#তোমাতেই_পরিপূর্ণ
লেখিকা-জান্নাতুল ফারিয়া প্রত্যাশা
৫.
~
বিকেলে ঘুমিয়েছিল মিথি। এখন রাত আটটা বাজে, তার ঘুম এখনও ভাঙেনি। আমিরা বেগমের মনের অবস্থাও আজ ভালো নেই। মিথি যে এখনও সিফাতকে অনেক বেশি মিস করে সেটা তার আর বুঝতে বাকি রইল না। বন্ধু হারিয়ে গেলেও বন্ধুত্ব কখনও হারিয়ে যায় না। সেই বন্ধুত্বের জোরেই একবার হলেও ফিরে আসুক সিফাত। মনে প্রাণে সেটাই চান আমিরা বেগম। কি জানি তার এই চাওয়া আদৌ কখনও পূরণ হবে কিনা?
মিথি চোখ খুলে দেখল মাহি তার মাথার উপর বসা। ছেলেটা কেমন ড্যাব ড্যাব করে ওর দিকে চেয়ে আছে। মিথি বড় একটা হাই তুলে উঠে বসলো। বললো,
‘কিরে এমন করে তাকিয়ে কি দেখছিস?’
মাহি সরু চোখে তাকিয়ে বললো,
‘বুবু, তুমি বেঁচে আছো? যেভাবে মরার মতো পড়েছিলে, আমি তো ভেবেছিলাম তুমি বোধ হয় ইনলিল্লাহ করেছো। কি খুশিটাই না হয়েছিলাম!’
মিথি রাগি চোখে মাহির দিকে তাকাল, বললো,
‘খুব খুশি না? আমি মরলে খুব খুশি হবি? ঠিক আছে, আমিও দেখবো তখন কে তোকে এত্তগুলো চকলেট কিনে দেয়। কে তোকে আম্মুর মার খাওয়া থেকে বাঁচায়। আর…আর পাড়ার তোর ঐ বন্ধুগুলো আছে না ওদের সাথে ঝগড়া লাগলে কে তোর সাপোর্ট করে সেটা আমিও দেখে নিব,হু।’
মিথি গাল ফুলিয়ে বসল। মাহি বাচ্চাদের মতো মুখ করে বললো,
‘বুবু, তুমি সত্যি সত্যি রাগ করেছো? আমি তো শুধু একটু মজা করছিলাম তোমার সাথে। রাগ করো না বুবু। আমি তো তোমায় এত্তগুলা ভালোবাসি।’
কথাটা বলে মাহি মিথিকে জড়িয়ে ধরে। ফিক করে হেসে দেয় মিথি। ভাইকে বুকে জড়িয়ে কপালে চুমু খায়। মাহি তখন কাঁদো কাঁদো মুখে বলে,
‘বুবু, আমার স্কুল থেকে অনেকগুলো ম্যাথ দিয়েছে। আমি না ঐগুলো পারছি না, আমাকে একটু ঐগুলো করিয়ে দিবে?’
মিথি হেসে জবাব দিল। বললো,
‘ঠিক আছে, তুই খাতা বই নিয়ে আয় আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।’
.
হাইয়ার ম্যাথের জটিল অংকগুলো মিথির মাথায় কোনোমতেই ঢোকে না। বেচারি হাঁপিয়ে উঠেছে অংক করতে করতে তাও যদি কিছু শেষ হতো। যতই করছে ততই যেন কঠিন থেকে আরো কঠিনতর হচ্ছে। কোন দুঃখে যে সে ইন্টারে এসে আবারও সাইন্স নিয়েছিল তা এক আল্লাহই জানে। নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারা বোধ হয় এটাকেই বলে।
মিথি একটা অংক করতে গিয়ে আটকে গেল। অন্যদিন হলে এতক্ষণে সে নৈরিথকে কল দিয়ে বসতো। অংক বোঝার উছিলায় একটু কথাও বলা হয়ে যেত। আজ আর কল দিল না সে। নিজে নিজে যখন চেষ্টা করে পারল না তখন গাইড খুলে বসলো। নিজের মনকে সংযত রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। কিন্তু কতক্ষণ? কতক্ষণ পারবে নিজেকে সংযত রাখবে? যদি হেরে যায়, মনের সাথে যুদ্ধ করে যদি সে আর না পারে তাহলেই তো মন আবার নৈরিথের জন্য উতলা হয়ে উঠবে। যেটা সে আর চায় না। কষ্ট হলেও পারতে হবে তাকে। নৈরিথ তাকে ভালোবাসে না আর কখনও বাসবেও না, এই অপ্রিয় বাস্তবটাকেই তার মেনে নিতে হবে।
কিছুক্ষণ থম মেরে বসে মিথি আবারও তার অংকে মনোযোগ দিল। দুইটা অংক করতেই তার ফোনটা বেজে উঠল। নেহা কল করছে। মিথি কলটা রিসিভ করলো। ওপাশ থেকে নেহা বলে উঠল,
‘দোস্ত, একটা গুড নিউজ আছে।’
উদ্বেগহীন কন্ঠে মিথি বললো,
‘কি?’
নেহা উচ্ছাসিত কন্ঠে বললো,
‘নৈরিথ ভাই চাকরি পেয়ে গেছে, মিথি।’
হঠাৎ করে মিথিও খুশি হয়ে গেল। নিমিষেই যেন তরতাজা হয়ে উঠল তার প্রাণ। খুশিতে ঝুমঝুম করে উঠল সে। বললো,
‘সত্যি? নৈরিথ চাকরি পেয়ে গেছে?’
‘হ্যাঁ সত্যি। একটা মাল্টিকম্পানিতে জব পেয়েছে এসিসটেন্ট ম্যানেজার হিসেবে।’
‘আলহামদুলিল্লাহ। আমার তো খুশিতে নাচতে ইচ্ছে করছে।’
নেহা তখন কিছুটা গম্ভীর সুরে বললো,
‘ভাই চাকরি পেয়ে গেছে মিথি। এখন কিন্তু ভাই আর তার কোনো টিউশনিই করাবে না।’
মিথি আলতো হাসল। ক্ষীণ সুরে বললো,
‘জানি তো। এতদিন চাকরি পাচ্ছিলেন না বলেই তো উনি টিউশনি করিয়েছিলেন। এখন চাকরি পেয়ে গেছেন। এখন আর টিউশনি করিয়ে কি হবে। আর আমিও নতুন টিচার পেয়ে গেছি। রাদিত স্যারের কাছেই পড়ছি। উনি বেশ ভালোই পড়ান।’
হুট করে মিথির কথার পিঠে বলার মতো কোনো কথা খুঁজে পেল না নেহা। এত এত ভাবার পরও কিছু পাচ্ছে না। পৃথিবীর সব কথা কি আজ করে ফুরিয়ে গেল নাকি? কোনো কথা কেন খুঁজে পাচ্ছে না সে? দুজনেই চুপ। এই নিরবতা যেন অনেক কিছুই বলছে কেবল শুনতে পাচ্ছে না তারা। কিছু ভাবতে ভাবতে নেহা বলে উঠল,
‘দোস্ত!’
ওপাশ থেকে মৃদু সুর ভেসে এলো,
‘হুম বল।’
‘আজ কলেজ ছুটির পর কি তুই সত্যি সত্যিই কেঁদেছিলি?’
মিথি হেয়ালির সুরে বললো,
‘তোর কি মনে হয়?’
অস্থির কন্ঠে নেহা বললো,
‘বল না প্লীজ!’
মিথি তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো,
‘হয়তো এক্টিং ছিল।’
নেহা বললো,
‘মিথ্যে বলছিস কেন?’
মিথি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
‘সত্যি বললে যে তুই বিশ্বাস করবি না, তাই।’
নেহা খানিক চুপ থেকে বললো,
‘মার সাথে কি আমি তোর ব্যাপারে কথা বলবো?’
মিথি হেসে বললো,
‘তোর ভাই আদৌ তোর মার কথা শোনে নেহা? কি দরকার এসবের মাঝে আন্টিকে আনার? তার চেয়ে সবকিছু যেভাবে আছে ওভাবেই থাকতে দে। সময়ের সাথে সাথে সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে, দেখিস।’
আর বেশিক্ষণ কথা হলো না তাদের। কলটা কেটে দিয়ে মিথি আবার তার পড়াশোনায় মনোযোগ দিল।
.
.
ঘড়ির ঘন্টার কাটাটা এগারোটা ছুঁই ছুঁই। প্লেটটা নিয়ে খাবার টেবিলে বসেছে নৈরিথ। গরম গরম ভাতের সাথে একটা ডিম ভেজে এনেছে সে। নৈরিথ দু লোকমা ভাত মুখে তুলতেই তার মা এসে বসলো তার পাশের চেয়ারটায়। ভদ্র মহিলার মুখপানে একবার চাওয়ারও কোনোরূপ প্রয়োজন বোধ করলো না নৈরিথ। খাবার খাওয়াই যেন এখন তার সব থেকে বড়ো কাজ। নৈরিথের মা মাংসের বাটি থেকে দুই টুকরো মাংস নৈরিথের প্লেটে দিতেই সে মানুষটার দিকে তাকাল। চোয়াল শক্ত করে ফেলল সে। বললো,
‘আমি নিজের খাবার নিজে নিয়েই খেতে পারি। কাউকে কষ্ট করে বেড়ে খাওয়াতে হবে না।’
কথাটা বলেই নৈরিথ উঠে যেতে লাগল। পেছন থেকে এক বুক আকুতি নিয়ে লাভলী হাসনাত তাকে ডেকে উঠলেন। মায়ের এই আকুতি ভরা কন্ঠে থেমে গেল নৈরিথের পদযুগল। ঈগল চোখে মায়ের দিকে ফিরে তাকাল সে। লাভলী হাসনাত এগিয়ে গেলেন নৈরিথের দিকে। মোলায়েম কন্ঠে বললেন,
‘বাবা, তুই নাকি চাকরি পেয়েছিস? শুনে আমি খুব খুশি হয়েছি। তোর এত এত পরিশ্রম কাজে দিয়েছে। আমি খুব খুশি বাবা, খুব খুশি।’
নৈরিথ তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো,
‘আপনি খুশি হয়েছেন দেখে আমারও ভালো লাগছে। তবে আপনার এই খুশিটা আদৌ মন থেকে আসছে কিনা সেটা নিয়ে অবশ্য আমার একটু সন্দেহ আছে।’
মুখের সেই অল্প বিস্তর হাসিটাও বিলিন হয়ে গেল লাভলী হাসনাতের। নৈরিথ তপ্ত শ্বাস ফেলে খাবারের প্লেটটা নিয়ে নিজের রুমে চলে গেল। বরাবরের মতো আজও চোখের কোণ ভিজে উঠল লাভলী হাসনাতের। মনে মনে ভাবতে লাগল, তার ছেলে কি আর কখনও তাকে আগের মতো ভালোবাসবে না? আর কখনও কি একবার তার সাথে ভালোভাবে কথা বলবে না? এই রাগ, ক্ষোভ, অভিমান কবে মিটবে তার? কবে?
_________
মিথি খাবার শেষ করে তার বাবার রুমে গেল। বাবা কি যেন জরুরি কথা বলবে তার সাথে। আতাউর সাহেব তখন মাহির ঔষধগুলো বের করছিলেন। মিথিকে দেখে বললেন,
‘তোমার বাদর ভাইটা কোথায়, মিথি? ঔষধ দেখলেই সে পালায়।’
মিথি হেসে বললো,
‘দুই মিনিট দাঁড়াও বাবা। আমি ওকে এক্ষুণি ধরে আনছি।’
জোরে করে মাহিকে ধরে আনল মিথি। ঔষধ খাওয়া যেন পৃথিবীর সবথেকে কষ্টদায়ক কাজ তার জন্য। ঔষধটা মুখে পুরার পর মুখের এমন সব ভঙ্গিমা করে সে যা দেখে মিথি হাসতে হাসতে কুপোকাত হয়। আজও তার ব্যাতিক্রম ঘটল না। মিথি হাসতে হাসতে বললো,
‘বাবা, তোমার ছেলের ফেইসটা দেখো। যেন ঔষধ না ওকে কেউ বিষ খাওয়াচ্ছে।’
মাহি তেতে উঠে বলে,
‘এএ তুমি খেলে বুঝতে। এটা বিষের চেয়ে কম কিছু না।’
মিথি ভেংচি কেটে কিছু বলার জন্য উদ্যত হতেই আতাউর সাহেব বললেন,
‘মিথি, তুমি বাবাকে একটা সত্যি কথা বলবে?’
কথার এহেন ভঙ্গিমায় অবাক না হয়ে পারলো না মিথি। বললো,
‘কি কথা বাবা?’
আতাউর সাহেব কিছুটা সময় নিয়ে বললেন,
চলবে..