তোমার নামে আমাকে ডাকো পর্ব-১২

0
2614

#তোমার_নামে_আমাকে_ডাকো
#লেখিকাঃ সারজীন ইসলাম

|পর্ব-১২|
সময়গুলো গড়ালো খুব দ্রুত। দিন পেরিয়ে সপ্তাহ এসেছে, কেটে গেছে অনেক গুলো দিন। আজ চারদিন হলো ইধা মুম্বাই শহরের নিজের ফ্ল্যাটে এসেছে। দীর্ঘ সতের দিন হসপিটালে এডমিট ছিল ইধা। একেবারে সুস্থ হয়ে ফিরেছে মুম্বাইতে। রুহি এবং তার বাবা-মা ইধাকে একা ছাড়েনি, ইধার সঙ্গে তারাও মুম্বাইতে ফিরেছে। ইধার অসুস্থতার কারণে চলতি মুভির শুটিং বন্ধ আছে আপাতত। ইধা ডিরেক্টর মিস্টার সেনের সঙ্গে কথা বলে প্রায় এক মাসের জন্য কাজ পিছিয়ে নিয়েছে। অত্যাধিক দুর্বলতার কারণে এই কয়েকদিন ইধা বিছানা ছেড়ে একদম উঠতে পারেনি। রুহি এবং তার মায়ের সেবা যত্নে তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠেছে ইধা। রৌদ্রোজ্জ্বল এক শুভ্র সকালে সূচনা হলো। স্বচ্ছ কাঁচ ভেদ করে রোদের একফালি আলো এসে পড়ে ইধার এলোমেলো চুলে লেপ্টে থাকা মুখে। মুখে এক চিলতে মিষ্টি হাসি ফুটিয়ে আড়মোড়া ভেঙে উঠে দাঁড়ালো ইধা। ধীর পায়ে এগিয়ে যায় ড্রেসিং টেবিলের সামনে। এক পলক তাকায় নিজের দিকে। কয়েকদিনের ব্যবধানে চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে, চেহারার উজ্জলতা কেমন ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। আনমনে হেসে চোখ সরিয়ে নেয় আয়নার উপর থেকে।

—————-

রুহির মা মানে নাদিয়া আহমেদ রান্নাঘর থেকে একের পর এক ডেকে যাচ্ছে রুহি আর ইধাকে। কিন্তু না এই দুইজনের কারোর কোনো হদিস নেই। ইধা না হয় অসুস্থতার জন্য আসতে একটু লেট হতে পারে তাই বলে তাদের আদরের বাঁদরটা দেরি করছে কেন? অয়ন আহমেদ তখন থেকে ডাইনিং টেবিলে বসে নিউজপেপার পড়ার সঙ্গে তার স্ত্রীর কার্যকলাপ দুই-এক বার লক্ষ্য করছে। বাড়ির কারো সামান্য অসুখ-বিসুখ করলে মানুষটা পুরো বাড়ি মাথায় তুলে ফেলে। সেখানে ইধা তার প্রাণের থেকেও প্রিয়। এসব ভেবে আনমনে হেসে ফেলে অয়ন আহমেদ।

কয়েক মিনিটের মাথায় ইধা আর রুহি একসাথে ডাইনিং টেবিলে আসে। নাদিয়া আহমেদ এর হালকা বকাঝকা শুনে খাওয়া-দাওয়া শুরু করে দুজনে। খাওয়ার মাঝে ইধা আর রুহি খুনসুটি করতে ভুলে না। অয়ন আহমেদ তা এক নজর দেখে স্বস্তি নিঃশ্বাস ফেলে নিজের খাওয়াতে মন দেয়।

——————

বেলা বোধহয় বারোটা কিংবা সাড়ে বারোটা বাজে। যে যার ব্যাগ পত্র গুছিয়ে তৈরি হচ্ছে। বেলা দু’টোর দিকে ফ্লাইট। ইরা আর রুহির পরিবারের যাত্রা উদ্দেশ্য ভিন্ন। রুহির পরিবার আজ তাদের নিজ বাড়ি দিল্লি তে ফিরে যাচ্ছে। আর ইধা? সে তো ফিরছে জমিদারবাড়িতে! ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে লিফটে উঠে, লিফট তাদের গ্রাউন্ড ফ্লোরে পৌঁছে দেয়। এক পা এক পা করে এগোচ্ছে আর নাদিয়া আহমেদ এর সতর্কবাণী পুনরায় উচ্চারণ করে ইধার মস্তিষ্কের বিচরণ করাতে চেষ্টা করছে। ইধা আনমনে তার প্রতিটা কথা শুনে মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানাচ্ছে। এয়ারপোর্টে পৌঁছে ইধা এবং রুহির পরিবার একে অন্যকে বিদায় জানিয়ে ফ্লাইটে বসে। এক নতুন অভিপ্রায়ের যাত্রা শুরু করে।

—————–

আদো কৃষ্ণকায় বিস্তার আকাশ জুড়ে ধ্রুবতারার খেলা। আকাশে আজ তারাধিপোর ( চাঁদ) দেখা নেই। হয়তো মেঘের আড়ালে লুকোচুরি খেলায় মেতেছে। ব্যস্ত ঢাকার শহরের রাস্তা পার করছে মিনিট দশেক হলো। ঘড়ির কাঁটার হিসেব মত মিনিট ত্রিশের আগেই পৌঁছে যাবে জমিদার বাড়িতে। গাড়ির কাচের জানালা ভেদ করে অন্ধকার রাস্তার দিকে তাকায়। আশেপাশে কেউ কিঞ্চিত সময়ের জন্য বসে নেই। ব্যস্ত সবাই নিজের বা প্রিয়জনের তাগিদে ছুটতে। রাস্তার পাশে দোকানগুলোর ভিড়ে মুখরিত হওয়া পরিবেশে দাঁড়িয়ে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যে কেনাকাটা করছে অফিস ফেরত অন্য কারো প্রিয়জনেরা। ইধা জ্যামে আটকে থাকার দৌলতে নিখুঁত চোখে সব জরিপ করে গেছে। জ্যাম ছাড়তে আবার গাড়ির চাকা ছুটতে থাকে নিজ গতিতে। ব্যস্ত মুহূর্ত পিছনে ফেলে এক নতুন মুহূর্তের খোঁজে। মাঝরাতের আগে হয়তো এই ব্যস্ত শহরের ব্যস্ততা কমতি হবে না। আর এখন সবে তো সন্ধ্যে মাত্র। জল্পনা-কল্পনার মাঝে ইধা খেয়াল করে সবে মাত্র ইধার গাড়িটা প্রবেশ করে জমিদার বাড়ির গেট দিয়ে। বিষন্ন মনে ঠোঁটে একফালি খুশির আমেজ ফুটে উঠে। আজ আবার অনেকদিন পরে দাদুভাই এবং দাদিমা কে দেখতে পাবে। গাড়ি থামানো সঙ্গে সঙ্গে ইধা গাড়ি থেকে নামে। পিছনে এক পলক তাকায়, তুষার এবং অন্যান্য বডিগার্ডরা পিছনের গাড়িতে আছে। ইধা শুধু তুষার কে নিয়ে দেশে আসতে চেয়েছিল কিন্তু অয়ন আহমেদ এর কড়া নির্দেশ এর জন্য বডিগার্ডদের সঙ্গে আনতে হয়েছে। ইধা চোখ সরিয়ে নিয়ে পা বাড়ায় জমিদার বাড়ির সদর দরজার দিকে। রাহাত খান চৌধুরীর সাথে ইধা বসে আছে আলিশান ডিভানে। ইধার একপাশে রাহাত খান চৌধুরী আর অন্যপাশে তার স্ত্রী আশা খান চৌধুরী। তাদের ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে বাড়ির সকলে। ইধার অসুস্থতা নিয়ে তাদের মাঝে উৎকণ্ঠার শেষ নেই। ক্ষণে ক্ষণে একই প্রশ্ন করে যাচ্ছে সকলে বারবার। ইধা বিরক্তহীন মুখে ছোট্ট একফালি সুখ নিয়ে কথা বলে যাচ্ছে সকলের সঙ্গে। কথার প্রসঙ্গে ইধা প্রশ্ন করে,

‘ মেজ চাচা চাচি কবে ফিরবে?’

রাহাত খান চৌধুরীর তিন ছেলে। তার মেজ ছেলে আনিস খান চৌধুরী। মেজ ছেলের স্ত্রী পিউলি খান চৌধুরী। তাদের বড় মেয়ে ইরা খান চৌধুরী এবং ছোট ছেলে অহন খান চৌধুরী। পিউলি খান চৌধুরীর ছোট বোন দীর্ঘ সময় ধরে হৃদ রোগে আক্রান্ত ছিল। দিনদিন অবস্থা অবনতি হওয়ায় ডাক্তার দ্রুত ওপেন হার্ট সার্জারির পরামর্শ দেয়। যেহেতু পিউলি খান চৌধুরীর বোনের শ্বশুরবাড়ির পুরো পরিবার নিউয়র্কের সেটেল সেহেতু পিউলি খান চৌধুরী স্বামী এবং পুত্র কে সঙ্গে নিয়ে পারি দেয় নিউইয়র্ক শহরে। গত সপ্তাহে তার বোনের অপারেশন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়েছে। এখন তারা যত দ্রুত সম্ভব দেশে ফিরে আসবে। ইধার প্রশ্ন শুনে আশা খান চৌধুরী মৃদু স্বরে বলল,

‘ বৌমা বলল তো কাল বাদে পরশু রওনা দেবে তারা।’

——————

সোনালী রোদের দীপ্তিতে নিমজ্জিত প্রকৃতি। শৈত্য প্রবাহে এক নিদারুণ পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। এই নিদারুণ চমৎকার পরিবেশ উপেক্ষা করে ইধা গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন। যেন কতকাল সে নিদ্রাহীন রাত্রি যাপন করেছে, আজ সুখের ছোঁয়া লেগে প্রগাঢ় নিদ্রার আহ্বান জানিয়েছে। এদিকে ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই এক নির্বাক কান্ড ঘটে গেছে। ইধার বাড়িতে আসায় রাহাত খান চৌধুরী খবর পাঠিয়েছে চৌধুরী পরিবারে, সেই খবর শুনে তৌফিক চৌধুরীর পুরো পরিবার কালবিলম্ব না করে চলে আসে জমিদার বাড়িতে।‌ দিঘীর ডাকে ঘুম ভাঙ্গে ইধার। দিঘী জানায় নিচে বৈঠকখানায় ডাক পড়েছে ইধার। ধীরে সুস্থে ফ্রেশ হয়ে নিজের রুম থেকে বের হয়। ইধা সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে এসে চোখ যায় মামুন আর ইমন খান চৌধুরীর উপরে। দুজনের চেহারার কৃষ্ণবর্ণ ধারন করেছে। চোখগুলো লালচে ধারন করেছে। ইধা কপাল ভাঁজ করে তাকায়। কিঞ্চিত মুহুর্ত পরে আঁখিপলব সরিয়ে আশপাশে তাকায়। সামনে থাকা লোকদের দেখে ইধার ভাঁজ পড়া কপালে আরো কয়েকটি চিন্তার রেখা ফুটে ওঠে। মাথায় নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে শুরু করে, এরা এই মুহূর্তে এখানে কী করছে? কিংবা এদের সঙ্গে জমিদার বাড়ির সম্পর্ক কী? এরা কী‌ জমিদার বাড়ির পূর্ব পরিচিত?

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here