#তোমার_নামে_আমাকে_ডাকো
#লেখিকাঃ সারজীন ইসলাম
|পর্ব-১৬|
গ্রামে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হওয়ার সময়টা দারুণ। সকালের উঠোনের ব্যস্ততা নেই। সূর্য পশ্চিম আকাশে হেলে পড়েছে। সেই হেলে পড়া সূর্যের আলো নারিকেল সুপারির বাগান ভেদ করে এসে পড়ছে উঠোনে। মধ্যদুপুরের কড়া রোদ এখন মিষ্টি হয়েছে। সেই মিষ্টি রোদ গায়ে মাখছে দুটো কুকুর ছানা। একটা কুকুর ছানা সাদা রঙের অন্যটা কালো রঙের। দুপুরবেলা থেকে কুকুর ছানা দুটো পুকুর পাড়ে বসে ছিল আমার সাথে। কুকুর ছানা দুটো বলতে গেলে নিরার। এই কুকুর ছানা দুটোর মা’কে নিরা খুব ছোটবেলা থেকে লালন পালন করতো। এখানে বেড়াতে আসার পর আমার এই অভ্যাসটা হয়ে গেছে, ভরদুপুরে পুকুর পাড়ে বসে প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করা। সময়টা ভালোই কাটে। দুদিন হয় এসেছি এখানে। এখানে মানে জমিদার বাড়িতে। অনেকটা শ্বশুর বাড়ি ও বটে। দাদা শ্বশুর বাড়িতে বেড়াতে এসেছি। এসব ভেবে ক্ষীণ হাসে নিলাংশ। ক্লান্ত দুপুরের অলসতা কাটাতে প্রকৃতির মাঝে নিজেকে উৎসর্গ করেছে। নিলাংশের কাছে আজকে দিনটা অন্য পাঁচটা দিনের থেকে আলাদা, কারণ আজ পহেলা ফাল্গুন। আজ কেন জানি মনে প্রেম, প্রেম তীব্র ইচ্ছে জাগছে। নিজের হৃদয়গ্রাহী জন্য লিখে ফেলতে ইচ্ছে করছে হাজারো কবিতা। শুধু ইচ্ছে করছে উঠোনে বসে বিকেলের মিষ্টি রোদ গায়ে মাখি, দু চারটা নাম না জানা পাখির ডাক শুনাতে প্রিয়সি কে, রোদটা আরেকটু পড়ে এলে পুকুরপাড়ে বসে পাশের ঝোপের ঝি ঝি পোকার ডাক শুনাতে প্রিয়সি কে। ফাগুনকে কখনও এরূপে দেখিনি নিলাংশ। দেখবোই বা কেমন করে, ব্যস্ত অস্ট্রেলিয়া শহরের ইট পাথরের দালানে কেটেছে ছেলেবেলা। ফাগুন নিলাংশের কাছে চারুকলার আনুষ্ঠানিকতা , ফাগুন মানে নারীদের শাড়ি ও খোঁপার ফুলের চোখ ধাঁধানো হলদে রঙ। বসন্তবরণ নিলাংশের কাছে নিতান্তই আনুষ্ঠানিকতা। কারণ নিলাংশ যে কোনোদিন বসন্তের আসল রূপ দেখিনি। ঋতু পরিবর্তনের বিষয়টা নিলাংশের কাছে ধরা পড়েছে এখানে এসে! আজ পহেলা ফাল্গুন। আজ কেন জানি গত কয়েকদিনের ঠাণ্ডা বাতাসটা নেই। বাতাসে একটা মিষ্টি ভাব এসেছে। এ বাতাস ঠিক কেমন যেন, বর্ণনা করা যায় না। শীতের শুষ্ক বাতাসও না আবার বর্ষার আদ্র বাতাসও না। শুধু এটাই বলতে পারি যে বাতাসটা হৃদয়স্পর্শী। অনেকটা আমার ব্যক্তিগত হৃদয়স্পর্শীর মত। হৃদয়স্পর্শী কথাটা মনে করে বেশি গম্ভীর হয়ে যায় নিলাংশ! আজ সকাল বেলায় তার হৃদয়স্পর্শী চলে গেছে ব্যস্ত শহর মুম্বাইতে। কিন্তু তারপরও আমার হৃদয়স্পর্শী। বিকেল গড়িয়ে প্রায় সন্ধ্যা হতে চলল। ঝি ঝি পোকার ডাক শুনতে পাচ্ছে। আকাশে শরতের আভা যদিও এটা শরৎকাল নয়। নিজের অজান্তেই আজ বসন্তকে বরণ করে নিলো প্রকৃতির কাছে থেকে নিলাংশ। প্রকৃতির যতই কাছে যাচ্ছে ততই অবাক হচ্ছে নিলাংশ। শহরে এক নাগারে একই শব্দ বারবার শুনতে থাকলে বিরক্ত হয় কিন্তু এখানে ঝি ঝি পোকার ডাক গোটা সন্ধ্যা শুনেও এতোটুকুও বিরক্তিবোধ করলো না নিলাংশ। মনে হয় প্রকৃতি প্রেমী ছেলেটা এখানের পরিবেশে একেবারে মিশে গেছি কিংবা নিলাংশকে এই শান্ত প্রকৃতি নিজেদের করে নিয়েছে। বিকেলের আর বিন্দুমাত্র আলো বাকি নেই, সব মিলিয়ে গেছে কৃষ্ণবর্ণের আবছা হওয়া আকাশে। তারপরও আকাশ দেখছে। মিটিমিটি কিছু তাঁরা জ্বলছে। সন্ধ্যা তাঁরা ছাড়া আর কিছুই চেনে না সে। কিন্তু সেটাই নিলাংশের কাছে অনেক। সন্ধ্যা তাঁরার উজ্জ্বলতা আর সব তাঁরার আলোকে মলিন করে দিয়েছে। এখন সেই এই তাঁরাকেই দেখছে। ভয় হয়, একে হারিয়ে ফেলবো না তোহ! ছোটবেলা থেকে একাকী সময় এই সন্ধ্যা তারা কে নিজের প্রিয়সি হিসেবে ভেবে এসেছে সব সময়। নিজের মনের হাজারো কথা শুনিয়েছে সেই সন্ধ্যা তারা কে। সেই প্রাণাধিক প্রিয় সন্ধ্যা তারা হারিয়ে ফেলার কথা চিন্তা করলেও বুকের ভিতরে কেমন ধক করে ওঠে। আর সেই প্রাণাধিক প্রিয় সন্ধ্যা তারা কি না হারিয়ে যাবে? দেহে শেষ নিঃশ্বাসটুকু থাকা অবস্থায় তা কখনো হতে দিতে পারে না নিলাংশ। উঁহু, কখনো না! আকাশ সম চিন্তা ভাবনার মাঝে নিজের পাশে করো অস্তিত্ব টের পায় নিলাংশ। সামান্য ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে দেখে তাজ দাঁড়িয়ে আছে। তাজ কে এই সময় এখানে দেখে আপনার আপনি ভুরু কুঁচকে আসে নিলাংশের। মনে হাজারো প্রশ্ন ছক কষতে শুরু করে। এই রাতের বেলা পুকুর পাড়ে কি করছে তাজ? ওহ কী একা এসেছে? নাকি সঙ্গে আর কেউ এসেছে? প্রশ্নের উত্তর খুঁজে না পেয়ে নিলাংশ জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাজের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘ তুই? এই সময়ে এখানে কী করছিস? একা এসেছিস? না কি সঙ্গে কেউ এসেছে?’
তাজ ফোঁস করে নিঃশ্বাস নিয়ে বলল,
‘ দারোয়ান আঙ্কেলের সঙ্গে এসেছি। তিনি আমাকে পৌঁছে দিয়ে চলে গেছেন। কিন্তু তোমার কি হয়েছে ভাইয়া? বাড়ির সবাই কেমন যেন একটা হয়ে গেছে! ইধা আপু, দাদাভাই কে সঙ্গে নিয়ে সকালবেলা চলে গেছে। তখন থেকে বাড়ির সবার মন খারাপ। আর এদিকে সেই দুপুর বেলা থেকে তুমি এখানে বসে আছো? তোমার ও কি মন খারাপ ভাইয়া?’
নিলাংশ হেসে ফেলে তার ভাইয়ের ওর জন্য ভালোবাসা দেখে। সারাদিন যতই ঝগড়াঝাঁটি করুক না কেন দিন শেষে সেই ওর বুকে মাথা রেখে ঘুমাই তাজ। নিলাংশ তাজ কে নিজের পাশে ডেকে বসতে বলে বলল,
‘ মন খারাপ হতে যাবে কেন আমার? এখানে আসার পর থেকে আমার মন নিদারুণ ভালো আছে। তার প্রধান কারণ হলো তোর ভাবি এবং প্রকৃতি।’
তাজ বিস্ময় গলায় বলল,
‘ ভাবি? কিন্তু তুমি না আমাকে ইধা আপুকে ভাবি ডাকতে নিষেধ করেছিলে। তাহলে?’
নিলাংশ ঠোঁটে চেপে হেসে বলল,
‘ আমি তো এখনো তাই বলছি। ইধা কে ভাবি ডাকার দরকার নেই। তুই শুধু নিরা কে ভাবি বলে ডাকবি। কেমন!’
তাজ ছোট ছোট চোখে নিলাংশের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘ অতি শোকে কিংবা কষ্টে তোমার মাথা কি নষ্ট হয়ে গেছে ভাইয়া? দুটো মানুষই তো একজনই। ইধা আপু কিংবা নিরা আপু দু’জনেই তো একজন মানুষ। তুমি কি এ কথা জানো না ভাইয়া?’
তাজের কথা শুনে নিলাংশ শব্দ করে হেসে উঠলো। মানব জীবনের সব থেকে সুন্দর এবং মধুর সম্পর্ক হলো ভালোবাসা, আর এই সুন্দর এবং মধুর সম্পর্কটা তৈরী হয় পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস, যত্ন, ঘনিষ্ঠতা, আকর্ষণ এবং স্নেহের মধ্য দিয়ে। ভালোবাসার এই সম্পর্ক কে একটু নতুন ভাবে আবিষ্কার করতে চায় নিলাংশ। তার হৃদয়স্পর্শী কে সঙ্গে নিয়ে প্রকৃতির মাঝে নিরুদ্দেশ হতে চায়। কোন মতে হাসি থামিয়ে বলল,
‘ এ কথা তোকে কে বলল দুটো মানুষ এক? এই দুটো মানুষের মধ্যে আকাশ পাতাল পার্থক্য। ইধা সে হলো একজন নামকরা সেলিব্রিটি, আর নিরা সে তো আমার হৃদয়স্পর্শী। আমার প্রিয়সি। তাহলে দুটো মানুষ এক হল কীভাবে?’
তাজের ছোট্ট মস্তিষ্কে এমন কঠিন, কঠিন বাক্য বিচরণ করতে অক্ষম হয়। তাজ ফ্যালফ্যালে চোখে নিলাংশের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘ আমি তোমার এমন কঠিন কঠিন কথার মানে বুঝতে পারছি না ভাইয়া!’
নিলাংশ হেসে ফেলে বলল,
‘ থাক, এখন আর আপনাকে আমার কঠিন, কঠিন বাক্যের মানে বুঝতে হবে না। আপনি যখন বড় হবেন আপনি তখন নিজে থেকে বুঝতে পারবেন। বুঝলেন তাজ বাবু?’
তাজ অভিজ্ঞদের মত মাথা নাড়িয়ে সায় জানালো যে, সে তার ভাইয়ের কথার মর্ম বুঝতে পেরেছে। কিন্তু আদৌ কিছু বুঝতে পেরেছে কিনা এই ভেবে নিলাংশ শব্দ করে হাসতে শুরু করে।
চলবে