#তোমাতেই_পরিপূর্ণ
লেখিকা-জান্নাতুল ফারিয়া প্রত্যাশা
৩.
~
সকাল হলো। অনেক সকাল, ঘড়ির কাটায় দশটা বেজে পনেরো। বাইরে এখন দিবাকর তার পুরো উদ্যম নিয়ে জ্বলে উঠেছে। এক পশলা রোদ জানলার গ্রিল টপকিয়ে মিথির রুমের ফ্লোরে এসে পড়ছে। এলোমেলো হয়ে শুয়ে আছে মিথি। মাথার উপর ফ্যানটা গটগট করে ঘুরে চললেও তার বাতাস আদৌ মিথির গায়ে লাগছে কিনা সেটা সন্দেহ। ঘামে ভিজে কপালে লেপ্টে আছে লেয়ার কাটের চুলগুলো। নাকের ডকায় বিন্দু বিন্দু ঘাম লাগা। হাঁসফাঁস করতে থাকে মিথি। একপর্যায়ে বিরক্ত হয়ে চোখ মেলে তাকায়। সোজা দৃষ্টি পড়ে মাথার উপরের ফ্যানটার দিকে। যার তিনটা পাখা স্থির। তার মানে ফ্যানটা অফ। ধরফরিয়ে উঠে বসে মিথি। মা বলে চিৎকার দেয়। মিথির চিৎকার শুনে তার রুমে তার ছোট ভাই মাহি আসে। এসেই সে কোমরে হাত দিয়ে বড়ো মানুষের মতো করে বলে,
‘এই কি হয়েছে তোমার? সকাল সকাল এত চেঁচামেচি করছো কেন?’
মিথি চোখমুখ কুঁচকে দাঁত কিড়মিড় করে বললো,
‘আমার রুমের ফ্যান অফ করলো কে?’
মাহি দাঁত কেলিয়ে হেসে বললো,
‘আমি।’
মিথি চোখ মুখ শক্ত করে সশব্দে চেঁচিয়ে উঠে বললো,
‘ঐ ইন্দুর তোর এত সাহস হয় কি করে? তুই জানিস আমি চাইলে এক্ষুণি এই পাঁচ তলার ছাদ থেকে তোকে নিচে ফেলে দিতে পারি? শুধুমাত্র..শুধুমাত্র তোর আসল মা বাবার কথা ভেবে তোকে ফেলছি না। নাহলে তো উনারা কষ্ট পাবেন, উনারা এত আশা করে তোকে দিয়েছিল আমাদের কাছে পালার জন্য উনাদের আশাটা কি করে নষ্ট করি বল? আমি আবার অনেক বড়ো মনের মানুষ তো তাই এইবারের মতো বেঁচে গেলি। নয়তো এখুনি তোর কেল্লা ফতে করে ফেললতাম। এখন তাড়াতাড়ি গিয়ে ফ্যান ছাড়, আমি আরেকটু ঘুমাবো।’
মাহি খিলখিল করে হেসে দিয়ে বললো,
‘এসব বলে লাভ নেই বুবু। আমি জানি সব কিছু। আব্বু বলেছে, আমি উনাদেরই সন্তান। আমাকে কেউ পালার জন্য দিয়ে যায়নি। বরং তোমাকে নাকি আব্বু আম্মু স্টেশন থেকে কুড়িয়ে এনেছে। তুমি মনে কষ্ট পাবে বলে তোমাকে কেউ সত্যিটা বলেনি।’
মিথি সরু চোখে মাহির দিকে তাকিয়ে বললো,
‘খুব চালাক হয়েছিস তাই না? আমার কথা আমাকেই ঘুরিয়ে বলছিস। বাতারি একটা। চলদি ফ্যান ছাড়। আমার ঘুমটা চলে যাচ্ছে।’
মাহি মৃদু প্রতিবাদ জানিয়ে বললো,
‘না, ফ্যান ছাড়া যাবে না। আম্মু বারণ করেছে। তোমার না আজকে কলেজ আছে? তাহলে এখনও ঘুমাচ্ছো কেন? কলেজে লেইট হয়ে যাবে না, উঠো তাড়াতাড়ি।’
মাহি বড় ভাইদের মতো মিথিকে শাসন করে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। মিথি উঠে বসলো। মনে মনে ভাবল, ভাইটা তার বড়ো হয়ে গিয়েছে।
.
খাবার টেবিলে বসে রুটি চিবুচ্ছে মিথি। তার পাশের চেয়ারে বসে মাহি সবজির সালাত খাচ্ছে। যেটা মিথির একটুও পছন্দ না। মাহিরও না। তবে সে একপ্রকার বাধ্য হয়েই এসব খাচ্ছে। তার খাবারের আলাদা চার্ট আছে। অসুস্থ হওয়ার পর থেকেই তাকে অনেক বেছে বেছে খেতে হয়। হুট করেই কিছু মনে চাইলে খেতে পারে না। বাইরের খাবার তো একদমই না। ভাই খেতে পারে না বলে মিথিও এখন বাইরের খাবার খাওয়া ছেড়ে দিয়েছে।
মিথির বাবা কফির কাপে চুমুক দিয়ে মিথিকে বললেন,
‘রাদিত কিন্তু আজ সন্ধ্যায় আসছে, মনে আছে তো তোমার?’
মুখের খাবারটা খুব কষ্ট করে গিলে মিথি বললো,
‘আমি রাদিত স্যারের কাছে পড়বো না বাবা। উনার পড়া আমি কিছু বুঝি না। উনি অনেক কঠিন করে বোঝান। আমি নৈরিথ স্যারের কাছেই পড়বো।’
আতাউর সাহেব ফিকে গলায় বললেন,
‘কিন্তু নৈরিথ তো তোমাকে পড়াতে চাইছে না। আর রাদিতও তো ভালো টিচার। তোমাদের কলেজে তো উনার খুব নাম। সবাই তো উনার পড়ার সুনাম করে। তুমি কয়দিন পড়েই দেখো না, তারপর ভালো না লাগলে না হয় অন্য ব্যবস্থা করা যাবে।’
মিথি উত্তেজিত কন্ঠে বললো,
‘না বাবা, আমি সত্যি বলছি উনার কাছে পড়ে আমি পাশ করতে পারবো না। আমি নৈরিথ স্যারের সাথে কথা বলবো। আমি উনার কাছে ক্ষমা চাইলে উনি ঠিক আমাকে ক্ষমা করে দিবেন। প্লীজ বাবা, তুমি রাদিত স্যারকে বারণ করে দাও। আমি পড়বো না উনার কাছে।’
আমিরা বেগম রান্নাঘর থেকে উঁকি দিয়ে বললেন,
‘পৃথিবীতে কি এক নৈরিথই আছে যে শুধু ভালো পড়াতে পারে? আর বাকিরা কি ঘোড়ার ঘাস কাটে? রাদিতও যথেষ্ঠ ভালো পড়ায়। ও তো আর এমনি এমনি আর কলেজের প্রফেসর হয়ে যায়নি, অবশ্যই ছেলের মাঝে সেই দক্ষতা আছে। আর তুই তো শুধু..’
মায়ের কথার মাঝখানেই কথা বলে উঠে মিথি। অনুযোগের সুরে বলে,
‘মা, রাদিত স্যার তোমার ফ্রেন্ডের ছেলে বলে তুমি সবসময়ই উনার একটু বেশিই প্রশংসা করো। উনি ভালো পড়ায় ঠিক আছে, কিন্তু আমার সেই পড়া বোধগম্য হয় না। আমার বুঝতে কষ্ট হয়। তারপরও যদি তোমরা জোর করে উনার কাছেই আমাকে পড়াও তাহলে আমার আর কিছু বলার নেই।’
চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে মিথি বললো,
‘আমি কলেজে যাচ্ছি।’
মিথি কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে গেল। রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আমিরা বেগম মিথির বাবার সামনে এসে দাঁড়ালেন। কপালে সুদীর্ঘ ভাজ টেনে তিনি বললেন,
‘মেয়ের হাব ভাব কিন্তু আমার ভালো ঠেকছে না বুঝলে? নৈরিথের প্রতি ওর ব্যবহারটা কেন যেন একটু অন্যরকম লাগছে।’
চোখে মুখে সন্দেহ যেন উপচে পড়ছে আমিরা বেগমের। কপালের ভাজ বলে দিচ্ছে মেয়েকে নিয়ে কত দুশ্চিন্তা উনার। মিথির বাবা আতাউর রহমান উনার কফিটা শেষ করলেন। তারপর চেয়ারটায় আরাম করে বসে নির্বিকার কন্ঠে বললেন,
‘তোমার গোয়েন্দাগিরিটা শেষ হলে দয়া করে একটু রুমে এসো। আমি মাহির ঔষধগুলো বের করছি।’
তেতে উঠে আমিরা বেগম। দারাজ গলায় বললেন,
‘পাত্তা দিচ্ছো না তো আমার কথা। একদিন ঠিকই বুঝবে। মেয়েকে একটু চোখে চোখে রেখো। মেয়ে বড়ো হলে মায়েদের দুশ্চিন্তা বাড়ে, সেটা আর তুমি কি বুঝবে?’
.
কলেজের মাঠে সবুজ ঘাসের গালিচায় বসে আছে মিথি আর নেহা। মিথির চোখমুখ কেমন থমথমে। নেহা কিছুক্ষণ চুপ থেকে মিথির ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করলো। কিন্তু সে বুঝে উঠতে পারলো না। তাই সে মিথির কাঁধে হাত রেখে মৃদু সুরে বললো,
‘এখনো মন খারাপ? ভাইয়ের হয়ে আমি তোকে সরি বলছি। প্লীজ আর মন খারাপ করে থাকিস না।’
মিথি মাথা উঠিয়ে নেহার দিকে তাকিয়ে বললো,
‘বাবা রাদিত স্যারকে ঠিক করেছে আমাকে পড়ানোর জন্য। আমি তোর ভাই ছাড়া অন্য কারোর কাছে পড়বো না।’
নেহা চুপ হয়ে গেল। এই মুহুর্তে কি বলে মিথিকে সান্ত্বনা দেওয়া যায় সেটাই সে ভাবছে। মিথি স্থির দৃষ্টিতে ঘাসের দিকে তাকিয়ে আছে। নৈশব্দে ক্ষীণ শ্বাস ফেলছে। ভাবছে কি করবে? নেহাও ভাবছে। নেহা বললো,
‘তুই আন্টি কালকে বারণ করে দে, তাহলেই তো হয়।’
মিথি মুখ কালো বললো,
‘এত সহজেই যদি সবকিছু হয়ে যেত তাহলে কি আর এত ভাবতাম বল। বলেছি, আমার কথা কেউ পাত্তায় দেয়নি। রাদিত স্যার তো আবার আম্মুর বান্ধবীর ছেলে তাই উনি একটু বেশিই প্রশংসা করছে উনার। এখন আমি কি করবো কিছুই বুঝতে পারছি না। তোর ভাইকে তো রাতে কল দিয়ে ছোট খাটো একটা ব্লেকমেইল করেছিলাম, কি জানি এটা কাজে দেয় কিনা!’
ব্লেকমেইলের কথা শোনে নেহা বেশ উৎসুক কন্ঠে বললো,
‘কি ব্লেকমেইল?’
‘বলেছি উনি যদি আমাকে না পড়ায় তাহলে আমি পরীক্ষাতে ফেইল করবো। আর আমি যদি পরীক্ষায় ফেইল করি তখন সুইসাইড করা ছাড়া আমার আর কোন উপায় থাকবে না।’
‘তোর কি মনে হয় ভাই তোর এসব কথা বিশ্বাস করেছে?’
বিচলিত হয়ে নেহার দিকে তাকায় মিথি। বলে,
‘কেন? কথাটা কি বিশ্বাস করার মতো না?’
নেহা তপ্ত শ্বাস ফেলে বললো,
‘কি জানি, তুই তো জানিস ভাই কি চিস। তোর চোরামী ঠিকই ধরে ফেলতে পারবে।’
মিথি মন খারাপ আকাশ ছুঁলো। কাঁদো কাঁদো মুখ করে বললো,
‘এখন আমি কি করবো দোস্ত?’
নেহা কিছুক্ষণ ভেবে বললো,
‘তুই কলেজ ছুটির পর ভাইকে আরেকবার কল দিয়ে কথা বলিস। ভালো ভাবে বুঝাস। তাও যদি ভাই না মানে তাহলে ন্যাকা কান্না জুড়ে দিবি। তারপর দেখ না ভাই কি বলে।’
মিথি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
‘ঠিক আছে। যেভাবেই হোক নৈরিথকে রাজি করাতেই হবে। আমি ঐ রাদিত স্যারের কাছে পড়ব না না না।’
কলেজ থেকে দ্রুত বেরিয়ে এল মিথি আর নেহা। কিছুটা পথ এগুতেই নেহা বললো,
‘নে এবার কল দে ভাইকে।’
মিথি ব্যাগ থেকে ফোনটা বের করতেই নেহা আবারো বলে উঠলো,
‘এই দাঁড়া দাঁড়া। কল করিস না।’
মিথি ব্রু কুঁচকে বললো,
‘কেন?’
নেহা তাকে হাতের ইশারা দিয়ে দেখাল। মিথি তাকিয়ে দেখল রাস্তার ঠিক অপর পাড়ে নৈরিথকে দেখা যাচ্ছে। মিথি কিছুটা অবাক হলো। নৈরিথ রাস্তা পাড় হয়ে তাদের সামনে এসে দাঁড়াল। নেহাকে উদ্দেশ্য করে বললো,
‘এদিকেই যাচ্ছিলাম। ভাবলাম তোর তো এখন কলেজ ছুটি তোকে বাসায় দিয়ে আসি।’
নেহা জোর পূর্বক হেসে বললো,
‘ওও।’
তারপর মিথির দিকে তাকিয়ে তাকে কিছু একটা বলার জন্য ইশারা দিল। মিথি তখন ঠোঁট ছড়িয়ে হেসে ইতস্তত কন্ঠে বললো,
‘স্যার, আমাকে কি আজ পড়াতে যাবেন না?’
নৈরিথ নির্বিকার কন্ঠে বললো,
‘তোমার মা বাবার সাথে আমার কথা হয়েছে মিথি। উনারা নাকি রাদিত স্যারকে তোমার জন্য ঠিক করেছেন। উনি কিন্তু খুব ভালো পড়ায় ইনফেক্ট আমার থেকেও ভালো। তুমি উনার কাছে পড়লে শুধু পাশ না আরো ভালো রেজাল্ট করবে। তাই এখন মাথা থেকে অন্য সব চিন্তা ঝেড়ে ফেলে উনার কাছে মনোযোগ দিয়ে পড়। তাতে তোমারই লাভ।’
ভীষণ রাগ হলো মিথির। মাথার উপর ঝলসানো রোদে ঘেমে একাকার সে। গালগুলো কিছুটা লাল হয়ে আছে। ক্ষোভে যেন ভেতরে ভেতরে ফেটে পড়ছে। মিথি জোরে একটা শ্বাস টেনে নিজেকে কিছুটা ধাতস্থ করে বললো,
‘আপনি ইচ্ছে করে এমন করছেন তাই না? আমাকে শাস্তি দেয়ার জন্য। এত অপছন্দ করেন আমায়? আমি কি খুব খারাপ স্যার? আপনি জানেন আমি আপনাকে ছাড়া আর কারো কাছে পড়তে চাই না তাও ইচ্ছে করে আপনি এমন করছেন। আমি পড়বো না, ঐ রাদিত স্যারের কাছে আমি জীবনেও পড়বো না। কোনো টিচারের কাছেই পড়বো না। আপনার কাছেও না। প্রয়োজন নেই আপনাকে আমার। আর কোনো দিন বলবো না আমাকে পড়ানোর কথা। আপনার তো আমার থেকে আরো হাজার গুণ ভালো ভালো স্টুডেন্ট আছে। আমি তো স্টুপিড। আমার মতো স্টুপিডকে কেন আপনি পড়াবেন? ঠেকা পড়েছে নাকি আপনার? আমারই বোঝা উচিত ছিল।’
কথাগুলো বলে কাঁদতে কাঁদতে সেখান থেকে চলে যায় মিহি। নেহা আর নৈরিথ হা করে মিথির যাওয়ার পথে তাকিয়ে থাকে। নেহা তখন মনে মনে ভাবে,
‘এই মেয়েটা এত ভালো এক্টিং কিভাবে করে? হাউ ম্যান হাউ?’
চলবে..