#তোমার_নামে_আমাকে_ডাকো
#লেখিকাঃ সারজীন ইসলাম
|পর্ব-১৫|
বিকাল চারটায় বেশি বাজে। সূর্য হেলে পড়েছে পশ্চিম আকাশে। সূর্যের আলোয় কমলাটে রং ধারণ করেছে। ইধা এক মনে গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে। আজকে দিঘী আর ওর বন্ধুদের সঙ্গে অনেক মজা করেছে। ওদের সঙ্গে আড্ডার মুহূর্তে সময় যে কোন দিক দিয়ে চলে গেছে বুঝতে পারেনি ইধা। ব্যক্তিগত কিছু কারণে ইরা আজ ভার্সিটিতে যায়নি। ফোনে রাজুকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়েছে। ইধা ফোনে সময় দেখে বাম পাশের রাস্তার দিকে তাকায়। দিঘী গাড়ি থামিয়ে কি যেন কিনতে বেরিয়েছে। দশ মিনিট হতে চলল অথচ তার কোনো দেখা নেই। মিনিট পাঁচেকের মাথায় দিঘী হাতে একটা ব্যাগ নিয়ে হেলেদুলে আসে। গাড়ির দরজা খুলে উঠে বসে ইধার দিকে ব্যাগটা এগিয়ে দিয়ে হাসি মুখে বলে,
‘ এই চকলেট গুলোর তোমার জন্য আপু। আমার কথা রাখতে তুমি এত কিছু করেছো তার জন্য আমি ভীষণ খুশি।’
ইধা হাসে দিঘীর বাচ্চামো দেখে। ইধা হাসি প্রসারিত করে বলল,
‘ আমি চকলেট খাই না দিঘী। চকলেট গুলো বরং তুই আর ইরা মিলে খেয়ে নিস।’
দিঘী অবাক গলায় বলল,
‘ বলো কি? তুমি চকলেট খাও না? কিন্তু আমার জানা মতে সব মেয়েরা যে চকলেট পছন্দ করে।’
ইধা দিঘীর দিকে খানিক তাকিয়ে বলল,
‘ কে বলল আমি চকলেট পছন্দ করি না? আর পাঁচটা মেয়ের মতো আমিও চকলেট পছন্দ করি। কিন্তু আমি চকলেট খেলে আমার দাঁতে প্রচন্ড ব্যথা হয়। তাই আমি চকলেট খাওয়া ছেড়ে দিয়েছি।’
দিঘী মন খারাপ করে বলল,
‘ ধুর, কোথায় ভাবলাম তুমি চকলেট গুলো পেয়ে খুশি হবে। ধুর!’
ইধা দিঘীর দিকে খানিক হাসি মুখে তাকিয়ে বলল,
‘ আমি ঝাল খাবার খেতে পছন্দ করি, পরে না হয় সময় করে তুই আমার জন্য ঝাল কোন খাবার তৈরি করেছ।’
দিঘী ঠোঁটে কোনে হাসি টেনে বলল,
‘ সত্যি তো? পরে আবার কথার নড়চড় হবে না তো?’
ইধা দুই আঙ্গুল দিয়ে দিঘীর নাক টান দিয়ে বলল,
‘ উঁহু, একদম কথার নড়চড় হবে না। তুই নিশ্চিন্তে থাকতে পারিস।’
ইধার কথা শুনে দিঘী তৃপ্তির হাসি হাসে। ইধা এক পলক তা দেখে নিজের ঠোঁটে হাসি ফুটায়।
———————-
হাতে গোনা শহরগুলো বাদ দিলে বাংলাদেশ বলতেই গ্রাম বাংলা। এই গ্রাম বাংলার অপরূপ রূপবৈচিত্র্যে এ দেশ গর্বিত। গ্রামের সৌন্দর্য নিটোল , এতটুকু কৃত্রিমতার ছোঁয়া নেই তাতে। যতদূর দৃষ্টি যায় সবুজ মাঠ, কোথাও কোথাও সবুজের অবগুণ্ঠন ভেদ করে সোনালি শস্যের উঁকিঝুঁকি। মেঠো পথের ধারে হয়তো বা মৌনী তাপসের মতো দাঁড়িয়ে ছায়া দিচ্ছে বিশাল বট কিংবা অশ্বত্থ গাছ। গাছপালায় ঘেরা ছোট ছোট ঘরগুলো ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড়। পুকুর, নদী, বিল কিংবা ঝিলে কাকের চোখের মতো স্বচ্ছ কালো জল। ফুটে আছে শাপলা সাদা, লাল কিংবা গোলাপি । এরই পাশে হয়তো একা ঝাঁক রাজহাঁস আপন মনে খেলছে জলের খেলা। ঠিক দুপুরে কাছেই কোথাও একটানা ডেকে চলেছে আসল বিরহী ঘুঘু । ক্লান্ত রাখাল গরু চরানোর ফাঁকে গাছের গুঁড়িতে হেলান দিয়ে বাঁশিতে তুলছে অপূর্ব সুর। গ্রাম বাংলার এই অকৃত্রিম সৌন্দর্যে রূপমুদ্ধ হয়েছে যুগে যুগে সবাই। গ্রাম বাংলার সন্ধ্যার রূপটি আরোও মধুময়। গোধূলি বেলায় রাখাল মাঠ থেকে গরু নিয়ে ফেরে। দিনান্তে কাজ শেষে গাঁয়ের চাষি ঘরে ফেরে, পাখিরা ফেরে নীড়ে। তাদের আপন ঠিকানায়। সূর্য প্রায় অস্ত যায় যায়। চারিদিকে এক অপার্থিব আলো। দুরে নীল আকাশের বুক চিরে দল বেঁধে উড়ে যায় বলাকারা। রাতে বাঁশ বাগানের মাথার ওপর চাঁদ ওঠে। ঢেলে দেয় জ্যোৎস্নার আলো। নিকোনো উঠোনে গাছের ছায়ার ফাঁকে ফাঁকে জ্যোৎস্নার আলো নানা আকৃতি নেয়, চলে আলো আঁধারির অপূর্ব খেলা। ছাদের নিস্তব্ধ পরিবেশে বিকেল থেকে এইসব আকাশকুসুম ভেবে চলেছে ইধা। সন্ধ্যার ফ্লাইটে মুম্বাইতে ফেরার কথা ছিল কিন্তু মুম্বাইয়ের প্রকৃতি অনুকূলে না থাকায় মুম্বাইয়ের ফ্লাইট বন্ধ আছে আপাতত। বিকেলে বাড়িতে ফেরার পর থেকে হাতে গোনা কয়েকজনের সঙ্গে শুধু কথা বলেছে ইধা। মাঝেমধ্যে খুব ইচ্ছে হয় মন উজাড় করে আপনজনদের সঙ্গে কথা বলতে কিন্তু ঐ যে অভিমান বলতে একটা কথা আছে না। তার জন্য কী আর সহজে এসব হবে? উঁহু, কখনো না? তা ইধা খুব ভালো করেই জানে। বিকেলে বাড়িতে ফেরার কয়েক মুহুর্ত পরে ছাদে এসে গ্ৰাম বাংলার সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে এসব ভাবছিল ইধা। বাড়িতে ফেরার পর পরই খবর পেয়েছে তার ছোটবেলার বন্ধু অন্ত এসেছিল তার খোঁজে। ইধা ঠিক করে রেখেছে ইরার হাতের কাজগুলো হয়ে গেলে ওকে সঙ্গে নিয়ে যাবে অন্তর বাড়িতে। তুষার কে পাঠিয়েছে ফুচকা, চটপটি, আইসক্রিম আর চকলেট কিনে আনার জন্য। আজ রাতে জমিয়ে আড্ডা দিবে অন্তর সাথে।
———————–
জ্যোৎস্না রাত আলােকময় প্রকৃতির এক বৈচিত্র্যময় উপহার। ভরা পর্ণিমার রাতে নিটোল চাঁদ তার ঝলমলে আলাের পসরা নিয়ে উপর আকাশে আবির্ভূত হয়। রুপালি জ্যোৎস্নার অনিন্দ্য সৌন্দর্যে অনবদ্যরূপে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে সমগ্র নিস নয়। চাদনি রাত প্রকৃতি প্রেমী মানুষের মনে বিচিত্র ভাব ও উদ্দাম আনন্দের সঞ্চার করে। চাদনি রাতের নৈসগিক পরিবেশ যেমন দৃষ্টিনন্দন, চিত্তাকর্ষক তেমনি উপভােগ্য। এ রাতে প্রকতি মায়াবী রূপ-মাধুর্যে ভরে ওঠে। পূর্ণিমা নিশিতে নির্জন অরণ্যের আলো-ছায়া জড়ানাে পথে ঘুরে বেড়ানাে— আহ! ভাবতেই মনটা কেমন অনির্বচনীয় আনন্দে রােমাঞ্চিত হয়। আর এই রোমাঞ্চকর রাতে ইধা, ইরা আর দিঘী বেরিয়ে পড়েছে অন্তদের বাড়িতে যাওয়ার উদ্দেশে। তাদের সঙ্গ দিচ্ছে তুষার। তার মতে মেয়ে মানুষ রাতের বেলা একা একা চলাফেরা করা ঠিক নয়। কখন কোন বিপদ উৎপেতে থাকে কেউ বলতে পারে না। তুষার বলেছিলো বাড়ির গাড়ি নিয়ে বের হতে, কিন্তু না, এই তিন বোন মিলে হেঁটে হেঁটে যাবে। অবশ্য বেশি দূরে নয় জমিদার বাড়ি থেকে অন্তদের বাড়ি। আর মিনিট পাঁচেক হাঁটলে পৌঁছে যাবে তারা।
অন্তর বাবা-মা ইধা কে তাদের বাড়িতে পেয়ে খুশির অন্ত নেই। অন্তর মা ইধাদের জন্য ইতিমধ্যে উনুনে রান্না চাপিয়েছে। সেই ছোটবেলায় দুই সই কে একসঙ্গে খাইয়ে দিতেন তিনি। বিশাল উঠানে শীতল পাটি বিছানো হয়েছে। সঙ্গে অন্তর চাচাতো ভাই বোন আছে। সবাই মিলে হৈ হল্লা দিয়ে আড্ডা দিচ্ছে। আর ইধা? সকালের আনন্দ দেখে তৃপ্তির হাসি ফুটে উঠে ইধার পদ্মফুলের নেয় ঠোঁটে।
চলবে