#তোমাতেই_পরিপূর্ণ
লেখিকা-জান্নাতুল ফারিয়া প্রত্যাশা
৯.
~
বাসার সামনে এসেই মিথি থেমে গেল। তাদের বিল্ডিং এর সাথে আরেকটা বিল্ডিং আছে। তারপর একটা সরু গলি। মিথি সেই বিল্ডিং এর গেইটের সামনে গেল। সেদিন যে দারোয়ান দেখেছিল আজ উনি নেই। ঐদিন মাকে নিয়ে এসেই অনেক ঝামেলা করে তাদের উপরে উঠতে হয়েছে। অপরিচিত কাউকে ঢুকতে দেওয়া হয় না। মিথি ভয়ে ভয়ে গেল দারোয়ানের কাছে। মিথিকে দেখে মধ্যবয়স্ক দারোয়ানাটি ব্রু কুটি করলেন। বললেন,
‘কে আপনি? কাকে চায়?’
মিথি ছোট্ট একটা ঢোক গিলে সপ্রতিভ গলায় বললো,
‘আসলে আংকেল আমি না এই পাশের বিল্ডিংটাতে থাকি। এখানে একটা কারণে এসেছি। যদি আপনি একটু আমাকে সাহায্য করতেন।’
দারোয়ানের কুঁচকানো ব্রু আরো কিছুটা কুঁচকে গেল। আকাশ পাতাল ভেবে তিনি বললেন,
‘কি সাহায্য?’
মিথি কাঁচুমাচু করতে করতে বললো,
‘এই বিল্ডিং এ আমার খুব পরিচিত একজন থাকে আংকেল। যার সাথে আমার অনেকদিন যাবত কোনো যোগাযোগ নেই। তবে আমি অনেক চেষ্টা করেছিলাম তার সাথে যোগাযোগ করার কিন্তু পারেনি। এই মানুষটা এই বিল্ডিং এই থাকে। প্লীজ আংকেল, আমাকে একবার তার সাথে কথা বলার সুযোগ করে দিন।’
দারোয়ান মিথির চোখ মুখের অবস্থা দেখে এইটুকু আশ্বস্ত হলো যে মেয়েটা মিথ্যে বলছে না। তিনি মিথিকে বললেন,
‘কত তলায় থাকেন উনি?’
মিথি একটু ভেবে বললো,
‘পাঁচ তলায়।’
‘পাঁচ তলার কত নাম্বার ফ্ল্যাট?’
মিথির এবার মনে পড়ল সেদিন যখন এসেছিল তখন ঐ ফ্ল্যাটের বাইরে বি ফাইভ লেখা দেখেছিল। মিথি সেই আন্দাজেই বললো,
‘বি ফাইভ।’
দারোয়ান বললেন,
‘ঠিক আছে। আপনি দাঁড়ান আমি কল কলে দেখছি।’
মিথি চুপচাপ দাঁড়াল। বুকের ভেতর ধুকধুক করছে তার। উত্তেজনা আর ভয়ে যেন ক্রমশ চুপসে যাচ্ছে সে।
দারোয়ানের কথা হলো। ঐ ফ্ল্যাট থেকে কেউ একজন আসছে। মিথি অধীর আগ্রহে সেই ব্যক্তিটির জন্য অপেক্ষা করছে। অনেকক্ষণ পর লিফট থেকে একটি ছেলে বেরিয়ে এলো। দেখেই বোঝা যাচ্ছে নাইন কি টেনে পড়ে। ছেলেটা তাদের সামনে এসে দাঁড়াল। দারোয়ান কে উদ্দেশ্য করে বললো,
‘কে এসছে মামা?’
দারোয়ান বললো,
‘এই যে এই মেয়েটা। আপনাদের ফ্ল্যাটে তার পরিচিত কে থাকে। তার সাথে কথা বলতে এসেছে।’
ছেলেটা বেশ কৌতুহল নিয়ে মিথির দিকে তাকাল। বললো,
‘কে আপনি আপু? কার খোঁজ করছেন?’
মিথি ইতস্তত হয়ে পড়ল। আমতা আমতা করে বললো,
‘সিফাত নামের কেউ কি আপনাদের ফ্ল্যাটে থাকে?’
ছেলেটি ব্রু কুঁচকে বললো,
‘না তো। আমাদের ফ্ল্যাটে তো কেবল আমি আর আমার আম্মু আব্বু থাকি। সিফাত নামের কেউ আমাদের সাথে থাকে না।’
মিথির মন খারাপ হলো। চোখে মুখে বিষন্নতা ছেয়ে পড়ল। সে দুঃখি দুঃখি গলায় বললো,
‘আচ্ছা ভাইয়া, তাহলে কি বারান্দায় বসে গিটার আপনিই বাজান? কাল রাতেও কি আপনি গান গেয়েছিলেন?’
ছেলেটা একটু থেমে বললো,
‘জ্বি। কেন আপু?’
মিথি মেকি হাসি দিয়ে বললো,
‘না আপনার গানের গলা খুব সুন্দর। আর আমি সরি আপনাদের ডিস্টার্ব করার জন্য।’
ছেলেটি হেসে বললো,
‘না না সমস্যা নেই আপু। সরি বলতে হবে না।’
তারপর মিথি বেরিয়ে এলো সেই বিল্ডিং থেকে। চোখ বুজে আগে কিছুক্ষণ জোরে জোরে নিশ্বাস নিল। যেন দম আটকে আসছে তার। খুব আশা করে গিয়েছিল সে, ভেবেছিল আজ নিশ্চয়ই সিফাতের দেখা পাবে। কিন্তু সব আশা তার ধূলিসাৎ হয়ে গেল। মিথি আস্তে আস্তে হেটে তাদের বিল্ডিং এ গেল। শরীর যেন আর চলছে না তার। মনটা তার ভীষণ অসুস্থ। এভাবে আর কতদিন? বেস্ট ফ্রেন্ডকে হারানো বুঝি এত কষ্টের। মিথি যে আর নিতে পারছে না। সিফাত একবার ফিরে এলে কি হয়? মিথির কান্না পাচ্ছে খুব। কিন্তু সে কাঁদল না। মানছে সে ভুল করেছে তার জন্য ক্ষমাও তো কম চায়নি। একবার কি ক্ষমা করে দেওয়া যেত না?
মিথি জোরে একটা নিশ্বাস টেনে নিজেকে শক্ত করলো। আর কাঁদবে না সে। সে যেমন অন্যায় করেছে তেমনি অন্যায়ের প্রায়শচিত্তও করেছে। এখন আর পারবে না। আর খুঁজবে না সে সিফাত কে। যদি ভাগ্যে থাকে তবে একদিন অবশ্যই তাদের আবার দেখা হবে।
.
বাসায় এসে প্রথমে ফ্রেশ হয় মিথি। তারপর খাবার টেবিলে বসে কিছু খেয়ে নেয়। আমিরা বেগম একটু শুয়েছেন, আর মাহি টিভি দেখছে। মিথি এক পলক তাদের দেখে নিজের রুমে গেল। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুলগুলো বেঁধে নিল। তারপর আলমারি খুলে সিফাতের দেওয়া সে ডাইরিটা বের করলো। একটা কলম নিয়ে বসলো টেবিলে। ডাইরির মাঝখান পাতাটা বের করে লিখতে আরাম্ভ করলো,
‘প্রিয় সুখ,
এখনও তুই আমার কাছে আমার প্রিয় সুখ। আর আজীবন তাই থাকবি। আমার উপর তোর খুব রাগ, তাই না? রাগ দেখিয়েই তো অনেক দূরে চলে গিয়েছিস। আর এইদিকে যে আমি তোকে মিস করতে করতে ক্লান্ত সেটা কি একবারও বুঝিস তুই? তুই আমাকে একবার প্রমিস করেছিলি না, কখনো আমাকে একা ছাড়বি না। সারাজীবন আমার পাশে থাকবি। তুই বলেছিলি না, আমি কখনও কারো প্রেমে পড়লে তুই আমাকে সাহায্য করবি? তাহলে আজ কোথায় তুই। আজ কোথায় তোর এই ওয়াদা। আমার তো আজ তোকে প্রয়োজন। এত এত কথা জমেছে তোকে বলার জন্য। কে শুনবে এগুলো? তুই ছাড়া আমি আর কাকে বলবো দোস্ত? প্লীজ একবার চলে আয়। একবার ক্ষমা করে দে আমায়। আমি তো এখনও ভালোবাসি। আগের মতো ভালোবাসি। আর আজীবন বাসবো।
ইতি,
তোর অপ্রিয় সুখ’
ডাইরিটা বন্ধ করে সেটা কিছুক্ষণ বুকে জড়িয়ে বসে থাকে মিথি। পুরোনো স্মৃতিগুলো বার বার এসে হানা দেয় তার মস্তিষ্কে।
শুক্রবারের এক সকাল। দশটায় মিথির একটা কোচিং ছিল। সিফাতও পড়ত সেই কোচিং এ। মিথি প্রতিদিন তাড়াতাড়ি কোচিং এ আসলেও সিফাত রোজ লেইট করতো। তবে সেদিন সে লেইট করেনি। বরং মিথির আগেই সে কোচিং এ চলে এসেছিল। মিথি কোচিং এ এসে সিফাতকে দেখে ভীষণ অবাক। সিফাতকে অন্যরকম লাগছে আজ। কালো পাঞ্জাবীটা বেশ ভালোই মানিয়েছে তার গায়ে। মিথি হেসে তার পাশে বসতে বসতে বললো,
‘কি রে আজ তো একদম জামাই সেজে চলে এসেছিস? ব্যাপার কি, বিয়ে টিয়ে করবি নাকি?’
সিফাত মুচকি হেসে বললো,
‘বিয়ে করবো না। তবে বিয়ের ব্যবস্থা করে যাবো।’
মিথি অবাক হয়ে বলে,
‘বিয়ের ব্যবস্থা মানে?’
সিফাত এদিক ওদিক তাকিয়ে আস্তে করে বললো,
‘মৃদুলাকে আমার পছন্দ। ভাবছি আজ ওকে প্রপোস করবো।’
মিথি ব্রু কুঁচকে হতভম্ব চোখে চেয়ে রইল সিফাতের দিকে। সিফাত একজনকে পছন্দ করে, তাকে প্রপোস করার প্লেনিংও করে ফেলেছে অথচ সে কিছু জানেই না। মিথির হঠাৎ খুব অভিমান হলো। সে কিছু না বলেই অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে বসলো। সিফাত মিথির কাঁধে হাত রেখে বললো,
‘কি হয়েছে দোস্ত? তুই মন খারাপ করছিস কেন?’
মিথি কোনো জবাব দিল না। সিফাতের দিকে তাকালও না। পরে স্যার চলে আসায় সিফাতও আর কিছু বলতে পারেনি।
মিথি তখনও বুঝেনি তার এই ছোট্ট অভিমানটা একদিন তাদের বন্ধুত্ব ধ্বংসের কারণ হয়ে দাঁড়াবে।
মিথি চোখ বুজে ছোট্ট একটা ঢোক গিলে। তারপর উঠে গিয়ে ডাইরিটা আলমারিতে রেখে আসে। একটা বই নিয়ে বিছানায় হেলান দিয়ে বসে। রাদিত স্যারের পড়া এখনও অনেক বাকি। বেটা আজকে এসেও চিল্লা ফাল্লা করবে। উফফ, মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে এর মুখে স্কস্টেপ দিয়ে বসিয়ে রাখতে।
বিকেলের দিকে রাদিত এলো। মিথি চেয়ারে বসতে বসতে খেয়াল করলো রাদিত স্যারকে আজ একটু অন্যরকম লাগছে। সব সময় যেমন ফর্মাল ড্রেসআপে থাকেন, আজ তেমন ফর্মাল ড্রেসআপে আসেন নি। কালো রঙের একটা টি শার্টের উপর অ্যাশ কালারের একটা শার্ট। চুলোগুলো আজ অন্যদিনের মতো গুছানো না। কেমন এলোমেলো। ব্যাপার কি? কালকে বিয়ের কথা বলায় কি আজ উনি এইভাবে এসেছেন। উনি যে এখনও যথেষ্ট ইয়াং আছেন সেটাই প্রমাণ করতে চাইছেন নাকি? যাকগে সেসব, উনি জোয়ান না বুড়ো সেটাতে মিথির কিছু যায় আসে না। মিথি ব্যাগ থেকে খাতা বের করতে করতে বললো,
‘স্যার, সবগুলো অংক পারিনি।’
রাদিত বললো,
‘সমস্যা নেই। দাও আমি করিয়ে দিচ্ছি।’
মিথি যেন ঝটকা খেল। হা করে রাদিতের দিকে তাকাল। রাদিত ব্রু কুঁচকে বললো,
‘কি হলো? এইভাবে তাকিয়ে আছো কেন?’
মিথি অবিশ্বাস্য কন্ঠে বললো,
‘আপনি আমার উপর চিল্লাবেন না স্যার?’
রাদিত স্বাভাবিক গলায় বললো,
‘না চিল্লানোর কি আছে? অংক না পারতেই পারো। সবাই তো আর সব পারে না। তুমি পারো না বলেই আমাকে রাখা হয়েছে শিখিয়ে দেওয়ার জন্য। নাও এবার বের করো অংকগুলো।’
মিথি মনে মনে খুশি হয়ে বললো,
‘বাহ, স্যার তো খুব ভালো মানুষ হয়ে গিয়েছে।’
.
.
প্রায় এক ঘন্টা রাদিত পড়াল মিথিকে। মিথি যখন বই খাতা গোছাচ্ছিল হঠাৎ রাদিত বলে উঠল,
‘আজ নৈরিথের সাথে দেখা হয়েছিল মিথি।’
মিথি চমকে উঠে রাদিতের দিকে তাকাল। সে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে আবারও বললো,
‘ছেলেটা কিন্তু বেশ ভালো। কথা বলে যা বুঝলাম আরকি।’
মিথি অবাক কন্ঠে জিগ্যেস করলো,
‘আপনি স্যারকে কিভাবে চিনেন?’
রাদিত বাঁকা হেসে বললো,
‘চিনি কোনো এক ভাবে।’
কথাটা বলেই সে উঠে পড়ল। মিথি আর দ্বিতীয় কোনো প্রশ্ন করার সুযোগ পেল না। মিথির মনে এই স্যারকে নিয়ে এক গাদা সন্দেহ এসে হানা দিল। এই স্যার আর তার মা দুইজনের মাথায় ই কিছু একটা চলছে। কিন্তু সেটা কি?
চলবে..