#তোমাতে
লেখনীতে~আগ্নেস মার্টেল
/পর্ব ২/
জুতো খুলে বাসায় ঢুকি। আপু সূচালো দৃষ্টিতে তাকিয়ে। বললাম, “কি? এভাবে তাকিয়ে আছিস কেন?”
“তোর লজ্জা বলতে কিছু নাই?”
“কেন?”
মিশেল আপু টিভির দিকে মুখ ঘুরিয়ে নেয়, “পুরো বিল্ডিং জানল তুই যে ইফাজকে চিঠি দিয়েছিস! আক্কেল বলতে কিছু নাই নাকি? সিড়িতে দাঁড়িয়ে বাঁশ গলায় কুকুরের মতো ঘেউ ঘেউ করিস!”
ইস, আমি ভুলেই গেছিলাম আমাদের অবস্থান। মনে থাকলে মোটেও এত জোড়ে কথা বলতাম না। আচ্ছা আন্টি কি শুনেছে কথাগুলো? ভাবতেই চোখ খিচে বন্ধ করি। শুনলে কি বেয়াদবটাই না ভাবছে! শান্তি এই আঙ্কেল বাসায় নেই। নইলে লজ্জায় আর ওমুখো হতে পারতাম না। বই ডাইনিং টেবিলে রেখে এসে সোফায় আপুর কাছ ঘেষে বসলাম। আপু বিরক্তচোখে তাকাল। দাঁতালো হাসলাম। আপু সন্দিহান চোখে বলে, “কি ব্যাপার? এমন চিপকে বসেছিস কেন!?”
আমি মধুর হাসি দেই। আমার টাটকা হাসিতে আপুর ভ্রু কুঞ্চিত হলো। বিরক্ত লাগে কিছুটা। সব কিছুতেই কেমন সন্দেহ করে। তবু মুখটা আগের মতো করে টেনে টেনে বলি, “আপু তুই না বায়ো কেমিস্ট্রি নিয়ে পড়ছিস?”
আপু দূরে সরে বসে বলে, “হ্যা তো?”
“না মানে তুই নিজেই তো আমাকে পড়াতে পারিস। কলেজ, স্কুলে কি মাগনা মাগনা পাশ মার্ক উঠেছে! তোর ছোট বোনকে মাঝে মাঝে পড়াতে ইচ্ছে হয় না?”
আমার আশাময় চোখ দু’টোয় আপু বিরক্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। মুখের ওপর বলে, “কখনোই না। তুই যা বাঁদর। পড়াতে গেলে উলটো আমাকে দ্বিতীয়বার ইন্টার বোর্ড পরিক্ষায় বসতে হবে!”
আশার প্রদীপ নিভে গেল। তবু হাসি টেনে আপুকে মানাতে যাচ্ছিলাম এসময় কিছুদূরে টুলে বসা রেনু খালার ওপর চোখ পরে। তিনি টিভি দেখে দেখে সবজি কাটছেন। আমার সাথে চোখাচোখিতে পালটা মধুর হাসি দিলেন। ফিকে হল আমার হাসি। উনি মুখ খোলা অর্থই আমার সর্বনাশ! বললেন, “আম্মা কি আকাম কইরা আইছ আবার?”
আমতা আমতা করে বলি, “কোন আকামই করি নাই খালা।”
“তোমার মতিগতি তো ভালা না। এমনেই কর ফেল। তার মধ্যে মাস্টুরে চেতাই আইছ। পাশ করবা কেমনে! মাস্টুর বন্ধুর লগে প্রেম করবা কইয়া আইলা শুনলাম। সাহস তো কম না! আবার এই মাস্টুরে ছাড়ানোর মতলব নাই তো?” অসহায় মুখে তাকিয়ে থাকি। তিনি মিশেল আপুর দিকে তাকান, “সাবধান মিশেল আম্মা, এই কাজ কোনদিনও করবা না। আমি হেদিন শাহানা আপার কাছ থেকে শুইনা আইছি। পোলা আমগর এক’এ। শাফিরে ছাড়লে ওর মতো মাস্টু আর পাইতা না।”
আমার মুখটা ফ্যাকাশে হল। আপু চোখ বড় বড় করে আমার দিকে তাকায়। মুখ ফিরিয়ে নেই। গাল ফুলিয়ে চিন্তা করতে থাকি খালাকে আমি চার পাঁচবার স্যাতস্যাতে কুয়োর মধ্যে ফেলছি আর তুলে আনছি দড়ি দিয়ে! আপু বলল, “ছাড়ানোর প্রশ্নই আসে না খালা। এ মেয়ে প্রত্যেকবার ফেল করে।”
জ্বলে উঠলাম, “কই প্রত্যেকবার ফেল করি! সিটিতে গতবার শুধু পাশ মার্ক উঠাতে পারিনি এই যা!”
খালার সবজি কাটা শেষ। সব উঠিয়ে নিয়ে যেতে যেতে দাঁতালো হাসেন। বলেন, “পরিক্ষা হইল পরিক্ষা। ছিটি মিটি সব এক বুঝছ সোনা? নইলে করিম ভাইয়ের লাগান ড্রাইভারি করতে হইব হারাজীবন!”
বিরক্ত অসহায় আমি চোখ-মুখ শক্ত করে রুমে এসে গেলাম। রাতে সাদ ভাইয়াও প্রস্তাব নাকচ করল। মামা’কে ফোন করে ঘ্যানর ঘ্যানর করলাম। তিনিও ভাইয়ার সাথে একমত! আজ বাবা-মা থাকলে! ভাবলাম হবু ভাবীকে দিয়ে কাজ চালাব। কিন্তু ভাগ্যের কলকাঠি কখনোই আমার পক্ষে থাকে না। এবারও থাকল না। ভাবীও পারল না ভাইয়াকে বোঝাতে। পরদিন আমাকে যেতেই হবে তিনতলায়! দুঃখভারাক্রান্ত আমার ঘুম হলো না সারারাত। ভয়ে ধরফর করছে বুকটা। যে সাহসই দেখাই না কেন উনার কাছে কাল একা পড়লে ভর্তা হয়ে যাব!
ভোরের দিকে ঘুম এসেছিল। ঘুম ভাঙতে দেরি হলো। সকালের কোচিংও মিস গেল। ফ্রেশ হয়ে কলেজের জন্য একবারে রেডি হয়ে বেরলাম। শুনলাম সাদ ভাইয়ার অফিসে মিটিং আছে জরুরি। সে চলে গেছে। বললাম ঠিকাছে আমি একাই যেতে পারব কলেজে। কিন্তু রেনু খালা, আপুর গাইগুই একা ছাড়া যাবে না। বিরক্ত লাগল।
“তাহলে তুই দিয়ে আসবি আমাকে?”
মিশেল আপু মুখের ভাত পেটে চালান করে বলে, “মাথা খারাপ? তোর কলেজ যেদিকে তার থেকে ঘুরতি পথে আমার ভার্সিটি।”
“তাহলে আমাকে একা ছাড়ছিস না কেন? কে দিয়ে আসবে?”
আপু উত্তর দেয় না। বিরক্তির চরমে পৌছে মাথা নিচু করে নিজ খাবার শেষ করি। মনে মনে জেদ ধরি একাই যাব। কত মেয়ে একা যাচ্ছে আসছে ওদের তো কিছু হয় না! ওদের পরিবার ছাড়ছেও আমার পরিবারই যত রাজা-বাদশার আমলে পরে আছে। ব্যাগ নিয়ে জুতো পরছি আপু রেডি হয়ে বেরিয়ে আসে। দরজা খুলেছে সবে ওপাশ থেকে জিসান ভাইয়ের কণ্ঠ এল, “মিশেল ঝুম রেডি?”
ফিতে বাধছিলাম। হাত থেমে গেল। আপুর বিগলিত উত্তর, “হ্যা রেডি।”
আমি হতবাক। উপরে তাকালাম। আপু নিচে তাকিয়ে বলে, “হাবার মতো বসে কেন। দ্রুত ফিতে বাধ। শাফির দেরি হয়ে যাবে!”
ফিতে বেধে উঠে দাঁড়াই। ভয়ে হাত-পা কাঁপছে। গলা শুকিয়ে আসতে চাইছে। রেনু খালা তখন টিফিন বক্স, পানির বোতল ব্যাগে ঢুকিয়ে দিচ্ছেন। কাঁপাকাঁপি দেখে বলেন, “কি হয়ছে আম্মা? এমনে কাঁপতেছ কেন?”
মাথা নাড়ি। আপু দরজার বাইরে থেকে ডাকে, “কই ঝুম?”
মৃদুকণ্ঠে বলি, “আ আসছি।” রেনু খালার দিকে ফিরি। করুণমুখে বলি, “খালা বিপদ আপদ যেন না হয় তার দোয়া করে দেও তো।”
খালা চোখ বড় বড় করেন, “কি কও আম্মা তোমার বিপদ হইতে যাব কেন?”
“আমার ভয় লাগছে খালা। দোয়া পড়ে ফু দিয়ে দাও।”
খালা চিন্তিত মুখে দোয়া পড়েন। মাথায়, পিঠে স্নেহময় হাত বোলান। কিছুটা সাহস ফিরে পাই। দরজার বাইরে এসে কিছুক্ষণ চোখ পিটপিট করি। জিসান ভাইয়ের চোখে চশমা, সাদা লং স্লিভ শার্টের হাতা গুটানো কনুই অবদি। ঝাকরা চুলগুলো নরম নরম লাগছে দেখতে। চারকোণা চশমাতে ব্রিলিয়ান্ট একটা ভাবও এসেছে মুখে। তবু এ ছেলেটিকে দারূণ লাগছে। আমিই হয়ত প্রথম কন্যা যে রণক্ষেত্রে যেতে যেতে শত্রুর ওপর ক্রাশ খেয়ে তব্দা মেরে আছি। উনার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি আমার ওপর এসে পরতেই চোখ সরিয়ে নিলাম। চুপচাপ আপুর পাশে পাশে বেরিয়ে এলাম। আপু বেরিয়ে এসে বলল, “কিসে যাবে তোমরা?”
“আমার বাইকে।”
“ও।” ঘড়ি দেখে, “আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে। তোমরা ভালমতো যেও। বাদরামি করবি না একদম।”
শেষের কথাটা আমাকে বলে আপু রিকশা ডেকে চলে গেল। গাল ফুলিয়ে অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে থাকি। জিসান ভাই একসময় ধমকে উঠেন, “কি হলো ধর।”
ভয় পেয়ে তাড়াতাড়ি তাকাই। তিনি হ্যালমেট এগিয়ে দিচ্ছেন। কাঁপা হাতে হ্যালমেট নিয়ে গুতাগুতি করছি। কিন্তু লাগাতে পারছি না। তিনি ছোট্ট শ্বাস ফেলে পেছনে ঘুরেন, বলেন, “এদিক আয়।”
বাইক স্টার্ট হলো। আমি উনার পিঠে হাত রাখতে গিয়েও বারবার সরিয়ে ফেলছি। দ্বিধা নিয়ে এরকম করতে গিয়ে উনি যখন ব্রেক চাপলেন পরে যাচ্ছিলাম। তিনি মুখ ঘুরিয়ে ধমকে উঠেন, “হচ্ছে কি ঝুম? সামনে এসে বসতে চাস?”
বিরক্তিতে নাবোধক মাথা নাড়ি। তিনি বলেন, “থাপড়ে গাল ফাটাব বেয়াদব! তাহলে ধরছিস না কেন? শেষে কোন না কোন গাড়ির তলে মরবি আর আমি জেলে যাই!”
সাহস যুগিয়ে কড়া জবাব দিলাম, “আমাকে আপনার মতো পেয়েছেন?”
ঝাঝালো কন্ঠে, “মানে?”
“আপনার অভিজ্ঞতা আছে মেয়েদের পিছে বসিয়ে। আমার আছে? ভাই, মামা বাদে আজ পর্যন্ত কারোর বাইকে উঠিনি। হেজিটেট লাগতেই পারে!”
তিনি তাকিয়ে থাকেন। গাল ফুলিয়ে আমিও তাকিয়ে রই। উনার মুখভঙ্গি হ্যালমেটের বাইরে থেকে আঁচ করা যাচ্ছে না। মুখ ফিরিয়ে একসময় বলেন, “কাধে নাহলে কোমড়ে শক্ত করে ধর! আমার দেরি হচ্ছে।”
মুখ বেকিয়ে, “জানি!”
“জানলে প্রয়োগ কর। বেয়াদব!”
আমি বাম হাতে ব্যাগ ধরে ছিলাম। ডান হাতে উনার কোমড়ের কাছের শার্টের অংশ শক্ত করে ধরলাম। তিনি বাইক স্টার্ট দেন। গতি বাড়ছে। এক সময় তিনি বাইক থেকে একহাতে সরিয়ে আমার ডানহাতটা টেনে উনার কোমড়ে জড়ালেন, বললেন, “আধিখ্যেতা পরে দেখাবি। মেইনরোডে তোর মামা-চাচারা শুধু গাড়ি চালায় না।”
হাতের টানে ধাক্কা খেলাম উনার পিঠে। ছেলেদের পার্ফিউম এর গন্ধ নাকে লাগল। কি মিষ্টি! মন চায়লো বেহায়ার মতো জিজ্ঞেস করি, “কি হে জিসান কি পার্ফিউম মাখিস তুই? ভুড়ভুড় করে যে সুগন্ধ ছাড়ছিস আমি না ফিট হই কিছুক্ষণ পর।” বলা হলো না। আমার লজ্জা লাগল। ঠোঁট টিপে হাসলাম। ফিট হবার চিন্তা থাকলেও সেই সুগন্ধটা বক্ষ পিঞ্জরে বেহায়ার মতো টেনে নিতে থাকলাম।
কলেজের মূল ফটকের বেশ দূরে জিসান ভাই বাইক থামান। অপেক্ষায় মূল ফটকে দাঁড়িয়ে নিসা তখন এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। আমাদের দেখে এগিয়ে আসতে গিয়েও থমকায়। সন্দিহান, সূচালো দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। ওকে দেখে বাইক থেকে নেমে যেই না দৌড়ে যাব বেনিতে টান পরল। ব্যাথাদায়ক শব্দ করে জিসান ভাইয়ের দিকে রাঙাচোখে তাকালাম। তিনি চুল ধরে রেখেই বলেন, “আমার বাড়ির কাজ করেছিস?”
“উঁউঁ জিসান ভাই আপনার দেরি হচ্ছে!”
“হোক। করেছিলি?”
উত্তর দেই না। নিসার দিকে অসহায় মুখে তাকাই। ওর চোখে বিস্ময়। তবু সেখানেই দাঁড়িয়ে। দূর থেকে ভেবলার মতো না তাকিয়ে একটু এগিয়ে আসলেও তো পারে! বেস্টফ্রেন্ডও পেয়েছি বলদা মার্কা!
“করিসনি না?” আমি ধরাপরা অপরাধীদের মতো হাসি। “দিয়েছিলাম দুবার লিখে আনতে। তোর কালকের তেড়ামি আর বাসায় যাওয়ার আগে যে বাদরামি করলি তাতে দশবার লিখে আমাদের বাসায় আসবি! নইলে আজকে মারের ওপর মার চলবে!”
কথা শেষে তিনি সজোরে টান দিলেন বেণিতে। ব্যাথায় চুলের গোড়া চেপে রেগে তাকালাম। তিনি বাইক স্টার্ট দিয়ে চলে গেলেন।
~চলবে❤️