তোমার নামে আমাকে ডাকো পর্ব-১৩

0
2395

#তোমার_নামে_আমাকে_ডাকো
#লেখিকাঃ সারজীন ইসলাম

|পর্ব-১৩|
ড্রইংরুম মেতেছে আজ আড্ডার আসরে। নানান কথার ছলে হেসে উঠছে এক এক জন উচ্চস্বরে। আড্ডার মাঝে বাড়ির মেয়ে বউদের দল এসে জানিয়ে গেছে জলদি ব্রেকফাস্ট সেরে নেওয়া কথা। কিন্তু সে কথা কী আর কেউ শোনে? যে যার মত উল্লাসে ব্যস্ত। ইতিমধ্যে সকলের চোখের মনি হয়ে গেছে তাজ। তারা দুষ্টুমির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছে এ বাড়ির কিছু লোকজন। রাহাত খান চৌধুরী ড্রইংরুমে এলে সবাই আড্ডা থামিয়ে তার সঙ্গে খাবার টেবিল যায়। রায়হান খান চৌধুরী বাড়িতে নেই রাজনীতির কাজের জন্য গত পরশুদিন চট্টগ্রামে গিয়েছেন কিছুদিনের জন্য। রাহাত খান চৌধুরী আদেশ দিয়েছেন তার বড় বৌমা এবং তার পরিবার যেন এই বাড়িতে থাকে। তার কথা মেনে কাল সবাই থেকে গেছে এই বাড়িতে। খাওয়া-দাওয়ার মাঝে টুকটাক কথা বার্তা বলে দু এক জন। নিলাংশ সে নিখুঁত চোখে সবকিছু পর্যবেক্ষণ করছে। হঠাৎ ইধা ফোনে কথা বলতে বলতে এসে ওর দাদা ভাইয়ের চেয়ারের পাশে বসে পড়ে। আরো মিনিট দুয়েক ফোনে কথা বলে ফোন রেখে ইধা এক পলক সবার দিকে তাকায়। মুহূর্তে চোখ সরিয়ে ওর দাদা ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলল,

‘ দাদু ভাই কাল তুমি তুষারের সঙ্গে চেন্নাই যাচ্ছো। আমার পরিচিত দুই একজন ডক্টর আছে। তারা কাল সকালের মধ্যে চেন্নাই পৌঁছে যাবে। ডক্টর পূজা মিত্রের স্যার ওখানে চাকরি করে। তুমি চিন্তা করো না আমি সব ব্যবস্থা করে ফেলেছি।’

খাওয়া থামিয়ে সবাই ইধার দিকে তাকালো। ইধা সেদিকে লক্ষ্য না করে ওর দাদা ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে আবার বলল,

‘ আমি তোমার সঙ্গে যেতাম কিন্তু কাল মুম্বাই ফিরতে হবে। কিছু ফটোশুট আছে।’

ইধার কথা থামতে না থামতে দাদিমা মৃদু চিৎকার করে বলল উঠলো।

‘ পরশু রাতে এলি এ বাড়িতে। মাঝে একটা দিন। কাল আবার তুই চলে যাবি এই অসুস্থ শরীর নিয়ে? কোথাও যাবি না তুই? একবার ও তোর মায়ের দিকে তাকিয়ে দেখেছিস? মেয়েটা তোর খবর জানতে পেরে সেই অস্ট্রেলিয়া থেকে চলে এসেছে আর তুই কী না সব ছেড়ে চললি শুটিং করতে!’

ইধা কয়েক মুহূর্ত থম দিয়ে বসে থেকে অধিক শান্ত গলায় বলল,

‘ কে এলো আর কে গেলো তাকে আমার কিছু যায় আসেনা। তোমার যদি বেশি অসুবিধে হয় আমাকে নিয়ে তাহলে আমি আর আসবো না এ বাড়িতে।’

কথা শেষ করে টেবিলের উপর থেকে ফোন আর সানগ্লাস হতে নিয়ে দিঘীর দিকে তাকিয়ে বলল,

‘ দিঘী আমি বাইরে ওয়েট করছি। থার্টিন মিনিটে মধ্যে রেডি হয়ে বাইরে আয়।’

আর কারো উত্তরের অপেক্ষা না করে হিল পড়া পায়ে হেঁটে চলে যায়। রেখে যায় সবার জন্য শুধু দীর্ঘ শ্বাস টুকু।

——————-

ইধা গাড়ি ড্রাইভ করছে। পাশে দিঘী বসা। ইরার আজ প্রথম ক্লাস না থাকলে কিছুক্ষণ পরে বের হবে, তবে রাজুর জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাতে যাবে। ইধা গাড়ি ড্রাইভ করার মাঝে সোজা রাস্তার দিকে তাকিয়ে বলল,

‘ তোদের ভার্সিটির পাশে কোন ভালো রেস্টুরেন্ট আছে? আই মিন ভিআইপি কেবিন সমৃদ্ধ।’

দিঘী এক ঝলক ইধার দিকে তাকিয়ে মৃদু স্বরে বলল,

‘ আছে তো! অনেকগুলোই আছে। আমাদের ভার্সিটির রাস্তার ওপরে অনেকগুলো রেস্টুরেন্ট আছে। কেনো আপু? ও বুঝছি তুমি সকালবেলা ব্রেকফাস্ট করে বের হও নি তার জন্য এখন রেস্টুরেন্টে খেতে যাবে!’

ইধা উত্তরে কিছু বলে না। তা দেখে দিঘী মন খারাপ করে ফেলে। মিনিট ত্রিশের মধ্যে ভার্সিটির গেটে গাড়ি থামায় ইধা। দিঘী কিছু না বলে গাড়ি থেকে নামতে শুরু করলে ইরা মৃদু স্বরে বলল,

‘ ভার্সিটির গেটে বারবার যে রেস্টুরেন্ট টা আছে এক ঘন্টার মধ্যে তোর বন্ধুদের নিয়ে ওখানে হাজির হবি।’

দিঘী কৌতুহল দমিয়ে রাখতে না পেরে বলল,

‘ কেনো? ওখানে ওদের নিয়ে যাবো কেনো?’

ইধা চোখে থাকা সানগ্লাস খুলে বলল,

‘ আমি তোর বোন, কোন বাঘ ভাল্লুক না যে আমার সঙ্গে কোনো কিছু শেয়ার করতে তো ভয় পাবি। আজ তোর কোন বন্ধুর জন্মদিন? যার সামনের আমাকে নিয়ে গিয়ে চমকে দিতে চেয়েছিলি। তার জন্য আমি এখানে এসেছি।’

দিঘী চোখ বড় বড় করে তাকায় ইধার দিকে। এটা যেন অবিশ্বাস্য ব্যাপার দিঘীর কাছে। কিঞ্চিৎ মুহূর্তের মধ্যে সবকিছু বোধগম্য হলে দিঘী জাপটে জড়িয়ে ধরে ইধা কে। খুশিতে চোখে পানি চিকচিক করছে দিঘী। অন্য রকম ভালোলাগা কাজ করছে দিঘীর মাঝে।

——————

ইশা এক মনে বসে আছে। মনের কোণে কৃষ্ণের ছায়া পড়েছে। কিছুতে মন বসছে না তার। তার জন্য মেয়েটা না খেয়ে বাড়িতে থেকে চলে গেছে। এখানে এসেছে পর থেকে মেয়েটা তার দিকে একবার চোখ তুলে তাকাই নি পর্যন্ত। অথচ অস্ট্রেলিয়া থাকা অবস্থায় কত কথা বলেছে দুজন। ছোট ছেলে আর তাদের বাবা বাড়িতে নেই। এসেছে পর থেকে চোখের দেখা দেখেনি। আর ইমন? সে তো চোখের দিকে তাকাতে পারে না হয়তো অপরাধবোধে। সব সময় গুরুজনদের মুখে একটা কথা শুনত, ক্রোধ মানুষকে অন্ধ করে দেয়। ক্রোধ শয়তানের আরেক রূপ। আজ অক্ষরে অক্ষরে কথাটার মানে উপলব্ধি করতে পারছে ইশা। তখন ক্রোধের বসেন দুজনেই হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল। যার জন্য আজ তাদের সুখের সংসার টার এমন অবস্থা। এইসব ভেবে বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস ফেলে ইশা।

———————

সময় যেনো খুব ধীর গতিতে চলছে। কখন থেকে ভার্সিটির সামনে রেস্তোরাঁয় বসে আছে। একনজর হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো দুই ঘণ্টার বেশি সময় হয়েছে ইধা রেস্টুরেন্টে বসে আছে। দিঘী ঘন্টা খানিক আগে মেসেজ দিয়ে জানিয়েছে ভার্সিটির একটা কাজে তারা সকলে আটকে গেছে। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে তারা চলে আসবে। ইধা কেবিন এর আশেপাশে চোখ বুলায়। সবকিছু একদম মার্জিত হয়েছে। এক ঘণ্টার মধ্যে এই রেস্তোরাঁর স্টাফদের দিয়ে রুমটা ফুল এবং বেলুন দিয়ে সাজিয়ে ফেলেছে। ইধার এখন বিরক্ত লাগছে। এখনো আসছে না কেন তারা? ইধার সঙ্গে বড় বড় ভিআইপি রা দেখা করার জন্য দিনের পর দিন অপেক্ষা করে থাকে। আর সেখানে কি না ইধা কয়েকটা বিচ্ছুর জন্য রেস্তোরাঁয় অপেক্ষা করছে। এসব ভেবে আনমনে হেসে ফেলে ইধা। সময় কাটাতে ইধা ফোনের লক খুলে ভিতরে প্রবেশ করে। গ্যালারিতে ঢোকার আগেই পিছন থেকে মিষ্টি স্বরে কেউ বলল,

‘ সরি, সরি আপু। আই অ্যাম রিয়েলি সরি। টাকলু স্যার টার জন্য আজ এমন হবে বুঝতে পারিনি। প্লিজ তুমি রাগ করো না।’

ইধা দিঘীর উত্তেজনা দেখে মাস্কের আড়ালে মৃদু হাসে। দিঘীর পাশের মেয়েটা দিঘী কে হালকা ধাক্কা দিয়ে বলল,

‘ দিঘী কে উনি? তুই না বললি রাজুকে সারপ্রাইজ দিবি তাহলে?’

দিঘী জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিয়ে বলল,

‘ বলছি, বলছি তুই আগে গিয়ে রাজুকে নিয়ে আয়। ওর চোখ বন্ধ করে নিয়ে আসবি কিন্তু!’

কৌতুহল নিয়ে মেয়েটা চলে গেলে দিঘী ইধার পাশে সোফায় বসে পড়ে। জোরে জোরে নিঃশ্বাস টাকলু স্যার টাকে মনে মনে আচ্ছা মত বকা দিতে শুরু করে। কবে না কবে বসন্ত উৎস আর তার জন্য আজ এমন গাঁদার মত খাটতে হয়েছে। উফ বিরক্তিকর!

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here