#তোমার_ছায়া (পর্ব ১৯)
#মেহেদী_হাসান_রিয়াদ
আবরার আর ফারহার চলে যাওয়ার দিকে কিছুক্ষন এক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো ফারদিন। ল্যাম্পপোষ্টের আলোয় চোখের কোনে জমে থাকা জল চিক চিক করে উঠছে। টলমলে আশ্রু কনা গড়িয়ে পরার আগেই তা টিসু দিয়ে মুছে নিলো সে। ঠোঁটের কোনে একটা হাসির রেখা টেনে নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে বাড়িতে ঢুকে গেট লাগিয়ে ঘরের দিকে হাটা ধরলো। হয়তো সব কিছুই আগের মতো ঠিকঠাক হয়ে যাবে একটা সময়। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে হার মেনে ভালোবাসার মানুষটিকে হারিয়ে ফেললে, তা আর কখনো ফিরে পাওয়া যাবেনা। হয়তো কিছু দিন কষ্টে থাকবে সবাই। কেউ ভালো থাকবে না। তবুও সারা জীবন কষ্ট পাওয়ার চেয়ে এই কিছু সময়টা সব সহ্য করে নেওয়াই ভালো। কারণ মায়া শব্দ টা বড্ড জটিল একটা শব্দ। আবার এসব বিসর্জন গুলো আর সব টুকু ভালোবাসা সঠিক মানুষের প্রতি বিনিয়োগ না করলে তার উল্টোটাই হয়। কারণ ভালোবাসা মানুষকে ধোকা দেন না। মানুষ মানুষকে ধোকা দেয়। আর জীবনে সঠিক মানুষকে বেছে না নিয়ে পরে ঠঁকে গেলে অনেকেই বলে ভালোবাসা বলতে কিছু হয় না, সবই বিশ্বাস ঘাতকতা। এই ক্ষেত্রে দোষ টা ভালোবাসায় না। দোষ টা হলো সঠিক মানুষ নির্বাচন করার মাঝে নিজের ব্যার্থতায়।
,
,
গাড়ির ভাড়া মিটিয়ে ফারহাকে নিয়ে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করলো আবরার। বাড়ির সামনে দাড়িয়ে কয়েকবার কলিং বেল বাজালে কিছুক্ষনের মাঝে মা এসে দরজা খুলে দেয়। আবরার মায়ের দিকে চেয়ে বলে,
– ফারহাকে নিয়ে এসেছি মা, একেবারের জন্য।
ফারহা নিশ্চুপ হয়ে দাড়িয়ে আছে। আজ শুধু এক কাপরে আবরারের হাত ধরে চলে এসেছে এই বাড়িতে। আজ থেকে সারা জীবনের জন্য এই ফ্যামিলিটাই তার নিজের ফ্যামিলি।
আবরার ইশারা করে বললো, মাকে সালাম করতে।
আবরারের ইশারায় ফারহা চুপচাপ তাই করলো। পাশে এসে দাড়ালো বাবা। বাবাকেও সালাম করে উঠে দাড়ায়।
মা ফারহাকে কাছে টেনে নিয়ে কপালে চুমু দিয়ে বলে,
– আমার ছেলে কখনো ভুল সিদ্ধান্ত নেয়নি আর নিবেও না। ভেবে চিন্তেই সিদ্ধান্ত নেয় সব সময়। তাই তার এই সিদ্ধান্ততেও আমরা দ্বিমত পোষন করছি না। আমাদের একটাই ছেলে, সে সুখি হলে আমরাও সুখি। এক আকাশ সমান সুখ নিয়ে এই বাড়িতে প্রবেশ করো আজ। দুঃখ সব পেছনে ফেলে আসা অতিত হয়ে যাবে। আশা করি আজ থেকে এই বাড়ির সবাইকে আপন করে নিবে। সবাইকে তোমার নিজের মানুষ বানিয়ে নিবে। তোমাদের দুজনের জন্যই রইলো অফুরন্ত দোয়া ও ভালোবাসা।
আবরার কিছুক্ষন এক পলকে মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে। ইশ, পৃথিবীর সব বাবা মা যদি তার মতো হতো। তাহলে হয়তো সবার ভালোবাসাই পূর্ণতা পেতো। আজ কাল বেশির ভাগ বাবা মা ই মেয়ের সুখ খোজে ছেলের অর্থ ও উপার্জনের মাঝে। অফুরন্ত অর্থ সম্পদ দিয়ে সংসার সুখি করা যায় না। যদি সেখানে ভালোবাসার অভাব থাকে।
আজ সারা দিন প্রচুর গরম পরেছে। ছোট বেলায় মুরুব্বিদের কাছে শুনতাম, গ্রীষ্মের শেষ সময়ে হুট হাট বেশি গরম পড়া মানেই এর পর অঝড়ে বৃষ্টি নামা।
গরমে সেই সাথে ভয় ও অস্থিরতায় ঘামে সারা শরিরে অস্বস্থিকর অবস্থা সৃষ্টি করেছে ফারহার মাঝে। মা আয়রিনের দিকে তাকিয়ে বলে,
– ফারহাকে তোর রুমে নিয়ে যা। আর ভালো দেখে ফারহাকে পার্ফেক্ট হবে এমন জামা বের করে দে। ফ্রেশ হয়ে পরে নিবে সে। আর কালকে গিয়ে আবরার ওর প্রয়োজনিয় সব কিছু নিয়ে আসবে।
আয়রিন একটু হেসে বললো,
– আচ্ছা সমস্যা নেই, আমার সব জামাই তাকে ফার্ফেক্ট হবে।
আবরার পাশ থেকে বললো,
– তোকে জামা’র কথা বলছে, জামাই’র কথা বলেনি।
আয়রিন এবার হাস্যজ্জল মুখে আবরারের দিকে বিরক্তিকর দৃষ্টিতে তাকায়। মানে বিরক্তিও প্রকাশ করছে, হাসিও থামিয়ে রাখছে এমন।
,
,
আরো কয়েকদিন কে’টে গেলো। ইদানিং আয়রিনের দিন খুব ভালো কাটছে। প্রথমত ফারহা এখন তার সাথেই থাকে আর দ্বিতীয়ত আর দুই এক দিনের মাঝেই মাহিন দেশে ফিরছে। তাই আয়রিনের খুশির মাত্রা ও আকাশ সমান। অনেক তো দুড়ে ছিলো মাহিন। কাছে থাকলে তো অবশ্যই মায়া বাড়বে। আর মায়া থেকেই তো ভালোবাসার সৃষ্টি হয়।
,
,
– নিজের রুমে তো কখনোই কারো প্রবেশ পছন্দ করতে না ভাইয়া। তাহলে কি ফারহাও সব সময় তোমার রুমের বাইরে থাকবে?
বলেই খিক খিক করে হেসে দিলো আয়রিন।
পাশ থেকে মা বললো,
– কেন, ফারহা তোর সাথে থাকছে বলে কি তোর অসুবিধা হচ্ছে?
আয়রিন এবার সিরিয়াস লুক নিয়ে বললে,
– আমি মোটেও এমনটা মিন করিনি। আমি যাস্ট ভাইয়ার সাথে মজা করছিলাম। আর আমি চলে গেলে তো ফারহা আমার রুমে একাই থাকবে। আমার সমস্যা হবে কেন? আর ফারহা সব সময় আমার সাথে থাকলে তো আমি আরো বেশি খুশি।
পাশ থেকে আবরার বললো,
– আয়রিন চলে গেলে তো ফারহা ওই রুমে একা ঘুমাতে ভয় পাবে, তাই না ফারহা?
এবার ফারহা মুখ খুলে বললো,
– আমি বাচ্চা না যে ভয় পাবো। আগেও আমি একা থাকতাম। তাই প্রব্লেম হবে না।
আবরার কিছুটা ভেবে আবারও বললো,
– আরে ফারহা লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই। তুমি যে লজ্জায় কাউকে ভয়ের কথা বলছে না এটা তো আমরা বুঝতে পারছি। ভু’তের ভয় তো তুমি নিশ্চই পাও তাই না?
ফারহা আবারও বললো,
– ভু’ত টুত বলতে কিছু নেই। আমি ওসব বিশ্বাস ও করিনা ভয়ও পাই না।
আয়রিন আবারও বললো,
– ঠিকই তো ফারহা বড় মেয়ে। ছোট বাচ্চা না। আর মা শুনো, অনুষ্ঠান করে সবাইকে জানিয়ে সব কিছু কমপ্লিট করে তারপর ওদেরকে এক সাথে থাকতে দিবে। এর আগে না।
আবরার আর কিছুই বলতে পারছে না। রাগ এবং লজ্জায় মায়ের দিকে আড় চোখে তাকিয়ে হাসতে হাসতে আয়রিনকে বলে,
– দয়া করে তুমি একটু কম পন্ডিতি করো বোন, নাহলে পরে কিন্তু পিঠের উপর ধুম ধাম ভু’তের থা’বা পরতে পারে।
রাতে ঘুমাতে গেলে আয়রিন বলে,
– কিছু আইডিয়া দে না প্লিজ।
ফারহা পাশ থেকে বললো,
– কি আইডিয়া বল।
– মাহিনের কাছে কিভাবে যাবো?
– তোর জামাই, তুই কি করবি না করবি এটা তোর ইচ্ছা।
– ভাবছি, কালো রং এর শাড়ি পরে ওর সামনে দাড়াবো। ও সব কিছু কালো ব্যাবহার করে, নিশ্চই ওর ব্ল্যাক কালার পছন্দ হবে।
– এমন ভাব করছিস, মনে হয় প্রথম ওর সাথে দেখা করতে যাবি?
– অনেকটা ওরোকমই।
– ওরোকম মানে?
– কাউকে বলিস না হ্যা,, বিয়ের পর যে দশ বারো দিন ওই বাড়িতে ছিলাম, ওই কয়দিন মাহিন আমার দিকে ফিরেও তাকায় নি ভালো ভাবে। রাতেও অন্য কোথাও গিয়ে ঘুমাতো। এখনো ভালোবাসা তৈরি হয়নি দেখে আমার কাছেও আসেনি। ভাবতে পারিস কতো ভালো মানুষ সে? মোট কথা হলো, আমাদের এখনো ঠিক ভাবে কথাও হয় নি। তাই এতো নার্ভাস লাগছে।
ফারহা কিছুটা ভাবুক হয়ে বললো,
– মানে, আমার মাথায় তো কিছুই ঢুকছে না। একটু খুলে বলবি কাহিনি টা কি?
– পরে একদিন বলবো, এখন শুধু তাকে ইম্প্রেস করার কথা ভাবছি। হিহিহি,,,
বলেই শুয়ে পরলো আয়রিন। ফারহা কিছুক্ষণ চিন্তিত ভাব নিয়ে বসে থেকে আয়রিনের দিকে তাকালো। কিছুই মাথায় ঢুকছে না তার।
আয়রিন চোখ বন্ধ করে বলে,
– তুই শুয়ে পরলে লাইট অফ করে দিস।
আয়রিন যে খুব আনন্দে আছে তা আয়রিনের আচরণ দেখেই বুঝতে পারছে ফারহা। তবে আয়রিনের কথা বার্তা গুলো বলছে ভিন্ন কাহিনি। বেশিক্ষন না ভেবে সেও ঘুমানোর প্রস্তুতি নিয়ে নিলো।
,
,
মাহিন আসবে আজ এই বাসা থেকে সবাই গেলো ওই বাসায়। সাথে ফারহাও। মাহিনের বাবা ও আবরার এয়ারপোর্ট থেকে রিসিভ করে নিয়ে আসলো।
বাসায় প্রবেশ করার পর সবার সাথে কথা বলে ভেতরে প্রবেশ করলো। আয়রিন সেই সকাল থেকে সাজুগুজু করেও সব যেন পানির জোয়াড়ে ভেসে গেলো। কারণ এতো কিছু করেও মাহিনকে ইম্প্রেস করতে পারলো না।
মাহিন তেমন একটা পাত্তা দিলো না তাকে। এর মাঝেই একটু সন্দেহ ঢুকে গেলো ফারহার মাঝে। তার কেন যেন মনে হচ্ছে, আয়রিন কিছু লুকিয়ে রেখেছে। কারণ আসার পর থেকে আয়রিনকে তেমন একটা গুরুত্ব দিচ্ছে না মাহিন।
আয়রিনকে কিছু জিজ্ঞেস করলেও বিষয়টা ফানি ভেবে হেসে উড়িয়ে দিলো সে। তার ধারণা আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে।
পর দিন আয়রিন কে ওখানে রেখে বাসায় চলে আসে সবাই। সবার মনটা বিষণ্ন। কারণ আয়রিন কে একেবারে দিয়ে এসেছে ওই বাড়িতে। এর পর এই বাড়িতে আসলেও আসবে মেহমান হিসেবে। যাই হোক মেয়েটা সুখে থাকলেই সব কষ্ট মুছে যাবে।
পার হয়ে গেলো আরো কয়েকদিন। ইদানিং মাহিনের চলাফেরা কেমন সন্দেহ জনক মনে হচ্ছে আয়রিনের কাছে। দেখে মনে হচ্ছে কিছু একটা করার জন্য উৎ পেতে আছে। কিন্তু বিষয়টা কি তা বুঝতে পারছে না সে।
সন্ধায় কলিং ব্যাল বাজতেই গিয়ে দরজা খোলে আয়রিন। বািরের দৃশ্য দেখে মুহুর্তেই বুকটা কেঁপে উঠলো তার। সোজা হয়ে দাড়িয়ে থাকার জন্য পায়ের নিচে যেন মাটি খুজে পাচ্ছে না। নিজের চোখ কেই বিশ্বাস করতে পারছে না যে, মাহিন দ্বিতীয় বিয়ে করে বৌ নিয়ে বাসায় এসেছে। আর আরেকটা অবাক করার বিষয় হলো, যেই মেয়েটাকে বিয়ে করেছে তার শরিরের গঠন দেখে মনে হচ্ছে কম করে হলেও ৬-৭ মাসের প্র্যাগনেট মেয়েটা। আর মাহিন মেয়েটাকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে অন্য হাতে আয়রিনকে সামনে থেকে সরিয়ে ঘরের ভেতরে প্রবেশ করলো। আয়রিন যেন এখনো বিশ্বাস করতে পারছে না নিজের চোখ কে। সব স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে আজ।
To be continue…..