তোমার নামে আমাকে ডাকো পর্ব-১৯

0
3382

#তোমার_নামে_আমাকে_ডাকো
#লেখিকাঃ সারজীন ইসলাম

|পর্ব-১৯|
শুক্ল পক্ষের প্রতিপদ থেকে শুরু করে এক এক কলা বুদ্ধি পেতে পেতে পঞ্চমীতে এসে চাঁদের ষোলােকলা পূর্ণ হয়। সেদিন দিবাগত সন্ধ্যার অন্ধকার কেটে বন-বৃক্ষরাজি, নদী-নালা, প্রকৃতি ভেদ করে চাঁদ তার উজ্জ্বল স্নিগ্ধ আলাে ছড়িয়ে দেয় আর সঙ্গে সঙ্গে দশ দিক খুশিতে ঝলমল করে ওঠে। ঝলমল করে দিঘির জল, টিনের চালা, নারকেলের পাতা। শুক্ল পক্ষের পঞ্চমীই পূর্ণিমা। পঞ্চমীর রাতে নিশিপতি চাঁদ তার পূর্ণ শশাভা নিয়ে আকাশে আলাের আসর জমায়। সারা রাত জ্যোৎস্নার বাধ ভাঙা হাসি হাসে রূপ-বিলাসী পূর্ণ শশধর। জ্যোৎস্নার অনুরাগে বিহ্বল হয়ে ওঠে বসুন্ধরা। মৌন প্রকৃতির বুকে জেগে ওঠে বিচিত্র অনুভূতি। সমগ্র প্রকৃতিকেই যেন মনে হয় একটি বাঅয় মূর্ত কবিতা। জ্যোৎস্নার চুমু খেয়ে প্রকৃতি স্বতন্ত্র বৈচিত্র্য নিয়ে স্বপ্নীল হয়ে ওঠে। সৃষ্টি যেন স্বপ্নে কথা বলার বাসনায় উন্মুখ। শুধু মানব মনে নয়, বিপুলা পৃথিবীর সর্বত্রই অব্যক্ত ধ্বনির পুঞ্জ। উন্মত্ত আনন্দের জোয়ার।

আলাে-আঁধারের স্নিগ্ধ মিতালিতে ঝলমল করে ওঠে জ্যোৎস্নাপ্লাবিত রাত। এমন রাতে অস্পষ্ট মায়ালােকে নিমজ্জিত থাকে প্রকৃতি। প্রকৃতির পরতে পরতে ছড়িয়ে পড়ে এক কোমল পরশ। শরতের নির্মেঘ আকাশে অথবা বৈশাখী পূর্ণিমার মেঘহীন আকাশে তারার ফুলঝুরি ফোটে। নদীর ধারের কাশবন দূর থেকে দেখলে মনে হয় সাদা কাশফুলের সাথে চাদের রুপালি আলাের মিতালি ঘটেছে। আবার মনে হয়, যেন শুভ্র বসন পরিহিত পরির দল নেচে নেচে চাঁদনি রাতকে স্বাগত জানাচ্ছে। আলােয় স্নাত প্রকৃতি যেন সেজেগুজে কার প্রত্যাশায় তৈরি হয়ে থাকে। বনে-বাগানে, পথে-প্রান্তরে, আকাশে-বাতাসে সৌন্দর্য, আনন্দ ও উচ্ছলতা ছড়িয়ে পড়ে। চারদিকেই আলাের শিহরণ, প্রাণের চাঞ্চল্য বিরাজ করে। আলােয় আলােয় দিক-দেশ-প্রান্তর হেসে ওঠে। আলাের আল্পনায় অপরূপ হয়ে ওঠে প্রকৃতিকন্যা। জ্যোৎস্না ছড়িয়ে পড়ে নদীর জলে, কাশ বনে, শেফালি বনে, পদ্মঝাড়ে। আলােয় ভরা চাঁদের তরী হালকা মেঘের পাল তুলে ভেসে-বেড়ায় আকাশ গঙ্গায়! শ্যামল প্রকৃতি জ্যোৎস্নার প্রাবনে ডুবে যায়। প্রশস্ত নদীর ঘােলা জলে চাঁদের আলাে ঝিলমিল করে। চাঁদ জলের আয়নায় তার মুখ দেখতে চায় কিন্তু ঢেউয়ের দোলায় তার শঙ্গার-বিলাসে ব্যাঘাত ঘটে। তখন এক চাঁদ নদীর জলে শত চাঁদ হয়ে দোল খায়। ধানের ঘনসবুজ নত পল্লব শিশির স্নাত, চাঁদের আলােয় তা মুক্তার মতাে চিকচিক করে। এত রূপ, এত বৈচিত্র্য, এমন গভীর মূরতি, স্নিগ্ধ সজল সুহাসিনী রাত একমাত্র পর্ণিমার জ্যোৎসালােকেই প্রত্যক্ষ করা যায়। জ্যোৎস্না বিধৌত প্রকৃতিতে দুচোখ রেখে মুগ্ধ বিস্ময়ে আত্মবিমােহিত। সন্ধ্যার মেঘ মুক্ত আকাশের দিকে তাকিয়ে নিলাংশ চন্দ্রের বিবরণ তুলে ধরে তাজের কাছে। তাজ ইধার কোলে বসে মনোযোগ দিয়ে সেই বিবরণ শুনছে। ইধার নিলাংশের বল বক্তব্য দিকে কোন মন নেই। সে নিজ ভাবনায় মশগুল। সন্ধ্যার পরে নিজের রুমে বসে টিভি দেখছিল ইধা। তখন কোথা থেকে তাজ আসে, ইধা কে তার সাথে যাওয়ার জন্য বায়না করে। ঠিক তখনই রুমে প্রবেশ করে তাজের মা আর চাচী। হঠাৎ তাদের এই রুমে দেখে ভুরু কুঁচকায় ইধা। আনমনে তাদের এখানে আসার কারণ খুঁজতে শুরু করে। তার ভাবনার সমাপ্তি ঘটিয়ে তাজের মা বলল,

‘ অস্ট্রেলিয়ায় নিঝুমের বিয়েতে তুই আমাদের সঙ্গে কত মজা করেছিলি। তখনতো জানতিস না তোর সঙ্গে আমাদের রক্তের সম্পর্ক রয়েছে। আর এখন, যখন জানতে পেরেছিস, আমাদের সঙ্গে তোর রক্তের সম্পর্ক আছে, তখন থেকে অপরিচিতের মতো ব্যবহার করছিস। কেনো? কেমন করছিস তুই নিরা? একবার অন্তত তোর মায়ের কথা ভাব। মানুষটা বছরের-পর-বছর তোর কথা ভেবে কষ্ট পেয়ে গেছে। তার এই আকাশ সম কষ্টের তোর কাছে কি কোন মূল্য নেই? কি হলো নিরা চুপ করে গেলি কেন? বল?’

ইধা শান্ত চোখে তাকায় তাদের দিকে। তাজ ইধার হাত ধরে ওর মায়ের দিকে তাকিয়ে আছে। ইধা কয়েক মুহুর্ত পরেই সূক্ষ্ম গলায় বলল,

‘ আমিতো তাকে কষ্ট পেতে বলিনি আন্টি?’

তাজের চাচি অবাক গলায় বলল,

‘ আন্টি? তুই তোর মামিদের আন্টি বলছিস কেন নিরা?’

ইধা কিঞ্চিৎ পরিমাণ হেসে বলল,

‘ আর কি বলব তোমাদের? যার মাধ্যমে সম্পর্কে সুতো, সেই সম্পর্কের সুতো যখন নড়বড়ে। তখন ডাকে কী এসে যায়।’

ইধার মুখে এমন গুরুগম্ভীর বাক্য শুনে, তার ভিতরে লুকিয়ে থাকা কষ্ট গুলো খানিকটা হলেও আন্দাজ করতে পেরেছে তারা।

ইধা ভাবনার সমাপ্তি ঘটিয়ে ছাদের দিকে তাকায়। সন্ধ্যার পর থেকে ছাদে তাঁর কাজিনদের সমাগম। নিলাংশের চন্দ্র বিবরণ অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে। তাজ ইধার ফোন নিয়ে কিছু একটা করছে। আর অহন রুহির ফোন নিয়ে। হঠাৎ চোখ পড়ে নিলাংশের দিকে, মিস্টার নিলাংশ অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে আছে ইধার দিকে। অন্তরালে শীতল করা তার দৃষ্টি। বুকের ভিতরে অদ্ভুত অনুভূতি সৃষ্টি হয় ইধা। ইধা নিজের অনুভূতি প্রসারিত হওয়ার আগে চোখ সরিয়ে নেয়। মনে পড়ে যায় এই দুই দিনের ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো তার।

ইধার বাবা এতদিনে ইধার মার অভিমান কিছুটা হলেও কমাতে পেরেছে। প্রথম দিকে ইধার মা অভিমান করে ইধার বাবার সঙ্গে কথা বলতো না, তবে ইদানিং দেখা যাচ্ছে দু’জন দু’জনের সঙ্গে টুকটাক কথা বলে।

এর মধ্যে বাড়ির একজন কাজের লোক এসে জানালো, বাড়ির বড়রা তাদের সবাইকে নিচের বৈঠকখানায় ডাকছে। কথাটা শোনার পরে একে একে সবাই নিচে নেমে পড়ে। বৈঠকখানায় বড়োসড়ো আসর বসেছে। মিথিলা আর অন্তরের বাবা-মা সেখানে উপস্থিত আছেন। দিঘীর বাবা বাড়ির ছোটদের সবাইকে বসতে বলে। ইধা সিঙ্গেল সোফায় বসে সবার কার্যালয় একনজর পরখ করে, নিজের ফোনে দৃষ্টি ফেলে। অনেকক্ষণ কথা বাত্রা এরপরে রাহাত খান চৌধুরী বলল,

‘ মিথিলার সঙ্গে আমার বড় নাতির বিয়ের পাকা কথা হয়ে আছে। এবার আমি চাইছি আমার ছোট নাতির সঙ্গে অন্তরের বিয়ে দিতে। এই বিষয়ে তোমার কি মতামত রহমত আলী? মেয়ে তোমার? তোমার মতামত ছাড়া তো এই বিষয়ে সামনে এগোনো যাবে না।’

জমিদার রাহাত খান চৌধুরীর বক্তব্য শুনে অধিকাংশ লোক বিস্ময় চোখে তার দিকে তাকায়। হাতেগোনা কয়েকজন ছাড়া সবার চোখে-মুখে হতবাকের ছাপ। রহমত আলী গলা পরিষ্কার করে বলল,

‘ চাচা আপনি যে আপনাদের বাড়ীর বউ করতে আমার অন্তর মায়ের হাত চেয়েছেন, এই আমাদের পরম সৌভাগ্য। কিন্তু চাচা আপনাদের সঙ্গে কি আমাদের আত্মীয়তা খাটে? কোথায় আপনারা বিশাল বড়লোক? সেখানে আমি একজন মধ্যবিত্ত মানুষ মাত্র!’

রাহাত খান চৌধুরী কট কট গলায় বলল,

‘ রহমত তুমি জানো আমি কখনোই জাত পাতের ভেদাভেদ করিনি। আমার কাছে সবার আগে অগ্রাধিকার পায়, একজন ব্যক্তি সে মানুষ হিসেবে কেমন। তাছাড়া তুমি হয়তো জানো না আমার ছোট নাতি তোমার মেয়ে কে ভালোবাসে। অন্তর জন্য এর আগে অনেক ভালো ভালো সম্বন্ধ এসেছিল। আমার নাতি নিজ দায়িত্বে সব সম্বন্ধ ভেঙে দিয়েছে।’

রাহাত খান চৌধুরীর কথা শুনে সবাই বিস্ফোরিত চোখে ঈশানের দিকে তাকায়। ঈশান অবাক চোখে তাকিয়ে আছে তার দাদু ভাইয়ের দিকে। ঈশানের মতে তার দাদু ভাইয়ের এই কথা জানার তো কথা নয়, ঈশানের বড় ভাই ইমন আর হাতে গোনা কয়েকজন বন্ধু ছাড়া এ কথা তো আর কেউ জানে না। তাহলে দাদুভাই কীভাবে জানলা এ কথা? রাহাত খান চৌধুরী তার নাতির মনের অবস্থা বুঝতে পেরে ঠোঁটে বাঁকা হাঁসি ফুটিয়ে আবারো বলল,

‘ কী ভাবছো এ কথা আমি জানলাম কীভাবে তাই তো? তুমি, তোমার বড় ভাই এবং তোমার বন্ধুরা মিলে তো অনেক চেষ্টা করলে, তোমার এবং অন্তর কথা যেন পাঁচ কান না হয়। কিন্তু কি করবে বলো, আমি তো জেনে গেছি। প্রথমে আমি এসব কথা কিছুই জানতাম না। সপ্তাহখানেক এর মত হবে এসব সত্য আমি জানতে পেরেছি।’

এইটুকু বলে রাহাত খান চৌধুরী থামে, নিঃশ্বাস নিয়ে সবার দিকে তাকায়। সবার চোখে-মুখে বিস্ময় ছাপ। তা দেখে রাহাত খান চৌধুরী আলতো হাসে। দিঘী কৌতুহলী হয়ে বলল,

‘ দাদুভাই তুমি কি সত্যি কথা বলছো, আমাদের ভাইয়া অন্ত আপুকে ভালোবাসে? কিন্তু ভাইয়ার হাবভাবে কখনো তা প্রকাশ পায়নি? সব সময় গম্ভীর মুখে থাকে। দাদুভাই তুমি কিভাবে জানতে পারলে, ভাইয়ার পাতালে লুকিয়ে থাকা রহস্য?’

রাহাত খান চৌধুরী ইধার দিকে তাকিয়ে বলল,

‘ আমাদের বাড়িতে একজন সিআইডি অফিসার আছে না, যে সাত সাগর তেরো নদীর পাড়ে বসে আমাদের বাড়ির প্রতি সদস্যদের প্রতি সেকেন্ডের খবর সে পায়। সেই এই খবরে জানিয়েছে আমাকে।’

একথা শুনে হতভাগ্য চোখে সবাই ইধার দিকে তাকায়। ইধার সেদিকে খেয়াল নেই। সে মনোযোগ দিয়ে ফোনে কিছু একটা দেখছে।

——————-

রাতে খাওয়া দাওয়ার পরে সবাই গল্পের আসর পেতেছে। বড় ছোট সবাই উপস্থিত সেখানে। সবার মধ্যমনি তাজ আর অহন। তাদের কর্মকাণ্ডে হেসে সবার পেটে খিল ধরে গেছে ইতিমধ্যে। হাসি নেই ইধার ঠোঁটে। নিজ ভাবনায় মাসগুল হয়ে আছে। আসরের সমাপ্তি খনে নিলাংশ সবার ইধার আড়ালে হাত চেপে ধরে। তা দেখে ইধা অবাকের সপ্তম পর্যায়ে পৌঁছে যায়। কপালে চিন্তার ভাঁজ ফুটিয়ে তুলে নিলাংশের দিকে তাকায় ইধা। নিলাংশ ইশারায় অনুরোধ করে চুপ থাকার জন্য, ইধা বুঝতে পেরে, একরাশ কৌতূহল নিয়ে অন্যদের দিকে তাকায়। একে একে সবাই বসার ঘর থেকে চলে গেছে। ইধা এবার কপালের ভাঁজ আরো তীব্র করে নিলাংশের দিকে তাকায় কিছু বলার জন্য, কিন্তু নিলাংশ ইধাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে, ইধার হাত ছেড়ে দিয়ে বলল,

‘ আজ রাত মধ্য প্রহরে একবার ছাদে আসবে তুমি? একবার এসো প্লীজ, অনেক না বলা কথা বলার আছে তোমাকে। আমি অপেক্ষায় থাকবো তোমার। মনে রেখে, মধ্য প্রহর!’

নিলাংশ আর দাঁড়ায় না, ইধার থেকে চোখ সরিয়ে চলে যায় সেখান থেকে। ইধা চোখ বড় বড় করে বিষ্ময়, হতবাক চোখে তাকায় নিলাংশের চলে যাওয়ার দিকে।

——————

ঐদিনের পরে কেটে গেছে অনেক গুলো সপ্তাহ। ঐদিনের ঠিক সাত দিন পরে অন্তর পরিবার তাদের মতামত জানায়। তারা রাজি আছে এই বিয়েতে। বাড়ির দুই ছেলের বিয়ে একসঙ্গে হবে। বিয়ের তারিখ ধার্য করা হয়েছে একমাস পরে বৈশাখের এক তারিখ অর্থাৎ পহেলা বৈশাখে। ইধা সে দেশে ছেড়েছে অনেকদিন। বর্তমানে ইধা কোরিয়ার কোন একটা গ্রামে মুভির শুটিং নিয়ে ব্যস্ত আছে। রাহাত খান চৌধুরী তাকে জানিয়েছে বিয়ের অন্তত পনের দিন আগে তাকে দেশে ফিরতে হবে। সবদিক বিবেচনা করেই ইধা তার কাজ এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। সকলের জীবন ধারা নিজ ছন্দে বয়ে চলেছে। শুটিং পেকাপ হওয়ার পরে, টিমের অন্যরা হোটেলে ফিরে গেলেও ইধা সে আশেপাশে ঘুরতে থাকে। আজ নির্ধারিত সময়ের আগেই শুটিং পেকাপ হয়ে গেছে। শুটিং স্পট থেকে খানিকটা দূরে বিস্তর বৃক্ষের নিচে, বসার জন্য তৈরি করা সিটে বসে ভাবে ঐদিন রাতের ঘটনা। বিডি থেকে আসার পর থেকে ঐ ঘটনা তাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে। কারণে অকারণে বারবার ওই ঘটনায় তার মস্তিষ্কে হানা দিচ্ছে।

ঐদিন মধ্য প্রহরের খানিক পরে ইধা ছাদে হাজির হয়। কথা অনুযায়ী নিলাংশ তখন ছাদে ছিল। চন্দের আলোতে আলোকিত পরিবেশ। ইধা প্রকৃতির এমন নিদারুণ সৌন্দর্য উপেক্ষা করে নিলাংশের দিকে তাকায় আলতো গলায় বলল,

‘ কী কথা বলতে আমাকে এখানে মধ্য প্রহরে ডেকেছেন আপনি? খুব গুরুত্বপূর্ণ কোনো বিষয়?’

নিলাংশ তালগোল পাকানো গলায় বলল,

‘ হ্যাঁ? গুরুত্বপূর্ণ? গুরুত্বপূর্ণ তো বটে।’

ইধা নিলাংশের ভাবসাব দেখে, ইধা তার দুহাত বুকে গুজে শীতল চোখ নিলাংশকে অভিনিবেস সহকারে দর্শন করছে। নিলাংশর ইধার চোখে চোখ পড়লে, ইধার চোখ নিলাংশের মনে কে হৃদয়গ্রাহী করে তোলে। নিলাংশ ঢিপঢিপ করা বুক নিয়ে, তালগোল পাকানো কন্ঠে, জানিয়ে দেয় সেই অব্যক্ত ভালোবাসার কথাগুলো। জানিয়ে দেয় তার না বলা অনুভূতিগুলো। জানিয়ে দেয়, তার ভালো লাগা, খারাপ লাগা। জানিয়ে দেয় তার মনের চিলেকোঠার বিনা অনুমতিতে ইধার সর্বস্তরের বিচরণের কথা।

ইধা হতভম্ব। সাঙ্ঘাতিক হতভম্ব। ইধা ঘুনাক্ষরেও টের পায়নি নিলাংশের মনে ইধার জন্য লালিত প্রণয়ের কথা। নিজেকে সামলাতে কষ্ট হয়ে যাচ্ছে ইধার। জীবনে তো কম ভালোবাসার প্রস্তাব পায়নি কিন্তু এবারের মত আলাদা উত্তেজনা বিরাজ করেনি মনে কখনো। নিলাংশ অধির আগ্রহে তাকিয়ে আছে ইধার উত্তরের অপেক্ষায়। ছাদে মৃদু বাতাসে মধ্যে ইধার ঠোঁট শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে মনে মনে নিলাংশের জন্য উত্তর সাজানো শুরু করে। ইধা নিলাংশের দিকে তাকিয়ে মৃদু স্বরে বলল,

‘ আপনি মনে হয় আমার সঙ্গে মজা করছেন? কিন্তু আমি এখন একদম মজা করার মুডে নেই। গুরুত্বপূর্ণ যদি কোনো কথা বলার নাই থাকে তবে ডেকে আনলেন কেনো?’

নিলাংশ আহত চোখে তাকিয়ে বলল,

‘ আমার অনুভূতিগুলো তোমার কাছে মজা মনে হচ্ছে? আমি সত্যি তোমায় ভালোবাসি। তা আজ কিংবা দুই-এক দিনে জন্ম নেওয়া ভালোবাসা না। আমার মনে লালিত সুপ্ত ভালোবাসা। তুমি পৃথিবীতে আসার আগে থেকে আমি তোমাকে ভালোবাসি। বুঝতে পেরেছো তুমি?’

শেষের কথা গুলো নিলাংশ চিৎকার করে বলার দরুন ইধা কেঁপে ওঠে। নিলাংশ থেমে আবার বলল,

‘ ফুপি যখন জানতে পারে তুমি তাদের ঘরে আসতে চলেছো। তখন ফুপি মনে মনে খুব করে দোয়া করতো তাদের ঘর আলো করে কন্যা সন্তান যেনো জন্ম নেয়। আম্মু, আমায় নিয়ে প্রায় সময়ই তোমাদের এই জমিদার বাড়িতে আসতে, তখন ফুপি আমার ছোট ছোট হাত তার পেটের উপর রেখে বলতো, ‘বাবা, এখানে যে আছে সে তোর। সে তোর সাথে হাসবে, খেলবে। তোর কথা শুনবে।’ আমি তখন অবাক গলায় কী জিজ্ঞেস করতাম জানো, ‘সে শুধু আমার?’ ফুপি আর আম্মু হেসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলতো, ‘শুধুই তোর!’ তুমি জন্ম নিলে আমার নামের সঙ্গে মিলিয়ে তোমার নাম রাখি। নীরের নিরা!সেই তখন থেকে আমি তোমাকে ভালোবাসি। আর তুমি আমার ভালোবাসাকে মজা বলে উড়িয়ে দিচ্ছো?’

নিলাংশের কথা শুনে ইধার মাথা ঘুরতে শুরু করে। মাথায় আঘাত পাওয়া জায়গায় দপদপ করে ব্যাথা করতে শুরু করে। নিজেকে সামলাতে ছাদের পাশের রেলিংয়ের ওপর হাত রাখে। নিলাংশ ইধার থেকে চোখ সরিয়ে খোলা আকাশের দিকে তাকালো। কয়েক মূহুর্ত থেমে থেকে আবার বলল,

‘ ঐদিন আমি আর ইমনের মধ্যে সাঙ্ঘাতিক তর্কাতর্কি হয়। তর্কাতর্কির মূল কারণ ছিলে তুমি। তোমাকে কোলে নেওয়া নিয়ে যত তর্কাতর্কি হয়েছিল। আমি তোমাকে কোলে নেওয়া জন্য জেদ করেছিলাম। আর ইমন? সে তার বোনকে কোলে নেওয়ার জন্য। তর্কাতর্কির এক পর্যায়ে ইমন আমাকে ধাক্কা দেয়। তারপর ঘটনা আমার কিছু মনে নেই। জ্ঞান ফিরে নিজেকে অস্ট্রেলিয়ার বুকে আবিষ্কার করি। পুরোপুরি সুস্থ হতে সময় লেগেছিল পুরো এক বছর। এরমধ্যে হঠাৎ ফুপি অসুস্থ হয়ে পড়ে। মানসিক চাপে তিনি ডিপ্রেশন চলে যায়। তাকে সুস্থ করতে লেগেছিল বেশ অনেকটা সময়। ফুপি সুস্থ হয়ে আমাদের অফিসে জয়েন করে। ততদিনে ফুপির, ফুপার প্রতি অভিমান পাহাড় সমান হয়ে গেছে। একটু বড় হয়ে আমি তোমার খোঁজ শুরু করি। ততদিনে তুমি এই বাড়ি ছেড়ে নিরুদ্দেশ। অস্ট্রেলিয়ার বুকে থেকে ফোনে ফোনে গার্ড নিয়োগ করি, এই বাড়ির উপর সর্বক্ষণ নজর রাখার জন্য। প্রতিদিন গার্ডদের ফোন দিয়ে তোমার কথা জিজ্ঞেস করতাম, যদি তোমার একটা খবর পাই এই আশায়! কিন্তু প্রতিবারই তুমি আমাকে বিমুখ করেছ। অবশেষে আমি তোমার দেখা পেলাম অস্ট্রেলিয়া। তোমার চোখের দিকে তাকালে, তোমার চোখ দুটো আমার ভিশন চেনা চেনা মনে হতো। তোমার হয়তো এই কথাটা একবার বলেও ছিলাম আমি। সে যাই হোক আমি আমার মনের অব্যক্ত কথাগুলো তোমাকে বলেছি। আমি তোমাকে জোর করছি না। তুমি যদি আমার প্রস্তাবে রাজি না থাকো, তাহলে আমি তোমার খুশিতে খুশি হবো। আমি সাইকো প্রেমিকের মতো নই যে ভালোবাসা জোর করে আদায় করে নেব। আমি বিশ্বাস করি ভালোবাসা একটা স্বর্গীয় অনুভূতি। এখন বাকিটা তোমার উপর নির্ভর করছে।’

ইধা নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। ইধা জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিয়ে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করছে। বুক অস্বাভাবিক ভাবে কাঁপছে। তীব্র ভাবে বুকের ভেতর ধুকধুক শব্দ হচ্ছে। হয়তো সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটা সেই শব্দ শুনতে পাচ্ছে। এ কোন অজানা রহস্য জানতে পারলো ইধা। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটা ইধার পৃথিবীতে আসার আগে থেকে তার নামে মানুষটার সমস্ত অস্তিত্ব লিখে দিয়েছে। এই পবিত্র ভালোবাসা প্রত্যাখান করবে কিভাবে ইধা?

—————–

কারো কন্ঠস্বর শুনে ইধা লাফিয়ে উঠে। বেরিয়ে আসে ভাবনা থেকে। সামনে তাকায় ইধা। সেম দাঁড়িয়ে আছে। বর্তমানে যে মুভির শুটিংর জন্য ইধা কোরিয়ার আছে, সেই মুভির নায়ক সেম। ভিশন অমায়িক ছেলে। ইন্ডাস্ট্রির দৌলতে তাদের সম্পর্ক এই কয়েক বছরে বন্ধুত্বে রুপান্তরিত হয়েছে। দুহাত কোমরে রেখে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। হয়তো দৌড়ে এখানে এসেছে। ইধা মনে মনে ভেবে নিয়েছে আজ তাকে সাঙ্ঘাতিক বকাঝকা শুনতে হবে। ইধা মনে মনে যখন এসব ভাবছিল তখন সেম চিৎকার করে বলল,

‘ ইধা, তেরে ফোন কাহা হে?’

সেমের কথা শুনে ইধা তার হাতে থাকা ফোনের দিকে তাকায়। না হাতে তো ফোন নেই। তাহলে? ইধা করুন চোখে তাকায় সেমের দিকে, সেম সেদিকে তোয়াক্কা না করে আবার বলল,

‘ মে তেরে বারেমে ছোসকার পাগাল হো যাউগা। ডক্টর পূজা মিত্র, শুভাশে তুজকো কিতনি বার ফোন কিয়া? কেয়া তুনে হাম লোগোকা বাত নেই শুননেকা ফেসলা লিয়া। উদার ইন্ডিয়া মে তেরা ভাবি তেরে লিয়ে ছোস ছোস পেরেশান হে।’

ইধা ছোট করে বলল,

‘ ফোন কাহাসে মিলা?’

সেম হেঁটে এসে ইধার পাশে বসে বলল,

‘ তেরা শুটিং কার মে।’

ইধা ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়লো। উঠে দাঁড়িয়ে বলল,

‘ ছাড় এসব কথা, চল হোটেলে যাই।‌ বড্ড খিদে পেয়েছে।’

সেম রাগি গলায় বলল,

‘ তুই আবারো কথা এরিয়ে যাচ্ছিস?’

ইধা সেমের দিকে তাকালো, বেচারা এই কয়েক বছরে ভালই বাংলা রপ্ত করতে পেরেছে। ভাবি মানে পলা সেমের বউ সে খাঁটি বাঙালি। মুর্শিদাবাদের মেয়ে সে। বিয়েটা ওদের পারিবারিক ভাবে হয়েছিল। বিয়ের পরে পলা সেমের সমস্ত কথা বুঝতে পারতো, এবং সে নিজেও হিন্দি পারতো। কিন্তু সেম বাংলা পারতো না। পলা সেমের উপর কোন বিষয়ে রেগে গেলে সে বাংলায় কী বলতো বুঝতে পারতো না সেম। পরে অনেক কাঠ-খড় পুড়িয়ে সেম বাংলা শিখতে সক্ষম হয়। বাংলা শিখতে অবশ্য ইধা অনেক সাহায্য করেছিলো সেম কে। এজন্য তাকে কম কথা শুনতে হয়নি পলার। এখনও মাঝে মধ্যে ফোন করে কাঁদো কাঁদো গলায় বলবে, ‘দিদিভাই তুমি আমার জীবনের সাঙ্ঘাতিক একটা সর্বনাশ করেছ। কি দরকার ছিল তোমার তাকে বাংলা শেখানোর। আগে তো নিজের রাগ কমানোর জন্য তাকে বাংলায় যা তা বলে গালিগালাজ করতাম, কিন্তু এখন? এখন আমি কিভাবে নিজের রাগ কমাবো? মানুষটা যে বাংলা শিখে গেছে।’ এইসব কথা মনে করে ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটে উঠে ইধা। ইধা কে হাসতে দেখে সেম ধমক দিয়ে বলল,

‘ তুই একদম আমার সামনে হাসবি না? ডক্টর পূজা মিত্র তোকে ফোন না পেয়ে আমাকে ফোন করেছিলো। এখানে আসার আগে সে তোর একবার চেকার করেছিল? আর সে কথা তুই আমাদের একবারও জানাসনি। পুজা মিত্র কয়েকটা অপারেশন নিয়ে ব্যস্ত থাকায় তোর রিপোর্ট দেখতে পারেনি। কয়েকদিন আগে তোর রিপোর্ট সে হাতে নেয়। তোর অবস্থা দিন দিন আরো খারাপের দিকে যাচ্ছে ইধা। এমন চলতে থাকলে তুই হয়তো….

সেম থেমে যায়। ইধা হাসে। হেসে বলল,

‘ কী হলো থামলি কেনো? এমন চলতে থাকলে আমি মরে যাবো তাই তো? তুই চিন্তা করিস না, তোদের মত বন্ধু থাকতে কিছু হবে না আমার।’

সেম গম্ভীর মুখে বলল,

‘ আমি এখানে হাসির কোনো কথা বলেনি ইধা, যে তুই দাঁত বের করে হাসবি? এখান থেকে ফিরেই তুই অপারেশন করতে রাজি হবি। এটা আমি তোকে অনুরোধ করছি না, আদেশ করছি তোকে আমি।’

সেমের কথা বলার ধরন দেখে ইধা আলতো হাসে। ইধার হাসি দেখে সেম বুঝে যায়, ইধা এবারো অপারেশন করতে রাজি হবে না। পলা আর তাকে মিলে কিছু একটা করে এই জেদি মেয়েটাকে অপারেশন জন্য রাজি করাতে হবে বলে মনে মনে ঠিক করে নেয় সেম।

চলতে…..

নোট: ইনশাআল্লাহ আগামী কাল গল্পটা শেষ করে দেবো।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here