তোমাতে বিলীন
লেখিকা—আমায়া নাফশিয়াত
পর্ব—38
আশিয়ান:-আন্ডার ওয়ার্ল্ড মাফিয়া কিং এটিসি সারাজ খানের নাম শুনেছো কখনো?(জানতে চেয়ে)
ঊদিতা একটু অবাক হয়ে জবাব দিলো;
ঊদিতা:-হুম শুনেছিলাম তো!ওই লোকটার ব্যাপারে পত্রিকায় আর টিভিতে অনেক নিউজ দেখেছি।তবে যতটুকু জানি,সে আজ পর্যন্ত অন্যায়ভাবে কারও কোনো ক্ষতি করে নি।বরং মানুষরূপি পশুদেরকে ভয়ংকর শাস্তি দেয়।তবে হঠাৎ মাফিয়ার কথা উঠলো কেন?(কৌতুহলী কন্ঠে)
আশিয়ান একটা ঢোক গিললো।ভয় হচ্ছে তার,,সত্যিটা জানার পর ঊদিতা তাকে ভুল বুঝবে না তো?ঊদিতা তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলে যে সে মরেই যাবে।লম্বা করে একটা দম নিয়ে বললো;
আশিয়ান:-সেই সারাজ খান আর কেউ নয়,,,ওটা আসলে আমি!
ঊদিতার কাছে মনে হচ্ছে সে ভুল শুনেছে।আশিয়ানের মুখ থেকে এমন কিছু শোনার জন্য সে মোটেও প্রস্তুত ছিলো না।তার বিশ্বাস হচ্ছে না আশিয়ানের কথা।অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সে আশিয়ানের দিকে।আশিয়ান আবারও বললো;
আশিয়ান:-দিনের আলোয় আমি একজন সফল বিজনেসম্যান আশিয়ান তায়েফ চৌধুরী এবং রাতের আঁধারে আমি মাফিয়া কিং এটিসি সারাজ খান।
আশিয়ানের কথা শ্রবণ করা মাত্রই ঊদিতা জ্ঞান হারিয়ে ঢলে পড়ে বিছানার ওপর।আশিয়ান একমুহূর্ত স্তব্ধ থেকে দ্রুত ঊদিতাকে নিজের বুকে নিয়ে নিলো।ভয় লাগছে ভীষণ তার।আশিয়ানের বলা কথা ঊদিতা নিতে পারে নি তাই সেন্সলেস হয়ে গেছে।আশিয়ান গ্লাস থেকে হাতের চেটোয় পানি দিয়ে ঊদিতার মুখের ওপর জোরে ছিটিয়ে দিলো।ভয়ের চোটে দরদর করে ঘামছে সে।ঊদিতার কিছু হয়ে গেলে সে নিজেও যে মরে যাবে।এই মেয়েটাই তো তার প্রাণ ভোমরা।
মিনিট পাঁচেক চেষ্টা করার পর ঊদিতার জ্ঞান ফিরে আসলো।ভেজা চোখে পিটপিট করে আশিয়ানের দিকে তাকালো সে।আশিয়ান ঊদিতার মুখের সামনে ঝুঁকে এসে তার নাম ধরে মোলায়েম কন্ঠে ডাকছে।ঊদিতা কাঁপা কাঁপা হাতে আশিয়ানের গালে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো;
ঊদিতা:-এসব কী শুনলাম আমি?আপনি,,,সারাজ,,,,!নাহ,,,আপনি এসব কাজ ছেড়ে দিন প্লিজ!আপনার কিছু হলে যে আমি যে মরে যাবো।এসব কাজে জড়িত থাকার কী দরকার?ছেড়ে দিন না।আমি আপনাকে কোনোমতেই হারাতে পারবো না।
এই বলে ঊদিতা হাউমাউ করে কেঁদে দিলো।বিয়ের এতটাদিন পর আজ ঊদিতাকে এভাবে পাগলের মতো কান্না করতে দেখছে আশিয়ান।ঊদিতার চোখে স্পষ্ট তাকে হারিয়ে ফেলার ভয় দেখছে সে।তার চোখের কোণেও জল জমেছে।ঊদিতাকে নিজের বুকের সাথে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললো;
আশিয়ান:-ভয় পেয়ো না গো বউ!তোমার স্বামীর একটা চুলও কেউ কখনো ছিঁড়তে পারবে না।আজ পর্যন্ত তোমাকে ছাড়া আমি কাউকে জানাইনি আমার ২য় রূপের কথা।তোমাকে জানাতে বাধ্য হলাম।আশা করছি সবটা না জেনে আমাকে তুমি ঘৃণা করবে না।
ঊদিতা কাঁদছে অনবরত।আশিয়ান ঊদিতার চোখের পানি মুছিয়ে দিলো।ঊদিতা ভেজা চোখে তাকিয়ে আছে আশিয়ানের দিকে।ঊদিতা ধরা গলায় জিজ্ঞেস করলো;
ঊদিতা:-এ পথে কেন এলেন আপনি?খারাপ লোকদেরকে শাস্তি দেয়ার জন্য তো দেশের আইন আছে।তারাই নাহয় এসব সামলাবে!তাই বলে আপনি কেন এসবে নিজেকে জড়ালেন?প্রধান কারণটা কী আসলে?
আশিয়ান:-জানো একদম ন্যাংটা কালের বন্ধু যাকে বলে জিগরি দোস্ত আরকি,,,আমরা চারজন ছিলাম।আমি,তৌহিদ,আসিফ ও আমাদের একটা মেয়ে বান্ধবী হ্যাপি।আমরা চারজন একে অপরের জানে জিগার ছিলাম।ছোট থেকেই একসাথে বড় হয়ে ওঠা,একই স্কুলে পড়া,একই টিচারের কাছে প্রাইভেট পড়া সবকিছুই আমরা একসাথে করতাম।সবাই আমাদের চারজনকে চিনতো খুব ভালো করে।একসঙ্গে থাকতাম আমরা সবসময়।হ্যাপি অনেক দুষ্টু কিন্তু ইমোশনাল টাইপের একটা মেয়ে ছিলো।আমাদের তিনটাকে সে একাই নাচিয়ে ছাড়তো,,এত পরিমাণ দুষ্টু ছিলো ও।আমাদের তিনজনের কলিজা ছিলো ও।খুব ভালোবাসতাম ওকে আমরা একদম নিজের আপন বোনের মতো।
ঊদিতা মনযোগ দিয়ে আশিয়ানের কথা শুনছে।আশিয়ানের চোখে স্পষ্ট বেদনার ছাপ লক্ষ্য করছে সে।কীসের কষ্ট লুকিয়ে আছে তার মনের ভেতর তা ঊদিতা জানে না।আশিয়ান আবারও বলতে শুরু করে;
আশিয়ান:-প্রাইমারি পার করে হাই স্কুল,,,তারপর হাই স্কুল শেষে এসএসসি পরীক্ষায় ভালো মার্কস পেয়ে উত্তীর্ণ হয়ে একসাথে একই কলেজে ভর্তি হই আমরা চারজন।সবার চোখেই ছিলো নিজের ক্যারিয়ার গড়ার ভিত মজবুত করার স্বপ্ন।হ্যাপির ইচ্ছে ছিল সে পড়াশোনা শেষে একজন সফল ডক্টর হবে।তাই সে সাইন্স নিয়ে পড়ছিলো।আলাদা ক্লাসে থাকলেও আমাদের মধ্যে কখনো কোনো দুরত্ব সৃষ্টি হয় নি।তখন আমরা প্রথম বর্ষের শেষের দিকে।একদিন কলেজে,,,সেদিন আমি যাই নি,,তৌহিদ আর আসিফ কলেজে গিয়েছিল।হ্যাপিও ছিলো।হ্যাপি সেদিন প্রথম ক্লাসটা শেষ করেই বেরিয়ে গিয়েছিল কলেজ থেকে।কারণ ওর শরীর খারাপ লাগছিলো খুব।তাই তৌহিদ আর আসিফের অপেক্ষাও করতে পারে নি।যদি করতো তবে হয়তো আজও সে আমাদের কাছে থাকতো।
এই বলে আশিয়ান চুপ করে গেল।তার বলতে প্রচুর কষ্ট হচ্ছে।কান্নারা দলা পাকিয়ে আটকে আছে গলার ভেতর।ভীষণ কষ্ট হচ্ছে তার।সেই দিনগুলোর কথা মনে পড়ে গেছে।ঊদিতা আশিয়ানের গালে হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করলো;
ঊদিতা:-তারপর কী হয়েছিলো ওনার?
আশিয়ান বহু কষ্টে জবাব দিলো;
আশিয়ান:-ধর্ষণ!সেদিন ওরা আমার বোন সমতুল্য বান্ধবীটাকে ছিড়েখুঁড়ে খেয়েছিলো ঊদিতা।ওদের মনে একটুও মায়া হয় নি আমার হ্যাপিটার জন্য।নিষ্পাপ মেয়েটিকে ওরা সেদিন মেরে ফেললো ঊদিতা,, মেরে ফেললো।
এই বলে আশিয়ান কাঁদতে লাগলো।আশিয়ানের কান্না দেখে ঊদিতাও কান্না করে দিয়েছে।পুরনো ক্ষত আবারও তাজা হয়েছে তার।বোন সমান বন্ধুকে হারানোর কষ্ট আজও ভুলতে পারে না আশিয়ান।মাঝে মধ্যেই তার সব ফাঁকা মনে হয়।তৌহিদ আর আসিফের সাথে যখন সে একত্রে আড্ডায় মিলিত হয় তখন অনেক বেশি করে মনে পড়ে হ্যাপির কথা।সেদিনের দূর্ঘটনায় ওরা তাদের জিগড়ি দোস্তটাকে হারিয়ে ফেললো।আশিয়ান নিজেকে সামলে আবারও বলে উঠে;
আশিয়ান:-সেদিন রিকশা না পেয়ে নির্জন রাস্তা ধরে বাসার দিকে হেঁটে যাচ্ছিলো হ্যাপি।একদল বখাটে ছেলে পিছু নেয় তার।রাস্তা একদম ফাঁকা ছিলো।সেই সুযোগে ওই নরপশুরা হ্যাপিকে একা পেয়ে জোর করে ধরে নিয়ে যায়।সারাদিনরাত মেয়েটাকে ওরা সবাই মিলে গণধর্ষণ করে।এত এত নির্যাতন সইতে না পেরে ঐদিন রাতেই হ্যাপি মরে যায়।তার পরের দিন সেই নির্জন রাস্তার কোণা থেকে পুলিশ ওর লাশ উদ্ধার করে।
—-যেদিন তাকে ওই কুত্তার বাচ্চারা তুলে নিয়ে যায় ঐদিন আমরা ওকে পাগলের মতো খুঁজেছি।কিন্তু তার কোনো হদিস পাই নি।পরদিন ওর লাশটা দেখে বোবা হয়ে গেছিলাম যেন আমরা।আমার মাথা তখন কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছিলো।নিজেকে পাগল পাগল লাগছিলো আমার কাছে।মেনে নিতে পারি নি ওর মৃত্যুটা।এখনও ওর হাসিমাখা নিষ্পাপ মুখটা আমার চোখের সামনে ভাসে ঊদিতা।ওর চোখ দুটোতে নিরব অভিযোগ দেখতে পাই আমি।যেন সে বলে,,,”কী দোষ করেছিলাম আমি আশু?কেন এত জলদি আমার সব স্বপ্ন আকাঙ্ক্ষা ধুলোয় মিশে গেল?আমি তো তোদের ছেড়ে এত জলদি মরতে চাই নি?তবে কেন আমার সাথে এমন হলো?”
এটুকু বলে আবারও চুপ করে যায় আশিয়ান।আবারও ধরে আসছে তার গলা।গ্লাস থেকে ঢকঢক করে সব পানি খেয়ে নেয় সে এক নিঃশ্বাসে।তারপর লম্বা এক শ্বাস নিয়ে আবারও বলে উঠে;
আশিয়ান:-ওর মৃত্যুটা স্বাভাবিক ভাবে মেনে নিতে পারি নি আমরা কেউ।আমাদের সকলের মাঝে নেমে এলো শোকের ছায়া।হ্যাপি তার মা বাবার বড্ড আদরের মেয়ে ছিলো।আন্টি হ্যাপির মৃত্যু মেনে নিতে পারেন নি তাই তিনি স্ট্রোক করে বসেন।এতে ওনার একপাশ প্যারালাইজড হয়ে যায়।আঙ্কেল যেন অকুল পাথারে পড়েছিলেন।একদিকে মেয়ের এমন অস্বাভাবিক মৃত্যু অন্যদিকে স্ত্রীর এমন অবস্থা।সবমিলিয়ে ওনি ডিপ্রেশনে চলে গেলেন।হ্যাপির বড়ভাই তাদের দুজনকে সামলাতে হিমশিম খাচ্ছিলেন।তাও বোনের সাথে ঘটা অন্যায়ের সুবিচার চেয়ে মামলা দায়ের করেন তিনি।
ঊদিতা:-হ্যাপি আপুর খুনিদের কী পরে শাস্তি হয়েছিলো?(জানতে চেয়ে)
আশিয়ান:-এই বখাটে ছেলেরা বড়লোক বাবার বিগড়ে যাওয়া সন্তান ছিলো।আর ওরা রাজনীতির সাথে সংযুক্ত ছিলো।তাই পুলিশ ওদের ধরলেও কারও শাস্তি হয় নি।বরং কয়েকদিন পর ঠিকই ক্ষমতার জোরে ওরা জেল থেকে বেরিয়ে গেছিলো।পুলিশ যেন তাদের হাতের পুতুল।ওরা কিছুই করে নি।রাগে দুঃখে হ্যাপির ভাই ওনার বাবা মাকে নিয়ে দেশের বাহিরে চলে যান।পরিস্থিতি আবার আগের মতো স্বাভাবিক হয়ে গেল।যেন কিছুই হয় নি।অপরাধীরা অপরাধ করে পার পেয়ে গেছে অথচ আমার নিষ্পাপ বোনটি অকালে দুনিয়া থেকে ঝরে গেল।
একটু চুপ থেকে আবারও বলে;
আশিয়ান:-সবাই সবকিছু ভুলে গেলেও আমি ভুলি নি।আমার ভেতরে প্রতিশোধের আগুন জ্বলতে লাগলো।আস্তে ধীরে মাফিয়ার লাইনে চলে এলাম।চিন্তা করলাম,,যে দেশের শাসনব্যবস্থা এত নড়বড়ে,সেই দেশে আমি আমার মতো করে অপরাধীদেরকে তার প্রাপ্য শাস্তি দিবো।আস্তেধীরে একটা গ্যাঙ গড়ে ওঠে আমার নিজের নেতৃত্বে।সর্বপ্রথম এক সন্ত্রাসী ও সর্বগ্রাসী এমপিকে টার্গেট করি মারার জন্য।এই এমপিকে মারার পর দেশে হইহই রব পড়ে গেল।তখন রটিয়ে দিতে বললাম আমার ছদ্মনামকে।সেই থেকে আমি সারাজ নামে পরিচিত।
—-তারপরের টার্গেট ছিলো ওই নরপশুরা।প্রত্যেকটার ছবিসহ ডিটেইলস আমার কাছে সংরক্ষিত ছিলো।আমার সহকারী মির্জা ও বিশ্বস্ত কয়েকজন লোক মিলে টার্গেট অনুযায়ী একজন একজন করে ধরে নিয়ে আসে।নিজের হাতে তাদের মনের খায়েশ মিটিয়ে শাস্তি দেই আমি।যদিও নিজের হাতে খুন করি নি।মির্জাই তাদেরকে জানে মেরেছিলো।কিন্তু আমি আমার বেস্ট ফ্রেন্ডের মৃত্যুর প্রতিশোধ নিয়েছি।আমি সফল হয়েছি ঊদিতা।যারা আমার হ্যাপিকে কষ্ট দিয়ে মেরেছিলো তাদেরকে এর থেকেও হাজারগুন কষ্ট দিয়ে কুকুরের মতো মেরেছি।দেশের আইন যেখানে এই ঘটনাটা ধামাচাপা দিয়ে দিয়েছিলো সেখানে আমি এই ঘটনা আবারও উন্মুক্ত করে নরপশুদেরকে মেরেছিলাম।বাংলাদেশের সবাই দেখেছে তাদের লাশ।ভয়ে আঁতকে উঠেছিলো সেদিন সবাই।
ঊদিতা আশিয়ানের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো।হ্যাপির জন্য ভীষণ কষ্ট হচ্ছে তার।মেয়েটা অকালেই দুনিয়া থেকে ঝরে গেল কয়েকটা মানুষরূপী জানোয়ারের কারণে।আশিয়ান পলকহীনভাবে ড্রেসিং টেবিলের নিচের ড্রয়ারের দিকে তাকিয়ে আছে।মনে মনে স্মৃতি রোমন্থন করছে সে তাদের বন্ধুত্বের।কত মিষ্টি মিষ্টি মুহূর্ত ছিলো সেসব।আর কী সেই দিনগুলো ফিরে আসবে?কলিজার টুকরো বান্ধবীটা তাদের ছেড়ে চলে গেল দূর আকাশে।ওর মৃত্যুর বেশ কতগুলো বছর চলে গেছে ঠিকই কিন্তু তারা কেউ তাকে আজও ভুলতে পারে নি।আর না ভবিষ্যতে কখনো ভুলতে পারবে!
ঊদিতা আশিয়ানের হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে আকুতি মেশানো কন্ঠে বললো;
ঊদিতা:-তারপরও দেশের আইন ব্যবস্থা এখন কিছুটা হলেও উন্নত হয়েছে।তাই বলে আপনি কেন নিজে এসব কাজে জড়িয়ে পড়বেন বলুন তো?এতদিন হয়তো আপনার পরিচয় কেউ জানে নি বা বুঝতে পারে নি যে আপনিই সেই সারাজ খান।কিন্তু পরে যে কেউ জানবে না তার কী গ্যারান্টি আছে?তখন তো খারাপ লোকেরা আপনার ও পরিবারের লোকজনের ক্ষতি করার চেষ্টা করবে?তখন কী করবেন আপনি?
আশিয়ান:-আর যা-ই বলো না কেন ঊদিতা।আমি এই কাজ থেকে নিজেকে কখনো বিরত রাখতে পারবো না।সো প্লিজ তুমি আমাকে বাঁধা দিয়ো না এ ব্যাপারে।আমাদের দেশে অপরাধীরা অন্যায় করে ঠিকই পার পেয়ে যায়,,আর ভুক্তভোগীরা সারাজীবন এর ফল ভুগে।এ দেশে অপরাধীদের কোনো শাস্তি নেই।ক্ষমতার জন্য জানোয়ারগুলো নিস্তার পেয়ে যায়।আমাদের দেশে মেয়েদের কোনো নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেই ঊদিতা।যদি থাকতো তবে প্রতিদিন ধর্ষণের মতো নিকৃষ্ট কোনো ঘটনা ঘটতো না।
—-প্রতিদিন কোনো না কোনো মেয়ের ধর্ষণের খবর আমার কানে আসে ঊদিতা।নিজের চোখে কত নিষ্পাপ মেয়ের আহাজারি দেখেছি আমি।তাদের পরিবারের লোকজনদের আর্তনাদ আকাশ বাতাস ভারি করে তুলে।এমনকি এখন পর্দাশীল ও বিবাহিতা নারীরাও এধরণের পশুদের হাত থেকে রক্ষা পায় না।দেশটায় নারীদের কোনো নিরাপত্তা নেই।তাই মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে নিয়েছি,,,মানুষ নামক নর্দমার কীটগুলোকে পুলিশ শাস্তি না দিলেও আমি দেবো।প্রতিটা মেয়ের নিরাপত্তার জন্য এই নরপশুগুলোকে দুনিয়া থেকেই বিদায় করে দেবো।
ঊদিতা আশিয়ানের বুকে মাথা রেখে কান্নারত কন্ঠে বলে;
ঊদিতা:-এসব খুবই বিপদজনক কাজ।একবার অন্তত চিন্তা করুন আপনার কিছু হলে আমাদের কী হবে?এত কীসের দরকার নিজের জীবন বাজি রেখে মাফিয়া বনে থাকার!দয়া করে এসব ছেড়ে দিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসুন প্লিজ!আমি আপনাকে হারাতে পারবো না।প্লিজ আমার কথাটি শুনে নিন,,,প্লিজ!
আশিয়ান ঊদিতার কথার বিপরীতে কিছু বললো না।চুপ হয়ে গেলো সে।ঊদিতা আসলে এসব মেনে নিতে পারছে না।সে অনেক বেশি উত্তেজিত হয়ে পড়েছে আশিয়ানকে নিয়ে।কোনো স্ত্রীই হয়তো স্বামীর এসব কাজ মেনে নিতে পারবে না।ঊদিতাও পারে নি।কান্না করতে করতে একসময় ঊদিতা ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে গেল আশিয়ানের বুকে।আশিয়ান ছলছলে চোখে ঊদিতার দিকে তাকিয়ে ওর কপালে আলতো ভালোবাসার পরশ বুলিয়ে দিয়ে বললো;
আশিয়ান:-আমি আমার নিজের ও পরিবারের কথা ভেবে হাত পা গুটিয়ে বসে থাকতে পারি না ঊদিতা।আমার ঘাড়ে যে অনেক দায়িত্ব।ছোটবেলা থেকেই ইচ্ছে ছিলো জনসেবায় নিজেকে নিয়োজিত করবো।বাবার টাকাপয়সা দিয়ে চাইলেও এতকিছু করা যায় না তাই তো নিজে একজন সফল ব্যবসায়ী হিসেবে নিজেকে গড়ে তুললাম।এবং নিজের টাকা খরচ করে গরীব দুঃখী দের স্বাবলম্বী করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।আর মা বোন সমতুল্য নারীজাতির সম্মান যাতে কেউ নষ্ট করতে না পারে সেজন্যই তো আমার এত লড়াই।
—-তুমি বুঝবে না ঊদিতা আমি ঠিক কী করতে চাই!আজ আমি এই পরিবারে আছি দেখে আমার মা,চাচী,বোন,ভাবী এবং তুমি তোমাদেরকে কেউ কিছু বলারও সাহস পায় না।কিন্তু যেসব ফ্যামিলিতে আমার মতো ছেলে নেই সেসব পরিবারের মেয়েদের তো কোনো নিরাপত্তা নেই।মেয়েরা একা কোথায় যেতে পারে না,চাপা ভয় মনে নিয়ে ওরা চলাফেরা করে,,কখন কোন হায়েনা হামলে পড়ে তাদের ওপর তার কোনো ঠিক ঠিকানা নেই।তাই তো প্রতিটি মেয়েরা যাতে নিশ্চিন্তে চলাফেরা করতে পারে সেই ব্যবস্থা করতেই আমার এত প্রয়াস।এবং ইনশাআল্লাহ আমি এতে সফল হবো।এমন একদিনের অপেক্ষায় আছি যখন বাংলাদেশে নারী ও শিশু পাচার,ধর্ষণ,নির্যাতন এসব কিছুর কোনো ছায়াও থাকবে না।আ’ম এগারলি ওয়েটিং ফর দিস টাইম!ক্ষমা করো আমাকে ঊদিতা তোমার মিনতিটুকু আমি রাখতে পারলাম না।
সারাটা রাত ঊদিতাকে বুকে নিয়েই কাটিয়ে দিলো আশিয়ান।দু চোখের পাতা এক করতে পারে নি রাতে।পরদিন থেকেই ঊদিতা আর আশিয়ানের সাথে কথা বলে না।একপ্রকার এড়িয়ে চলে তাকে।আশিয়ান বুঝতে পেরেছে রাতের বিষয়টা নিয়ে ঊদিতা ভীষণ আপসেট হয়ে গেছে।আশিয়ান কিছু বললো না আর এ ব্যাপারে।ঊদিতাও এই বিষয় নিয়ে টু শব্দও করলো না।
সময় কীভাবে বয়ে যায় কেউ টেরও পায় না।সত্যি সময় কারও জন্য অপেক্ষা করে না।দেখতে দেখতে আরও ১ মাস পার হয়ে গেছে।আজ আলেয়া একটা ফুটফুটে মেয়ে সন্তান জন্ম দিয়েছে।সবাই হসপিটালে।শুধু ঊদিতা আর আশিয়ান বাদে।আশিয়ান অবশ্য হসপিটালে গিয়ে একবার দেখে এসেছে বাচ্চাকে।সবাই ভীষণ খুশি নতুন পিচ্চিটার আগমনে।ঊদিতার মা বাবা এসেছেন আলেয়ার মা বাবার সাথে।ওনারাও হসপিটালে গিয়েছেন।
ঊদিতার এখন সাড়ে আটমাস চলে।পেট এখন অনেক উঁচু হয়েছে তার।আর পিচ্চিটা কিছুক্ষণ পর পরই পেটে লাথি মারে।সে এক অসহ্য অনুভূতি!যা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়।ঊদিতা আগের চাইতে এখন অনেক নীরব হয়ে গেছে।আগে যেমন চঞ্চল টাইপের ছিলো এখন তার মধ্যে এসব কিছুই নেই।
আশিয়ানের থেকে নিজেকে অনেকটাই গুটিয়ে নিয়েছে সে সেদিনের পর থেকে।সে চায় আশিয়ান এসব ছেড়ে দিক,,,এবং নরমাল জীবন ধারণ করুক।কিন্তু আশিয়ান তার সিদ্ধান্তে অটল।সে তার জায়গা থেকে একটুও নড়চড় করে নি।তবে ঊদিতার যত্নে কোনো ত্রুটি রাখে নি সে।ঊদিতা তার সাথে তেমন একটা কথা না বললেও আশিয়ান ঠিকই ঊদিতার সাথে সবসময় স্বাভাবিক ভাবে কথা বলে।যেন তাদের মাঝে কিছুই হয় নি।
একদিন পর আলেয়াকে হসপিটাল থেকে ডিসচার্জ দেয়া হলো।নতুন অতিথির আগমনে পরিবারের সবাই খুশি।বাসায় উৎসব উৎসব ভাব লেগে গেছে পুরো।ঊদিতা পিচ্চিটাকে কোলে নিয়েছিলো একবার।এত ছোট ছোট হাত পা তার,, ঊদিতার তো চোখ জোড়া খুশিতে চকচক করছে।কারণ আর ক’দিন পর তার নিজেরও সন্তান আসতে চলেছে।পরম মমতায় নিজের ভরাপেটে হাত বুলায় সে।মাতৃত্বের স্বাদ অনুভব করার জন্য মনটা আনচান করে তার।আলেয়া তো মেয়ের চেহারা দেখেই গলে গেছে পুরোপুরি।তাসকিন খুশিতে কান্না করে দিয়েছে মেয়েকে প্রথমবার কোলে নিয়ে।
পিচ্চি মেয়েটার জন্মের সাতদিন পরে ধুমধাম করে আকিকা অনুষ্ঠান সম্পন্ন করা হলো।মা বাবার সাথে মিলিয়ে নামকরণ করা হয়েছে পিচ্চিটার।তাসকিয়া আতিয়া চৌধুরী।রাতে ঊদিতা নিজের রুমে বিছানার ওপর বসে আছে।অশান্তি লাগছে তার আজ।কেমন হাসফাঁস করছে শরীরটা।গরমও লাগছে ভীষণ।প্রেগন্যান্সির সময়টাতে এরকমটা প্রায়ই হয়েছে ঊদিতার ক্ষেত্রে।আশিয়ান ঊদিতার শরীর থেকে ওড়না সরিয়ে দিয়ে এসির পাওয়ার বাড়িয়ে দিলো।তারপর ঊদিতাকে নিজের কোলে নিয়ে বললো;
আশিয়ান:-সোনা,,,কিছু খাবে তুমি?
ঊদিতা মাথা নেড়ে না বোঝালো।আশিয়ান ঊদিতার মাথা নিজের বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে বললো;
আশিয়ান:-জান,,,আর কতদিন এভাবে আমার ওপর অভিমান করে থাকবে বলো তো?একটাবার আমার সাথে নরমালি কথা বলো না কলিজা!কষ্ট হয় তো এখানে!(বুকে ইশারা করে)কেন বুঝতে পারো না বউ?
আশিয়ানের আকুতিভরা কন্ঠ শুনে ঊদিতা তার ওপর আর রাগ করে থাকতে পারে না।আশিয়ানের বুকে মুখ লুকিয়ে চোখের জল ফেলতে থাকে নীরবে।আশিয়ান বুঝতে পারে যে ঊদিতা কাঁদছে।আশিয়ান ঊদিতার কপালের ওপর থেকে বেবি হেয়ার গুলো সরিয়ে দিয়ে হাসিমুখে বলে;
আশিয়ান:-এত ভয় পাও কেন বউ?৫-৬ বছর ধরে আমি এই প্রফেশনে আছি।আজ পর্যন্ত কেউ জানতে পারে নি যে সারাজ খান আসলে কে?কী তার আসল পরিচয়?এতই সূক্ষ্মরূপে কাজ করি আমরা।আমাদের পরিচয় এত সহজে কেউ জানতে পারবে না আর না কেউ কখনো আমার ক্ষতি করতে পারবে!তারপরও তুমি অহেতুক এত ভয় পাও আমাকে নিয়ে।তোমার স্বামী এত কাঁচা খেলোয়াড় নয় বউ।জুডো,মার্শাল আর্ট,কুংফু এসবকিছু শিখে এসে তারপর কাজে নেমেছি।বুদ্ধির প্যাঁচ গেমে প্রত্যেকবার নিজের কুটিল বুদ্ধির পরিচয় দিয়ে প্রথম স্থান অর্জন করেছি।এই পর্যায়ে আজ এমনি এমনি আসতে পারি নি বউ।তোমার স্বামী অনেক অভিজ্ঞ একজন মানুষ।জীবনেও কেউ টের পাবে না যে আমিই সারাজ খান।কারণ আমার ইমেজ সবার কাছেই পুরোপুরি ক্লিয়ার।বুঝলে?
আশিয়ানের কথায় ঊদিতা অনেকটা শান্ত হয়ে যায়।আশিয়ানের টিশার্ট আঁকড়ে ধরে চুপচাপ বুকে মুখ গুঁজে বসে থাকে সে।আশিয়ান নিজের প্রিয়তমাকে বুকে নিয়ে বিছানায় আধশোয়া হয়ে বসে ঊদিতার মাথার চুলে বিলি কেটে দিতে লাগে।আরামে চোখ জোড়া বুঁজে আসে তার।
🐠🐠🐠
১ মাস পর,,
আজ সকালের দিকে ঊদিতার হুট করে পেইন উঠে গেছে।অথচ ডেট আরও একসপ্তাহ পর ছিলো।ঊদিতার পেটের তীব্র ব্যথায় ছটফটানি ও কান্না দেখে তো আশিয়ানের মাথা নষ্ট হয়ে যাওয়ার জোগাড়।সে নিজেও যেন পাগল হয়ে গেছে ঊদিতার কষ্ট দেখে।আশিয়ান দ্রুত একটা বড় ওড়না দ্বারা ঊদিতার শরীর ঢেকে তাকে কোলে নিয়ে নিচে চলে আসে।তাশজিদ গাড়ির চাবি হাতে দ্রুত বেরিয়ে আসে।ঊদিতার হুট করে এমন অবস্থা দেখার জন্য কেউই প্রস্তুত ছিলো না।
আশিয়ান পাগলের মতো গাড়ির পিছনে ঊদিতাকে কোলে নিয়ে বসলো।আশিয়ানের সাথে মিসেস ইয়াসমিন ও মিসেস তারানাও ছিলেন।বাকিরা অন্য গাড়িতে করে আসছেন।তাশজিদ দ্রুত গাড়ি স্টার্ট দিয়ে ড্রাইভ করতে লাগলো।ঊদিতা পেটের তীব্র ব্যথা দাঁতে দাঁত চেপে ধরেও সহ্য করতে পারছে না।অজান্তেই মুখ দিয়ে আর্তনাদ বেরিয়ে আসে তার।আশিয়ান ঊদিতার গালে হাত রেখে পাগলের মতো বলে;
আশিয়ান:-একটু সহ্য করো ঊদিতা।আর একটু।এক্ষুনি হসপিটালে যাচ্ছি আমরা।জাস্ট একটু ধৈর্য্য ধরো প্লিজ।
ঊদিতা:-আআআ,,,,আমি,,,আর পারছি না,,,ভীষণ কষ্ট হচ্ছে আমার,,, আআআআ!
আশিয়ান:-তাশজিদ দ্রুত চালা,,,গাড়ির স্পিড বারিয়ে দেয়,,,জলদি হসপিটালে পৌঁছাতে হবে,,।আমার ঊদিতার কষ্ট হচ্ছে।
ঊদিতার ব্যথা দেখে আশিয়ান পাগল হয়ে যাচ্ছে।মিসেস ইয়াসমিন ঊদিতার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন এবং তাকে সাহস জুগিয়ে দিচ্ছেন।তাশজিদ যতটা স্পিড বাড়ানো সম্ভব ততটা স্পিড দিয়ে গাড়ি চালাচ্ছে।
ঊদিতা আজ হারে হারে বুঝতে পারছে মা হওয়ার যন্ত্রণা ঠিক কতখানি কঠিন।পেটের ব্যথায় মনে হচ্ছে তার পেট এই মুহুর্তে ফেটে যাবে।ঊদিতা দু চোখে অন্ধকার দেখছে ব্যথার চোটে।তার মনে হচ্ছে আজই হয়তো জীবনের শেষ দিন।মৃত্যু যন্ত্রণার মতো কঠিন মনে হচ্ছে তার এই ব্যথাটা।হাড্ডি গুঁড়ো করলেও মনে হয় এত ব্যথা করবে না।
খুব দ্রুতই কাছের একটা হসপিটালের পার্কিং লটে গাড়ি থামালো তাশজিদ।আশিয়ান জলদি করে গাড়ির ডোর খুলে ঊদিতাকে কোলে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো।ঊদিতা ব্যথার চোটে বেঁহুশ হয়ে যাচ্ছে বারবার।আশিয়ান পাগলের মতো করছে ঊদিতার কষ্ট দেখে।এই হসপিটালে গাইনী ডক্টর হলো আশিয়ানের মেয়ে ফ্রেন্ড চিত্রা।আশিয়ান তাকে ফোন করেছিলো বাসায় থাকতে।চিত্রা আশিয়ানের কথা মতো কেবিন বুক করে সব রেডি করে নিয়েছে ততক্ষণে।আশিয়ান দ্রুত ঊদিতাকে কোলে নিয়ে হসপিটালের ভেতর প্রবেশ করলো।চিত্রার সহকারী আরেক ডক্টর স্ট্রেচার নিয়ে অপেক্ষা করছে তাদের আসার।আশিয়ান দ্রুত এগিয়ে এলো সেদিকে।ঊদিতাকে সাবধানে স্ট্রেচারে শুয়িয়ে দিলো সে।
#চলবে