#তোমার_ছায়া (পর্ব ১৮)
#মেহেদী_হাসান_রিয়াদ
মায়ের এমন হিংস্র রুপ টা এর আগে কখনো দেখেনি ফারহা। ছোট বেলায়ও তো অনেক মে’রেছিলো। হয়তো গাছ থেকে চিকন ঢাল ভে’ঙে কয়েকটা লাগিয়ে দিতো, আবার কখনো পড়ার টেবিল থেকে স্কেল নিয়ে কয়েকটা দিতো।
ওগুলোকে মা’র বলা গেলেও আজকেরটা কে কোনো মতেই মা’র বললে ভুল হবে। বাইরে থেকে ফারদিন বার বার দরজায় আঘাত করে বললো,
– মা তুমি কি পাগল হয়ে গেলে আজ।
কিন্তু কোনো কথাই কানে না নিয়ে নিজের সব শক্তি নিয়ে পি’টিয়ে মনে হচ্ছে সব রাগ এই মা’রের মাধমেই ঝাড়লেন।
একটাই মেয়ে, আশে পাশের কিছু মেয়েদের খবর শুনতে শুনতে সব সময় ফারহাকে নিয়ে যাই ভয়টা পেতো সেটাই আজ সত্যি হয়ে গেলো। মেয়েকে এতো শাসন করলেও শেষে এসে সব মান সম্মান ধুলোয় মিশিয়ে দিলো সে।
নিজের সব টুকু রাগ এতোক্ষন ঝেড়ে রুম থেকে বেড়িয়ে গেলো তার মা। ফারদিন দ্রুত রুমে ঢুকে দেখে ক্লান্ত শরিরে চোখ বন্ধ হবে হবে ভাব নিয়ে ফ্লোরে শুয়ে আছে ফারহা। একটু আগের আঘাত গুলো হাত পা যতটুকু দেখা যাচ্ছে সবটা লাল হয়ে আছে। কিছু যায়গায় ফেটে র’ক্তও বেড়িয়ে গেছে অনেকটা। মায়ের এমন রুপ টা যেন কল্পনায়ও আনতে পারছেনা সে।
ফারদিন দ্রুত ফারহাকে কোলে তুলে নিয়ে সবাইকে উচু গলায় ঝাড়ি দিতে দিতে ঘর থেকে বেড়িয়ে হসপিটালের উদ্দেশ্যে ছুটে চলে।
,
,
সন্ধার আগে বাসায় ফিরে রুমে নিশ্চুপ হয়ে বসে ছিলো আবরার। মাথা জুড়ে নানান চিন্তা৷ এতো দিন যেই ভয়টা বার বার পেছন থেকে তাড়া করছিলো আজ সেটাই সত্যিই হয়ে গেলো। কেন হতে হলো এমন? সবাইকে সব কিছু বুঝিয়ে বললে কি মেনে নিবে সব?
প্লিজ না চাইলেও সব কিছু একবার মেনে নাও না তোমরা। আমি যে আশে পাশের প্রিয় মানুষ গুলোর ভয়ে কখনো তাকে ভালোবাসি শব্দটা বলারও সাহস পাই নি। কেন এমনটা হয়?
প্রিয় জিনিস গুলো চাইলাম, আর পেয়ে গেলাম। নিয়মটা এমন হলেই বোধ হয় পৃথিবী টা সুন্দর হতো। তাহলে আর প্রিয় জিনিস হারানোর ভয় থাকতো না। প্রিয় মানুষটার কথা ভেবে বুকের ভেতরটায় ধুক ধুক শব্দ তৈরি হতো না। আমি যে ছায়া হয়ে হলেও তার পাশে থাকতে চাই। না চাইতেও নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছি তার সাথে। যেমন করে কারো সাথে তার ছায়া মিশে থাকে।
নিজের মাঝে এসব ভাবতে ভাবতে নিজেকে আরো অস্থির করে তুলছে আবরার। এর মাঝে আয়রিন এসে নাস্তা করার জন্য ও মায়ে কি জন্য যেতে বলছে তাই ডেকে গেলো।
রুম থেকে বেড়িয়ে দেখে মা চা হাতে সোফায় বসে টিভি দেখছে। আয়রিন নাস্তা নিয়ে নিজের রুমে চলে গেলো।
আবরার চুপচাপ মায়ের পাশে গিয়ে ফ্লোরে বসে মায়ের কোলে মাথা রেখে নিশ্চুপ হয়ে রইলো। মা তার চুলে বিলি কেটে দিতে দিতে বললো,
– কিরে এমন দেখাচ্ছে কেন তোকে? কিছু বলবি?
আবরার কিছুক্ষন নিশ্চুপ থেকে বললো,
– মা,,,
মা এবার টিভির থেকে মনোযোগ সরিয়ে বলে,
– কি হয়েছে তোর?
– ছোট বেলা থেকে কখনো তোমাদের কথার অবাধ্য হয়েছি?
– না, কারণ আমার ছেলে তো অবাধ্য হওয়ার মতো না।
– কখনো তোমার কথার বাইরে কিছু বলিনি। তোমাদের চাওয়াকেই সব সময় প্রধান্য দিয়েছি। আচ্ছা মা, আমি যদি তোমাদের কাছে খুব বেশি কিছু একটা চেয়ে বসি, তাহলে দিবে আমাকে? যদি তোমাদের মনে আ’ঘাত লাগবে এমন কিছু?
– চাওয়া অনেক রকমেরই হয়। শুধু নিজেকে মিলিয়ে দেখতে হয় যে, আমি যেই জিনিস টা চাইছি তা আমার লাইফে কতটুকু দরকারি। আর এর মাঝে কি আমার উপকার হবে নাকি অপকার। সব মিলিয়ে চাওয়া গুলো হতে হবে সব থেকে উত্তম।
– আমি জানি না মা, আমার চাওয়াটা আমার জন্য কতটুকু বেষ্ট হবে। শুধু এটা জানি যে, চাওয়া টা পুরণ না হলে আমি কখনোই ভালো থাকতে পারবো না।
মা একটু হেসে বললো,
– চাওয়া টা কি ফারহা?
আবরার মুহুর্তেই অবাক চোখে মায়ের দিকে তাকিয়ে তাকে কিছুক্ষন।
– তুমি কিভাবে জানো মা?
মা আবারও হেসে বললো,
– ওটা পরে বললো। এখন কাজের কথা বল। তাকে পেলে তুই হ্যাপি হবি?
– জানিনা মা, তবে না পেলেও হ্যাপি থাকতে পারবো না। প্লিজ মা, এই একটাই চাওয়া তোমাদের কাছে। জীবনে কিচ্ছু চাইবো না, তোমরা যাই বলতে তাই করবো।
মায়ের হাসিটা আরো বেড়ে গেলো। হাসতে হাসতে বললো,
– তোর মাঝে আজ ঠিক সেই ছোট্ট কালের অভ্যেস গুলো ভেষে উঠেছে। ছোট বেলায়ও কিছু আবদার করলে ঠিক এভাবে বলতি।
– মা,,, আমি যদি ফারহাকে এখানে নিয়ে আসি তাহলে তোমরা মেনে নিবে, মা?
– যদি তোরা একে অপরকে মন থেকে ভালোবাসিস, আর তোরা যদি এতে সুখে থাকতে পারিস, তাহলে নিয়ে আয়।
– সত্যি মা?(আবরারের হাস্যজ্জল মুখ)
– হুম।
– কিন্তু বাবা?
– তোর বাবার কথা ভাবতে হবে না। আমি ম্যানেজ করে নিবো তাকে।
– থ্যাংক ইউ মা, লাভ ইউ। আমার দেখে পৃথিবীর সবচেয়ে শ্রেষ্ট মা টা হলে তুমি।
,
,
হসপিটালে ফারহার পাশে বসে আছে ফারদিন। পাশে ঘুমিয়ে আছে ফারহা। প্রথমে নিয়ে আসার পর অনেক ভয়ে ছিলো ফারদিন। এর পর ডাক্তার এসে দেখে গেলো। মেডিসিনও দিয়ে গেছে। এখন কিছুক্ষন লং টাইম রেস্ট নিলে মোটামুটি সুস্থ হয়ে যাবে।
রাত তখন ৯ টা। ফারদিনকে পাশে দেখে একপাশে লুকিয়ে গ্লাস ভেদ করে ফারহার দিকে চেয়ে আছে আবরার। ফারহা হসপিটালে ভর্তি হয়েছে শুনেই ছুটে এসেছিলো। এসেই ফারদিনকে ওর পাশে দেখে আর সামনে গেলো না। আড়াল থেকে তাকিয়ে রইলো। হয়তো বাসায় অনেক কিছুই হয়ে গেছে ফারহার সাথে। যার কারণে হসপিটাল পর্যন্ত আসতে হলো তাকে। আবরারের চোখের কোনে এক ফোটা জল জমে এলো। প্রত্যেক মানুষের জীবনেই একটা সময় আছে, যেই সময়টা খুব খারাপ কাটে। তার জীবনে হয়তো এই সময়টা।
,
,
পর দিন বাসায় নিয়ে গেলো ফারহাকে। কিন্তু ফারহার এমন অবস্থা দেখেও মন গললো না কারো। কথা কখনো গোপন থাকে না। তেমনই খবটাও চলে গেলো আশে পাশের মানুষদের কানে।
ওই দিনের ঐ মহিলাটা কিছুক্ষন আগে এসে বললো,
– বলেছিলাম, বিয়ের বয়স হয়েছে মেয়েকে বিয়ে দিতে। না ওনি ঐ দিন আরো উল্টো কতো মহান মহান কথা শুনালো মেয়েকে নিয়ে। শেষে কি হলো? ওই যেই লাউ সেই কদু।
ফ্যামিলির অবহেলা, আশে পাশের মানুষদের এমন কথা সহ্য করে চুপচাপ রুমে বসে আছে ফারহা। আজ দুই দিন বাবা মা কেউই কথা বলছে না তার সাথে। ফারদিন খাবার নিয়ে আসে। এর পর ঔষধ খাইয়ে দিয়ে যায়।
ফোনের স্কিনে আবরারের নাম্বার ভেষে উঠলে তা কেটে দেয় ফারহা।
কল লিষ্ট চেক করে দেখে, এই দুই দিনে অগনিত বার ফোন দিয়েছিলো আবরার। বাট সে রিসিভ করেনি। কিছুক্ষন ফোনের দিকে স্থির হয়ে তাকিয়ে থাকলে আবারও ফোন আসে। এবার রিসিভ করে নিশ্চুপ হয়ে থাকে সে। ওপাশ থেকে আবরার বার বার কথা বললে, সে ছোট্ট করে বলে,
– কেনো ফোন দিচ্ছেন এতো বার?
– তুমি ফোন রিসিভ করছিলে না কেন?
– ভালো লাগছেনা তাই।
– বাসার পরিবেশ এখন কেমন?
– ভালো না।
– ওহ্,,,
– হুম, ভাইয়া ছারা আর কেউ ফিরেও তাকায় না আমার দিকে।
– ওই দিন খুব মে’রেছিলো তাই না?
– হুম,,
– এখন মেনে নিয়েছে?
– না, মা বলেছে বাসা থেকে বের হয়ে যেতে আর বাবা দুই দিন ধরে বাড়িতে কিছুই খায়না। হয়তো আমি আছি বলে কিছুই সহ্য হচ্ছে না তাদের। শুধু ভাইয়াই কথা বলে আমার সাথে। একটুও ভালো লাগছে না আমার। দম বন্ধ হয়ে আসছে। ইচ্ছে করছে দুরে কোথাও হারিয়ে যাই।
– খেয়েছো কিছু?
– না, ভাইয়া এখনো ফিরে আসেনি। সে বাইরে থেকে নিয়ে আসলে তখন খাবো।
– কেন বাইরে থেকে কেন?
– মা বলেছে বাসায় খাওয়া দাওয়া সব বন্ধ আমার। আর বাসা থেকে চলে যেতে। আমাকে সহ্যই করতে পারছেনা কেউ। এতো কিছু আর নিতে পারছি না। ইচ্ছে করছে মরে গিয়ে সবাইকে মুক্ত করে দিই। তখন আপনিও মুক্তি পেয়ে যাবেন।
আর কিছু না বলে ফোন রেখে দিলো আবরার। একটা শ্বাস নিলো ফারহা। নিঃস্বঙ্কোচে আবরারের কাছে আজ বলে দিলো তার অভিযোগ গুলো। কে সে? কেউ না। সেও তো ভালোবাসে না আমায়। সব খারাপ, কেউ ভালো না।
,
,
ফারহার বাসার সামনে এসে ফোন দেয় আবরার, বলে এক্ষুনি রাস্তায় আসতে। নয়তে সে নিজেই ভেতরে চলে আসবে। রাত তখন ১১ টা। একটু আগে ফারদিন খাবার খাইয়ে বললো ঘুমাতে। বাড়ির সবাই হয়তো ঘুমিয়ে আছে।
রুম থেকে বেড়িয়ে চুপচাপ বাইরে চলে আসে ফারহা। আজ আর ভয় করছে না। সবাই ই তো জেনে গেছে সব। যা হওয়ার হয়ে গেছে। আর সে বাসা থেকে চলে গেলেই তারা হ্যাপি।
রাস্তায় এসে আবরারের সামনে দাড়ায় সে। শান্ত ভাবে বললো,
– যা বলার তারাতারি বলুন। আর কয়দিন বাকি আছে ডিবোর্সের?
– দিন গুনতে হবে না আর, চলো আমার সাথে।
– কোথায়?
– আমার বাসায়? এক সাথে থাকবে আমরা দুজন।
ফারহা একটু হাসির রেখা টেনে বললো,
– ভালোবাসা ছারা করুনা দেখাতে গিয়ে এমন করলে সুখি হতে পারবেন না। তার চেয়ে বিচ্ছেদই ভালো।
– ভালোবাসি বলেই, হাত ধরতে এসেছি, আর না বাসলে ছেরে দেওয়া হাত ছারাই থেকে যেতো।
আর কিছু না বলে ফারহার হাত চেপে ধরে নিয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায় আবরার। তখন গেট দিয়ে বেড়িয়ে আসে ফারদিন। আবরারের এমন শক্ত করে ধরে রাখা হাত দুটুর দিকে তাকিয়ে বললো,
– ওই দিন এই জন্যই বলেছিলাম, ফারহাকে ভালোবাসিস কি না? ওই দিন যদি ডিবোর্সের কথা না বললে এভাবে ভালোবাসি বলতি, তাহলে এতো কিছু হতো না। আমি নিজেই ফারহাকে তোর কাছে তুলে দিয়ে সব সামলে নিতাম। মা বাবা হয়তো আরে অনেকদিন এভাবে রাগ করে থাকবে। ধীরে ধীরে আমি মানিয়ে নিবো ওদের। তোরা হ্যাপি থাক এটাই চাই। চলে যা তোরা। এক্ষুনি চলে যা। নিজেদের মতো সব কিছু গুছিয়ে নে।
আবরার চুপ হয়ে দাড়িয়ে থাকলে ফারদিন করুন গলায় ডাকলো,
– আবরার,,,,
বলেই আবরারকে জড়িয়ে ধরে বললো,
– ওই দিনের ব্যাবহারের জন্য সরি রে। এখনও মন খারাপ করে থাকবি? আর শুন, ফারুকে কখনো কষ্ট দিস না। আমি যানি তোর কাছে থাকলে ও খুব ভালো থাকবে। আগলে রাকিস কেমন? কখনো কষ্ট দিস না আমার বোন টা কে।
To be continue……..