তোমাতে বিলীন🍁
লেখিকা—আমায়া নাফশিয়াত ☘
পর্ব—|| ১১ ||
আশা এবার ভয়ে থরথর করে কাঁপতে লাগলো। সাহস দেখিয়ে তো বলে ফেলেছে এই কথা। এখন প্রমাণ করবে কী করে সেটাই ভাবছে সে!আর আশিয়ান যে নাছোড়বান্দা টাইপের ছেলে,, আজকে সত্যি সত্যিই মনে হয় জোর করে সুইসাইড করিয়েই ছাড়বে!আশার নিরবতা দেখে আশিয়ান একটা শয়তানি হাসি দিয়ে বললো;
আশিয়ান:-প্রমাণ দাও তুমি আমাকে ভালোবাসো!আমি মুখের কথায় নয় কাজে বিশ্বাসী।যদি তুমি সত্যি সত্যিই এই কাজ করতে পারো তাহলে আমি তোমায় বিয়ে করবো কথা দিলাম।তাই এই মুহুর্তে তুমি তোমার দুই হাতের কব্জির যে রগগুলো আছে সেগুলো কেটে আমাকে ভালোবাসার প্রমাণ দিবে।
আশা ভয়ে ঘামতে লাগলো এবার। সামান্য আঙ্গুলে একটা কিছুর গুতো লাগলেই চিৎকার চেঁচামেচি করে সে সারা বাড়ি মাথায় তুলে ফেলে সে। সেখানে কিনা ও সুইসাইড করবে! বড্ড অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে ব্যাপারটা!হাত পুড়ে যাওয়ার ভয়ে ভুলেও যে মেয়ে রান্নাঘর মারায় না সেখানে এই মেয়ে নিজে নিজে হাতের রগগুলো কেটে ফেলবে এটা কী মগের মুল্লুক নাকি!! আশা তোতলাতে তোতলাতে বলতে লাগলো;
আশা:-এ,,এসব,, তু,,মি,,ক,,কী বলছো আ,,আশিয়ান?আ,,আমি নিজের হ,,হাতের রগ,,কীভাবে ক,,কাটবো?
আশিয়ান:-কেন!যেভাবে সুইসাইড করবে বলেছো ঠিক সেভাবেই! এনা,,,(এনাকে জোরে ডেকে)
এনা জবাব দিলো;
এনা:-হ্যা ভাইয়া,,বলো!
আশিয়ান:-যা তো,, ধারালো দেখে একটা চাকু নিয়ে আয়!একদম বেশি ধারালো হবে এমন দেখে আনবি। যাতে এক পোঁচেই হাতের রগ আলাদা হয়ে যায়! (ঠোঁটে শয়তানি হাসির রেশ)
এনা:-আচ্ছা ভাইয়া,,,আনছি,,
এই বলে এনা রান্নাঘরে চলে গেল ধারালো চাকু আনতে।এবার আশা কাঁপতে কাঁপতে কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বললো;
আয়শা:-আ,, আশিয়ান,, প্লিজ,, এমন কিছু করো না। আমি সত্যি তোমায় ভালোবাসি। এরজন্য নিজের জীবন দিয়ে কী হবে?আমার কথা কী তোমার বিশ্বাস হয় না?
আশিয়ান ঘাড়ত্যাড়ামি করে উত্তর দিলো;
আশিয়ান:-না হয় না। আমি প্রমাণ চাই। প্রমাণ ছাড়া আমি মোটেই তোমার কথা বিশ্বাস করতে রাজি না।আর প্রমাণটা এক্ষুনি দিবে তুমি! নইলে আজ এই বাসা থেকে এক পাও বেরোতে পারবে না। সো ডিসিশান ইজ ইউরস,,,হয় হাতের রগ কেটে ভালোবাসার প্রমাণ দাও!আর নয়তো আমার পার্সোনাল লাইফে ইন্টারফেয়ার করা বন্ধ করো এবং আমার সামনেও আর কখনো আসবে না।
এমন সময় এনা চাকু হাতে ফিরে এলো। আশিয়ানের কাছে এগিয়ে এসে চাকুটা তার হাতে তুলে দিয়ে আগের জায়গায় চলে গেল। বাকিরা নিরবে কমেডি দেখছে। তাশজিদ, তাসকিন আর তাজিমের তো আশার ভয়ার্ত চেহারা দেখে পেট ফেঁটে হাসি আসছে।কিন্তু আশিয়ানের জন্য হাসতে পারছে না তারা।এদিকে চাকু দেখে আশার তো ভয়ে সেন্সলেস হওয়ার উপক্রম।নিজের জালে যে নিজেই এভাবে ফেঁসে যাবে তা কখনো ভাবতেই পারে নি বেচারিটা।আশার এ অবস্থা দেখে তারিনও ভয়ে ঘেমে যাচ্ছে। আশা যে কী পরিমাণ ভীতু তা এই পরিবারের সবাই জানে। ও যে জীবনেও হাতের রগ কেটে ভালোবাসার প্রমাণ দেবে না তা সবাই খুব ভালো করেই বুঝতে পারছে। তাই তো নিরবে উৎসুক হয়ে সবাই নাটক দেখে যাচ্ছে।
আশিয়ান:-হাতটা কী তুমি কাটবে নাকি আমি কেটে দিবো?কোনটা?
আশা জবাব না দিয়ে আশিয়ানের কাছ থেকে দুই পা পিছিয়ে গেল৷ ভয়ে ঘনঘন ঢোক গিলছে সে। চোখ দুটো যেন তার ঠিকরে বেরিয়ে আসবে মনে হচ্ছে। আশা পিছিয়ে যাওয়ায় আশিয়ান তার দিকে একপা এগোলো চাকু উঁচিয়ে ধরে খুন করার ভঙ্গিতে। আশার তো ভয়ে কলজের পানি শুকিয়ে গেছে পুরোপুরি। কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললো;
আশা:-আ,,আমাকে ছেড়ে দাও,,আশিয়ান। আম,,আমি আর জীবনেও তোমাকে ভালোবাসার কথা বলবো না!
আশিয়ান:-ওমা,,এখনো তো কিছুই করলাম না,, তাহলে এত জলদি পাল্টি খেলে কীভাবে?এটা তো ঠিক নয়। ভালোবাসার প্রমাণ তো দিয়ে যাও আশা,,।তুমি না আমাকে ভালোবাসাে?(ইনোসেন্ট ফেস করে আরেকপা এগিয়ে)
আশা আবারও পিছিয়ে গিয়ে বললো;
আশা:-স,,সত্যি বলছি,,আর কোনোদিনও তোমায় ভালোবাসি বলবো না,, এবারের মতো ছেড়ে দাও৷ তুমি যাকে ইচ্ছা তাকে বিয়ে করো আমার কোনো অসুবিধা নেই। কাছে এসো না প্লিজ। ও,,ওইটা নিয়ে দুরে যাও। আমার ভয় লাগছে।
আশিয়ান:-তুমি সুইসাইড করবে বলেছো তার মানে আজ তুমি সুইসাইড করবেই। কথার খেলাপ আমি পছন্দ করি না। হাত তো আজ তোমার কাটতেই হবে। তোমার ভয় লাগলে নো প্রবলেম আমি আছি কেটে দেয়ার জন্য। যতই হোক আমার কাটাকুটিতে প্রচুর এক্সপেরিয়েন্স আছে কিন্তু। মনে আছে তোমার,, এক বখাটে ছেলের হাত যে কেটে দিয়েছিলাম আমি! তোমার সামনে! মনে থাকার তো কথা! ঠিক এভাবেই তোমার দুই হাতের রগ আলগা করে দেবো। নো প্রবলেম সেন্সলেস হয়ে গেলে আমি নিজ দায়িত্বে তোমায় হসপিটালে এডমিট করে দেবো।(ডেবিলের মতো চাহনি দিয়ে)
আশিয়ানের কথাগুলো শুনে এমনিতেই সব সাহস ফুস করে হাওয়া হয়ে গেছে আশার। আর এভাবে গুণ্ডার মতো চাকু নিয়ে এগিয়ে আসার দৃশ্য দেখে তো তার হার্ট অ্যাটাক হয়ে যাবে মনে হচ্ছে। সে খুব ভালো করেই জানে যে আশিয়ান যা বলে তা করেই ছাড়ে। এই ছেলেটা যে কতটা জেদি তা আশাকে আর নতুন করে বলে দিতে হবে না। ভয়ে তার শিরদাঁড়া বেয়ে যেন ঠান্ডা পানির স্রোত বয়ে যাচ্ছে।
আশা:-আমার কসম আমি জীবনেও আর তোমার পিছে পিছে ঘুরবো না।কোনোদিনও আর ছেঁচড়ামি করবো না। পায়ে ধরি চাকুটা সরাও।আমার ভীষণ ভয় করছে। আমি পাপার কাছে যাবো। (ভয়ে কান্না করে দিয়ে)
আশিয়ান:-ওলে লে লে,,,থাক কাঁদে না। তা খুকি পাপার কোল ছেড়ে আমাদের বাসায় কীসের জন্য?এসব ড্রামা করার আগে তোমার মনে রাখা উচিত ছিলো যে আমি চাইলে ঠিক কী করতে পারি!আমার জেদ সম্পর্কে তো তুমি অবগত,, তারপরও বেহায়ার মতো কেন পিছে পড়ে থাকো অলটাইম?শরম করে না বয়সে বড় একটা ছেলের সাথে জোঁকের মতো লেগে থাকতে?তুমি আস্ত একটা বেহায়া মেয়েমানুষ।তোমার আব্বু আম্মু তোমাকে ঠিকমতো মানুষ করতে ব্যর্থ হয়েছেন। এখনও সময় আছে শুধরে যাও,, নয়তো তার ফল কী হতে পারে তা তুমি খুব ভালো করেই বুঝতে পারছো?মনে থাকবে তো? (কঠিন কন্ঠে)
আশা:-হ্যা,, হ্যা,, মনে থাকবে। খুব ভালো করে মনে থাকবে। এবার তো সরাও প্লিজ। (করুন কন্ঠে মিনতি করে)
আশিয়ান চাকুটা সরিয়ে নিয়ে এনার হাতে তুলে দিলো। আশার দিকে তাকিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বললো;
আশিয়ান:-যাও গিয়ে ডাইনিং টেবিলে বসে সবার সাথে ব্রেকফাস্ট করো।আর হ্যা এসে যখন পড়েছো তাহলে এখানে থাকো। আমার বিয়ের খবর যখন তোমার কানে পৌঁছে গেছে তার মানে এটা ভালো করেই জানো যে শুক্রবারে আমাদের দুই ভাইয়ের এনগেজমেন্ট!তো তোমার কাজ হলো কনেদের বাড়িতে পাঠানো তথ্যগুলো এনা ও কেয়া ভাবীর সাথে মিলে প্যাকেট করা। ও অন্যান্য যত টুকিটাকি কাজ আছে সব তুমি করবে। কাজে যদি কোনো গাফিলতি পাই,,, আর যদি কোনো ঝামেলা করার চেষ্টা করো তাহলে আজ যে ভয়টা দেখিয়েছি ওটা সেদিন তোমার আব্বু আম্মুর সামনে বাস্তব করবো!কথাটা মাথায় থাকে যেন!এন্ড ইউ নো দ্যাট ভেরি ওয়েল আমি মুখে যা বলি কাজে তা করে দেখাই। মাইন্ড ইট! (দাঁতে দাঁত চিপে)
আশা ভয়ে আর একটা কথাও বললো না। আশিয়ানের কথায় মাথা নেড়ে সায় জানিয়ে একদৌড়ে ডাইনিং টেবিলের কাছে গিয়ে একটা চেয়ার টেনে নাশতা করার জন্য বসে পড়লো। পরিস্থিতি শান্ত হয়ে গেছে। বাকিরাও খুব ইনজয় করেছে আজকের এই কমেডি সিনটা। তাশজিদ তো দাঁত কেলিয়ে আশার আড়ালে আশিয়ানকে আঙ্গুলকে 6 বানিয়ে দেখালো। আশিয়ান মুচকি হেসে এনার পাশের চেয়ার টেনে বসে পড়লো।এনা তার ভাইকে প্লেটে নাশতা বেড়ে দিলো।সবকিছু একদম স্বাভাবিক যেন একটু আগে কিছুই হয় নি।
নাশতা করার পাশাপাশি সবাই টুকটাক আলোচনা করলো এনগেজমেন্ট ও শপিং নিয়ে। তাজিম, তাশজিদ,তাহমিদ,তামজিদ ওরা নাশতা সেড়ে বেরিয়ে পড়লো তাদের ওপর ভাগ করে দেয়া দায়িত্ব পালন করতে। আশিয়ান চলে গেল তার অফিসে। তাসকিন গেল ডেকোরেটার্স এর অফিসে। কী কী ফুল দিয়ে সাজাতে হবে,, এবং কোন কালার লাইট লাগবে তা সব ম্যানেজারকে বুঝিয়ে দিতে হবে। এসব কাজ তাশজিদই করতো কিন্তু ওদিকে আত্মীয় স্বজনদের দাওয়াত দিতে গিয়ে ওরা একা কিছু করতে পারবে না তাই তাশজিদকেও হেল্পিং হ্যান্ড হিসেবে সাথে নিয়ে গেছে।
বাকিরা সবাই শপিংয়ে যাবেন দুপুরের পর। বাসায় এনা, কেয়া ও তারিন থাকবে শুধু, বাচ্চারা স্কুলে চলে গেছে আগেই।আর আশা বাসায় যাবে কাপড় চোপড় নিয়ে আসার জন্য।ভয়ে আর টু শব্দও করে নি সে।মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে নিয়েছে আর জীবনেও কখনো আশিয়ানকে সামনাসামনি এভাবে রাগিয়ে দেবে না সে।তবে আড়ালে থেকে অবশ্যই তাকে নিজের করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে আশা। আর বিয়েটা কী করে ভেস্তে দেয়া যায় মনে মনে অতি সুকৌশলে তা প্ল্যান করতে লাগলো।যেই মেয়ের সাথে ওর বিয়ে ঠিক হয়েছে ওই মেয়েকেই সর্বপ্রথম কনভিন্স করতে হবে। আশিয়ানের বিরুদ্ধে আজেবাজে কথা শুনলে নিশ্চয়ই মেয়েটা বিয়ে ভেঙে দেবে। এটা ভাবতেই তার মুখে শয়তানি হাসি ফুটে ওঠলো।
🦚🦚🦚
ঊদিতা নিজের রুমে শুয়ে আছে। একটু আগেই আশিয়ানদের বাড়ির লোকেদের সাথে ঊদিতা ও আলেয়ার পরিবারের সবাই শপিংয়ে চলে গেছে। বাসায় শুধুমাত্র আলেয়া আর সে আছে। একা একা কিছু ভালো লাগছে না তার। তাই নিজ রুম থেকে বেরোয় নি সে। ঘরে যে একজন মানুষ আছে আলেয়ার সে দিকে কোনো ধ্যানই নেই। সে তার রুমে বসে একমনে ফোন টিপতে ব্যস্ত অর্থাৎ সে নিজের হবু স্বামীর সাথে প্রেমালাপে বিজি হয়ে আছে।আলেয়ার মতো আকামের ঢেঁকি খুঁজলে মনে হয় দুটো পাওয়া যাবে না। জীবনেও নিজে থেকে কোনো কাজ তো করেই না,,উল্টো তার দৈনন্দিন কাজও অারেকজনের করে দেয়া লাগে।বিয়ের পর তো মনে হয় তাসকিনকে দিয়েই নিজের কাজকর্ম করাবে। বেচারা তাসকিন যদি জানতো যে তার হবু বউ একগ্লাস পানি পর্যন্ত নিজে ঢেলে খায় না তবে জীবনেও আর একে বিয়ে করার জন্য এমুখো হতো না।
ঊদিতার সময় কাটছে না দেখে বহু খুঁজে পেতে কয়েকটা বই নিয়ে এলো পড়বে বলে। এতেও যদি কিছুটা সময় কাটে।বোরিং জিনিসটা হারে হারে টের পাচ্ছে সে এই মুহুর্তে।বই পড়তে পড়তে একটা সময় ঘুমিয়ে পড়লাে সে। একা একা খেতেও ইচ্ছে করছিলো না।হাজার রকম টেনশনে মাথা বনবন করে ঘুরছে তার।তাই একটুতেই চোখে ঘুম চলে এলো তার।
শপিং শেষে ওনারা সবাই প্রায় রাতের দিকে বাসায় ফিরে এলেন।প্রচুর কেনাকাটা করা হয়েছে আজ। আজকের জন্য যথেষ্ট।সবাই ক্লান্ত হয়ে গেছে আজকের এই কেনাকাটা করতে গিয়ে।ঊদিতা বিকেলে ঘুম থেকে ওঠে রান্নাবান্না করে খেয়েদেয়ে আবার রুমে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলো।আজকে জম্পেশ এক ঘুম হয়েছে ঊদিতার।মন মাইন্ড একদম ফ্রেশ হয়ে গেছে তার।
ফুরফুরে মেজাজ নিয়ে সবার সাথে কথা বলছে সে।এখন চা শরবত পরিবেশন করছে প্রত্যেককে।আজকে শপিংয়ে গিয়ে কী হয়েছে,, কে কী করেছে,, তা নিয়ে গল্পে মশগুল হয়ে পড়লো সবাই।আনন্দ ফুর্তিতে মজে উঠলো পরিবেশটা।কী কী কেনাকাটা করা হয়েছে তা হাসিমুখে একে একে দেখাচ্ছে তারা।সবার মুখের তৃপ্তির হাসি দেখে ঊদিতার মনটা যেন একদম ভরে গেল।কতদিন পর সবাই এভাবে একসাথে আনন্দ করছে।প্রিয়জনদের মুখের হাসির কারণটা যদি নিজে হয় তাহলে মনে ভীষণ সুখ সুখ অনুভূত হয়।যেমনটা এখন ঊদিতার অনুভব হচ্ছে।
🌾🌾🌾
আশিয়ান কাজ করতে করতে বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়েছে আজ।অফিসে ইদানীং প্রচুর কাজ করতে হচ্ছে তাকে।অফিসের অনার এবং এমডি হিসেবে তার দায়িত্ব অনেক।মাথা ব্যথাটাও ইদানীং যেন বেড়ে গেছে।ভালো লাগে না আর কাজ করতে।মাঝে মাঝে হাঁপিয়ে ওঠে সে এত কাজের চাপে।সব ছেড়ছুড়ে বনবাসে চলে যেতে ইচ্ছে করে তার।আজকের জন্য বিরতি দিয়ে রাত ৯ টায় বাসার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলো সে।বাসায় গিয়ে জম্পেশ একটা ঘুম দিলে তবেই মাথাটা ঠিক হবে এর আগে নয়৷কালকে আবার শপিংয়ে যেতে হবে।মায়ের কথা রাখতে হলে অফিস মিস করে যেতে হবে তাকে।কালকের কাজগুলো সিইও, তার ম্যানেজার এবং তার পিএ ইউনুস সবটা সামলে নেবে।
গাড়ি ড্রাইভ করতে করতে হঠাৎ ঊদিতার কথা মনে হলো তার।আনমনে মেয়েটার কথা ভাবতে লাগলো সে।ঊদিতা কী তার মনমতো হবে?সে যেমনটা পছন্দ করে তেমনটা না হলে সংসারটা তছনছ হয়ে যাবে প্রায়।কারণ তার কথার অবাধ্য কোনো মেয়েকে নিয়ে আর যা-ই হোক এটলিস্ট সংসার করতে পারবে না সে।এবং অভার স্মার্ট হলে তো জীবনেও বিয়ে করবে না আশিয়ান।এই একই কারণে তো আয়শাকেও সে মোটেই পছন্দ করে না।নয়তো আয়শাকেই বিয়ে করতো।যাইহোক,, কালকে শপিংয়ে গেলেই বোঝা যাবে মেয়েটা কেমন?
বাসায় এসে সোজা নিজের রুমে চলে গেল সে।অন্যদিনের মতো আজও ড্রয়িং রুমে আড্ডার পসরা বসেছে।মেয়েরা সব মিলে কনেদের বাড়িতে পাঠানোর জন্য তথ্য সাজাচ্ছে যত্নসহকারে।
আজ তাদের সাথে জয়েন হতে ভালো লাগছে না আশিয়ানের।প্রথমত আশা জোঁকটা সেখানে আছে তার চেহারা দেখার ইচ্ছা বর্তমানে নেই ওর,,আর দ্বিতীয়ত আজ ইলিয়ানার কথা ভীষণ মনে পড়ছে। প্রথম ভালোবাসা মোটেও ভোলা যায় না।হোক সে প্রতারক। তারপরও তার জন্য মনের কোণে আলাদা একটা অনুভূতি থেকেই যায়।
আশিয়ান নিজের মাথার চুল টানতে টানতে কাপড় চোপড় খুলে টাওয়েল নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেল গোসল করতে।শাওয়ার সেড়ে এসে দেখলো তার আম্মু কফির মগ হাতে ওর বিছানায় বসে আছেন।এই একটা মানুষ হাজার বিজি থাকলেও তার যত্নের কোনো ত্রুটি রাখেন না।সবদিক সামলিয়ে ঠিকই আশিয়ানের কেয়ার করেন। তার কখন কী লাগবে সব না বলতেই বুঝে যান ওনি।আশিয়ানের সবকিছু একদিকে আর তার মা আরেকদিকে।অনেক ভালোবাসে সে তার আম্মুকে।
আশিয়ানকে দেখে মিসেস ইয়াসমিন একটা প্রশান্তির হাসি দিলেন।প্রতিত্তোরে আশিয়ানও মুচকি হাসলো।এগিয়ে এসে মায়ের কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো সে।মিসেস ইয়াসমিন কফির মগটা সেন্টার টেবিলের ওপর রেখে আশিয়ানের হাত থেকে টাওয়েল নিয়ে চুল ভালো করে মুছে দিতে লাগলেন।আস্তে করে বললেন;
মিসেস ইয়াসমিন:-তোর বুঝি আজ মাথা ব্যথা করছে বাবা?(জানতে চেয়ে)
আশিয়ান:-কী করে জানলে?(অবাক হয়ে)
মিসেস ইয়াসমিন:-সন্তানের সব রকমের অবস্থাটাই যদি উপলব্ধি করতে না পারি তবে ৪ বাচ্চার মা হতাম না।
আশিয়ান:-হুমম,,ইদানীং কাজের প্রচুর চাপ পড়ছে আম্মু। কাজ করতে করতে মাথা ফেটে যাচ্ছে আমার।একটুর জন্য শান্তি পাই না কিছুতে। ভালো লাগে না আর। ইচ্ছে করে সব ছেড়েছুড়ে চলে আসি।(হতাশা মিশ্রিত কন্ঠে)
মিসেস ইয়াসমিন তার মাথায় হাত বুলিয়ে আদুরে কন্ঠে ;
মিসেস ইয়াসমিন:-বুঝলাম,,,। তাহলে কয়েকদিনের জন্য সব কাজ তোর অফিসের পিএ,সিইও এবং ম্যানেজারের ওপর ছেড়ে দিয়ে রিল্যাক্সে থাক না। ওরা তো তোর বিশ্বস্ত লোক আছে। ঠিকই সব সামলে নেবে। আর বেশি প্রয়োজনীয় কোনো কাজ যেটা তুই ছাড়া সম্ভব নয় সেসব কাজ ঘরে বসে করলেই পারিস।এত চাপ নিস না বাবা।কয়েকদিনের জন্য বিরতি নে নইলে সবকিছু থেকে মনযোগ ওঠে যাবে তোর।এককথায় ডিপ্রেশনে চলে যাবি তখন।
আশিয়ান:-হুম মা তুমি ঠিকই বলেছো।আচ্ছা বিয়ে কোনদিন ঠিক করলে কিছু তো জানাও নি আমাদের তোমরা?(কৌতুহলবশত জানতে চেয়ে)
মিসেস ইয়াসমিন:-হুম আজকে একটা রেস্টুরেন্টে খাওয়া দাওয়া করে বিয়ের দিন তারিখ পুরোপুরি পাক্কা করে এলাম।এনগেজমেন্টের ৪ দিন পর মেহেদি অনুষ্ঠান,পরদিন হলুদ সন্ধ্যা,তারপরের দিন আরেক শুক্রবারে বিয়ে।আর বিয়ের পরদিনই আমাদের বাসায় রিসিপশন পার্টির আয়োজন করা হবে।তবে ঊদিতার পরিবারের পক্ষ থেকে শাহরিয়ার একটা শর্ত দিয়েছে এবং তা হলো বিয়েতে বা অন্যান্য অনুষ্ঠানে ঊদিতা পর্দাশীল টাইপের ড্রেস পড়বে সাথে হিজাব এবং নেকাবও থাকবে।আর যেহেতু তুই একজন নামকরা ব্যক্তি তোর বিয়েতে তো অবশ্যই অন্যান্য সেলিব্রিটিরা এবং মিডিয়ার লোকজন থাকবে তো তুই তাদের সাথে কথা বলার জন্য ঊদিতাকে ফোর্স করতে পারবি না।মেয়েটা একটু বেশিই ইন্ট্রোভার্ট টাইপের কিনা এত এত মানুষের সাথে কথা বলতে গেলে লজ্জায় মরেই যাবে।তবে আলেয়ার ব্যাপারে কোনো ধরনের কোনো শর্ত প্রয়োগ করা হয় নি।ও অনেক বেশি স্মার্ট এবং স্টাইলিশ,,এসব কথার ধার ধারে নি তার পরিবার।শুধু শাহরিয়ারই বললো তার বোন আলেয়ার মতো নয় একদম আলাদা স্বভাবের মানুষ।এবং প্রকৃতপক্ষে ঊদিতাই তার ভাইকে দিয়ে আমাদেরকে এসব বলিয়েছে। এবং আমিও সানন্দে রাজী হয়েছি তাদের প্রস্তাবে।ভালো করি নি বল?(জানতে চেয়ে)
আশিয়ান ঊদিতার শর্তর কথা শুনে একটু নয় অনেকটাই অবাক হলো।এই যুগে এসে কোনো মেয়ে এমন শর্ত দেয় জানা ছিলো না তার।ছোট থেকেই সে পর্দাশীল নারী খুব কমই দেখেছে সে।আর দেখলেও তাদেরকে এলিয়েন বই আর কিছুই মনে হতো না। আর এখন কীনা তার কপালেই এরকম মেয়ে এসে জুটেছে। ভাগ্য বলতে হবে।আশিয়ান মায়ের কথায় সায় জানিয়ে বললো;
আশিয়ান:-হুম ভালো করেছো।আমিও এত নির্লজ্জ টাইপ মেয়ে পছন্দ করি না।তবে শুধু পর্দাশীল হলে কী হবে মন যদি ভালো না হয়ে থাকে?ও কী সত্যি আমার মনের মতো হবে আম্মু?
মিসেস ইয়াসমিন হাসলেন ছেলের কথা শুনে। তিনি বললেন;
মিসেস ইয়াসমিন:-বোকা ছেলে আমার,,, ওকে আমি শুধু তার গুণ দেখেই পছন্দ করিনি।করেছি এই কারণে যে মেয়েটাকে এখনো পর্যন্ত কোনো ধরনের কলুষতা ধরতে পারে নি।মেয়েটা পড়ালেখা করলেও এতটাই হাবাগোবা যে হিংসা,ঈর্ষা,রাগ,জেদ এসব বিষয় পর্যন্ত সে ঠিকমতো বুঝতে পারে না। তবে সে কাউকে পছন্দ করলে তার জন্য জীবন দিয়ে দিতেও কার্পণ্য বোধ করবে না কখনো।এই মেয়েটা যদি তোর জীবনে আসে তবে তুই তাকে নিজের মতো করে গড়ে নিতে পারবি।তুই যেরকমটা চাস সেরকমটা করে ওকে মানিয়ে নিতে পারবি।এটা তোর জন্য একটা প্লাস পয়েন্ট।আর বাকিটা কাল ওর সাথে শপিংয়ে গিয়ে বুঝতে পারবি।আশা করি তুই নিরাশ হবি না।
আশিয়ান:-হুম বুঝলাম,,,
মিসেস ইয়াসমিন:-আচ্ছা তাহলে তুই কফিটা খা,,আর মাথা ব্যথা কমলে নিচে আসিস ডিনার করতে।আমি যাই,, গিয়ে দেখি বরং কদ্দুর তাদের কাজ সম্পন্ন হলো।
আশিয়ান:-আচ্ছা,,, তুমি যাও।আমি এখন কফি খেয়ে একটু রেস্ট নেবো।
মিসেস ইয়াসমিন মাথা ঝাঁকিয়ে নিচে চলে গেলেন।আশিয়ান কফিটা খেয়ে বারান্দায় গিয়ে ইজিচেয়ারে বসে চোখ মুদে আরাম করে বাহিরের মৃদুমন্দ হাওয়া খেতে লাগলো।এখন অনেক আরাম লাগছে তার।প্রশান্তি এসে ভর করলো তার মনে।
🤍🤍🤍
ঊদিতা সবাইকে রাতের খাবার বেড়ে দিয়ে নিজেও খাবার নিয়ে রুমে এসে খেতে বসে পড়লো।ডাইনিং রুমে প্রচুর মেহমানেরা আছে।সবাই তাদের আত্মীয় স্বজন। ছেলেদের সংখ্যা অনেক বেশি তাই তো সবার আড়ালে ডাইনিং টেবিলে খাবার বেড়ে দিয়ে চুপকে নিজের রুমে চলে এসেছে যাতে কেউ তাকে না দেখে।সে কখনো তার নিজের ছেলে কাজিনদের সামনেও যায় না।পর্দা করতে হলে সবদিক মেইনটেইন করে তবেই পর্দা করতে হয়।আমি যথেষ্ট পর্দাশীল একথা বললেই তো আর হয়ে যায় না।পর্দার নিয়মাবলি সব মানলে তবেই সেটা সঠিক পর্দা বলে বিবেচিত হয়।যা ঊদিতা সবসময় মেনে চলে।মিসেস আনিতা মনে মনে অনেক গর্ববোধ করেন তার ছেলেমেয়েদেরকে তিনি তার শিক্ষায় বড় করে তুলতে পেরেছেন বলে।কয়জন সন্তান তার বাবা মায়ের আদর্শে বড় হতে পারে!!
ঊদিতা খাওয়া শেষ করে রুমে এসে ঘুমিয়ে গেল৷ বরাবরের মতো আজও তার আম্মু তার সাথে ঘুমালেন।
🍁🍁🍁
আশিয়ান ঘন্টাখানেক সময় বারান্দায় কাটিয়ে নিচে ডাইনিং রুমে চলে গেল ডিনার করতে।সবার সাথে গল্প করে করে ডিনার শেষে আবারও নিজের রুমে ফিরে এলো সে।আয়শা ভদ্র মেয়ের মতো চুপ করে বসে ছিলো তবে তার চোখে মুখে খেলা করছে শয়তানি হাসি। যা কেয়ার চোখ এড়ায় নি।তারিনও আজ বেশ উৎফুল্ল কারণ আয়শার সাথে মিলে বিয়ে ভাঙার জন্য এক জম্পেশ প্ল্যান করেছে সে।এবং কালকেই সেটা সাকসেসফুল হবে বলে ওরা দুজন এত খুশি।রাতে মিসেস ইয়াসমিনের রুমে গিয়ে কেয়া তারিন ও আয়শার শয়তানি মার্কা হাসির কথা বললো। মিসেস ইয়াসমিন কিছুই বললেন না। তিনি শুধু মুচকি হাসি দিয়েছেন আর কেয়াকে বলেছেন চিন্তা না করতে।কেয়াও আর মাথা না ঘামিয়ে নিজের রুমে চলে গেল।
আশিয়ান বিছানায় শুয়ে শুয়ে ইলিয়ানার সাথে কাটানো মুহূর্ত গুলোর কথা ভাবছে।ভাবছে ওর করা প্রতারণার কথা।এসব ভাবতে ভাবতে আনমনে চোখের জল ছেড়ে দিলো সে।আশিয়ানের মতো শক্ত মনের মানুষ প্রতিটা রাত এভাবে একটা মেয়ের কথা চিন্তা করে বালিশ ভেজায়,,, কতটা ভালোবাসলে একটা শক্ত মনের ছেলে একটা মেয়ের জন্য কাঁদতে পারে।মেয়েটা অনেক ভাগ্যবতী কিন্তু আফসোস আশিয়ানের ভালোবাসা সে কখনোই রিয়েলাইজ করেনি।
আশিয়ান কাঁদতে কাঁদতে একটা সময় ঘুমিয়েই পড়লো৷
🌿🌿🌿
পরদিন সকালে ঘুম থেকে ওঠে জিম করে ট্রেডমিলে বেশ কিছুক্ষণ ব্যায়াম করে তার রুমের বারান্দায় সুইমিংপুলটাতে উদোম গায়ে ঝাপ দিয়ে পড়লো সে৷ এই মুহুর্তে তাকে যে মেয়ে দেখবে সেই মেয়েই হার্ট অ্যাটাক করতে বাধ্য।পানিতে বেশ কিছুক্ষণ দাপাদাপি করে এবার শান্ত ভঙ্গিতে ধীরলয়ে সাঁতরাতে লাগলো সে।তার সুগঠিত ও সুঠাম দেহের উপর যে কেউ ক্রাশ খাবে।বুকের মধ্যে ঝাঁকড়া লোমগুলোতে পানি লেগে চিকচিক করছে।জিম করা সিক্স প্যাগ ওয়ালা বডি,,, হায় আশা এসে দেখে পুরোপুরি রূপে ক্রাশ খেয়ে গেল আশিয়ানকে দেখে।আশাকে লক্ষ করে আশিয়ান গলা পর্যন্ত পানির নিচে ডুবিয়ে চুপচাপ বসে রইলো।এই মেয়েটা যখন তখন নক না করে রুমে ঢুকে যায়। বেয়াদবের বংশধর একটা।
(ভুলত্রুটি ক্ষমা সাপেক্ষে।একটা কথা বলতে চাই, আমি কিন্তু অযথা এত বর্ণনা করি না গল্পের,, আমি সকল পাঠক পাঠিকাদের বুঝার উদ্দেশ্যে ভালোভাবে বর্ণনা দিই যাতে তাদের মনে প্রশ্ন না থাকে কোনো কিছু নিয়ে।কিছু কিছু পাঠক আছে আমার মতো যাদের এত বর্ননার প্রয়োজন পড়ে না।কিন্তু আমার সবদিক বিবেচনা করে লিখতে হয়।সবার কথা ভাবতে হয়।তাই আমি এত ডিটেইলস এ লিখি।তাও সবার কাছে অনুরোধ করছি গঠনমূলক কমেন্ট করার জন্য।কালকের পার্টেই আশিয়ানের সাথে ঊদিতার মিট করিয়ে দেবো পাক্কা।সো গাইজ,হ্যাপি রিডিং ❤️)
#চলবে ..