#তোমার_নামে_আমাকে_ডাকো
#লেখিকাঃ সারজীন ইসলাম
|পর্ব-১৭|
আলাে-আঁধারের স্নিগ্ধ মিতালিতে ঝলমল করে ওঠে জ্যোৎস্নাপ্লাবিত রাত। এমন রাতে অস্পষ্ট মায়ালােকে নিমজ্জিত থাকে প্রকৃতি। প্রকৃতির পরতে পরতে ছড়িয়ে পড়ে এক কোমল পরশ। বসন্তের নির্মেঘ আকাশে অথবা চৈত্রের পূর্ণিমার মেঘহীন আকাশে তারার ফুলঝুরি ফোটে। গাছগাছালির দিকে দৃষ্টি দিলে দূর থেকে দেখলে মনে হয় ফুলের সাথে চাদের রুপালি আলাের মিতালি ঘটেছে। আবার মনে হয়, যেন শুভ্র বসন পরিহিত পরির দল নেচে নেচে চাদনি রাত কে স্বাগত জানাচ্ছে। আলােয় স্নাত প্রকৃতি যেন সেজেগুজে কার প্রত্যাশায় তৈরি হয়ে থাকে। বনে-বাগানে, পথে-প্রান্তরে, আকাশে-বাতাসে সৌন্দর্য, আনন্দ ও উচ্ছলতা ছড়িয়ে পড়ে। চারদিকেই আলাের শিহরণ, প্রাণের চাঞ্চল্য বিরাজ করে। আলােয় আলােয় দিক-দেশ-প্রান্তর হেসে ওঠে। আলাের আল্পনায় অপরূপ হয়ে ওঠে প্রকৃতি কন্যা। জ্যোৎস্না ছড়িয়ে পড়ে ব্যস্ত শহরে, বনে বাঁদাড়ে, গ্রাম বাংলায়, পদ্ম দীঘির সরোবরে। আলােয় ভরা চাঁদের তরী হালকা মেঘের পাল তুলে ভেসে-বেড়ায় আকাশ গঙ্গায়! শ্যামল প্রকৃতি জ্যোৎস্নার প্রাবনে ডুবে যায়। ঘন সবুজ নতুন পল্লবের শিশির মত স্নাত, চাদের আলােয় তা মুক্তার মতাে চিকচিক করে। এত রূপ, এত বৈচিত্র্য, এমন গভীর মূরতি, স্নিগ্ধ সজল সুহাসিনী রাত একমাত্র পর্ণিমার জ্যোৎসালােকেই প্রত্যক্ষ করা যায়। জ্যোৎস্না বিধৌত প্রকৃতিতে দুচোখ রেখে মুগ্ধ বিস্ময়ে আত্মবিমােহিত হয়ে ইধা সেই সৌন্দর্য নিখুঁত চোখে উপভোগ করছে। ইধা গাড়ির জানালার কাঁচ নামিয়ে উপভোগ করছে প্রকৃতির সৌন্দর্য। এই সৌন্দর্যের যেন শেষ নেই। ঘন্টা খানেকের মত হবে ফটোশুট শেষ হয়েছে। কাল আবার বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কয়েকটা মিটিং আছে। বিকেলের ফ্লাইটে দাদা ভাইয়ের সঙ্গে চেন্নাই তে যেতে হবে। ডক্টর পূজার মিত্রর স্যারের স্ত্রী হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে পড়ায় তিনি দুদিন ধরে ছুটিতে আছেন। হসপিটালে আজ তার জয়েন করার কথা। কাল সকালে একবার ডক্টর পূজা মিত্রর সঙ্গে ফোনে কথা বলতে হবে। দাদু ভাইয়ের বিষয়ে কোন রিক্স নিতে রাজি নয় ইধা। ছোটবেলা থেকে বাবা-মায়ের অবর্তমানে দাদুভাই আর দাদীমা আগলে রেখেছে তাকে। সেই দাদুভাইয়ের কিঞ্চিৎ পরিমাণ কষ্ট সহ্য করতে পারবে না ইধা। এদিকে সকালবেলা মুম্বাই এয়ারপোর্ট থেকে বেরোনোর সময় মিডিয়ার লোকজন ঘিরে ধরে দাদুভাই আর ইধা কে। জমিদার রাহাত খান চৌধুরীর সঙ্গে তাকে দেখে মিডিয়ার লোকজন নানাবিধ প্রশ্ন শুরু করে দেয়। ইধা কারো পরোয়া না করে জনসম্মুখে প্রকাশ করে তার পরিচিত। ইধার পরিচয় জানার পর মিডিয়ার লোকজন এবং আশেপাশে উপস্থিত যারা ছিল তারা বেশ চমকায়। ইধা বেশ জানে এই বিষয় নিয়ে কাল নিউজপেপারে বড় বড় আর্টিকেল ছাপানো হবে। ইতিমধ্যেই হয়তো ইন্টারনেট দুনিয়ায় ছেয়ে গেছে এই বিষয়টা। এসব ভাবে ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে ইধা।
ড্রইংরুম বেরিয়ে যাওয়ার সময় ইধা লক্ষ করে দাদু ভাইয়ের জন্য নির্ধারিত রুমটিতে এখনও আলো জ্বলছে। ইধা ভুরু কুঁচকে দেওয়াল ঘড়ির দিকে তাকায়। রাত তিনটে বাজবে বাজবে ব্যবস্থা। এত রাত পর্যন্ত দাদুভাই জেগে আছে ভেবে কপালে চিন্তার ভাঁজ ফুটে। হাতে থাকা ব্যাগ আর ফোন সোফার উপর রেখে পা বাড়ায় দাদু ভাইয়ের রুমের দিকে। রুমের দরজা খোলা থাকায় নির্দ্বিধায় প্রবেশ করে ইধা। বিছানায় আধশোয়া হয়ে বই পড়ছে দাদুভাই। ইধা চোখ ছোট ছোট করে ওর দাদু ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘ তুমি এত রাত পর্যন্ত জেগে আছো কেন দাদুভাই? শরীর খারাপ করবে তো! ডাক্তার তোমাকে নিষেধ করেছে না বেশি রাত পর্যন্ত জাগতে? তাহলে? আর এখন কি তোমার বই পড়ার সময়? তুমি নিয়ম মেনে চলতে এত গাফিলতি করো কেন দাদুভাই?’
হঠাৎ করে কারো কণ্ঠস্বর শুনে চমকে ওঠে রাহাত খান চৌধুরী। পরক্ষণে নিজের আদরের নাতনি কে দেখতে পেয়ে ঠোঁটে হাসি ফোটে। তার আদর মাখা বকুনি শুনে ঠোঁটের হাসি আরো প্রসারিত করে। নতুন জায়গায় সঙ্গে মানিয়ে নিতে তার সময় লাগে। তিনি তার বিছানা ছাড়া কখনো শান্তিতে ঘুমাতে পারে না। তার ওপরে নতুন জায়গা নতুন পরিবেশে খাপ খাইয়ে নিতে তার সময় লাগবে। একথা তো তার আদরের নাতনি কে বুঝতে দেওয়া যাবে না। তাহলে হয়তো মেয়েটার মনে খারাপ লাগা সৃষ্টি হতে পারে। তিনি ইধা কে হাতের ইশারায় কাছে ডাকে। ইধা গাল ফুলিয়ে তার দাদু ভাইয়ের পাশে গিয়ে বসে। হাতে থাকা বই টা পাশে রেখে ইধার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
‘ তোর অপেক্ষায় ছিলাম আমি দাদুভাই। এত রাত করে ফেললি যে?’
ইধা ছোট করে বলল,
‘ কাজ ছিল দাদুভাই।’
নিঃশ্বাস নিয়ে ইধা আবার বলল,
‘ নেও এবার ঘুমিয়ে পড়ো। রাত তো আর কম হলো না। কাল আবার অনেক জার্নি করতে হবে।’
দাদুভাই বলল,
‘ সে না হয় ঘুমলাম। কিন্তু তুই কী প্রতিদিন ই এমন রাত করে বাড়ি ফিরিস?’
ইধা কিছুক্ষণ থেমে বলল,
‘ প্রতিদিন নয় কিন্তু অধিকাংশ সময়ই রাত করে বাড়ি ফিরতে হয়। আচ্ছা দাদুভাই তোমার জানতে ইচ্ছে করে না আমি এই অভিনয়ের জগতে কীভাবে প্রবেশ করলাম? কেনোই বা তোমাদের থেকে এত বছর দূরে ছিলাম। তোমরা হাজার খুঁজেও আমাকে খুঁজে পাওনি কেনো? জানতে ইচ্ছে করে না এই সব প্রশ্নের উত্তর?’
দাদুভাই ইধার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘ জানতে ইচ্ছে করে বৈ কী? খুব জানতে ইচ্ছে করে। আমার সেই ছোট্ট দাদুভাই কিভাবে এতগুলো বছর নিজের সঙ্গে নিজের লড়াই করে গেছে তা আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে। সবকিছু প্রকাশ পাওয়ার একটা নির্দিষ্ট সময়ে রয়েছে। হয়তো এই রহস্য প্রকাশের সময় এখনো হয়নি। তাই আমার দাদু ভাই আমাকে এই বিষয়ে কিছু বলেনি। তবে আমি অপেক্ষায় থাকবো আমার দাদু ভাইয়ের জীবন সংগ্রামের গল্প শোনার জন্য। কী দাদুভাই শোনাবে তো তোমার জীবনের গল্প?’
ইধা উঠে গিয়ে খাটের ওপাশের বিশাল কাঁচের জানলার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। মুম্বাই শহরের মধ্যরাতের ব্যস্ততা দিকে নিস্পলক চোখে তাকায়। কয়েক মিনিটের মাথায় ইধা শান্ত গলায় বলল,
‘ তোমার মনে আছে দাদুভাই আমি তখন পঞ্চম শ্রেণীতে পরীক্ষা দিয়ে অবসর সময় পার করছিলাম, তখন ফুপি দাদুর ছোট ছেলের বিয়ে উপলক্ষে আমরা সবাই সেই বাড়িতে গেলাম। বিয়ে উপলক্ষে হাসি-আনন্দে কাটছিল আমার দিন। আমার বয়সী বাচ্চাদের সঙ্গে সারাদিন খেলাধুলা হৈ-হল্লা নিয়ে পড়ে থাকতাম। বিয়ের আগের দিন রাতে আমরা যখন সবাই বাগানে বসে খেলছিলাম তখন কোথা থেকে একটা ছেলে এসে আমাকে একটা ফুল দিয়ে বলে, তুমি আমার বউ হবে? আমি পুতুল খেলার বর বউ এর কথা চিন্তা করে হ্যাঁ বলে দেই। কিন্তু কে জানত এই হ্যাঁ আমার জীবনের কাল নামিয়ে আনবে। তখন ইমন ভাইয়া আমাদের পাশে দাঁড়িয়ে আমাদের সমস্ত কথা শুনছিল। ছেলেটাকে ধমকে ওখান থেকে পাঠিয়ে দিয়ে, আমাকে প্রচন্ড বকাবকি করে। যে ভাইয়া আমাকে কখনো কিছু বলেনি তার এমন রুক্ষ ব্যবহার আমি মেনে নিতে পারিনি। অভিমান হয় আমার ভাইয়ার প্রতি। খুব অভিমান। পরেরদিন বাবা বিয়ে বাড়িতে এলে, ভাইয়া সবকিছু বাবাকে বলে দেয়। বাবার আমাকে ডেকে সকলের সামনে আমার গালে চড় লাগিয়ে দেয়। রাগে, অভিমানে, দুঃখে আমি ঘরে নিজেকে বন্ধ করে রাখি। বিয়ের অনুষ্ঠান শেষ হলে বাড়ি ফিরে বড় ভাইয়া আর বাবার সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দেই। কিছুদিনের মধ্যে তোমাকে বলি আমাকে বাড়ি থেকে অনেক দূরে পাঠিয়ে দিতে, কিন্তু তুমি তো প্রথমে কিছুতেই রাজি ছিলেন না। অনেক কষ্টে তোমাকে রাজি করিয়ে ছিলাম। তারপরে তুমি আমাকে নিয়ে গেলে দিল্লির বোর্ডিং স্কুলে। সেখানকার প্রিন্সিপাল ছিল তোমার পরিচিত। এক বছর যাবত তোমাদের সবার সঙ্গেই আমার যোগাযোগ ছিল। এক বছর পরে তোমার সেই পরিচিত প্রিন্সিপাল স্যার রিটার্ড করে। স্কুলে আসে নতুন প্রিন্সিপাল। বাবা আর ভাইয়ার প্রতি অভিমান দিন দিন বাড়তে বাড়তে সেই ছোট বয়সে সিদ্ধান্ত নেই তোমাদের কারো সঙ্গে আর যোগাযোগ রাখব না। হারিয়ে যাবো একা অজানার উদ্দেশ্যে, যেখান থেকে তোমরা কেউ আমাকে খুঁজে পাবে না। হলোও তাই তোমরা কেউ আমাকে খুঁজে পাওনি। আমি যদি নিজের ইচ্ছায় ধরা না দিতাম তাহলে এখনো তোমরা আমাকে খুঁজে পেতে না। স্কুলের সেই নতুন প্রিন্সিপাল ছিল আমার বেস্ট ফ্রেন্ডে রুহির খালামণি। দিল্লিতে এসেছি পর রুহির সঙ্গে আমার প্রথম বন্ধুত্ব হয়। রুহি দিল্লির স্থানীয় ছিল, তাই তাকে স্কুলের হোস্টেলে থেকে পড়ার দরকার পড়েনি। বাড়ি থেকে স্কুলে আসতো। সাপ্তাহিক ছুটিতে আমিও মাঝে মাঝে ওদের বাড়িতে যেতাম। বাবা আর ভাইয়ার সাথে অভিমান করে একদিন হোস্টেল থেকে পালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেই কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে রুহির খালামণির কাছে ধরা পড়ে যাই। তিনি আমার মুখ থেকে সবকিছু শুনে সিদ্ধান্ত নেয় আমি হোস্টেলে থেকে লেখাপড়া করব, কিন্তু আমার উপস্থিতি কেউ জানতে পারবে না। শুধু প্রিন্সিপাল ম্যাম নয় স্কুলের আরো কয়েকজন স্যার এবং ম্যাডামের আমাকে এ বিষয়ে অনেক হেল্প করেছে। তুমি যখন আমার নিখোঁজ হওয়ার কথা শুনে তড়িঘড়ি করে দিল্লির বোর্ডিং স্কুলে গেলে তখনো প্রিন্সিপাল ম্যাম আমাকে ওখান থেকে সরিয়ে নেয়। পাঠিয়ে দেয় রুহিদের বাড়িতে। সেই থেকে আমার লুকোচুরি খেলা শুরু।’
ইধা থামে। তাকায় তার দাদু ভাইয়ের দিকে। তার চোখে-মুখে বিস্ময় এর ছাপ। ইধা আলতো হেসে আবার বলল,
‘ কী হলো দাদুভাই এইটুকু তেই চমকে উঠলে চলবে? এখনো তো আরো অনেক কিছু জানা বাকি তোমার!’
কথাটা বলেই ইধা হেসে ফেলে। যেনো চোখে-মুখে প্রকাশ পাচ্ছে রহস্যময়ী হাসি।
চলবে