#তোমার_প্রেমে_পড়েছি
#পর্ব_১১
#Rimy_Islam
আধলা কমলা রঙা চাঁদটা আকাশ জুড়ে গভীর আলো মেলেছে। বাড়ির সামনে গুল্ম শ্রেণীর যুথিকা গাছটা সাদা চাদরে নিজেকে মুড়ে নিয়েছে। থোকা থোকা ফুলগুলো থেকে কি মিষ্টি সুঘ্রাণই না বেরোচ্ছে! নমনী ঘন শ্বাস টেনে নিতেই এক মাতাল ঘ্রাণের দেশে বিরাজ করতে লাগলো। নেত্র’র হাতে বই। এদিকে নমনীর চোখ জানালার গ্রিল ভেদ করে পড়েছে ওই যুথিকা ফুলের গাছে। সাথে সাথে এক অজানা আকাঙ্খা উঁকি দিলো ওর মনে। ইশ! কেউ যদি একগুচ্ছ ফুল এনে গুঁজে দিতো চুলে! মন্দ হত না। বিফল চিত্তে সে একবার নেত্র’র পানে চেয়ে বললো,
— আপনাদের বাড়িতে কি কি ফুল গাছ আছে?
— হুম। আছে কিছু কিছু। – আনমনে বলে নেত্র।
নমনী অস্থির হয়ে বললো,
— নেত্র একটু শুনবেন কি?
— অবশ্যই, বলো।
— এক থোকা যুথিকা ফুল আমাকে এনে দিবেন প্লিজ!
— এখন! আমি পড়তে বসেছি।
— কচি খোকা পড়তে বসেছে। সারাদিন পড়েন একটু বউয়ের দিকে নজর দেন না।
— হলো না। তুমি এখন আমার বউ না, প্রেমিকা। ভুলে গেলে আমরা প্রেম করছি!
নমনী তুড়ি বাজিয়ে বললো,
— গ্রেট, এখন প্রেমিকাকে ফুল এনে দেন।
নেত্র নিতান্ত নাখুশ মেজাজে উঠে চলে যায়। প্রায় মিনিট দুয়েক পর হাতে একগুচ্ছ যুথিকা ফুল নিয়ে ফিরে আসে। সেগুলো নমনীকে সপে দিয়ে মৃদু হেসে বললো,
— প্রেম বালিকা এবার খুশি তো?
নমনী দাঁত কেলিয়ে হেসে বললো,
— হুম খুব। এবার ঝটপট এগুলো আমার চুলে গুঁজে দেন।
নেত্র খোঁপায় ফুল গুঁজতে যেয়ে অধিকাংশ ফুল ঝরে পড়ে যায়। সামান্য কতক ফুল চুলে গুঁজতে সক্ষম হলে ওগুলো তারার মতো ফুটে রইলো। তা দেখে নেত্র প্রথম দফা পুলকিত বোধ করে। ডাগর চাহনি মেলে দেখতে থাকে। চিরকাল শুনে এসেছে এবং পড়েওছে, ‘ফুলের সৌন্দর্য গাছে’। অথচ তার সেই ধারণাকে মেকি প্রমাণ করে কত সুন্দর করে ফুলগুলো নমনীর চুলে হেসে খেলে শোভা পাচ্ছে!
প্রাতে নমনীকে দেখে অবাক হয় নেত্র। তার চিবুকের এক অংশে গাঢ় লাল হয়ে ফুলে রয়েছে। হঠাৎ এমন দেখে নেত্র ভয় পেয়ে যায়। না সে নমনীর গায়ে হাত তুলেছে, না নমনী পড়ে গেছে। তাহলে ওর মুখে দাগ এলো কিভাবে?
— এই নমনী! পড়ে গেছো নাকি? মুখে দাগ দেখছি!
নমনী ঠোঁট ফুলিয়ে কান্নার ভঙ্গিতে বললো,
— না।
— তাহলে এমন কান্নার ভাব করছ কেন?
নমনী এবার সত্যিই কাঁদতে শুরু করে। বলতে লাগলো,
— আপনাদের আম গাছ থেকে আম পাড়তে গিয়ে আমের আঠা পড়েছে মুখে। আজ বাড়িতে অনুষ্ঠান আর আমার মুখের এই হাল।
নেত্র অবাক হয়ে বললো,
— অাম পাড়তে তুমি গেলে কেন? অনুষ্ঠান আবার কেন?
— সখের বশত গিয়েছিলাম। আর অনুষ্ঠান কেন সেটা নিচে গেলেই বুঝতে পারবেন।
পুরো বাড়িতে গিজগিজ করছে লোক। কেউ ফুলের ডালি, কেউবা মণ্ডা-মিঠাই নিয়ে আসছে। আমিরাকেও ব্যস্ত দেখা গেলো। তার পাশে বসা নদী বিস্মিত হয়ে পুরো বাড়িতে চোখ বুলিয়ে যাচ্ছে। নীলুফা বেগম একবার এইদিকে তো একবার ওইদিকে ছুটে যাচ্ছেন। মাঝে মধ্যে থেমে খানিক জিরিয়ে আবারো কাজে লেগে পড়ছেন। নেত্র’ র এবার বুঝতে বাকি রইল না কে আসতে চলেছে। এ বাড়িতে এমন অায়োজন শুধু একজনের আগমনেই হয়। সে হলো প্রিয়ম। এ বাড়ির বড় ছেলে অর্থাৎ, নেত্র’র বড় চাচার ছেলে। নেত্র’র দাদা এ বিশাল বাড়িটি খুব সখ করে বানিয়েছিলেন যেন দুই ছেলে একত্রে থাকতে পারে। কিন্তু বড় চাচা জনাব আনোয়ার হোসেন পরিবার নিয়ে পাড়ি দিলেন অস্ট্রেলিয়ায়। পরবর্তীতে তাঁরা এ বাড়িমুখো কখনো হননি। তবে মাঝে মাঝে তাদের একমাত্র ছেলে প্রিয়ম এসে বেড়িয়ে যায়। বয়সে নেত্র’র দুই বছরের বড় প্রিয়ম খুব খামখেয়ালি। ভিন্ন দেশে মানুষ হয়েছে কিনা! চাল-চলন, কথা-বার্তায় সে ছাপ যথারীতি প্রমাণ পায়।
বিকেল। সবাই মূল ফটকে এসে দাঁড়িয়েছে। প্রত্যেকের দৃষ্টি গেটসংলগ্ন কংক্রিটের পাঁকা সড়কটায়। নমনী উসখুস করে উঠলো। সে কেবল জানে আজ বিশেষ কেউ একজন আসতে চলেছে। কিন্তু কে তা সে জানে না।
— এই নেত্র, বলতে পারেন কে আসতে চলেছে? ক্ষীণ গলায় বললো নমনী।
— আমার ভাই।
— এমা! আপনার আর কয়টা ভাই আমদানি হওয়া বাকি আছে?
— আরে পাগলি এটা আমার বড় চাচার ছেলে। উনারা সবাই অস্ট্রেলিয়ায় সেটেল্ড।
— আচ্ছা!
একটা গাড়ি এসে থামলো। নমনীর কোনো আগ্রহ না থাকলেও মুমুর যথেষ্ট আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে রয়েছে। কে নামে গাড়ি থেকে তা দেখার জন্য। সত্যি সত্যি গাড়ির দরজার ঠেলে একটি পা বের হলো। এরপর পুরো মানুষ। ‘ মাই গড, হোয়াট আ গুডলুকিং বয়!’ হিসহিস করে বলে মুমু। নমনী এখনো নির্বিকার। পুরো ফরেইনার। এ্যাশ কালার কোট- প্যান্ট উইথ হোয়াইট শার্ট। হাতে দামি বড় ডায়ালের ঘড়ি, চোখে সানগ্লাস। শুভ্র সাদা ছেলে এক কথায়। তবে বিদেশিদের মতো ক্যাটক্যাটে সাদা নয়, অদ্ভুত মুগ্ধতর এক সাদা গায়ের চামড়া। নেত্র এবং নিলয় দু’জনেই অনেক ফর্সা। অথচ এই নতুন আগত অতিথির কাছে তাদের গায়ের রঙ ভীষণ চাপা। ছেলেটা প্রথম কথা বললো,
— ‘Hi guys! Are you all fine? ‘
নীলুফা বেগম ধমক ছাড়লেন।
— প্রিয়ম তোকে কতবার বলেছি বাবা যে, বাংলায় কথা বলবি! তোর ফরেইন কান্ট্রিতে যা ইচ্ছা করিস। এখানে এসব চলবে না।
— আচ্ছা সরি ছোট আম্মু। কেমন আছো?
— আলহামদুলিল্লাহ আছি। ভেতরে চল।
সানগ্লাসটা হঠাৎ খুলে মুমু এবং নমনীকে দেখে নেয় প্রিয়ম। এরপর বলে,
— এই দুইজনকে নতুন দেখছি!
রায়হান সাহেব বললেন,
— এইটা নিলয় এবং এইটা নেত্র’র বউ। তুই এতবছর পর এলে দেখবি কোথা থেকে!
মুমু এবং নমনীকে দেখিয়ে কথাগুলো রায়হান সাহেব বলতেই প্রিয়ম দুই বোনের আপাদমস্তক ঠিকঠাক দেখে নিয়ে সূক্ষ্ম হেসে বললো,
— প্রিটি লেডিস!
খাবার খেতে খেতে সবাই অনেক কথা বললো। মুমু সামান্য সময়ের মাঝে প্রিয়মের সাথে বেশ ভাব জমিয়ে নিয়েছে। এদিকে নমনীর খাওয়া উঠে গেছে। একজন অপরিচিত ব্যক্তির সামনে তার সঙ্কোচ হচ্ছে। তাই খাবার কোনোমতে অর্ধেক খেয়েই উঠে চলে যায় সে। রুমে এসে হাফ ছেড়ে বাঁচে নমনী। ছেলেটাকে তার মোটেও সুবিধার ঠেকছে না। খাওয়ার ফাঁকে নমনীর দিকে বারবার কেমন চোরা চোখে দেখছিলো।
‘ এক্সকিউজমি, মে আই কাম ইন?’ খোলা দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে প্রিয়ম। এক হাত প্যান্টের পাশ পকেটে রেখে অপর হাতে গোছালো চুলগুলোকে বিন্যস্ত করছে যেন সেগুলো ভীষণ অগোছালো।
নমনী ভড়কে যায়। নতুন মানুষটাকে তার শুরু থেকেই মানতে সমস্যা হচ্ছে। যেখানে সে নিজেই চলে এসেছে আলাপ করতে, সেখানে কথা না বলে কি উপায় আছে!
চলবে………….