#তোমাতে
লেখনীতে~আগ্নেস মার্টেল
/পর্ব ১৩/
নেহা আপুদের বাড়ি দোতলা। তার চারদিক ঘেরাও করে পাঁচিল তুলে দেয়া। ভেতরে বাগান। রঙ বেরঙের ফুলগুলো থোকায় থোকায় এখানে সেখানে ফুটে আছে। ঢোকার রাস্তা ইটের। কোমল বাতাসে উপরের দিকে তাকাই। মনে হলো কেউ দ্রুত সরে পরল। অদ্ভুত! আমাদেরকে বসার রুমটায় বেশ আপ্যায়ন করে বসালো। ঢোকার সময় আমাকে তীব্র লজ্জায় পরতে হয়েছে। গোল গাল চেহেরার এক আন্টি আমাকে দেখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। সবাই যখন ভেতরে ঢুকছি তিনি আমার দিকে সরে আসেন। থুতনি ধরে বলেন, “তুমি রাধিকার বিয়েতে গেছিলে না?”
কিছু না বুঝে মাথা নাড়লাম। তিনি মিষ্টি হাসলেন। আরও দৃঢ় চোখে পর্যবেক্ষণ শুরু করলেন। আমার পরিবার তখন কিছুদূরে দাঁড়িয়ে। তিনি বললেন, “সেদিন তোমাকে ইফাজের পেছনে ঘুরঘুর করতে দেখেছিলাম।”
বজ্রাহত হই। চোখ পিটপিট করতে থাকি। লজ্জায় মাথা নুয়িয়ে প্রমাদ গুনি। ছিঃ আমার পরিবার কি ভাববে! এই আন্টিরই বা আক্কেল কি! এত মানুষের মাঝে কেউ এ কথা বলে? উদ্ধার করল জাদরেল আপুটা। এগিয়ে এসে কাধে হাত রাখল। বলল, “বয়স কম। আবেগ বেশি। ভাললাগা আকসার হয়েই যায়!”
আন্টি তবু নিভলেন না। তৃপ্তচোখে চেয়ে রইলেন। বিভ্রান্ত হলাম। সাথে ক্ষুব্ধ। এই ইফাজও জিসান ভাইয়ের কাজিন!? নানু, মামাও ছিলেন। লজ্জায় আর তাকাতে পারছিলাম না। মনে হচ্ছিলো আমাকেই দেখতে এসেছে। আমার একপাশে মিশেল আপু আরেক পাশে তিয়াস ভাইয়া বসেছে। ভাইয়া ফোন পকেটে রেখে খোচা মারল। রেগে তাকালাম। সে হাসে, “এমন লজ্জা পাচ্ছিস কেন? ফ্রি হ। আবেগে ভাসা কমন ব্যাপার। বাবা, দাদা কেউ তোকে পরখ করছে না। কেউ বসেও নেই!”
কথায় একটু ভরসা পেলাম। আড়চোখে নানা, মামা’র দিকে তাকালাম। না কেউ আমার ব্যাপারে কৌতুহলী নয়। নিজেরা নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত। স্বস্থির এক শ্বাস ফেলি। কিন্তু জমাট বাধা অস্বস্থিরা ঠায় বসে থাকে। একসময় নেহা আপু আসে। ট্রে হাতে পেছনে প্রায় একই চেহেরার আরেক মেয়ে। উচ্চতায় নেহা আপুর তুলনায় কিছু খাটো। রংটা আপুর থেকে একটু বেশি ফর্সা। তাদের পরে শিফা। ভেতরের রুমগুলোতে উঁকিঝুকি দিলাম। মনে হচ্ছে নেহা আপুর সব আত্মীয়রা এ বাড়িতে একজোট হয়েছেন। আপুর কাজিনদের কাউকে অবশ্য এখান থেকে চোখে পরছে না। তিয়াস ভাইয়ার ফিসফিসানো কণ্ঠ এল, “ঐ আকাশি স্কার্ট পরা পিচ্চিটা তোদের ভাড়াটে না? সকালে ছাদে দেখেছিলাম। ভুতের মতো বর্ডারে পা তুলে বসে গুনগুনাচ্ছিল।”
চোখ মেলে সামনে তাকাই। আশপাশে দৃষ্টি ঘুরতে ঘুরতে কিছুদূরে গিয়ে থামে। আমার দৃষ্টি সুচালো হয়। বলি, “হ্যা কেন?”
ভাইয়া ফিচেল হাসে। উত্তর দেয় না। সন্দিহান কণ্ঠে বলি, “জিসান ভাই যে আমাদের বিল্ডিংয়ে থাকেন এটা জানিস?”
“জানব না কেন? এটাও জানি তোর রুমে প্রায় প্রতিদিন আসে।”
আমি ভেবাচেকা খেয়ে গেলাম। ভাইয়া যেন মজা পেল। বলল, “কি রে তুই! আমার দুই ফ্রেন্ডের পেছনেই লেগেছিস! মনে হচ্ছে দুইটার মাথাই খেয়েছিস! কি দেখল তোর মধ্যে? শুটকি মার্কা চেহেরা, হাসলে শুধু দাঁত দেখা যায়, গায়ের রঙ জন্ডিসের রোগীর মতো এরকম কাউকে কারোর পছন্দ হয়!?”
রেগে গেলাম। ভাইয়ার বাহুতে কয়েক ঘা মারতে লাগলাম। ভাইয়া হেসে সেগুলো প্রতিহত করছিল।আপু পাশ থেকে চিমটি কাটে। হাত থেমে যায়। আপুর দিকে তাকালাই। আপু চোখ রাঙায়। গাল ফুলিয়ে হাত গুটিয়ে নিলাম। আপু কঠিনস্বরে ফিসফিসাল, “যেখানে সেখানে শুরু হয়ে যাস! অবস্থা বুঝিস না?”
নিরুত্তর বসে থাকি। একসময় অসহ্য লাগতে থাকে। চুপ করে এতক্ষণ সং হয়ে বসে থাকা যায়? পা ইতিমধ্যে ঝিনঝিন করছে! উনারা বিয়ের কথাতেও এখনো যাননি। না বর কনেকে আলাদা কথা বলতে পাঠিয়েছেন! শিফারা দূরে দাঁড়িয়ে ছিল। শিফার দৃষ্টি একসময় আমার ওপর পরল। হাসল। হাত নেড়ে কাছে ডাকলাম। ভাইয়া আবার ফিসফিসায়, “মেয়েটার নাম কি রে?”
আড়চোখে তাকালাম, “শিফা!”
ভাইয়ার চোখ বিস্ফারিত হল। গুঙিয়ে বলল, “ও শাফির ছোটবোন?”
সম্মতিতে মাথা নাড়ি, “কেন চিনিস না?”
ভাইয়া অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। শিফা কাছে এসে দাঁড়াল। রিনরিনে কণ্ঠে বলল, “কি হয়েছে আপু?”
একবার বড়দের দিকে তাকালাম। বললাম, “আমাকে একটু ওয়াশরুম দেখিয়ে দিবা?”
মেয়েটা সম্মতিতে মাথা নাড়ল। তিয়াস ভাইয়ার সাথে একবার চোখাচোখি হল। সৌজন্যমূলক হাসল। মনে হলো ভাইয়া বজ্রাহত হয়ে গেছে। আমি মনে মনে হাসলাম। ড্রয়িং রুমটা পেরিয়ে বললাম, “ঐখানে বড়দের ভিড়ে থাকতে থাকতে বিরক্ত হয়ে গেছি।”
“স্বাভাবিক। আমার বড় চাচা কথা শুরু করলে দুনিয়াদারী খেয়ালে রাখেন না।”
আশপাশ দেখতে দেখতে বলি, “পুরো পরিবার এসেছ তোমরা?”
“হ্যা।”
“জিসান ভাইও?”
শিফা ঠোঁট টিপে মাথা নাড়ল। ওর হাতে ব্যাগ ধরিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেলাম। বেরনোর সময় নিজেকে খুটিয়ে আয়নায় দেখি। লেহেঙ্গাই যা পরেছি। সেজে আসা হয়নি। কপালে লেহেঙ্গার রঙ মিলিয়ে টিপ! এটুকুই। এতে আন্টিটার ওমন গলিত দৃষ্টি পরবে আদো? ভাবনা ঝেরে ফেলি। আমার কি! বেরিয়ে চমকে উঠি। জিসান ভাই কিছুদূরে ওয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে। ফোন টিপছেন। হাতে আমার ব্যাগ। দরজা খোলার শব্দে মুখ তুলে তাকালেন। বিস্ময়ে আশপাশে তাকাই। শিফা নেই। উনার স্থির দৃষ্টিতে হালকা ঢোক গিললাম।
“এটা কি পরেছিস? এদিক ওদিক হলেই ওড়নার নিচে কোমড় উঁকি দিচ্ছে!”
বিস্ময়ে কোমড়ের দিকে তাকাই। ঠিকই তো আছে। ব্যাগটা নিতে গেলাম। তিনি ব্যাগধরা হাতটা ওপরে তুলে দেন। তিনি উচ্চতায় আমার থেকে প্রায় এক ফুট বড়। হাতটা সামান্য একটু উঁচু করলেই জিনিসটা নিতে আমাকে লাফাতে হয়। আর এখন তো হাত সটান ওপরে তোলা! গাল ফুলিয়ে উনার দিকে তাকাই। তিনি একহাতে কোমড়ে চেপে আমাকে দেয়ালের দিকে হেলান দিয়ে নিজে সামনে এসে দাঁড়ান। চমকে যাই। ওয়াশরুমটা আলাদা। হয়ত কমন! যেখানে দাঁড়িয়ে আছি জায়গাটা খোলামেলা। ভয় লাগল। উনার হাতটা সরাতে গেলাম তিনি আরও শক্ত করে চেপে ধরেন। আফসোস হলো এত কেন হেংলা হলাম! আরেকটু মাংস থাকলে হয়ত শক্তিতে উনাকে টেক্কা দিতে পারতাম।
“তোকে শাড়ি পরতে বলেছিলাম!”
চঞ্চল দৃষ্টিজোড়া এদিক ওদিক ঘুরতে থাকে। অচেনা পরিবেশে কেউ একবার এভাবে দেখে ফেললে? হাত দিয়ে মৃদু ধাক্কা দিলাম উনাকে। উনি টললেন না। বরং আরও ঝুকে আমার সামনের চুলগুলো এক আঙুলে প্যাচিয়ে খেলতে লাগলেন। ত্যক্ত কণ্ঠে বললাম, “সরুন। কেউ এসে পরলে খারাপ হবে!”
উনি কুটিল হাসেন। আমার সেদিনের ডায়লগটা রিপিট করেন, “আসুক। এসে ভাবুক কেলেংকারী হয়ে গেছে। ভেবে গ্রামের মানুষদের মতো বিয়ে দিয়ে দিক।”
চোখ পাকিয়ে তাকাই। তিনি ঠোঁট টিপে হাসেন। দৃষ্টিজোড়া আমার ঠোঁটে নিবদ্ধ। কেঁপে উঠে ধাক্কা দেই, “এটা আমাদের বিল্ডিংয়ের রুম বা ছাদ না! সরুন।”
“রোমান্সের স্পেশিফিক জায়গার দরকার হয় না।”
“পাগল!? এটা খোলামেলা জায়গা!”
ফিচেল হাসেন, “খোলামেলা না হলে কি অংশগ্রহণ করতি?”
“আপনার মুখের লাগাম দিন দিন বাজেভাবে খুলে দিচ্ছেন।”
“বাজের কি দেখলি প্রিয়া
এখনো ডাকিস জিসান ভাইয়া!”
আমি খিলখিলিয়ে হাসি। তিনি গালে টোকা দেন, “এটা কি পরে এসেছিস?”
“সরুন। উত্তর দিচ্ছি।”
“আমার মন আগেই নষ্ট করেছিস। তুই সামনে থাকলে এখন শুধু উদ্ভট ইচ্ছে জাগে। এক মিনিটও শান্ত থাকতে দেয় না। মন মস্তিষ্ক অকেজো করে যে বিন্দু পরিমাণ চিন্তাশক্তি রাখলি তাও কেড়ে নিতে চাস?”
কণ্ঠে মাদকতা আর চোখে অদ্ভুত সম্মোহন। উনার কণ্ঠ ক্রমশ ধীর হচ্ছিল। ফিসফিসিয়ে মুখ নিচু করছিলেন। আমি ভয়ে চোখ বড় বড় করে তাকাই। তিনি লাপাত্তা। ঠোঁট যখন ছুইছুই অবস্থা এমন সময়ে শিফার বিস্মিত কণ্ঠ আসল, “ভাইয়া!”
দুজন ছিটকে সরে যাই। থতমত খেয়ে সামনে তাকাই। শিফা আর নেহা আপুর ছোট বোনটা দাঁড়িয়ে। মেয়েটি ঠোঁট টিপে হাসছে। আর শিফা চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। লজ্জায় মাথা নুয়িয়ে দ্রুত জায়গা ত্যাগ করলাম। পেছন থেকে শিফার বিস্মিত কণ্ঠ আসতে থাকল, “কি করছিলি ভাইয়া?”
জিসান ভাইয়ের ত্যক্ত কণ্ঠ, “কিছু আর করতে দিলি? বড় হয়েছিস বুদ্ধিসুদ্ধি মাথায় ধর কিছু।”
লজ্জায় মন চায়ল মাটি ফুড়ে ক্ষণস্থায়ী অক্সিজেনযুক্ত কবরে ঢুকে যাই। মুড সুয়িংয়ে যখন সেখানে থাকার ইচ্ছে চলে যাবে আবার এই মাটির ওপর চলে আসব। কিন্তু হায়, আমার কাল্পনিক ইচ্ছে আর পূরণ হয় না!
~চলবে❤️
[প্যাচ প্যাচ করেন কেন! আমার মতো অকর্মার কাছে প্যাচ আশা করেন? হায়, প্যাচ দিলে নিজেই প্যাচ খোলার রাস্তা পাই না উল্টায় থাকি!💀]