#তোমাতেই_পরিপূর্ণ
লেখিকা-জান্নাতুল ফারিয়া প্রত্যাশা
৩৪.
~
নৈরিথ এগিয়ে গেল মিথির দিকে। নেহা নৈরিথ কে দেখে ঘাবড়ে গেল। মনে এক ভয় ঝেঁকে বসল তার। নৈরিথ নিশ্চয় রেগে মেগে আগুন হয়ে যাবে। না জানি এখন সে কি সিনক্রিয়েট করে বসে। ভয়ে নেহা তার চেয়ারে থ মেরে বসে থাকে। নৈরিথ মিথির সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। তারপর ঠান্ডা গলায় বলে,
‘কে ও মিথি?’
নৈরিথের কন্ঠস্বর শুনে মিথির হুশ এল। চমকে উপরের দিকে তাকাল। নৈরিথ কে হঠাৎ দেখে সে কথা হারিয়ে ফেলেছে। সিফাতও নিরবে তাকিয়ে আছে নৈরিথের দিকে। মিথি সিফাতের হাত ছেড়ে দিল। ঠোঁট জোড়া কাঁপছে তার। কথাগুলো গলায় আটকে যাচ্ছে। তাও সে বললো,
‘ও সিফাত, নৈরিথ। আপনাকে বলেছিলাম না ওর কথা?’
নৈরিথের মনে পড়ল। হ্যাঁ, মিথি তাকে আগেই সব কিছু বলেছে। নৈরিথ সিফাতের দিকে তাকাল। কেমন যেন তার চোখ মুখ হয়ে আছে। অতঃপর নৈরিথ বললো,
‘হ্যাঁ, বলেছিলে। কিন্তু এতদিন পর ও কোথা থেকে এসেছে? এতদিন কোথায় ছিল ও?’
মিথি জবাব না দিয়ে সিফাতের দিকে তাকাল। সে চাইছে সিফাত’ই নৈরিথের প্রশ্নের জবাব দিক। মিথি চুপ হয়ে রইল। সিফাতও কিছুক্ষণ চুপ থাকল। তবে একসময় আর পারল না। সে উঠে দাঁড়াল। নৈরিথের মুখোমুখি হয়ে বললো,
‘আপনি কে? মিথির সাথে আপনার কি সম্পর্ক?’
নৈরিথ গম্ভীর সুরে বলে,
‘আমি ওর হাজবেন্ড।’
সিফাত অবাক হওয়ার ভান করলো। মিথির দিকে তাকিয়ে উদ্বেগ নিয়ে বললো,
‘বাহ মিঠু, তুই বিয়েও করে নিলি। কনগ্রেচুলেশন!’
মিথি খুশি হলো। সিফাতের মুখে আবার ‘মিঠু’ ডাকটা শুনতে পেয়ে ভীষণ খুশি হলো সে। বললো,
‘হ্যাঁ, কিছুদিন আগেই আমাদের বিয়ে হয়েছে। সেদিনও তোকে খুব মিস করেছিলাম। তুই বলেছিলি না আমার বিয়ের সমস্ত আয়োজন তুই একা করবি, কিন্তু সেদিন তুই ছিলি না। খুব মনে পড়ছিল তোকে। জানিস তো, শুধু সেদিন না এর আগেও এমন অনেক দিন গিয়েছে যখন আমার মনে হচ্ছিল তুই আমার কাছেই আছিস। আমি এক দুবার তোকে দেখেছিও হয়তো। তুই কোথায় ছিলি এতদিন? সত্যি করে বলতো, তুই কি আমাদের পাশের বিল্ডিং টা তে থাকতি?’
সিফাত জবাব দিল না। জবাব দেয়ার প্রয়োজন বোধ করলো না সে। সে নৈরিথের দিকে তাকাল। হেসে বললো,
‘নতুন জীবনের জন্য শুভেচ্ছা। আমার মিঠু কে ভালো রাখবেন কিন্তু। আসছি তাহলে।’
সিফাত কথাটা বলে পা এগুতে নিলেই মিথি তার হাতটা খামছে ধরে। সিফাত, নৈরিথ দুজনেই তার হাতের দিকে তাকায়। মিথির চোখগুলো আবারও ভিজে উঠে। কান্না ভেজা কন্ঠে সে বলে,
‘প্লীজ, যাস না।’
মিথির এই সুর সিফাতের বুকে গিয়ে বিঁধল। কিন্তু পারছে না সে, নিজের ইগোর কাছে বারবার হেরে যাচ্ছে। নৈরিথ অবাক হয়ে মিথির দিকে তাকিয়ে থাকে। কিছু সম্পর্কের গভীরতা শুধু মুখে বলে বোঝানো যায় না। মাঝে মাঝে সেটাকে মন দিয়ে উপলব্ধি করতে হয়। এই মুহুর্তে মিথির চোখের এই পানি’ই বলে দিচ্ছে সে সিফাত কে কতটা ভালোবাসে। নৈরিথ সম্মান করে এই ভালোবাসাটা কে। কিছুটা খারাপ লাগলেও অনেক বেশি ভালো লাগে এটা ভেবে যে সত্যিই এই স্বার্থপর পৃথিবীতে এখনও বন্ধুত্ব নামক একটা সুন্দর সম্পর্ক টিকে আছে। নৈরিথ এবার তপ্ত শ্বাস ফেলল। বললো,
‘চলে যাচ্ছো কেন সিফাত? মিথি তোমাকে ছাড়া ভালো থাকতে পারবে না। আর কত রাগ নিয়ে বসে থাকবে? এবার তো ওকে ক্ষমা করতে পারো। মেয়েটা যে খুব ভালোবাসে তোমায়। আমি জানিনা তোমাদের মাঝে কি হয়েছিল। তবে এতদিনে এইটুকু জেনে গিয়েছে তোমাদের সম্পর্ক টা খুব স্পেশাল। আর আমি এটাও জানি যে তুমিও মিথিকে ছাড়া ভালো নেই। কষ্ট তোমারও হচ্ছে। তবে, কেন? কেন এই কষ্টের সুতোটাকে আরো লম্বা করছো? এবার তো থামো। নিজেকে একবার বুঝাও, এই মেয়েটার জন্য হলেও নিজের রাগটা দমিয়ে নাও। বন্ধুত্বের হাতটা আবার বাড়িয়ে দাও। প্লীজ সিফাত!’
নৈরিথের কথা শুনে সিফাত যতটা না অবাক হয়েছে তার চেয়ে অনেক বেশি অবাক হয়েছে মিথি। মিথি ভেবে নিয়েছিল তার এহেন কর্মকান্ডে হয়তো নৈরিথ রেগে যাবে। ব্যাপার টা তো অস্বাভাবিক কিছু না। নিজের বউকে অন্য একটা পুরুষের হাত ধরে বসে থাকতে দেখলে সব স্বামীই রেগে যাবে। এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু নৈরিথ, সে একজন বিচক্ষণ মানুষ। সে বুঝে সম্পর্কের গভীরতা। নিজের জীবনে খুব মূল্যবান ভালোবাসাগুলো হারিয়েছে তো তাই সে হয়তো অন্যসব ভালোবাসাগুলোকে সম্মান করতে জানে। মিথি তাকিয়ে থাকে তার মানুষটার দিকে। তারপর আবার তাকায় সিফাতের দিকে। সিফাত নিচের দিকে চেয়ে রইল। যেন কিছু একটা নিয়ে খুব গভীরভাবে ভাবছে সে।
.
.
নীরবতায় কেটে গেল অনেকটা সময়। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়েছে। মিথি নৈরিথ সিফাত আর নেহা সবাই’ই এক টেবিলে বসা। কারো মুখেই কোনো কথা নেই। যেন নীরবতার ব্রতে নেমেছে সবাই। অনেকটা সময় পার হবার পর নৈরিথ এবার নীরবতার ব্রত ভাঙল। থমথমে কন্ঠে বললো,
‘কি এমন হয়েছিল তোমাদের মাঝে যে তোমরা একে অন্যকে ছেড়ে চলে গেলে?’
সিফাত আর মিথি একে অন্যের দিকে চাওয়া চাওয়ি করলো। তারপর মিথি মাথা নিচু করে ফেলল। সিফাত বললো,
‘কি রে মিঠু, তুই বলবি নাকি আমিই বলবো?’
মিথি ক্ষীণ সুরে বললো,
‘তুই’ই বল।’
সিফাত দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতে আরম্ভ করলো,
‘ওর সাথে আমার পরিচয় ক্লাস নাইনের লাস্টের দিকে। তখনও আমরা এত ক্লোস ফ্রেন্ড ছিলাম না। কেবল ক্লাসমেটই ছিলাম। ও আর আমার বাসাও এক জায়গায় ছিল, সেই সুবাধে যাওয়া আসাও এক সাথে হতো। আর ঐভাবেই আস্তে আস্তে আমাদের সম্পর্কটা আরো গভীর হতে থাকে। তবে আমরা নিজেরাও বুঝতে পারি নি যে কবে আমরা একে অন্যের পরিপূরক হয়ে উঠি। তখন এমন হয়েছিল যে মিথিও আমাকে ছাড়া কিছু বুঝতো না অর আমিও মিথিকে ছাড়া কিছু বুঝতাম না। অনেক অনেক আনন্দ করি সেসময় দুজন। অনেক পাগলামী করেছি। স্যারদের বকা খেয়েছি। বাসায়ও মার খেয়েছি খুব। কিন্তু তাও আমাদের মধ্যে কোনো হেলদোল আসেনি। আমরা আমাদের মতোই ছিলাম। আসলে সেই সুন্দর মুহুর্তগুলো এখন আমি মুখে বলে এক্সপ্লেন করতে পারবো না। সব ভালো চলছিল। দেখতে দেখতে টেনের টেস্ট পরীক্ষাও শেষ হয়ে গেছিল। ততদিনে আমাদের বন্ধুত্বের এই জুটি পুরো স্কুলে খুব প্রিয় হয়ে গেছিল। সবাই পছন্দ করতো আমাদের। কিন্তু…কিন্তু এই পছন্দের মাঝেই কারো একজনের নজর পড়ল। মিথিকে কেউ আমার নামে খুব বাজে কিছু বলে। অনেক কিছু দেখায়ও ওকে। আসলে সেই ব্যক্তিটা মিথির ব্রেইনটা কে এমন ভাবে ওয়াশ করলো যে মিথি নিমিষেই আমাদের বন্ধুত্বের কথা ভুলে গেল। ক্লাসের সবার সামনে ও আমাকে চড় মেরেছিল, শুধু এইটুকুই না সেই ব্যক্তিটা নাকি ওকে বলেছিল যে আমি ওকে ইউজ করছি। আমার ইনটেনশন ভালো না। আমি ওকে নিয়ে খুব খারাপ কিছু ভেবে রেখেছি, ব্লা ব্লা আরো কত কি। আর সেই সব কিছু মিথি বিলিভ করে। অবশ্য বিলিভ করারও কারণ আছে কারণ যেই মানুষটা ওকে এসব বলেছে সেই মানুষটার কাছে অনেক ফেইক প্রমাণ ছিল। আর এইজন্যই সে মিথিকে খুব সহজেই বুঝিয়ে ফেলতে পারে। আর আমার মিঠু তো খুব বোকা, বিশ্বাস করে ফেলে সব কিছু। ক্লাসের সবার সামনে সেদিন সে আমাকে অপমান করে। আমি কখনো বন্ধু ছাড়া ওর দিকে অন্য কোনো নজরে তাকাই নি। সেই সাহস আবার ছিল না। কিন্তু সেইদিন ও আমার সেই ব্যক্তিত্বের উপরও আঙ্গুল তুলে। মেনে নিতে পারে নি আমি। আমার আবার খুব ইগো। সেদিনই সেই স্কুল থেকে বেরিয়ে যাই। ডিরেক্ট টি সি নিয়ে ফেলি। আর বাবাকে বলে বাইরে যাওয়ার প্রস্তুতি নেই। কিন্ত মজার ব্যাপার কি জানেন? আমার যেদিন ফ্লাইট সেদিনই মিথি সব সত্যি জানতে পারে। ফ্লাইটের ঠিক দু ঘন্টা আগে ও আমার কাছে এসেছিল। সে কি কান্না মেয়ের। নাকের পানি চোখের পানি সব এক করে ফেলেছিল। তাও আমার ইগো কে তার জায়গা থেকে নড়াতে পারলো না। আমি ইগনোর করে চলে এলাম। আর তারপর ও অনেক ভাবে আমার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করে কিন্তু আমি করেনি। সেইদিনের সেই কষ্ট টা ভুলতে পারেনি। এখনও না। তাই ওকেও কষ্ট দিয়েছিলাম খুব। তবে একপর্যায়ে আমি আর না পেরে দেশে ফিরে আসি। আর মিথিদের বিল্ডিং এর সামনের বিল্ডিং এ উঠি। যেখানে প্রথম থেকেই মিথির সন্দেহ হয়, তবে আমিও খুব কৌশলে সেটা হ্যান্ডেল করি। আর..আর আমি আগে থেকেই সব কিছু জানি। আপনাদের বিয়ে থেকে শুরু করে মিথির আর মাহির অপারেশন কোনাটাই আমার অজানা নয়। ইচ্ছে করেই এতদিন মিথির কাছ থেকে লুকিয়ে ছিলাম। কিন্তু আজ ধরা পড়ে গেলাম। মেয়েটা এক দেখায় চিনে ফেলল আমাকে। আবারও সেদিনের মতো কেঁদে উঠল। আর আমি..’
সিফাত থেমে গেল। নৈরিথ আর নেহার চোখের পলক পড়ছে না। হতভম্ব হয়ে চেয়ে আছে তারা। মিথি আবারও কাঁদছে। মেয়েটা এত কাঁদে কেন? একটু কষ্টও সহ্য করতে পারে না। সে কাঁদতে কাঁদতে বললো,
‘সরি। আমি জানি আমি অনেক বড়ো ভুল করেছি। আমি আমার বন্ধুত্বের সম্পর্কটাকে অপমান করেছি, তোকে অপমান করেছি; কিন্তু কষ্টও পেয়েছি খুব। প্লীজ, প্লীজ ক্ষমা কর আমায়। আমি আর এই কষ্ট সহ্য করতে পারছি না।’
মিথি এবার শব্দ করে কেঁদে উঠল। নৈরিথের আর ভালো লাগছে না। মিথির এই কান্না সহ্য হচ্ছে না তার। তবে কিছু তো করারও নেই। সিফাত ছাড়া তো কেউই মিথির এই কান্না থামাতে পারবে না। কিন্তু এই ছেলে তো এখনও চুপ করে বসে আছে। নৈরিথ এই সবকিছুতে হাঁপিয়ে উঠল। চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে চোখ বুজে ফেলে সে। তখনই সিফাত বলে উঠে,
‘হয়েছে এবার কান্না অফ কর। আর ভালো লাগছে না তোর এই ফ্যাচফ্যাচ দেখতে। যাহ ক্ষমা করে দিলাম। তবে কান খুলে শুনে রাখ, এটাই ফার্স্ট আর এটাই লাস্ট ক্ষমা। এরপর যদি আর কোনোদিন এমন হয় তবে আমি কিন্তু আর কোনো কথা শুনবে না, এই বলে রাখলাম।’
মিথি খুশিতে ঝলমলিয়ে উঠে। সিফাতকে জড়িয়ে ধরতে গিয়েও থেমে যায়। নৈরিথের দিকে তাকায়, মুচকি হেসে তাকে জড়িয়ে ধরে। নৈরিথ প্রথমে অবাক হলেও পরে সেও হেসে মিথির মাথায় হাত রাখে। নেহা আর সিফাতের মুখেও হাসি ফুটে উঠে। সত্যিই, ভালোবাসা সুন্দর!
চলবে..