তোমায়_পাবো_বলে পর্ব_৫

তোমায়_পাবো_বলে
পর্ব_৫
#নিশাত_জাহান_নিশি

শালা। শুধুমাএ তোর বোকামোর জন্যই টয়া আমাকে রীতিমতো ভুল বুঝতে বাধ্য হচ্ছে। তোর কি মনে হয়? এতো বড় ব্ল্যান্ডারটা করার পর তোর বন্ধুকে টয়া চোখ বুজে বিশ্বাস করে নিবে? আমাকে মানতে বাধ্য হবে? আমার ভালোবাসাকে স্বীকার করবে? ভাববে দুই বন্ধুই একই ধাঁচের! প্রতারক, বিশ্বাসঘাতক!”

আর এক মুহূর্ত ও বিলম্ব করলাম না আমি। নিঃশব্দে হেঁটে রুম থেকে প্রস্থান নিয়ে সোজা পাশের রুমে চলে এলাম। আমার অগোচরেই আমাকে নিয়ে দু-বন্ধুর মধ্যে এতো চাল চলছিলো? অথচ সেই চাল আমি এতোগুলো বছর পর আজ ধরতে পারলাম? আসলে সত্যি কখনো চাঁপা থাকে না। কোনো না কোনো উপায়ে ঠিকই প্রকাশিত হয়। বুঝতে বিলম্ব হলে ও সত্যিটা ঠিক প্রকাশ্যে আসবেই। এ যেনো প্রকৃতির এক অবিনশ্বর বিধান।

এই এক মাসে পরশ ভাইয়ার প্রতি আমার যতোটা সম্মান তৈরী হয়েছিলো না? সেই সম্মান গুলো মুহূর্তের মধ্যেই কেমন যেনো ফিকে হয়ে গেলো। হিমেশের অভিব্যক্তি জেনে ও পরশ ভাই এতো গুলো দিন খুব অনায়াসে আমার থেকে সত্যিটা গোপন করে রেখেছিলেন? অযথাই হিমেশকে খোঁজে বের করার নাটকীয় মোহরা তৈরী করছিলেন? এখন তো মনে হচ্ছে পরশ ভাই পূর্ব থেকেই অবগত ছিলেন হিমেশ এই হোটেলে আত্নগোপন করে আছেন। সব জেনে ও পরশ ভাই গোটা একটা মাস আমায় আশায় আশায় রেখেছিলেন? আমার দুর্বলতার সুযোগ নিয়েছিলেন? আচ্ছা? তবে কি পৃথিবীর সমস্ত পুরুষ মানুষরাই এক? নারীদের দুর্বলতার সুযোগ নিতে তারা পছন্দ করেন? নারীদের সরলতাকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের ইচ্ছে মতো নারীদের ব্যবহার করতে তারা দুবার ও ভাবেন না? এতোটাই নির্মম, বর্বর, স্বার্থপর তারা?

পর পর দু দুটো ধাক্কা ঠিক হজম করতে পারছিলাম না আমি। কেঁদে কেটে যে মনে জমা ভারী দুঃখ গুলো কিঞ্চিৎ হালকা করব সেই ইচ্ছে শক্তিটা ও আপাতত অনুপস্থিত আমার মধ্যে। অনুভূতি শূন্য হয়ে আমি দু হাতে ভর করে বিছানার উপর কুঁজো হয়ে বসলাম। স্থির দৃষ্টি আমার সাদা টাইলসের তৈরী ফ্লোরের দিকে। একই স্থির দৃষ্টিতে কোনো বস্তুর দিকে এক নাগাড়ে তাকিয়ে থাকলে মাথায় ঝিম ধরার পাশাপাশি প্রচন্ড মাথাব্যাথার ও উৎপত্তি হয়। মস্তিষ্ক ক্লান্ত হয়ে উঠে, মস্তিষ্কের বিকিরন ক্ষমতা লোপ পায়। তখন আপনা আপনি আঁখিপল্লবে প্রখর ক্লান্তি ভর করে। সেই ক্লান্তি দূর করতেই আমি হাত-পা ছড়িয়ে বিছানার উপর লম্বভাবে শুয়ে পড়লাম। কিঞ্চিৎ বিলম্ব না করেই আমি চোখ জোড়া বুজে মুহূর্তের মধ্যেই ঘুমের অতলে নির্বিঘ্নে তলিয়ে পড়লাম!

,
,

আকস্মিক মাথায় প্রচন্ড ব্যাথার অনুভূতি আঁচ করছিলাম। ঘুমের মধ্যেই মনে হচ্ছিলো কেউ যেনো আমার মাথায় বসে হাতুড়ী পেটা করছিলো। ধ্যান ফিরতেই আমি ধপ করে ঘুম ভেঙ্গে উঠে বসলাম। নাক, মুখ বিশ্রিভাবে ভাবে কুঁচকে আমি কপালের মাঝখানটা বাঁ হাতের আঙ্গুল দিয়ে ঘঁষছিলাম। ঈষৎ খোলা চোখে আমি আশেপাশে দৃষ্টি বুলাতেই জানালার কাঁচ ভেদ করে আসা সকালের তেজর্শিনী রোদের ঝলক আমার চোখে, মুখে তীর্যক ভাবে বিকিরন ঘটাচ্ছিলো। কপালের ভাঁজে প্রখর বিরক্তি ভর করতেই কর্ণপাত হলো দরজায় বিকট শব্দের করাঘাত। প্রশ্নবিদ্ধ কন্ঠে আমি আওয়াজ তুলে বললাম,,

“কে?”

“আমি৷ দরজাটা খোলো।”

পরশ ভাইয়ার কন্ঠস্বর কর্নপাত হতেই আমার মাথায় যেনো আকস্মিক ক্রোধ চেঁপে বসল। মুহূর্তের মধ্যেই মাথার যন্ত্রনা ভুলে আমি চোয়াল শক্ত করে বললাম,,

“হুম বলুন? কি চাই?”

পরশ ভাই তীক্ষ্ণ কন্ঠে পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে বললেন,,

“কি আশ্চর্য! বাড়ি যাবে না?”

মাথায় গাড্ডা মেরে আমি বসা থেকে উঠে দাঁড়ালাম। শাড়ির কুঁচি ঠিক করতে করতে নিজেই নিজেকে শুধিয়ে বললাম,,

“ভুলে গেছিস? তুই এখন নিজের বাড়িতে না। একটা বিলাস বহুল হোটেলে আছিস। তোকে এক্ষনি বাড়ি ফিরতে হবে। দু-দুটো “মানুষখেঁকো” বন্ধুর হাত থেকে নিজেকে উদ্ধার করতে হবে!”

শাড়ির কুঁচি এবং আঁচলের অংশটা সামলে আমি দ্রুত পা ফেলে দরজার সন্নিকট হলাম। অতঃপর মাথায় বড় এক ঘোমটা টেনে দরজার খিলটা খুলে দিলাম। পরশ ভাইকে প্রদর্শন করার পূর্বেই আমি মাথা ঘুড়িয়ে উল্টো পাশ ফিরে দাঁড়ালাম। আমার এহেন অদ্ভুত আচরনে নিশ্চয়ই পরশ ভাই ভীষন অবাক হয়েছেন। তাই কিঞ্চিৎ সময় উনাকে মৌণ অবস্থায় পরিলক্ষিত করা গেলো। ইতোমধ্যেই মনে হলো সশব্দে পা ফেলে পরশ ভাই আমার সম্মুখীন হলেন। বিষয়টা আঁচ করতে পেরেই আমি অর্ধ ঘোমটা টা টেনে নতুন বউদের মতো মাথায় বিশাল এক ঘোমটা টেনে নিলাম। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা কোনো লোক যে আমার মুখের আদল প্রদর্শন করতে পারবেন না, সেক্ষেএে আমি শতভাগ নিশ্চিত। পরশ ভাই বোধ হয় এবার ক্ষেপেই গেলেন। ক্ষিপ্র কন্ঠে আমার দিকে প্রশ্ন ছুড়ে বললেন,,

“এই? হয়েছেটা কি তোমার? নাটক করছ আমার সাথে?”

ঘোমটার তলায় ভেংচি কেটে আমি মনে মনে মানুষটাকে শুধিয়ে বললাম,,

“দেখো দেখো। লোকটা আমাকে শুধাতে এসেছে আমি নাটক করছি কিনা! নিজেই এতো গুলো দিন ধরে রীতিমতো আমার সাথে নাটক করে আসছিলো, এখন আবার ঢং করে আমাকে শুধাতে এসেছে আমি নাটক করছি কিনা! ভারী অদ্ভুত লোক তো!”

আমার মৌনতা দেখে বোধ হয় পরশ ভাইয়ার রাগটা তড়তড় করে উড়ে আকাশ অবধি পৌঁছে গেছে। আকাশ থেকে টুপ করে রাগটা মস্তিষ্কে উদয় হওয়া মাএই তৎক্ষনাৎ লোকটা আমার মাথার ঘোমটা টা এক টানে খুলে ব্যগ্রকন্ঠে বললেন,,

“অযথা মাথায় এতো বড় ঘোমটা টেনে রেখেছিলে কেনো? নব বধূ তুমি? স্বপ্নে হিমেশকে বিয়ে করেছিলে?”

ক্রুদ্ধ কন্ঠে আমি পরশ ভাইকে শাসিয়ে বললাম,,

“পাগল? আমি আর পৃথিবীতে ছেলে মানুষ পাই নি বিয়ে করার? আপনার বন্ধুর মতো বিশ্বাসঘাতক, প্রতারক মানুষটাকে আমি বিয়ে করতে যাবো?”

কন্ঠে শক্ত ভাব বজায় রেখে লোকটা পুনরায় বললেন,,

“ওহ্ আই সি! ওকে ফাইন, তাহলে ঠান্ডা লাগছিলো? রুমে তোমার জন্য স্পেশালি এসির এরেন্জ্ঞমেন্ট ছিলো? নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিলো তোমার?”

কটমট চোখে আমি পরশ ভাইয়ার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলাম। ঘোমটা টা পুনরায় মাথায় টেনে আমি তেজী কন্ঠে লোকটাকে বললাম,,

“এবার থেকে বেগানা কোনো পুরুষকে আমি মুখ দেখাব না। সেজন্যই এতো বড় ঘোমটা টানা। আশা করি আপনি আপনার সব প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেছেন?”

দম নেওয়ার সুযোগটা পেলাম না পর্যন্ত৷ পরশ ভাইয়ার হু হা হাসির ঝংকারে পুরো রুমটা যেনো কেঁপে উঠছিলো। মনে হচ্ছিলো যেনো রুমের প্রতিটা দেয়ালের সঙ্গে আমি ও থরথর করে কঁপছি! রূঢ় কন্ঠে আমি লোকটাকে প্রশ্ন ছুড়ে বললাম,,

“হয়েছেটা কি? এভাবে জোকারদের মতো হাসছেন কেনো? আমি কি কোনো জোকস বলেছিলাম?”

পরশ ভাই হাসি থামালেন৷ হাঁফিয়ে উঠা কন্ঠে বললেন,,

“ওহ্ মাই গড। আমি আর পারছি না হাসতে। বেগানা পুরুষকে নাকি মুখ দেখাবে না! অথচ ঐদিকে পেটের অংশে যে স্পষ্ট ফুটে থাকা কালো তিলটা অনেকক্ষন যাবত আমার দৃষ্টিহরন করছে সেদিকে এই মেয়ের কোনো খেয়ালই নেই!”

মাথার ঘোমটা পায়ে ফেলে আমি ঝট করে দৃষ্টি স্থির করলাম পেটের অংশে। সত্যিই তো তিলটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। ঐদিকে যে আমার আঁচলের অংশ ফ্লোরে হামাগুড়ি খাচ্ছে সেদিকে মোটে ও নজর নেই আমার। আবারো সেই হুংকার দেওয়া হাসি আমার কর্নকুহরে উচ্চ আওয়াজে প্রতিধ্বনিত হতেই আমি তাজ্জব দৃষ্টিতে পরশ ভাইয়ার দিকে দৃষ্টি স্থির করলাম। চোখ বুজে পরশ ভাই পেটে হাত রেখে হাসতে হাসতে আমায় বললেন,,

“তুমি না আসলেই একটা উল্লুক। এতো বোকা কেনো তুমি? একদিক ধরতেই আরেক দিক ছেড়ে দাও। মানে, তোমার কি কোনো দিকেই ব্যালেন্স নেই?”

অবাক হলাম আমি। মুখ খুলে উনার দিকে প্রশ্ন ছুড়ার পূর্বেই উনি নিচু হয়ে ফ্লোর থেকে আমার শাড়ির আঁচলটা উঠিয়ে খুব যত্নসহকারে আমার কাঁধে আঁচলটা পেঁচিয়ে চোখ বুজা অবস্থাতেই ম্লান হেসে বললেন,,

“শাড়ি যেহেতু ঠিকভাবে সামলাতেই পারো না, তাহলে কি দরকার শাড়ি পড়ার? নেক্সট টাইম শাড়ি পড়তে যথেষ্ট কেয়ারফুল থাকবে। শাড়ি পড়ে তো রাস্তাঘাটে একদম বেরই হওয়া যাবে না। ওকে?”

সন্তপর্ণে রাগটাকে আয়ত্তে আনার চেষ্টা করছিলাম। সব চেষ্টাকে ব্যর্থ করে আমি খর্ব কন্ঠে লোকটাকে বললাম,,

“শাড়ি তো আমি পড়বই। রাস্তাঘাটে ও শাড়ি পড়েই বের হবো। এতে আপনার কি অসুবিধে শুনি?”

পরশ ভাই ক্রুর হাসলেন। অতঃপর আমার দিকে সারল্য দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললেন,,

“অসুবিধে? বুঝবে না তুমি!”

“বুঝি ওকে? খুব ভালো ভাবেই বুঝে গেছি আপনার অসুবিধে। শুধু অসুবিধে কেনো? আপনাকে ও ভালোভাবে বুঝে গেছি আমি। নতুন করে আপনাকে বুঝার বা চেনার প্রয়োজন নেই আমার!”

আকস্মিকতায় পরশ ভাই ভ্রু যুগল ঈষৎ কুঁচকালেন। কপালের ভাজে বিরক্তি ভর করতেই পরশ ভাই শক্ত কন্ঠে আমায় বললেন,,

“কি চিনেছ আমায়? কতটুকু চিনেছ? কতোখানি বুঝেছ আমায়? কাইন্ডলি বলবে?”

পরশ ভাইয়ার থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে আমি প্রসঙ্গ পাল্টাতে ব্যতিব্যস্ত কন্ঠে বললাম,,

“এক্ষনি, এই মুহূর্তে বাড়ি ফিরতে চাই আমি। শেষ বারের মতো দয়া করে আমাকে একটু নিরাপদে বাড়ি পৌঁছে দিন। আজীবন আপনার কৃতজ্ঞতা স্বীকার করব আমি। অনেক করেছেন আপনি আমার জন্য। মনে থাকবে আপনার এই ঋণ।”

“তোমার কৃতজ্ঞতা পাওয়ার জন্য তোমাকে হেল্প করি নি আমি। না ঋণ হিসেবে তোমার জন্য কিছু করেছি। হ্যাঁ, তবে ধরতে পারো। মানবিক দায়বোধ থেকে ঐ সময় তোমার পাশে দাঁড়িয়েছিলাম। এর প্রতিদান হিসেবে কিছু চাই না আমি।”

দীর্ঘশ্বাস নির্গত করে আমি বললাম,,

“হাহ্। মানবিক দায়! আসলে মানবিক দায় বলতে কিছুই নেই৷ সবটাই হলো, কারো দুর্বলতার সুযোগ নেওয়া! নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য অন্যকে ব্যথীত করা, দিন দিন অপর পাশের মানুষটাকে নিরাশা, প্রতীক্ষার দিকে ঠেলে দেওয়া!”

“ও হ্যালো? কি মিন করতে চাইছ তুমি? ঘুড়িয়ে পেঁচিয়ে কথা না বলে সোজা পয়েন্টে এসো।”

মাথা উঁচিয়ে আমি পুনরায় প্রসঙ্গ পাল্টে বললাম,,

“আপনি যান। আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।”

“প্রসঙ্গ পাল্টাচ্ছ তুমি?”

“কই না তো!”

“আমার সাথে চালাকি?”

আমি অট্ট হেসে বললাম,,

“উফফস না ভাই না। আমার সেই দুঃসাহস নেই। চালাকের সাথে চালাকী করা গেলো ও চিটার, বাটপার বা বিশ্বাসঘাতকদের সাথে চালাকী করা যায় না! ইহা আমার জন্য নিতান্ত দুঃসাধ্যকর ব্যাপার!”

তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলেন পরশ ভাই। হাত দুটো মুষ্টিবদ্ধ করে দাঁতে দাঁত চেঁপে আমায় প্রশ্ন ছুড়ে বললেন,,

“এই? তুমি কোনোভাবে আমাকে ইনডিরেক্টলি পিঞ্চ মারছ না তো? চিটার, বাটপার, বিশ্বাসঘাতক আমাকেই বলছ না তো?”

“ঘাঁড়ে ক’টা মাথা আছে আমার শুনি? আপনাকে এসব বলে আমি পাড় পেয়ে যাবো? তখন তো দুই বন্ধুই একজোট হয়ে আমাকে জ্যান্ত মাটিতে পুঁতে দিবেন। এতো অল্প বয়সে মরার শখ কার ই বা থাকে বলুন?”

কেনো জানি না, পরশ ভাই কোনো কথা বাড়ালেন না। বিক্ষুব্ধ হয়ে কপাল চাপড়াতে চাপড়াতে রুম থেকে প্রস্থান নিলেন। উনার যাওয়ার পথে তাকিয়ে আমি শক্ত কন্ঠে বললাম,,

“ধার ধারী নাকি আমি এই গম্ভাট পরশের রাগের? সত্যি কথা বললে দেখছি সবার ইগুই হার্ট হয়। অপরাধীরা ও তখন অপরাধ ভুলে হিংস্র পরায়ন হয়ে উঠে। যতোসব উটকো রাগ লোকজন আমার সাথেই দেখাতে আসে!”

হনহনিয়ে ওয়াশরুমে প্রবেশ করলাম আমি। ফ্রেশ হয়ে কিছুক্ষনের মধ্যে ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে আমি তড়িৎ বেগে হেঁটে দুই ক্রিমিনালের রুমের দিকে পা বাড়ালাম। হিমেশের রুমের দরজার সম্মুখস্ত হয়ে দাঁড়াতেই ভেতর থেকে পরশ ভাইয়ার ক্ষুব্ধ কন্ঠ আমার কর্নকুহরে বেশ তীক্ষ্ণ ভাবে প্রতিধ্বনিত হলো। মানুষটা যেনো লৌহকন্ঠে বলছেন,,

“রেডিকিউলেস। ঐ হাঁটু বয়সী মেয়ের সাহস হয় কি করে? আমাকে ইনডিরেক্টলি পিঞ্চ মেরে কথা বলার? কথার ধার শুনলে তুই বুঝতি ইয়ার! এই মেয়ে কতোটা উড়নচন্ডী, ঝগড়ুটে আর তেজী।”

হিমেশের অট্ট হাসির ঝংকার কর্নপাত হতেই গভীর মনযোগের সহিত আমি শুনতে পেলাম হিমেশ বলছেন,,

“হাঁটুর বয়সী মেয়ে বলতে তুই কি এক্সেয়েক্টলি কি মিন করতে চাইছিস? মানে তুই জেঁচে নিজেকে বয়স্ক সাবস্ত করছিস? আরে গর্দভ উর্ধ্বে গেলে টয়া তোর ৫ বছরের ছোট হবে। এর’চে তো বেশিকিছু না। আর তাছাড়া মেয়েরা একটু অরকমই হয়। উড়নচন্ডী, ঝগড়ুটে আর তেজী। মানিয়ে নিতে হবে তোকে বুঝছিস?”

“ইমপসিবল। এসব মানামানি আমি দ্বারা হবে না। আমার কথার উপর কেউ সামান্য কথা বললেই আমার মাথায় আগুন জ্বলে উঠে, সে জায়গায় ঐ মেয়ে তো রীতিমতো আমার সাথে তর্ক করছিলো ইয়ার। এই মেয়ের সাথে মানিয়ে নিতে গেলে দেখা যাবে ঐ মেয়েকে খুন করতে হবে আমার! মার্ডার ফার্ডার করতে পারব না আমি!”

“ধ্যাত। একটু বেশিই ভাবছিস তুই। বিয়ের পর যখন সংসার জীবনে পা রাখবি না? তখন ঐ উড়নচণ্ডী, ঝগড়ুটে, তেজী মেয়েটার স্বভাব গুলোকেই একটু একটু করে ভালোবাসতে শুরু করবি। তখন সে অভ্যেসে পরিনত হবে। মনে হবে যেনো তার সাথে ঝগড়া না করলে দিনটাই হয়তো থমকে যাবে!”

“এতোই যেহেতু বেশি বুঝিস, তাহলে বিয়ে করলি না কেনো ঐ মেয়েটাকে? কেনো আমার জন্য ছেড়ে দিলি?”

“নির্দিষ্ট কারোর মায়ায় আটকে পড়েছিলাম! তাই নতুন করে কারো মায়ায় জড়াতে পারি নি। শোধ বোধ নেওয়া যেহেতু শেষ ই হলো, এবার অন্তত ট্রাই করব নতুন কারো মায়ায় জড়াতে!”

গাঁ জ্বালা করছিলো আমার। দুজনের ঢঙ্গীপূর্ণ কথা বার্তা কান ঠেঁসে শ্রবণ করতে। মাথায় হঠাৎ কি যেনো চেঁপে বসল আমার, জানি না। আগ পাছ না ভেবেই আমি মাথায় চেঁপে বসা দুষ্টু বুদ্ধিকে প্রশ্রয় দিয়ে দরজার ঠিক নিচের অংশটায় শরীরের সমস্ত শক্তি ব্যয় করে সজোরে এক লাথ মেরে ভৌঁ দৌঁড়ে ক্ষনিকের মধ্যে জায়গা পরিত্যাগ করে সোজা এক তলায় নেমে এলাম। অহংকার মিশ্রিত রাজ্য জয়ের হাসি ঝুলে আছে আমার ঠোঁটের কোণে। হাঁফাতে হাঁফাতে আমি হোটেল সংলগ্ন এক তলার রেস্টুরেন্টটার দিকে মোড় নিলাম। ক্ষুধায় পেট চোঁ চোঁ করছে। তার উপর অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে দৌঁড় ঝাঁপের কারনে ক্ষুধা মন্দায় চেতনা শক্তি হারাতে বোধ হয় খুব বেশি একটা সময় ব্যয় হবে না আমার। ওয়েটারকে ডেকে স্যুপ, নুডলস, স্যান্ডুইচ অর্ডার করে আমি টেবিলের উপর কপাল ঠেঁকিয়ে পেটে দুহাত গুজে চরম ক্ষুধায় নাক, মুখ কুঁচকে কাতরাচ্ছিলাম। ইতোমধ্যেই মনে হলো আমার পাশের চেয়ার গুলো টেনে কেউ বসেছে। উৎসুক দৃষ্টিতে আমি মাথা উঁচিয়ে সামনে তাকালাম। পরশ ভাই চেয়ারে হেলান দিয়ে এক ভ্রু উঁচু করে অপর পাশের ভ্রু খানিক সংকুচিত করে আমার দিকে প্রশ্ন ছুড়ে বললেন,,

“কখন এলে?”

শুকনো ঢোক গিলে আমি পরশ ভাইয়ার পাশের চেয়ারে ঠোঁটে মুচকি হাসি ঝুলিয়ে বসে গভীর মনযোগ দিয়ে ফোনে স্ক্রলিং করা হিমেশের দিকে তাকালাম। বুঝতে বেশি বিলম্ব হলো না, দুজনই আমার কু-কীর্তি ধরে ফেলেছেন! যাই হোক, কিছুতেই বুঝতে দেওয়া যাবে না একটু আগের ঘটনাটা আমারই তৈরী। পরিস্থিতি আয়ত্তে আনার প্রয়াসে অটল থাকতে হবে আমার। নিজেকে কিছুতেই এই দুই ক্রিমিনালের কাছে নতজানু করা যাবে না৷ গলায় দম সঞ্চার করে আমি স্বাভাবিক দৃষ্টিতে পরশ ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে বললাম,,

“এইতো কিছুক্ষন হলো!”

পরশ ভাই বেশ সিরিয়াস ভঙ্গিতে আমার দিকে ঝুঁকে এসে বললেন,,

“বাই এ্যানি চান্স তুমি দেখেছিলে? কে বা কাহারা আমাদের রুমের দরজায় লাথ মেরেছিলো?”

“আশ্চর্য! আমাকে কোন দিক থেকে আপনার গার্ড মনে হয়? জব নিয়েছি নাকি আমি এই হোটেলে? প্রতিটা রুমের সামনে রাত-দিন টহল দেওয়ার? কে বা কাহারা কখন কার রুমে লাথ মেরে দৌঁড়ে পালাবে এসব পর্যবেক্ষন করার?”

পরশ ভাই অকস্মাৎ চেয়ারে হেলান দিয়ে বাঁকা হেসে ভ্রু যুগল উঁচিয়ে বললেন,,

“আমি কিন্তু বলি নি। দরজায় লাথ মেরে কেউ দৌঁদৌদৌড়ে পালিয়েছে! আই গেইস মেইন কালপ্রিট নিজের পাতা জালে নিজেই পা দিয়েছে!”

#চলবে….?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here