#তোমায়_পাবো_বলে
পর্ব_৭+৮
#নিশাত_জাহান_নিশি
“কাল তোমায় কেউ আটকাবে না ওকে? ফর দ্যা গড সেইক এসব উস্কানিমূলক কথা বার্তা বলে আমার ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙ্গো না। মাথায় রক্ত উঠে যায় আমার! রাগ কন্ট্রোল করতে পারি না তখন, বুঝলে?”
নিজেকে যথেষ্ট স্বাভাবিক রাখার চেষ্টায় বহাল থেকে আমি পরশ ভাইয়ার সম্মুখস্থ হয়ে নমনীয় কন্ঠে শুধালাম,,
“উস্কানিমূলক কথা বার্তা কি আমি বলছিলাম? নাকি আপনি বলছিলেন? দোষটা কার ছিলো আপনিই বলুন?”
পরশ ভাই আমার দিকে ক্ষেপে এসে বললেন,,
“অবশ্যই দোষটা তোমার ছিলো। বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার হুমকিটা কে দিয়েছিলো? আমি না তুমি?”
“আশ্চর্য! হুমকি হতে যাবে কেনো? আমি তো স্বাভাবিক ভাবেই কথা গুলো বলেছিলাম। বিষয়টাকে এতো জটিল ভাবে দেখছেন কেনো? আর তাছাড়া…
খানিক থেমে পুনরায় রুদ্ধ শ্বাস ছেড়ে বললাম,,
“সত্যিই তো আমার এখন বাড়ি ফিরতে হবে। যে উদ্দেশ্যে আমি আপনাদের শহরে এসেছিলাম, অপারগ হয়ে আপনাদের বাড়িতে উঠেছিলাম সেই উদ্দেশ্যের ফলাফল তো মিলেই গেছে। প্রয়োজন ও ফুরিয়ে গেছে! এবার আমাকে সত্যিই ফিরতে হবে।”
ঘাঁড়ের রগ গুলো টান টান করে পরশ ভাই উচ্চ আওয়াজে বললেন,,
“তো ফিরে যাও না। কে বারন করেছে? চাইলে তুমি এক্ষনি, এই মুহূর্তে কুমিল্লার বাস ধরে বাড়ি ফিরতে পারো। কেউ তোমাকে বারন করবে না এমনকি আটকাবে ও না। প্রয়োজন তো শেষ তাই না? আর এক মুহূর্ত আমাদের বাড়িতে থেকে, আমাদের সাথে থেকে তোমার ভেলুএ্যাবল টাইম গুলো লস করার কোনো প্রয়োজন নেই। জাস্ট গো টু দ্যা হ্যাল ইউ ইডিয়ট গার্ল!”
হুট করেই ভেতর থেকে গুঙ্গিয়ে কান্নার শব্দ নিঃসৃত হলো আমার। না চাইতে ও ফুঁফিয়ে কেঁদে আমি দৌঁড়ে রুম থেকে প্রস্থান নিতেই পরশ ভাই পেছন থেকে তটস্থ কন্ঠে আমায় ডেকে বললেন,,
“আমার পারমিশান ব্যতীত তুমি বাড়ি থেকে এক কদম পা ও বাড়ানোর চেষ্টা করবে না। আমি যখন পারমিশান দিবো ঠিক তখনই তুমি বাড়ি থেকে বের হবে। জাস্ট কাল সকালটা হতে দাও। সেইফলি তোমাকে কুমিল্লা পৌঁছে দেওয়ার সমস্ত রেসপন্সিবিলিটি আমার। আর এক মুহূর্ত ও তোমাকে এই বাড়িতে থেকে, আমার পরিবারের সাথে থেকে ফাউল টাইম নষ্ট করতে হবে না। আই টোল্ড ইউ ওকে?”
কোনোরূপ প্রতিত্তুর না করেই আমি দ্রুত পায়ে হেঁটে রুম থেকে প্রস্থান নিয়ে সোজা পাশের রুমে চলে এলাম। দরজায় খিল আটকে আমি দরজায় পিঠ ঠেকিয়ে কাঁদতে আরম্ভ করলাম। মানুষটা এতো নির্মম কেনো? অন্যজনকে হার্ট করে কথা বলার অভ্যেসটা কি উনার আগে থেকেই? চাইলেই কি এই বদ অভ্যেসটা পরিত্যাগ করা যায় না? কেনো সবসময় উনাকে এভাবে তিরিক্ষিপূর্ণ মেজাজে কথা বলতে হবে? সহজ বিষয়টাকে সহজ ভাবে নেওয়ার মন মানসিকতা নেই উনার? নাকি সব বিষয়কেই জটিল ভাবে নিতে উনি অভ্যস্ত? মনে হয় যেনো আমি উনার চক্ষুশূল। আমার বিচরণ উনার সহ্য ক্ষমতার বাইরে। কালই আমি বাড়ি ফিরে যাচ্ছি। আমাকে ঐ লোকটার আর সহ্য করতে হবে না! একদম না।
বিছানায় গড়াগড়ি খাচ্ছিলাম প্রায় অনেকক্ষন যাবত। তবে কিছুতেই যেনো আঁখিপল্লবে নিদ্রার আবির্ভাব ঘটছিলো না। ক্লান্তির ছিটিফোঁটা ও নেই আঁখি জোড়ায়। তবে এতোটা মুহূর্ত ধরে যে কেঁদে কেটে অস্থির হয়ে উঠছিলাম সেই খেয়াল কি নেএযুগলের নেই? ক্লান্ত হয়ে উঠে নি তারা? অনুভূতির মিশ্রণ কি তারা ও হারিয়েছে? ঠিক আমার মতো অবচেতন, উদাসীন, নিলির্প্ত কি তাদের অনুভূতি গুলো ও?
না এভাবে আর পেরে উঠছি না। নিদ্রা হয়তো আজ আমার আঁখি পল্লবে ধরা দিবে না। মস্তিষ্কে বিঘ্ন ঘটাতে তারা যেনো আট ঘাট বেঁধে নেমেছে। বিছানা ছেড়ে উঠে আমি দেয়াল ঘড়ির দিকে দৃষ্টিপাত করতেই দেখলাম ঘড়িতে ১২ঃ৩০ মিনিট বাজছে। উন্মুক্ত চুলেই আমি দরজার খিল খুলে ধীর পায়ে হেঁটে সোজা ছাঁদে চলে এলাম। ভাগ্যিস ছাঁদের দরজাটা খোলা ছিলো! নয়তো ছাঁদের দরজায় বসেই রাত্রি যাপন করতে হতো। ছাঁদের রেলিং ঘেঁষে দাঁড়াতেই হুড়মুড়িয়ে আসা রাতের স্নিগ্ধ, হিমেল, লোমহর্ষক হাওয়াটা যেমন বেসামাল ভাবে উড়নার আঁচল উড়িয়ে নিচ্ছিলো ঠিক তেমনি আমার খোলা চুল গুলোকে ও সমান তালে উড়িয়ে নিচ্ছিলো কয়েক ইঞ্চি দূরে। চন্দ্রলোকিত আকাশে আজ অগনিত তাঁরার হাট বসেছে। পূর্ণচন্দ্রের আলোয় প্রকৃতি মহা আলোকিত। রাস্তাঘাটে এখনো যানবাহনের কোলাহল, কলরব স্পষ্টত। থেকে থেকে এ্যাম্বুলেন্সের হুইসেল, বড় বড় বাস, ট্রাকের বিকট হর্ণ কর্নকুহরে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। এভাবে কিঞ্চিৎ সময় আশপাশটাকে পর্যবেক্ষন করতে করতে কখন যেনো আঁখিপল্লবে অঢেল ঘুম ধরা দিলে বুঝতেই পারি নি। মনে হলো যেনো ছাঁদ থেকে নামার সময়টা ও পাবো না আমি। ছাঁদের সিঁড়িতেই হয়তো হাত, পা ছড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়তে হবে। আগ পাছ না ভেবে আমি ঢুলুঢুলু শরীরে ছাঁদের চিলিকোঠায় পাতা একটা ছোট্ট খাটে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়লাম। উড়না দিয়ে সমস্ত শরীর ঢেকে আমি কুঁজো হয়ে মুহূর্তের মধ্যে ঘুমের অতলে তলিয়ে পড়লাম। ভোর হতেই নিজের রুমে ফিরতে হবে সেই চিন্তা ও অবশ্য মাথায় ঘুড়ছে।
,
,
শরীরময় ভ্যাপসা গরমের অনুভূতি অনুভব হতেই আমি ধরফরিয়ে ঘুম ভেঙ্গে উঠে বসলাম। হতবিহ্বল চোখে আমি আশপটায় চোখ বুলাতেই বুঝতে পারলাম এখনো আমি চিলিকোঠাতেই আছি। শরীরে হাত দিয়ে দেখলাম সমস্ত শরীর আমার ঘামে ভিজে একাকার। চিলিকোঠায় পাখার কোনো ব্যবস্থা নেই। আলাদা জানালার ও কোনো ব্যবস্থা নেই। তাই অসহনীয় গরমে অবস্থা আমার ঘর্মাক্ত। ছোট খোঁপড়ীর মতো রুমটায় দম বন্ধ হয়ে আসছিলো আমার। হাঁসফাঁস করছিলাম এই বদ্ধ রুমটা থেকে বেরুতে৷ ভাঙ্গা দরজা দিয়ে কেবল সূর্যের তেজর্শি রশ্মি বিনা সংকোচে রুমে প্রবেশ করছিলো। শরীরে জ্বালা ধরিয়ে দেওয়ার জন্য সূর্যের এই সামান্যতম তেজটাই যথেষ্ট। উড়নাটা কোনো রকমে গাঁয়ে পেঁচিয়ে আমি চিলিকোঠা থেকে বের হয়ে স্বস্তির শ্বাস ফুসফুসে সঞ্চার করলাম। অস্ফুটে চোখে আশপাশটা পর্যবেক্ষন করতেই মনে হচ্ছে অনেকটা বেলা হয়ে গেছে। জিভ কেটে আমি হম্বিতম্বি হয়ে দৌঁড়ে সোজা দু তলায় নেমে এলাম। আমার রুমের দিকে পা বাড়াতেই নিচ তলার ড্রইং রুম থেকে আন্টি, পিয়ালী আপু এবং পায়েলের কন্ঠস্বর আমার কর্ণকুহরে উচ্চ আওয়াজে প্রতিধ্বনিত হলো। রুমে প্রবেশ করতে যেয়ে ও থেমে গেলাম আমি। কৌতুহল বশত দ্রুত পায়ে হেঁটে আমি সিঁড়ি বেয়ে ড্রইং রুমে পা রেখে সদর দরজায় অস্থিরতা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা আন্টিকে ডেকে বললাম,,
“কি হয়েছে আন্টি?”
ফটাফট আন্টি পিছু ফিরে আমার দিকে অবিশ্বাস্য দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন। উদগ্রীব হয়ে আন্টি কিছু বলার পূর্বেই পিয়ালী আপু আমার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে উত্তেজিত কন্ঠে বললেন,,
“হেই টয়া। কোথায় ছিলে তুমি?”
বিস্মিত দৃষ্টিতে আমি পিয়ালী আপুর দিকে চেয়ে বললাম,,
“কেনো আপু? কি হয়েছে?”
পাশ থেকে পায়েল তিক্ত গলায় বলল,,
“কি হয় নি সেটা বলো? সকাল থেকে এই পর্যন্ত তোমাকে খুঁজতে খুঁজতে আমরা পাগল প্রায়। কোথায় ছিলে তুমি বলো তো?”
কম্পিত কন্ঠে নতজানু হয়ে বললাম,,
“চিচিচিলিকোঠায় ছিলাম!”
পায়েল পুনরায় বিরক্তি নিয়ে বলল,,
“আর ঐদিকে ভাইয়া তোমাকে খুঁজতে অলরেডি কুমিল্লায় রওনা দিয়েছে!”
আশ্চর্যিত চোখে আমি পায়েলের দিকে তাকাতেই আন্টি পিয়ালী আপুকে উদ্দেশ্য করে নমনীয় কন্ঠে বললেন,,
“এই পিয়ালী। পরশকে কল করে বলে দে তো তাড়াতাড়ি ব্যাক করতে। টয়াকে পাওয়া গেছে।”
পিয়ালী আপু হ্যাঁ সূচক সম্মতি জানিয়ে পরশ ভাইকে ফোন করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। আন্টি আমার পাশে দাঁড়িয়ে খানিক ইতস্ততবোধ করে আমায় প্রশ্ন ছুড়ে বললেন,,
“চিলিকোঠায় কি করছিলে টয়া? আর কখনই বা গেলে চিলিকোঠায়?”
মাথা উঁচিয়ে আমি ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে আন্টির দিকে চেয়ে বললাম,,
“রাতে গিয়েছিলাম আন্টি। রুমে অস্বস্তি বোধ হচ্ছিলো তাই। কিন্তু হঠাৎ যে এভাবে ঘুম পেয়ে যাবে বুঝতে পারি নি। চিলিকোঠাতেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। সেই ঘুম ভাঙ্গল আমার এই তো একটু আগে।”
আন্টি ম্লান হেসে বললেন,,
“আচ্ছা যাও। রুমে যাও, ফ্রেশ হয়ে নিচে এসো। আমাদের সাথে ব্রেকফাস্ট করবে।”
হ্যাঁ সূচক সম্মতি জানিয়ে আমি মাথা নিচু করে সিঁড়ির দিকে পা বাড়ালাম। রুমে প্রবেশ করে ঘড়ির দিকে তাকাতেই দেখলাম ১০ঃ১৫ মিনিট বাজছে ঘড়িতে। চোখ দুটো চড়ক গাছে পরিনত হলো আমার। জিভ কেটে প্রায় আধ ঘন্টার মধ্যে ফ্রেশ হয়ে আমি ভেজাক্ত মুখমন্ডলে ড্রেসিং টেবিলের মুখোমুখি দাঁড়াতেই মনে হলো রুমের দরজা ঠেলে কেউ রুমে প্রবেশ করলেন। ধরফড়িয়ে উঠে আমি ভয়াল চোখে দরজার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলাম। প্রখর রাগে বশীভূত পরশ ভাইকে দেখামাএই আমার অন্তর্আত্তা কেঁপে উঠল। ব্ল্যাক শার্টের হাতা জোড়া ফোল্ড করতে করতে পরশ ভাই আমার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে দাঁতে দাঁত চেঁপে আমায় প্রশ্ন ছুড়ে বললেন,,
“আমাকে অযথা ঘুড়াতে তোমার বেশ মজা লাগে না? মজা পাও তুমি? আমাকে এভাবে চড়কির মতো ঘুড়াতে? ”
শুকনো ঢোক গিলে আমি কম্পিত কন্ঠে বললাম,,
“কোকোকোথায় আআপনাকে অঅযথা ঘুড়ালাম আমি?”
“চিলিকোঠায় কি করছিলে তুমি? কোন মহা কাজটা ছিলো চিলিকোঠায়?”
“ঘুমিয়ে পড়েছিলাম হঠাৎ। কি করতে পারতাম আমি? ঘুম তো আর জায়গা, অজায়গা বুঝে না। কাজকর্ম ও বুঝে না!”
“অযথা হয়রান করলে কেনো আমায়? বুঝো না তুমি? টেনশান হচ্ছিলো আমার, টেনশান!”
“আমাকে নিয়ে আপনার কিসের এতো টেনশান পরশ ভাই? আমি তো আপনার চক্ষুশূল তাই না? আপনার হুটহাট রেগে যাওয়ার কারন তো একমাএ আমিই!”
পরশ ভাই থমকালেন। মুষ্টিবদ্ধ হাত জোড়া ঢিলে করে মুখমন্ডলে শান্ত ভাব ফুটিয়ে নিচু গলায় বললেন,,
“তুমি আমার চক্ষুশূল? তাই মনে হয় তোমার?”
“আলবাত মনে হয়। আমাকে দেখলেই আপনি খিটখিট করেন। অযথাই রেগে যান। দু, একটা কটু কথা শুনাতে ও তখন দ্বিধাবোধ করেন না।”
পরশ ভাই কিঞ্চিৎ মুহূর্ত মৌন থেকে বাম হাত দ্বারা নাকটা ঘঁষে সাবলীল দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে বললেন,,
“ব্রেকফাস্ট করে রেডি হয়ে যাও। তোমাকে কুমিল্লা পৌঁছে দিয়েই সন্ধ্যের মধ্যে আমাকে আবার ঢাকা ব্যাক করতে হবে। অফিসে ইম্পর্টেন্ট কাজ আছে।”
পরশ ভাই প্রস্থান নিলেন। মানুষটার যাওয়ার পথে তাকিয়ে আমি হেয় হাসলাম। মানুষটা ভাঙ্গবে তবু মচকাবে না। কিছুতেই মনের কথা মুখে স্বীকার করবে না। ভেজা মুখটা তোয়ালে দিয়ে মুছে আমি ব্যাগপএ, জামা-কাপড় সব গুছিয়ে নিলাম। পুরোপুরি রেডি হয়ে রুম থেকে প্রস্থান নিতেই আন্টি অশ্রুসিক্ত চোখে আমার মুখোমুখি দাঁড়ালেন। উদ্বিগ্ন কন্ঠে আমি আন্টির দিকে প্রশ্ন ছুড়ে বললাম,,
“কি হয়েছে আন্টি? আপনি কাঁদছেন কেনো?”
আন্টি আমার হাত জোড়া চেঁপে ধরে কান্নাজড়িত কন্ঠে বললেন,,
“তুমি যেও না টয়া। এই কয়দিনে তোমাকে অনেকটাই ভালোবেসে ফেলেছি। তুমি চলে গেলে বাড়িটা অনেক ফাঁকা হয়ে যাবে। নিরাগ নিরাগ লাগবে। থেকে যাও না প্লিজ মা।”
মাথা নিচু করে আমি বেদনাহত কন্ঠে বললাম,
“স্যরি আন্টি। আমি আপনার রিকুয়েস্ট টা রাখতে পারব না। আসলে, বাড়ি থেকে অনেক ফোন, কলস আসছে। আব্বু, আম্মু, আপু এমনকি গোটা পরিবার আমার অপেক্ষায় অস্থির হয়ে আছেন। তাছাড়া কিছুদিন পরেই আমার অনার্স সেকেন্ড ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষা। তার উপর আগামী দুদিন পর আমার চাচাতো বোনের বিয়ে৷ মাস্ট বি বিয়েতে এটেন্ড থাকতে হবে আমার!”
আন্টি অকস্মাৎ আমার কাছে প্রস্তাব রেখে বললেন,,
“আমার পরশের বউ হবে তুমি? বিয়ে করবে আমার পরশকে?”
চরম আশ্চর্যিত চোখে আমি আন্টির দিকে তাকাতেই আন্টি অসহায় ভঙ্গিতে বললেন,,
“রাজি হয়ে যাও না আমার পরশকে বিয়ে করতে। বিশ্বাস করো, মন থেকে আমার ছেলেটা অনেক ভালো। অনেক সুখে রাখবে তোমায়। আমি মা হয়ে গ্যারান্টি দিচ্ছি!”
এক ঝটকায় আন্টির হাতটা ছাড়িয়ে আমি অসম্মতি জানিয়ে বললাম,,
“পরশ ভাইকে বিয়ে করার কথা আমি কখনো ভাবি নি আন্টি। না কখনো ভাবতে পারব। উনার মতো বর্বর একটা ছেলের সাথে আর যাই হোক, সংসার বাঁধা যায় না আন্টি। দয়া করে আমার কথায় আপনি আঘাত পাবেন না। সত্যিটা সরাসরি বলতেই আমি পছন্দ করি!”
ছেলের বিরুদ্ধে করা কটুক্তি বোধ হয় আন্টির পছন্দ হয় নি। অসন্তুষ্টি নিয়ে আন্টি হম্বিতম্বি হয়ে আমার সম্মুখ থেকে প্রস্থান নিলেন। দীর্ঘশ্বাস নির্গত করে আমি আন্টির পিছু নিলাম। ডাইনিং টেবিলে সবাই উপস্থিত। পরশ ভাই ও আছেন অবশ্য। আমাকে দেখা মাএই পরশ ভাই মাথাটা নিচু করে নিলেন। আন্টি আনমনে সবাইকে ব্রেকফাস্ট সার্ভ করে দিচ্ছেন। আন্টির উদাসীনতা দেখে পরশ ভাই পরোটায় বাইট বসিয়ে আধো কন্ঠে আন্টিকে শুধিয়ে বললেন,,
“কি হয়েছে আম্মু? তোমাকে এতো ডাল দেখাচ্ছে কেনো?”
আন্টি জোরপূর্বক হেসে বললেন,,
“কই কিছু না তো!”
পরশ ভাই সন্দেহ সূচক কন্ঠে বললেন,,
“সিউর?”
আন্টি হ্যাঁ সূচক সম্মতি জানালেন। পরশ ভাই প্রসঙ্গ পাল্টে বললেন,,
“আব্বুকে দেখছি না তো। আব্বু কোথায়?”
পিয়ালী আপু গরম চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন,,
“আব্বু অফিসে ভাইয়া। ইম্পর্ট্যান্ট কাজ ছিলো আজ অফিসে। তাই সকাল সকাল বের হয়ে গেছেন।”
“আচ্ছা!”
মাথা নিচু করে আমি কোনো মতে আধটা পরোটা খেয়ে হম্বিতম্বি হয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। কাপড়ের ব্যাগটা হাতে নিয়ে আমি পরশ ভাইকে উদ্দেশ্য করে গম্ভীর কন্ঠে বললাম,,
“আপনি খেয়ে দ্রুত আসুন। আমি গাড়িতে ওয়েট করছি।”
পরশ ভাই নিবোর্ধ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন। অপরাধী দৃষ্টিতে আমি আন্টির দিকে চেয়ে বললাম,,
“আমি আসছি আন্টি৷ ভালো থাকবেন আপনি। স্বাস্থ্যের যত্ন নিবেন।”
চোখে সহস্র জলরাশি নিয়ে আন্টি মাথা নুঁইয়ে নিলেন। পিয়ালী আপু এবং পায়েল বিষন্ন মনে আমার দিকে চেয়ে আছেন। তাদের দুজনের দিকে আহত দৃষ্টিতে চেয়ে আমি গলা জড়ানো কন্ঠে বললাম,,
“আসছি পিয়ালী আপু। আসছি পায়েল!”
আঁখি যুগলে ভীড় জমা উদয়স্ত জল নিয়ে আমি দ্রুত পায়ে হেঁটে ড্রইং রুম পরিত্যাগ করে সোজা পার্কিং লনে চলে এলাম। কিঞ্চিৎ মুহূর্তের মধ্যে গাড়িতে উঠে আমি মাথা নিচু করে চোখের জল ছাড়তে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। কেনো জানি না খুব মায়া হচ্ছে আন্টি, পিয়ালী আপু এবং পায়েলের প্রতি। উনাদের ছেড়ে আসতে মন সায় দিচ্ছিলো না মোটে ও। অদ্ভুত এক টান অনুভব করছি তাদের প্রতি। দীর্ঘ এক মাস ধরে তাদের সাথে থেকেছি, খেয়েছি, শুয়েছি, প্রয়োজনে হাজারটা কথা বলেছি, নানা ধরনের আবদার করেছি, আন্টির অসীম, ভালোবাসা, আদর, যত্ন পেয়েছি। সম্ভব কি খুব সহজেই এই মধুর সম্পর্কটার টান ছিন্ন করা? এতো সহজে তাদের ছেড়ে চলে যাওয়াটা? তবে শেষ মুহূর্তে এসে আমি একটা চরম বেয়াদবি করেছি, ঘোর অন্যায় করেছি। আন্টির মুখের উপর কটু কথা বলেছি! জানি, আন্টি ভীষন ব্যথিত হয়েছেন। তবে আমারো যে কিছু করার ছিলো না। আন্টির মুখের উপর সত্যি কথা গুলো না বললে হয়তো আন্টি আশায় থাকতেন। পরশ ভাইয়ার বউ হিসেবে আমাকেই ভাবতে শুরু করতেন। আমি জেনে শুনে কাউকে আশাবাদী করতে চাই না। কাউকে ঠকাতে চাই না! পরশ ভাইকে আমি এই জন্মে বিয়ে করতে পারব না।
ইতোমধ্যেই পরশ ভাই গাড়ির দরজা খুলে গাড়িতে প্রবেশ করলেন। গুরুগম্ভীর ভাব নিয়ে পরশ ভাই আশেপাশে দৃষ্টিপাত না করেই তড়িৎ বেগে গাড়িটা স্টার্ট করে দিলেন। লোকটার থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে আমি চোখে উদয়স্ত ভাসমান জল গুলো উড়নার আঁচল দিয়ে মুছতেই পরশ ভাই কেমন যেনো নমনীয় কন্ঠে বললেন,,
“সম্ভব হলে চেষ্টা করো আম্মু, পিয়ালী এবং পায়েলের সাথে যোগাযোগ রাখতে। ভেবো না শর্ত দিচ্ছি, জাস্ট কথার কথা বলছি। মনের বিরুদ্ধে যাওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই।”
আমি ম্লান কন্ঠে বললাম,,
“চেষ্টা করব।”
পরশ ভাই নিশ্চুপ, নিস্তব্ধ, নির্বিকার। ধ্যান শুধুমাএ গতিশীল রাস্তায় নিবদ্ধ। দৃঢ়তার সহিত উনি গাড়ির স্টিয়ারিং চেঁপে ধরে আছেন। অনুমান করতে পারছি, আঁখি জোড়া উনার কিছুক্ষন পর পর কেমন যেনো ঘোলাটে হয়ে আসছে। বুঝি চোখের কোণে মোহ মেঘ ধরা দিচ্ছে! আমার চলে যাওয়ার বিষন্নতাতেই কি লোকটার চোখে আদৌ মেঘ জমেছে নাকি অন্য কোনো ব্যাপার আছে?
,
,
ঘড়িতে বিকেল ৪ টার কাছাকাছি। আমার পাঁচ পাঁচটে চাচাতো বোনের মাঝখানে সোফায় গুটিশুটি হয়ে বসে আছেন পরশ ভাই! জনাজীর্ন এক অবস্থা উনার। অস্বস্তিতে হাঁসফাঁস করছেন উনি। চোখ জোড়ায় আগুনের স্ফূলিঙ্গ বেশ আন্দাজ করতে পারছি আমি। আশেপাশে আমার চাচা-চাচীরা ভীড় জমিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন৷ কৌশল বিনিময় করছেন পরশ ভাইয়ার সাথে। মেঝো চাচী, ছোট চাচী এবং চাচাতো বোনরা তো পরশ ভাইয়ার সুঠাম দেহ এবং রূপের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। আম্মু কিছুক্ষন পর পর চা, নাশতা, মিষ্টি সাজিয়ে দিচ্ছেন পরশ ভাইয়ার সামনে। মিষ্টি মিষ্টি কথা বলছেন পরশ ভাইয়ার সাথে। জোরপূর্বক হাসি টেনে পরশ ভাই সবার প্রশ্নের প্রতিত্তুর করছেন। গুরুজনদের টপকে যে বৈঠক ছেড়ে উনি উঠে দাঁড়াবেন তার ও সাধ্যি নেই উনার। তাই অপারগ হয়ে এই বিরূপ পরিস্থিতিতে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার শতভাগ চেষ্টা করছেন। সিংহের মতো ভয়াল গর্জন একদম সিঁধিয়ে গেছে! নম্র,ভদ্র কচ্ছপ হয়ে বসে আছে! লোকটার জনার্জীন, অসহায় এবং নেতিয়ে যাওয়া মুখটা দেখে ভীষন হাসি পাচ্ছে আমার। কিচেন রুম থেকে সশ্রদ্ধচিত্তে সবটা পর্যবেক্ষন করছিলাম আমি। হাসিটা ক্রমান্বয়ে আমার কন্ট্রোল ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছিলো। শেষ মেশ অপারগ হয়ে আমি বড় আপুর সামনেই হু হা শব্দে হেসে উঠলাম। বড় আপু উদ্বিগ্ন মুখোভঙ্গি পাল্টে মুহূর্তের মধ্যে চরম আশ্চর্যিত কন্ঠে বললেন,,
“তুই হাসছিস কেনো টয়া? আমার কথা তোর বিশ্বাস হচ্ছে না? আমি সত্যিই হিমেশকে নয় জিহাদকে ভালোবাসতাম!”
#চলবে…?