হবে। মিথি নেহাকে কল লাগায়। এবার কলটা রিসিভ হয়। কিন্তু নেহা কিছু বলার আগেই মিথি বলে উঠে,
‘নেহু, তুই তোর ভাইয়ের অফিসের লোকেশন জানিস?’
নেহা খানিক অবাক হয়ে বললো,
‘হ্যাঁ জানি। কিন্তু, কেন বলতো?’
‘আমাকে এখনই তোর ভাইয়ের অফিসে নিয়ে যাবি। আমি তৈরি হচ্ছি। তুইও তৈরি হয়ে আমাদের বাসায় চলে আয়।’
নেহা কিছু বুঝে উঠার আগেই মিথি কলটা কেটে দেয়। তারপর সে আলমারি খুলে একটা শাড়ি বের করে। শাড়িটা গায়ে দিয়ে আয়ানার সামনে দাঁড়িয়ে মুচকি হেসে বলে,
‘আপনার আর কষ্ট করে কাউকে কিছু বলতে হবে না নৈরিথ। আমি নিজেই সবাইকে সারপ্রাইজ দিতে আসছি।’
চলবে..