#তোমাতেই_পরিপূর্ণ
লেখিকা-জান্নাতুল ফারিয়া প্রত্যাশা
২৭.
~
নৈরিথের কেবিনে বসে আছে মিথি আর নেহা। নৈরিথ চেয়ারে বসে বার বার চোখ রাঙিয়ে মিথির দিকে তাকাচ্ছে। কিন্তু মিথি সেটা বরাবরের মতোই ইগনোর করছে। নেহার মনোযোগ ফোনে। আজকাল একটু বেশিই ফোন ঘাটছে মেয়েটা। মিথি অনেকক্ষণ চুপচাপ থেকে বললো,
‘আপনার অফিসে যে দুজন মহিলা কলিগ আছে তারা আপনার থেকে বয়সে অনেক বড়ো। এদের সাথে যে আপনি ঘেষা ঘেষি করতে যান না সেটা আমি জানি। আর বাকি রয়েছে আপনার বসের মেয়ে, সে নিঃসন্দেহ ভীষণ সুন্দরী। ব্যবহারও ভালো। তবে আমার মনে হয়না আপনি ঐ মেয়ের দিকে নজর দিবেন। কারণ সে তো অলরেডি একজনের ফিয়ন্সি। তো এখন বলুন তো কি কারণে আপনি আমাকে এসব বলেছিলেন? আর আমি সেই জন্য রাগে ক্ষোভে এইভাবে হুট করেই আপনার অফিসে এসে পড়েছি। সব তো আপনার দোষ তাই না? তাই না, এই নেহা বল?’
নেহা ফোনের থেকে নজর সরিয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে ব্যস্ত ভঙিতে ‘তাই তাই’ বলে আবারও ফোনের দিকে তাকাল।
নৈরিথ রাগে ফুঁসে উঠে বললো,
‘তোমাকে না ইচ্ছে করছে এই পাঁচ তলা থেকে ছুঁড়ে নিচে ফেলে দেই। সাধে কি আর তোমাকে স্টুপিড বলি? সামান্য মজাও তুমি বুঝো না? উফফ!’
মিথি ভেংচি কেটে বললো,
‘হু, ঢং! যান আর আসবো না আপনার অফিসে। এখনই চলে যাব। এই নেহা চল!’
নৈরিথ চেয়ারটায় হেলান দিয়ে বসলো। ঠান্ডা গলায় বললো,
‘ঠিক আছে যাও। আমি ড্রাইভার কে বলে দিচ্ছি, তোমাদের নামিয়ে দিয়ে আসবে।’
মিথি বাঁকা চোখে বিরক্তি নিয়ে নৈরিথের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বললো,
‘কেন, আপনি নামিয়ে দিয়ে আসতে পারেন না?’
.
.
বিকেল পাঁচটা। চারদিকে এখন কমলা রোদ। নেহা তার বারান্দায় বসে আছে। তার চোখে মুখে আছড়ে পড়ছে গোধূলির এই মিষ্টি রোদগুলো। অধরে লেগে আছে তার কিঞ্চিত হাসির রেশ। দৃষ্টি তার ফোনের উপর। খুব মনোযোগ দিয়ে কিছু একটা করছে। ডান হাতের বৃদ্ধা আঙ্গুলটা ক্রমাগত স্ক্রিনের উপর নড়ে যাচ্ছে। এতে করে এইটুকু বোঝা যাচ্ছে যে সে কারো সাথে চ্যাট করছে। হয়তো খুব প্রিয় কারোর সাথে। তার ঠোঁটের কোণে হাসির রেশটা তো সেটাই বলে দিচ্ছে..
.
সুন্দর ঘুমটা ভেঙে গেল মোবাইলের বিরক্তিকর শব্দে। চোখ কচলিয়ে সেদিকে তাকাল সে। ঝাপসা চোখের দৃষ্টি পরিষ্কার হতেই দেখতে পেল নৈরিথের নাম্বার। কিছুটা বিরক্ত হলেও ভালো লাগাটা একটু বেশিই ফিল করলো মিথি। উঠে বসে কলটা রিসিভ করলো। সঙ্গে সঙ্গেই নৈরিথের গম্ভীর কন্ঠখানা শুনতে পেল,
‘ঘুমাচ্ছিলে?’
‘হুম।’
‘ওহহ, তাহলে তো ডিস্টার্ব করলাম।’
‘না না বলুন, সমস্যা নেই।’
নৈরিথ অনেকক্ষণ সময় নিয়ে বলে উঠে,
‘অফিসে শাড়ি পরে আসতে কে বলেছিল?’
মিথি ব্রু কুঁচকে বললো,
‘কেউ বলেনি। আমি নিজের ইচ্ছাতেই পরেছি। কেন?’
নৈরিথ ক্ষেপা কন্ঠে বললো,
‘আদনান সাহেব তোমার একটু বেশিই প্রশংসা করছে। কিন্তু আমার সেটা মোটেও পছন্দ হচ্ছে না।’
মিথির মন নেচে উঠে। ওহহো জেলাস? মিথি ঠোঁট চেপে হেসে বললো,
‘কি কি বলেছে আদনান সাহেব?’
‘সেসব তোমার না জানলেও চলবে। তবে আজ থেকে আর বেশি শাড়ি টাড়ি পরবে না।’
মিথি ব্রু নাচিয়ে বললো,
‘কেন কেন?’
নৈরিথ রাগি কন্ঠে জবাব দিল,
‘আমি না করেছি তাই। খুব প্রয়োজন হলে আমার সামনে পরবে। বাইরে এত বের হতে হবে না। মনে থাকবে?’
‘উঁহু থাকবে না।’
‘ঠাস ঠাস করে গালে দুইটা চড় পড়লে সব মনে থাকবে।’
মিথি কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বললো,
‘আপনি আমাকে মারবেন?’
নৈরিথ তপ্ত শ্বাস ফেলে মোলায়েম কন্ঠে বললো,
‘না মারবো না। তোমাকে আমি মারার জন্য বিয়ে করেনি। আর আমি তোমাকে তোমার স্বাধীনতাতেও বাঁধা দিতে চাই না। কিন্তু বিশ্বাস করো, তোমাকে শাড়িতে খুব এট্রাক্টিভ লাগে। তখন না চাইতে আমার চোখ বার বার তোমার উপর যায়। কিন্ত আমি চাই না আমি যেই দৃষ্টিতে তোমাকে দেখি অন্য কোনো পুরুষ সেই দৃষ্টিতে তোমাকে দেখুক। সেই জন্যই কথাগুলো বলেছি। তোমার স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করে থাকলে সরি।’
মিথি হাওয়ায় ভাসছে যেন। উফফ, লজ্জায় মরে যাওয়ার ফিলিংস হচ্ছে তার। ইশ, এইভাবে কেউ বলে বুঝি? শাড়ি পরলে সত্যিই তাকে খুব এট্রাক্টিভ লাগে? সত্যিই? লজ্জায় মর মর অবস্থা তার। নৈরিথ কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে বললো,
‘কি হলো কথা বলছো না যে?’
মিথি মুচকি মুচকি হেসে বললো,
‘আমি এখন থেকে শুধু আপনার সামনেই শাড়ি পরবো। আমিও চাই না আপনি ছাড়া অন্য কোনো পুরুষ মানুষ আমাকে দেখুক।’
ঠোঁট ছড়িয়ে হাসে নৈরিথ। কিছু বলতে গিয়েও থেমে যায়। একটা প্রশান্তির নিশ্বাস নিয়ে বলে,
‘কাল তোমাকে একটা কোচিং সেন্টারে ভর্তি করাবো। আমার আগে থেকেই কথা বলা আছে ওদের সাথে।’
মিথি হঠাৎ চুপসে গেল। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বললো,
‘বাবা তো অলরেডি আমাকে একটা কোচিং সেন্টারে ভর্তি করিয়ে দিয়েছেন। কাল থেকে আমি সেখানে যাবো।’
নৈরিথ অনেকটা অবাক হয়ে বলে,
‘কই তুমি তো আমাকে কিছু বললে না?’
মিথি অপরাধী কন্ঠে বললো,
‘আসলে মনে ছিল না। আগেই ভর্তি করে রেখেছিলেন, কিন্তু আমি এখনও একটাও ক্লাস করেনি। তাই ওভাবে এই কথাটা মাথায়’ই ছিল না। সরি।’
‘ব্যাপার না। কালকে আমি না হয় তোমাকে সেই কোচিং এই নিয়ে যাবো। তখন দেখেও আসতে পারবো কোথায় ভর্তি হয়েছো? সেখানের পড়াশোনার ভান কেমন?’
মিথি বললো,
‘ঠিক আছে। আর আপনি বাসায় ফিরবেন কখন? সাড়ে পাঁচটা তো বাজে।’
‘এইতো এখনই বের হবো। রাখছি তাহলে।’
‘আচ্ছা, আল্লাহ হাফেজ।’
‘আল্লাহ হাফেজ।’
সন্ধ্যার দিকে ভাইকে নিয়ে পড়াতে বসেছে মিথি। মাহির সবচেয়ে অপছন্দের সাবজেক্টটাই মিথির প্রিয় সাবজেক্ট। ইংলিশটা একদমই পছন্দ না তার। অন্যদিকে মিথির এটা প্রিয় সাবজেক্ট। খুব মনোযোগ দিয়ে ভাইকে গ্রামার বোঝাচ্ছে সে। মাহির পিটপিট করে কেবল তাকিয়েই আছে। কতটুকু যে গলাধঃকরণ করতে পারছে সেটা কেবল সেই জানে।
কিছুটা সময় পড়ার পর মাহি বই বন্ধ করে বললো,
‘বুবু, আর পড়ব না।’
মিথি ব্রু কুঁচকে তার দিকে তাকিয়ে বললো,
‘সবে এক ঘন্টা হয়েছে। আরো দু ঘন্টা পড়বি।’
মাহি নাক মুখ কুঁচকে বললো,
‘তুমি নিজে পড়তে এতক্ষণ? সবসময় তো নৈরিথ ভাইয়ের বকা শুনতে। এখন আসছে আবার আমাকে পড়ার কথা বলতে।’
মিথি ঠোঁট কামড়ে মাহির কান মুচড়িয়ে ধরে। বলে,
‘খুব কথা শিখেছিস। একদম কান ছিড়ে ফেলবো ফাজিল ছেলে। চুপচাপ পড়। আমি এক্ষুণি পড়াগুলো নিব। না পারলেই মাইর।’
মাহি নাক ফুলিয়ে ভেংচি কাটল। উপায়ান্তর না দেখে বিরক্ত হয়ে আবারও বইয়ের দিকে তাকাল।
রাতের খাবার শেষ করে মাহি মিথির রুমে গেল। মিথি তখন বসে বসে কোনো এক উপন্যাসের বই পড়ছিল। মাহি গিয়ে তার পাশে বসে। অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে থাকে। মিথি ব্যাপারটা খেয়াল করে তার দিকে তাকিয়ে দেখে মাহির চোখ মুখ কেমন যেন থমথমে। মিথি সোজা হয়ে বসে। মাহির মাথায় হাত রেখে বলে,
‘কি হয়েছে? মন খারাপ?’
মাহির বোধ হয় কান্না পাচ্ছিল। তার ঠোঁট জোড়া কাঁপছে। চোখের কোণটা ভেজা। মিথির দিকে তাকিয়ে সে বললো,
‘তুমি আমাকে কিডনী দিয়েছ বুবু?’
চলবে..