#তোমার_নামে_আমাকে_ডাকো
#লেখিকাঃ সারজীন ইসলাম
|পর্ব-০৮|
নীরা কে বুকে জড়িয়ে নিয়ে কান্না করেছে রাহাত খান চৌধুরী সহধর্মিনী আশা খান চৌধুরী। হারিয়ে যাওয়া সাত মানিক যেনো খুঁজে পেয়েছেন তিনি। ইরা খান চৌধুরী ওদের দিকে এগিয়ে এসে আশা খান চৌধুরী কে মৃদু স্বরে বলল,
‘ দাদিমা তুমি এভাবে কান্না করো না, অসুস্থ হয়ে পড়বে তো তুমি!’
নীরা দাদি মাকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে চোখের পানি মুছে দেয়। দাদিমা কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলল,
‘ তুই মুখে কাপড় দিয়ে ঢেকে রেখেছিস কেন? মুখ থেকে কাপড়টা সরা। কতগুলো বছর হয়ে গেছে আমি তোকে দু চোখ ভরে দেখি না।’
নীরা মাথা নাড়িয়ে ধীরে ধীরে মুখ থেকে কাপড়টা খুলে। বিস্ফোরিত চোখে তাকায় সবাই। এই কাকে দেখছে তারা তাদের সামনে? সবার চোখগুলো যেন চোখের কোঠা দিয়ে বেরিয়ে আসবে এমন অবস্থা। মামুন খান চৌধুরীর মেয়ে দিঘী খান চৌধুরী বিস্ফোরিত গলায় বলল,
‘ ইধা, ইধা চৌধুরী!’
ইধা সবার কৌতহলী চোখের দিকে তাকিয়ে কিঞ্চিৎ হাসে। চোখের পলকে মুখের হাসি মুছে ফেলে কাট কাট গলায় বলল,
‘ হ্যাঁ তোমাদের বাড়ির সেই ছোট্ট নীরা আজ সেলিব্রেটি নায়িকা ইধা চৌধুরী।’
সবাই অবাক চোখে তাকিয়ে আছে, যেন কথা বলতে ভুলে গেছে সবাই। ইধা আবারো মৃদু স্বরে বলল,
‘ এত বছর পরে এসে যে কেউ নিজেকে নীরা বলে দাবি করলে তোমাদের চমকে যাওয়ার কথা, তোমাদের আমার কথাগুলো বিশ্বাস না হয় তাহলে দাদু ভাইয়ের হাতে থাকা কাগজগুলো তোমরা দেখতে পারো। আমার পাসপোর্ট, ভোটার আইডি কার্ড সেখানে গোটা গোটা করে আমার নাম উল্লেখ করা আছে। এরপরেও যদি তোমাদের সন্দেহ থাকে তাহলে তোমরা আমার দিল্লি কলেজ কিংবা ইউনিভার্সিটিতে যোগাযোগ করতে পারো।’
এরমধ্যে মামুন খান চৌধুরী এগিয়ে এসে বলল,
‘ কার কি প্রমান লাগবে আমি জানিনা। আমার মন বলছে তুই আমাদের বাড়ির মেয়ে। তার উপরে তোর মুখের আদল অনেকটা তোর বাবার মত। এর থেকে বড় প্রমাণ আর কী হতে পারে।’
কথা শেষ হতে না হতে বাড়ির সামনে পরপর কয়েকটা গাড়ি থামানো শব্দ পায়। তার কয়েক মুহূর্ত পরে কারো গম্ভীর কণ্ঠে শুনে সবাই সে দিকে তাকায়।
‘ আমাদের বাড়ির সামনে এতগুলো গার্ড কেন ইমন? এনিথিং সিরিয়াস?’
রায়হান খান চৌধুরী কথাটা তার বড় পুত্র কে উদ্দেশ্য করে বলেছে। ইমন কিছু বলার আগে ঈশান উত্তেজিত গলায় বলল,
‘ বাবা, বাবা আমাদের বোন ফিরে এসেছে।’
রায়হান খান চৌধুরী উল্লসিত চোখে তার ছোট ছেলের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘ কোথায় আমার মেয়ে? কোথায় সে?’
ইধা ঠোঁটে হাসি বজায় রেখে বলল,
‘ মিস্টার চৌধুরী কেমন আছেন আপনি?’
রায়হান খান চৌধুরী পলকহীন চোখে ইধার দিকে তাকিয়ে, ইধা রায়হান খান চৌধুরীর উত্তরের অপেক্ষা না করে মৃদু স্বরে বলল,
‘ আজ এতগুলো বছর পরে আমি নিজের ইচ্ছে আবার বাড়িতে ফিরে এসেছি নিশ্চয়ই তার কোনো কারণ আছে তাই নয় কী? বাড়ির লোকজন তো আর কম চেষ্টা করল না আমার নিরুদ্দেশ হওয়ার রহস্য খুঁজে বের করতে। কেউ কেউ তো রাজনৈতিক ক্ষমতার জোরে খুঁজে গেছে আবার কেউ কেউ তো বড় পুলিশ কর্মকর্তা হওয়ার সুবাদে খুঁজে গেছে। আমি পুরনো কথাগুলো বলতে চাচ্ছি না আমি আজ এ বাড়িতে এসেছি মাত্র দুটো মানুষের জন্য। এক নম্বর দাদুভাই দ্বিতীয় দিঘী।’
এইটুকু বলে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে আবার বলল,
‘ দাদুভাই তুমি প্রতিবার অধিক চিন্তা করে অসুস্থ হয়ে পড়ো। তোমার অসুস্থ হওয়ার পেছনে পরোক্ষ কিংবা প্রত্যক্ষভাবে হয়তো আমিই দায়ী। অন্য সকল চিন্তা না হয় বাদ দিলাম তুমি আমায় নিয়ে চিন্তা করতে করতে বারংবার অসুস্থ হয়ে পড়ে। তাই ভাবলাম অনেক তো হলো লুকোচুরি এবার না হয় এসবের ইতি টানা দরকার। আমি তোমাকে স্পষ্টভাবে একটা কথা বলছি দাদুভাই, এতদিন তুমি আমায় নিয়ে চিন্তা করে অসুস্থ হয়ে পড়তে। এবার আমি দেখা দিয়েছে তোমার সঙ্গে এরপরেও যদি তুমি আবার অসুস্থ হয়ে পরো তাহলে দেখে নিও তোমার একদিন কি আমার একদিন।’
ইধার শান্ত সুরের ধমকানো দেখে বাড়ির সবাই ঠোঁট টিপে হাসে। ইধা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সে দিকে তাকালে তাদের ঠোঁটের হাসি গায়েব হয়ে যায়। ইধা চার কদম এগিয়ে যায় তার ছোট চাচা মামুন খান চৌধুরীর দিকে। তিনি হা করেন কিছু বলবে বলে তার আগে ইধা গম্ভীর গলায় বলল,
‘ তুমি আর ছোট চাচী তো ভালবেসে বিয়ে করেছিলে তাই না? কলেজ লাইফ থেকে চেনো তোমরা দুজন দুজনকে! তাহলে আজ এতগুলো বছর পরে তোমাদের মাঝে বিচ্ছেদ কেন? তাহলে কী তোমাদের ভালোবাসায় কোন খাদ ছিল?’
মামুন খান চৌধুরী ইধার কথায় ঘাবড়ে গিয়ে মিনমিনিয়ে বলল,
‘ আমার ভালোবাসা ঠিকই আছে। তোর চাচি এখন আর আমাকে আগের মত ভালবাসে না।’
ইধা আবার পাল্টা প্রশ্ন করে,
‘ তুমি ভালোবাসো তো?’
মামুন ভুরু কুঁচকে বলল,
‘ মানে?’
ইধা ওর চাচার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘ তুমি শেষ কবে চাচি কে ভালোবাসি কথাটা বলেছিলে মনে আছে? সারাদিনের হাজারো ব্যস্ততার মাঝে তুমি কখনো এক ঘন্টার জন্য সময় বের করে চাচিকে সঙ্গে নিয়ে কখনো ঘুরতে গেছো? না তা করোনি উল্টে আরো অভিযোগ করেছো, চাচি তোমার থেকে দুদিন পরপর দামী দামী অলঙ্কার আবদার করে। কেন করে একবার বোঝার চেষ্টা করেছিলে? দিনের পরে দিন তোমার ভালোবাসা না পেয়ে চাচি অলংকার কে তার জীবন তৈরি করে নিয়েছে। সারাদিন তুমি যখন কর্মক্ষেত্রের যুদ্ধ করে ক্লান্ত শরীর নিয়ে বাড়িতে ফিরে তখন তো ঠিকই চাচি হাসি মুখে দরজা খুলে দেয়। তাহলে তুমি কেন পারবে না ক্লান্ত শরীর নিয়ে রক্তিম গোলাপ চাচির হাতের মুঠোয় গুঁজে দিতে। চাচি যখন যখন তোমার কাছে দামী অলংকারে আবদার করেছে তখন যদি তুমি চাচির হাতে একটা রক্তিম গোলাপ তুলে দিতে ছোট্ট করে ‘ভালোবাসি’ কথাটা বললে তো আর এই দিনটা তোমাদের দেখতে হতো না।’
ইধা এইটুকু বলে থামে। চোখ ঘুরিয়ে দিঘীর দিকে তাকায়। মেয়েটা অশ্রু ভেজা চোখে মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে আছে। ইধা ছোট নিঃশ্বাস ফেলে আবার বলল,
‘ তোমাদের তো একটা গুডনিউজ জানাতে আমি বড্ড দেরি করে ফেলেছি। তোমার আর চাচির বিচ্ছেদের কথা শুনে তোমাদের আদরের মেয়ে দিঘী সুইসাইড করতে চেয়েছিল। তোমাদের ভাগ্যটা অনেক ভালো সময় মত দাদীমা আর ইরা ওখানে পৌঁছে গিয়ে সবটা সামলে নিয়েছে। না হলে এতক্ষনে তোমরা তোমাদের আদরের মেয়ের মৃত্যুর জন্য একে অন্যকে দায়ী করতে।’
ইধার কথা শুনে সবাই চমকে ওঠে। দিঘী আত্মহত্যা করতে চেয়েছিল অথচ বাড়ির কেউ তা জানে না। অথচ ইধা ওদের থেকে হাজার মাইল দূরে থেকেও সে খবর জানে। দাদিমা বা ইরা এই ঘটনা বাড়ির কাউকে জানতে দেয় নি। মামুন খান চৌধুরী কাঁপা কাঁপা পায়ে এগিয়ে যায় তার আদরের রাজকন্যা রে দিকে। মুহূর্তে বুকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করে মামুন খান চৌধুরী। মামুন খান চৌধুরীর স্ত্রী চোখ ভরা জল দিয়ে এসে জড়িয়ে ধরে একসঙ্গে বাবা মেয়েকে। মামুন খান চৌধুরী কান্না থামিয়ে তার স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বলল,
‘ তোমার যা প্রয়োজন সব কিছু আমি মিটাবো, যখন যা বলবে তাই করব। এরপরও যদি ডিভোর্সের কথা বলেছ তাহলে আমি তোমাকে জানে মেরে ফেলবো।’
মামুন খান চৌধুরীর কথা শুনে সবাই হেসে দেয়। অন্যদিকে মামুন খান চৌধুরীর স্ত্রী মালা খান চৌধুরী মুখ বাঁকা করে বিড় বিড় করে বলল,
‘ দাঁড়াও বুড়ো আজ তোমার হচ্ছে আমাকে মারার হুমকি দেওয়া তাই না।’
চলবে….