#তোমাতে
লেখনীতে~আগ্নেস মার্টেল
/পর্ব ১০/
বাসার পরিবেশটা আজ উৎসবমুখর। ভাইয়া দুপুরের পর অফিস ছুটি নিয়ে কেজি কেজি মিষ্টি এনেছে। আপু সেগুলোর গোটা কয়েক আমাকে জোর করে গিলিয়েছে। সাথে মাথায় কয়েক গাট্টা মেরে বলেছে, “মান রাখলি তাহলে! আমি তো ভাবলাম রেজাল্ট ভাল করলেও মেডিক্যালে চান্স পাবি না!”
মুখ মুছে রেগে তাকাই। আপু আরও ঠেসে কয়েক মিষ্টি খাওয়ায়। বিরক্তিতে কয়েক কিল ঘুষি বসালাম। আপু সেগুলোকে উড়িয়ে চলে গেল নিজ রুমে। উৎসবমুখর হওয়ার আরেকটা কারন মামাদের পরিবার। লস এঞ্জেলস থেকে রওনা হয়েছেন। রেনু খালার এখন একবিন্দু স্থিরতা নেই। এখানে ওখানে ছুটোছুটি করছেন, রান্না বান্নার ঝক্কিঝামেলা একাহাতে সামলাচ্ছেন। ভাইয়া মিষ্টি বিলাতে ব্যস্ত। ফোন চেক করলাম। কল আসেনি। উনার ফোনটাও বারবার ব্যস্ত বলছে। তিনি একবার শুধু শুভেচ্ছা মেসেজ করেছেন। ফোন করেননি। আজকাল ভীষণ ব্যস্ত তিনি। প্রায়ই ফোন করে শুনি তিনি অটিতে যাচ্ছেন। নয়ত মাত্র বেরলেন। মনে হল জিসান ভাইদের বাসায় গিয়ে বলে আসি। ভাইয়া হয়ত বলেছে! নিজে আবার বলতে দোষ কি?
আন্টি যত্ন করে বাসায় বসালেন। আঙ্কেল ছিলেন। মানুষটা হাসোজ্জ্বল। কুশলাদি শেষে খোজ খবর নিলেন। শুভেচ্ছা জানিয়ে হেলতে দুলতে রুমে চলে গেলেন। রুমের দিকে উঁকিঝুকি দিয়ে জিজ্ঞেস করি, “শিফা বাসায় নেই আন্টি?”
আন্টি কিছু শুষ্ক খাবার এনে হাতে দেন, “না মা। ওর এখন কোচিং হয়!”
বুঝদারের মতো মাথা নাড়ি। গল্প করতে করতে আন্টি একসময় বলেন উনারা বাসা চেঞ্জ করবেন! আমার মাথায় বাজ! হতবাক আমার ব্যাপারটা বুঝতে বেশ সময় লাগল। প্রায় হাহাকার করার মতো জিজ্ঞেস করি, “কেন?”
আন্টি স্নিগ্ধ হাসেন। গাল টিপে দেন। আন্তরিক কণ্ঠে বলেন, “জিসানের এখান থেকে যাওয়া আসায় সমস্যা হয়। ধকল পরে বেশি। তাছাড়া তোমার আঙ্কেল রিটায়ার নিয়েছে। ও চাচ্ছে গ্রামে চলে যেতে।”
বুকের ভেতর আর্তনাদের বিক্ষুব্ধ গর্জন শুরু হয়। তীব্র ভয়ে নিজেকে খাপছাড়া পাগল পাগল মনে হতে থাকে। ভয়ার্ত সে ভাব আন্টি যেন না বুঝেন তাই মাথা নিচু করি। ম্লান কণ্ঠে বলি, “শিফা? ওর সমস্যা হবে না?”
“ওকে ওর কলেজ হোস্টেলে রাখব। কষ্ট না করলে জীবনে কিছু শেখা যায়?”
গল্প আর জমে না। আমি একসময় বাহানা দেখিয়ে উঠে পরি। নিষ্প্রাণ পায়ে সিড়ি বেয়ে নেমে আসি। রুমে এসে কিছুক্ষণ পড়ার টেবিলে বসে রইলাম। মন টিকল না। গাল ফুলিয়ে রুমের জানলার পর্দা টেনে দিলাম। বিছানায় এসে বালিশ জড়িয়ে বসে পরি। অনুভূতিদের গোমট দমবন্ধ অবস্থায় একা যুদ্ধ করতে থাকি। এত খুশির খবর উনাকে বলে বাড়াতে না পেরে কান্না পাচ্ছে। আর ঐ খবরটা! আগ বাড়িয়ে না গেলেই হয়ত ভাল হত। রুমটা পুরো অন্ধকার। কানে ইয়ারফোন গুজি। দেয়ালে হেলান দেই। গান শুনতে থাকি। সবগুলোই উনার গাওয়া। ভিন্ন ভিন্ন সময়ে পাঠানো। কখনো আবদারে পাঠিয়েছেন, কখনো অভিমান ভাঙাতে। কিছু ভয়েস মেসেজ, কিছু রেকর্ডিং। দেয়ালে হেলান দিয়ে দীর্ঘ এক শ্বাস ফেলি। মুগ্ধকর কণ্ঠের আবেশে চোখের কোল ছাপিয়ে তপ্ত ফোটারা গাল গড়ায়।
সন্ধ্যে নাগাদ আমাদের কলিং বেল বেজে উঠে। আমি তখন উদাসমুখে সোফায় বসে। টিভিতে মুভি দেখছি। আশপাশে কাউকে না দেখে নিজে উঠে গেলাম। দরজা খুলে চিৎকার করে উঠি! এতদিন পর প্রিয় মুখগুলো দেখে আনন্দে আত্মহারা আমি এক মুহূর্তে ভুলে যাই সব। ঝাপিয়ে পরি মামীর ওপর। মামী কিছুটা পিছিয়ে যান। দুহাতে জড়িয়ে পিঠে হাত বুলোতে বুলোতে বলেন, “কি দারূণ রেজাল্ট করেছিস ঝুম। মেডিক্যালেও চান্স পেয়েছিস! বাহঃ আমার মা’টা লাখে একটা!”
তিয়াস ভাইয়ার কণ্ঠ আসে, “তোমার ছেলেও লাখে একটা।” মামী ভাইয়ার দিকে তাকায়, “প্রত্যেকের ব্যাগ ধরে আছি! লাখে একটা না? ভাই রে, দরজা ছেড়ে আনন্দ যাপন কর। ব্যাগ ধরতে ধরতে হাত ব্যাথা হয়ে গেল!”
আমি মৃদু হাসিতে সরে দাঁড়াই। নানাকে পা ছুয়ে সালাম করি। তিনি আমার থুতনি ধরে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলেন। কি যেন বিরবির করলেন। বুঝিনি। চোখে মুখে তৃপ্তির ছোয়া পরখ করেছি শুধু। বাসায় হট্টগোল পরে গেল। মামীর কথা, রেনু খালার বাঁশ গলা, সাদ ভাইয়া আর মামার গুরু গম্ভীর কথোপকথন, তিয়াস ভাইয়ার জোরালো কণ্ঠে মন খারাপেরা কিছু সময়ের ছুটি দেয়। বিল্ডিংয়ের একতলা আর দোতলা আমাদের দখলে। আমাদের ফ্ল্যাটের ভেতরে দোতলায় যাওয়ার আরেকটা সিড়ি আছে। আমাদের গল্প চলছিল সে সিড়িতে বসে। তিয়াস ভাইয়া সামনে বসে। আমি আপু তার মুখোমুখী। ভাইয়া কখনো বিরক্ত, কখনো কৌতুকপূর্ণ মুখভঙ্গিতে উনার বিদেশি গফদের কাহিনী বলছে। আমি আর আপু প্রায় সময়ই হেসে লুটোপুটি খাচ্ছি। বিশেষ করে ভাইয়ার বলার ধরনটা! গল্প হাস্যকর না হলেও ভঙ্গিমায় হাসি এসে যায়। হৈ চৈ চলল অনেক রাত অবদি। আমাদের আড্ডা ভাঙে মামীর ধমকে। রাত নাকি অনেক হলো। অনিচ্ছেয় ভঙ্গ হলো আড্ডা। রুমে এসে দরজা আটকে লাইট জ্বাললাম। পেছন ফিরে চমকে উঠলাম। জিসান ভাই ক্লান্ত হাসেন। চেয়ার ছেড়ে দাঁড়ান। উনাকে দেখে মনকোণে আবার মন খারাপেরা ভিড় জমায়। কান্নার দমানোর চেষ্টায় ঠোঁট কাঁপতে শুরু করে। তিনি বিস্মিতচোখে তাকান। দ্রুত দুরত্ব কমিয়ে উনাকে জড়িয়ে ধরি। হাউমাউ করে কাঁদতে থাকি। উনি আমায় বুকে চেপে ধরেন। কিছুক্ষণ পর মুখ তুলে কপালে আলতো ঠোঁট ছোয়ান। চোখ মুছিয়ে বলেন, “কাঁদছিস কেন এভাবে?”
আমি ফোঁপাতে ফোপাঁতে বলি, “জিসান ভাই আপনার চাকরি হয়ে গেছে তবু আমাকে কেন বিয়ে করছেন না?”
তিনি ধমকান, “থাপড়াব, ভাই লাগি তোর?”
চমকে আরও কাঁদতে থাকি। এবার চোখের পানির থেকে মুখ চলছে বেশি। যত না কাঁদছি তার থেকে বেশি কান্নার শব্দ তুলছি।
“মহা যন্ত্রণায় পরলাম তো। তোর পুরো পরিবার ছুটে আসবে শব্দে!”
“আসুক। এসে কেলেংকারী হয়ে গেছে ভাবুক। ভেবে গ্রামের মানুষদের মতো বিয়ে দিয়ে দিক।”
তিনি এবার হাসতে থাকেন। আমি ভেজা চোখে মুখটা দেখি। বুকটা শীতল সুখব্যাথায় জুড়িয়ে যায়। তিনি চোখ দুটো আলতো হাতে মুছে দেন। চোখের পাতায় ঠোঁট ছুয়িয়ে দুহাত কোমড়ে আবদ্ধ করেন। টেনে কাছঘেষে দাঁড় করেন। গাল টেনে বলেন, “চাকরি হয়েছে অর্থই কি বিয়ে? আমার এখনো বিসিএস বাকি। নিজে ঠিকঠাক প্রতিষ্ঠিত হই পরে তোকে বিয়ে করব। নইলে সংসার চলবে কি করে? আবেগে ভেসে ভেসে বাস্তবতার শক্ত ছোবল সামলানো যাবে? বরং তাতে নিংড়ে আরও নিঃস্ব হব। অভাবে না সম্পর্ক টিকবে না সুখ।”
আমি অসহায় চোখে তাকিয়ে থাকি। অভিমানী কণ্ঠে বলি, “আপনারা নাকি বাসা চেঞ্জ করবেন?”
তিনি কিছুক্ষণ কপালে ভাজ ফেলে কিছু ভাবেন। বলেন, “এমন কিছু ভাবা হচ্ছে।”
গাল ফোলাই, “কই আগে তো সমস্যা হয়নি! দিব্যি আসা যাওয়া করেছেন!”
“আগে কি আর নাইট ডিউটি ছিল? গতদিন ভোর বেলায় ফিরতে গিয়ে ক্লান্তিতে এক্সিডেন্ট করে ফেলছিলাম। একদিন ছিনিতাই হলো। মা তাই চাইছে না এতদূর..”
কান্না এবার থেমে গেল বিস্মিত কণ্ঠে বললাম, “এসব আমাকে বলেননি তো?”
“তোকে বাড়তি চিন্তায় ফেলতে চাইনি। পড়ার চিন্তায় এমনিতেই শুটকি হয়ে গেছিস।”
ছোট্ট এক শ্বাস ফেলে রুমের এদিক ওদিক তাকাতে শুরু করি। উনি বলেন, “কি খুজছিস?”
জবাব দেই না। কাঙ্ক্ষিত জিনিসটা চোখের সামনে না পেয়ে একসময় অসহায় মুখে বলি, “আপনার কাছে টিস্যু আছে?”
“না কেন?”
“নাক মুছব।”
উনি কিছু বলার আগেই উনার টি-শার্টটা টেনে পরপর দু-তিনবার নাক মুছে নিলাম। তিনি নাক-মুখ কুচকে তাকিয়ে থাকেন। আমি সরলমুখে হাসি। তিনি কিছু বলতে আবার মুখ খুলেন সে সময় রুমের দরজায় কেউ কড়া নাড়ে। দুজনেই চমকে তাকাই। তিয়াস ভাইয়ার কণ্ঠ আসে, “কার সাথে কথা বলছিস ঝুম?”
~চলবে❤️