#তোমার অপেক্ষায়….(পর্ব -২/শেষ পর্ব)
#মৌমিতা হোসেন
বাসন্তি পাঞ্জাবিতে শ্যামলা বর্ণের অনন্তকে একেবারে মন্দ লাগছেনা। হাতে ঘড়ি, চোখে চশমা সব মিলিয়ে আলাদা একটা ভাব আছে অনন্তর। আলাদা একটা স্টাইল। যেটা নন্দিনীকে খুব আকৃষ্ট করে।
অনন্তর অবশ্য এসব পাঞ্জাবি একেবারেই পছন্দ নয়। নন্দিনীর বিশেষ অনুরোধে ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও প্রতিবছর এই দিনে অনন্ত পাঞ্জাবি পড়ে আসে। আর এটা নন্দিনীর ভীষণ ভালো লাগে। নন্দিনী অনন্তকে দেখে কিছু বলবে তার আগেই অনন্ত বলে,”বাহ্ আজ তো তোমায় দেখতে অপরুপ লাগছে নন্দিনী। একেবারে হলুদ প্রজাপতির মতো।”
অনন্তর কথায় নন্দিনী লজ্জায় এদিক সেদিক তাকাতে থাকে। অনন্ত এবার পাশে বসে নন্দিনীর হাত ধরে বলে,”এই যে প্রশংসা করতেই তোমার ঠোঁটে লাজুক হাসিটা দেখা যায় এটা কিন্তু আমার ভীষণ প্রিয় জানো নন্দিনী? একেবারে পাগল করা হাসি। এই হাসিটা কিন্তু তুমি আমার জন্যই রেখো। আর কারো সামনে কখনো এভাবে হাসবে না বলে দিচ্ছি।”
নন্দিনী এবার হাসি বন্ধ করে কপাল কুঁচকে অনন্তর দিকে তাকিয়ে ধীরকন্ঠে বলে,”আর কার সামনে এভাবে হাসবো বলোতো? আর প্রতিবার এই একই কথা কেনো বলো?”
“কারন আমার খুব ভয় হয়। তোমার হাসিটা এতোটাই চমৎকার যে….মনে হয় যে কোন কেউ তোমার এই হাসি দেখলে তোমার প্রেমে পড়ে যাবে। আর তোমাকে আমার কাছ থেকে কেড়ে নেবে। আর তাই তো বারবার তোমায় এই একই কথা স্মরন করিয়ে দেই।”
নন্দিনী এবার অনন্তর চোখের দিকে তাকিয়ে বলে,” তুমিই বলো অনন্ত এটা কি সত্যি কখনো সম্ভব? নন্দিনী কি কখনো অনন্ত ছাড়া অন্য কারো হতে পারে? নন্দিনী যে তার পুরো জীবনটাই অনন্তর নামে লিখে দিয়েছে। তাই বলছি মন থেকে এই ভয় সরিয়ে ফেলোতো।”
অনন্ত শান্ত,গম্ভীর কণ্ঠে বলে,”কখনো আমার কিছু হয়ে গেলেও তুমি আমার হয়েই থেকো কিন্তু নন্দিনী।”
নন্দিনী এবার দুজনের মধ্যকার দুরত্ব মিটিয়ে দিয়ে অনন্তর কাঁধে মাথা রেখে বলে,”এমন কথা আর কখনো বলো না প্লিজ। এমন কথা শুনলে আমার ভীষণ ভয় হয়।”
এরপর বেশ কিছু সময় দু’জন এভাবে চুপচাপ বসে থাকে। দু’জনেই বেশ কিছু সময় নিরবতা পালন করে। এর মাঝে হঠাৎ অনন্ত বলে ওঠে,” কোই তাড়াতাড়ি টিপের পাতাটা দাও। টিপটা পরিয়ে দেই। টিপ ছাড়া কেমন যেনো অপুর্ণ লাগছে তোমায়।”
নন্দিনী কপালে ভাঁজ ফেলে বলে,”ওমা এই না বললে আমায় একেবারে প্রজাপতির মতো লাগছে? তাহলে আবার অপুর্ণতা কিসের?”
অনন্ত হেসে বলে,”হুম ঠিকই তো বলেছি। টিপ ছাড়া প্রজাপতির মতোই তো লাগছে। এখন টিপ পরলে লাগবে আমার নন্দিনীর মতো। আর আমি তো প্রজাপতিকে নয় আমার নন্দিনীকে ভালোবাসি। ভীষণ ভালোবাসি।”
নন্দিনী আবারো মুচকি হেসে চুপচাপ ব্যাগ থেকে টিপের পাতা বের করে অনন্তর হাতে দেয়। আর অনন্ত চুপচাপ একটা কালো টিপ নিয়ে পরিয়ে দেয় নন্দিনীর কপালে। এতো জনসমাগমের মধ্যেই টুপ করে কপালে চুমু খেয়ে বলে,”এখন তোমায় পরিপূর্ণ লাগছে। একেবারে আমার নন্দিনীর মতো। আচ্ছা অনেক সময় হয়ে গেলো এবার তাহলে আমি আসি? তুমি কিন্তু ভালো থেকো নন্দিনী। নিজের যত্ন নিও আর….”
“আর কি অনন্ত?”
“আর আমার হয়েই থেকো।”
অনন্তর এমন কথা শুনে নন্দিনী ছলছল চোখে তাকিয়ে ওর হাতটা শক্ত করে ধরে বলে,”না এবার তোমায় আর যেতে দেবো না। প্রতি বছর তুমি এসে একটু থেকে আবার আমায় একলা ফেলে চলে যাও। তুমি জানো যে আমি তোমায় ছাড়া থাকতে পারি না। তাহলে কেনো চলে যাও অনন্ত? এএবার গেলে আমাকেও সাথে নিয়ে যেতে হবে ব্যস।”
অনন্ত বলে,”তুমি তো জানো যে আমার সাথে এভাবে তুমি যেতে পারবেনা। তাহলে কেনো যেদ করো বলো তো। তাছাড়া জানোই তো আমি আবার আসবো।”
নন্দিনী এবার কাঁদতে কাঁদতে বলে,”না তুমি কথা দিয়ে কথা রাখো না। তুমি আমায় ভীষন অপেক্ষা করাও। কিন্তু এবার আর অপেক্ষা নয়। এবার আমিও যাবো তোমার সাথে।”
নন্দিনীর কান্না আর কথার মাঝেই সেই বাদামওয়ালা ছেলেটা এসে বলে,”আফনে কার সাথে কথা কইতাছেন আন্টি? একলা একলা কান্দেন কেন?”
“আরে না না কাঁদবো কেনো? আমি তো তোমার আংকেল এর সাথে….” নন্দিনী চোখ মুছতে মুছতে এই কথা বলে পাশে তাকাতেই দেখে ওর পাশে কেউ নেই। অনন্তকে না দেখে নন্দিনী তাড়াতাড়ি দাঁড়িয়ে আশেপাশে খুঁজতে থাকে।
ঠিক সেই সময়ে ছেলেটা বলে,”এই খানে কেউ ছিলো না আন্টি। আফনে অনেকক্ষন ধইরা একলা একলা কথা কইতাছিলেন। সেইডা দেইখাই আমি আফনেরে কইতে আইলাম।”
এভাবে অনন্তর গায়েব হয়ে যাওয়া এরপর ছেলেটার এমন সব কথা নন্দিনী যেনো আর নিতে পারছিলো না। হঠাৎ করে প্রচন্ড মাথা ব্যাথা শুরু হয়ে যায় ওর। মাথায় দুই হাত দিয়ে চেপে ধরে চারদিকে তাকিয়ে দেখে বেশ কিছু ছেলে মেয়েরা উৎসুক দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। আর নিজেদের মধ্যে কি যেনো বলাবলি করছে। যার কোন কিছুই ওর কান অব্দি পৌছাতে পারছিলোনা। আর একটা সময় নন্দিনীও বিরবির করে অনন্তর নাম নিতে নিতে ওখানেই জ্ঞান হারায়।
___________
মাথায় কারো হাতের স্পর্শে জ্ঞান ফেরে নন্দিনীর। পিটপিট করে চোখ খুলতেই দেখে মা শালিনী ছলছল চোখে জানালার দিকে তাকিয়ে কিছু একটা ভাবছে আর চুপচাপ ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। রুমে স্বল্প আলোর লাইটটা জ্বলছে। নন্দিনী ধীরে ধীরে চারিদিকে তাকিয়ে দেখে রুমের কর্ণারে সোফায় চৈতি বসে বসে ঝিমাচ্ছে। মা আর চৈতি ছাড়া রুমে আর কারো অস্তিত্ব নেই। আর দুজনের মাঝেই কেমন যেনো মন খারাপ মন খারাপ একটা গন্ধ। ঘটনার আদ্যোপান্ত কিছু বুঝতে না পেরে মায়ের হাতের ওপরে হাত রেখে নন্দিনী ধীরে কন্ঠে বলে,”তোমরা আমার ঘরে কেনো মা? আর এই মন খারাপের লাইট জ্বালিয়ে রেখেছো কেনো? কি হয়েছে?”
মেয়ের কন্ঠ শুনে শালিনী সোজা হয়ে বসে আর চৈতিও দৌড়ে বোনের বিছানার পাসে এসে দাঁড়ায়। শালিনী দ্রুত হাতটা মেয়ের গালে রেখে বলে,”এখন কেমন লাগছে মা? একটু ভালো লাগছে? নাকি এখনো মাথায় ব্যাথা করছে? তোকে কতোবার করে বলেছি যে একা মেলায় যেতে হবে না। কিন্তু না তুই তো কথাই শুনবিনা। ভাগ্যিস চৈতি তোর পেছনে পেছনে গিয়েছিলো। নাহলে আজ কি হতো বলতো?”
মায়ের কথা শেষ না হতেই চৈতিও কিছু বলতে নেবে অমনি নন্দিনী নিচের দিকে তাকিয়ে ছলছল চোখে বলে,”অনন্ত আজও আমায় একলা ফেলে চলে গেছে তাইনা মা? তোমাদের জামাই আজকেও আমার সাথে এলো না তাইনা?”
মেয়ের এমন প্রশ্নের কি উত্তর দেবে সেটা সত্যি শালিনী জানেনা। কারন প্রায় দশ বছর আগেই যে নন্দিনীর প্রিয় মানুষটা রোড এক্সিডেন্টে এই পৃথিবী ছেড়ে,নন্দিনীকে ছেড়ে চলে গেছে। আর এটা আদরের মেয়ে কোন ভাবেই মেনে নিতে চাইছেনা। দশ বছর ধরে শতো বোঝানোর পরেও বুঝতে চাইছে না। চাইছে না মানতে। প্রতিটা মুহূর্ত পাগলের মতো অনন্তকে ভালোবেসে যাচ্ছে। যার অস্তিত্ব এই পৃথিবীতে নেই তার জন্য অপেক্ষা করে যাচ্ছে এতো বছর ধরে। এই মেয়েকে কীভাবে বোঝাবে সবটা! আর এসব ভেবেই কাঁদতে থাকে শালিনী।
মায়ের কান্না দেখে নন্দিনী আর কোন প্রশ্ন করেনা। চুপচাপ চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকে। আর চোখের কার্নিশ বেয়ে ঝরতে থাকে অশ্রুকনা।
________
রাত তিনটা। ঘড়ির কাঁটা শব্দ করে জানান দিচ্ছে তার উপস্থিতি। অনন্তর ছবি বুকে জড়িয়ে প্রায় দুই ঘণ্টা যাবত চুপচাপ বসে আছে নন্দিনী। কাঁদতে কাঁদতে চোখ দুটো লাল হয়ে ফুলে আছে। সারাদিন কিছু খায়নি তাই শরীরটা প্রচন্ড খারাপ লাগছে। আর শরীরের চেয়েও বেশি ব্যাথা হচ্ছে মনে। বুকে চিনচিনে ব্যাথা, জমানো অভিমান আর মাথায় হাজারো প্রশ্ন সব মিলিয়ে অসহ্যকর একটা সময় কাটাচ্ছে নন্দিনী। গতো দশ বছর ধরে প্রতি বছর এই দিনটি এলেই নন্দিনী যেনো আর ওর নিজের ভেতরে থাকেনা। কেমন যেনো পাগল পাগল মনে হয় নিজেকে, সব কিছু এলোমেলো লাগে,অসহ্য লাগে। কারন এই বিশেষ দিনটাতেই নন্দিনী হারিয়েছিলো তার জীবনের সবচেয়ে প্রিয় মানুষটিকে। আজকেও তার ব্যাতিক্রম হয়নি।
হঠাৎ দরজা ধাক্কানোর শব্দে নন্দিনীর ধ্যান ভাঙে। জড়িয়ে ধরে রাখা ছবিটা পাশে রেখে ধীর পায়ে এসে দরজা খুলতেই দেখে চরম উৎকণ্ঠা নিয়ে শালিনী দাঁড়িয়ে আছে। পেছনে আছে চৈতি আর ওর বাবা। শালিনী কিছু বলার আগেই নন্দিনী ভেজা কন্ঠে বলে,”আমাকে একটু একা থাকতে দাও মা। আমি একটু একা থাকতে চাই।”
কথাটা বলে দরজা লাগাতে গিয়েও আবার দরজা ফাঁকা রেখে অস্ফুট স্বরে বলে,”ভয় পেওনা মা। এতো গুলো বছরেও যখন নিজের ক্ষতি করতে পারিনি তখন আজও করবো না। জানোই তো আমি তোমাদের স্বার্থপর হবু জামাইয়ের কাছে ওয়াদাবদ্ধ। তাই চাইলেই পৃথিবী ছাড়ার অধিকারটাও আমার নেই। তাই ভয় পেওনা।”
এরপর দরজা লাগিয়ে চুপচাপ বারান্দায় চলে যায়। রাতের অন্ধকারে তারাভরা আকাশের দিকে তাকিয়ে আবারো হু হু করে কেঁদে ওঠে আর বলতে থাকে,” আমি কিন্তু কথা রেখেছি অনন্ত। আজ অবদি আমি তোমার হয়েই আমার প্রতিটা দিন পার করছি। তোমার অনুপস্থিতিতেও প্রতিটা মুহূর্ত তোমার দেয়া অনুভূতি আর স্মৃতিকে সঙ্গি করেই বেঁচে আছি। বেঁচে আছি শুধু তোমার অপেক্ষায়। তুমিহীনা এই বিস্বাদ পৃথিবী ছেড়ে তোমার কাছে আসার অপেক্ষায়…”
সমাপ্ত