#তোর_অপেক্ষায়
#সামান্তা_সিমি
#পর্ব_১৫
সন্ধ্যার পর থেকেই টের পেলাম শরীরে বেশ উত্তাপ। মাথায় হালকা ব্যথা।চোখদুটো টনটন করছে।নিশ্চয়ই বৃষ্টিতে ভেজার ফল এসব।আমার অনুমান যদি ভুল না হয় তবে রাত বাড়ার সাথে সাথে গা কাঁপিয়ে জ্বর আসতে চলেছে।ছাদ থেকে আসার পর থেকে সন্ধ্যা অবধি মায়ের সামনে যাইনি।যদি আমার চুল ভেজা এটা ঘূর্ণাক্ষরেও টের পায় তাহলে দফারফা হবে।তবে এখন চুল শুকিয়ে এসেছে প্রায়।
দোতলার করিডোরে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছি।আশেপাশে কেউ নেই।বাইরে এখনো টিপটিপ বৃষ্টি। ঠান্ডা হাওয়া শরীরে জ্বর আসার অনুভূতি জানিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এসবে আমার কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই।মন পড়ে আছে অন্যকোথাও।এই ঠান্ডা হাওয়াতেও যেন সুখের ছোঁয়া পাচ্ছি। আমার অবাধ্য চোখ সবদিকে সেই মানুষটাকে খুঁজে চলেছে।কিন্তু তাঁর কোনো পাত্তা নেই।তবে সে যদি আমার সামনে উপস্থিত হয় আমি কি তাঁর চোখে চোখ রাখতে পারব?
তাঁর সেই চাহনি, অদ্ভুত ব্যবহার সবই তো খোলাশা এখন।সে ভালোবাসে আমায়!তাঁর কন্ঠের সেই আবেদন,দুচোখে জড়ানো মায়া কোনোমতেই ভুলে থাকতে পারছি না।বাকি রইল সেই উত্তর না জানা প্রশ্নগুলো।সে তো বলেছে সময় আসলে আমাকে জানিয়ে দেবে।আমার কাছে এই মুহূর্তে একটা জিনিসই সত্য এবং মুখ্য।আমাকে ছাড়া অপূর্ণ সে!
‘ পূর্ণী একা বসে আছিস কেনো রে?’
অহনা আপুর আওয়াজ পেতে সোজা হয়ে বসলাম।আমার দেখাদেখি আপু ঘর থেকে চেয়ার নিয়ে পাশে বসল।কাঁধে হাত রেখে জিজ্ঞেস করল,
‘ মন খারাপ বুঝি?নিচে চল সবাই বসে আছে।খালামণি বারবার খুঁজছে তোকে তাই আমায় ডাকতে পাঠাল।’
‘ আমার মন ভালই আছে আপু।তুমি নিচে যাও আমি আসছি।’
‘ তা হবে না।আমার সাথেই চল।খালামণি বলেছে তোকে সাথে নিয়েই যেন যাই।উঠ্।
অহনা আপু আমার হাত ধরতেই চমকে উঠে বললেন,
‘ একি রে! তোর শরীর তো গরম।জ্বর টর আসছে নাকি।হায় হায় এজন্যই বুঝি চুপচাপ বসে আছিস?’
‘ আপু আস্তে কথা বলো।আমি ঠিক হয়ে যাব এসব কিছুই না।’
‘ একদম চুপ।বৃষ্টি ভিজেছিস এই কথাটা তোর রিকোয়েস্ট রাখতে খালামণিকে জানাইনি আমি।আর এখন গা কাঁপিয়ে জ্বর আসতে চলেছে তাও বলছিস ঠিক হয়ে যাবি।আমি এক্ষুনি খালামণিকে ডেকে আনছি।আজ তোকে বকা না খাইয়ে ছাড়ছি না।কেনো গেলি বৃষ্টি ভিজতে?’
আপু হম্বিতম্বি করে সিড়ির কাছে দাঁড়িয়েই মাকে ডাকতে লাগল।ব্যস্ হয়ে গেল আর কি!
মাও চলে এল ছুটতে ছুটতে।অহনা আপু মুখ গম্ভীর করে মায়ের কাছে কবিতার মতো সব বলে দিল।মা আমার দিকে কটমট তাকাচ্ছে আর আমি অসহায় মুখ করে বসে আছি।একে একে খালামণি,নানু এবং মামীও হাজির।মা এসে কপালে হাত রেখে তাপমাত্রা পরখ করে বলতে লাগল,
‘ এতবড় মেয়ে হয়েও তুই এমন বাচ্চাদের মত গেছিস বৃষ্টি ভিজতে।ঠান্ডার দোষ জেনেও এই কাজটা করলি!আমাকে না জ্বালিয়ে তোর শান্তি নেই।এখন তোর বাবা জানতে পারলে কি হবে ভাবতে পারছিস?যদি শুনে তুই জ্বর বাঁধিয়েছিস তাহলে সব চোট তো আমার উপর দিয়ে যাবে।’
মায়ের শাসনও আজ মধুর লাগছে।মায়ের চিন্তিত চেহারায় দিকে তাকিয়ে হাসছি মিটিমিটি। এটা ঠিক যে বাবা জানতে পারলে খুব বকবে।আমাকে নয় মাকে।
‘ আশ্চর্য মেয়ে।এদিকে জ্বর বেড়ে চলেছে আর হাসছিস তুই?উঠ এখন হালকা কিছু খেয়ে তারপর ওষুধ খাবি।’
খালামণির কথায় চেয়ার ছেড়ে উঠলাম।তখনই বুঝতে পারলাম শরীর অনেকটাই দুর্বল লাগছে।তাই আর কথা না বাড়িয়ে চলে এলাম রুমে।
.
প্রচন্ড মাথাব্যথা নিয়ে চোখ খুললাম।সবকিছুই ঘোলাটে দেখছি।প্রবল ঠান্ডায় কাঁপছি ঠকঠক করে।কেউ একজন গায়ে কাঁথা জড়িয়ে দিল ভালোভাবে।ঘরে লাইটের তীব্র আলোতে চোখ মেলা দুষ্কর। সমস্ত শরীরে অসম্ভব দুর্বলতা।ঘরে পরিচিত মানুষদের গলার আওয়াজ পাচ্ছি। পরক্ষণেই টের পেলাম কেউ আমার মাথায় পানি ঢালছে।এবার মনে হচ্ছে চোখ জুড়ে ঘুম নেমে আসছে।ধীরে ধীরে সকলের কথা অস্পষ্ট হয়ে এল।এরপর আর কিছুই মনে নেই।
যখন ঘুম ভাঙলো তখন ঘরের মেঝেতে ঝকঝকে রোদ্দুর। আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসতেই দেখি অহনা আপু খাটের পাশে টুলে বসে ফোন টিপছে।আমার দিকে খেয়াল হতে উদ্বিগ্ন হয়ে ফোন রেখে বলতে লাগল,
‘ এখন কেমন লাগছে রে?আর জ্বর নেই তো?’
আপু উঠে এসে গায়ে হাত দিয়ে নিশ্চিন্ত হলো।হাঁফ ছেড়ে বলল,
‘ জ্বর নেই।তুই রাতে যে কারিষ্মা দেখিয়েছিলি মনে আছে কিছু? প্রত্যেকটা মানুষকে ভয় পাইয়ে দিয়েছিলি!তোর আক্কেল থাকলে আর কখনো বৃষ্টি ভেজার নাম করিস না। ‘
খাটে হেলান দিয়ে বসে গতরাতের ঘটনা মনে করার চেষ্টা করলাম।শুধু মনে পড়ছে আমার মাথায় কেউ পানি দিচ্ছিল।এই মুহূর্তে মাকে দেখতে ইচ্ছে করছে খুব।আমার মমতাময়ী মা নিশ্চয়ই ভীষণ ভয় পেয়ে গেছে।কে জানে এতক্ষণে বোধ হয় বাবার কানেও খবর চলে গেছে আর বাবা হুমকি ধমকি দিয়ে শহরে ব্যাক করতে বলেছে।আমার এক্সিডেন্টের পর থেকে মা বাবা দুজনই সবসময় আমাকে নিয়ে স্বাভাবিকের চেয়ে একটু বেশিই চিন্তিত থাকেন।
‘ কাল রাতে তোর গা জ্বলন্ত উনুনের মত গরম হয়ে গেছিল।তোর তো কোনো জ্ঞানই ছিল না।এমন অবস্থা দেখে খালামণির চোখ ভিজে উঠছিল বারবার।তখন রাত প্রায় দশটা।গ্রামে এমন সময়ে ডক্টর পাওয়া খুব মুস্কিল।কিন্তু দুর্জয় ভাইয়া কি করেছে জানিস?গ্রামে যিনি ডাক্তার উনাকে সোজা ঘর থেকে তুলে নিয়ে এসেছে।’
দুর্জয় ভাইয়া নামটা শুনতে পেয়ে চোখ থেকে ঘুমের রেশ কেটে গেল।কাল বিকেল থেকে একবারও উনার দেখা পাইনি।আমার জ্বর হয়েছে শুনে নিশ্চয়ই খুব ঘাবড়ে গেছিল নাহলে কি এমনি এমনি ডাক্তারকে তুলে নিয়ে এসেছে?
‘ তারপর কি হলো?’
‘ তারপর আর কি!ডাক্তার আংকেল পরীক্ষা-নিরীক্ষা করল।পরে অবশ্য হাসতে হাসতে বলল কিছুসময়ের জন্য ভেবেছিল উনাকে বুঝি ডাকাত দলের কোনো লোক কিডন্যাপ করেছে।কিন্তু পূর্ণী তোকে আরো একটা কথা বলার ছিল।’
‘ হ্যাঁ বলে ফেলো।’
আপু চারদিকে একবার সজাগ দৃষ্টি দিয়ে গলা নামিয়ে ফিসফিস করে বলতে লাগল,
‘ কালরাতে তুই আরো একটা ঘটনা ঘটিয়েছিস!’
আমার দুই ভ্রু কুঞ্চিত হলো।আপু এসব পাত্তা না দিয়ে আবার বলল,
‘ রাতে ডাক্তার তোকে চেক করে মেডিসিন দিয়ে যাওয়ার পর সবাই যার যার রুমে চলে গেছিল।সুহানা আর জেরিন অন্য রুমে ঘুমিয়েছে।শুধুমাত্র আমি ছিলাম তোর সাথে।রুম খালি হওয়ার পর দুর্জয় ভাইয়া এসেছিল তোকে দেখতে।ভাইয়া তোর কপালে হাত রেখে জ্বরের মাত্রা চেক করছে তখন তুই হঠাৎ চোখ খুলে ভাইয়ার হাত জাপটে ধরে আবার ঘুম।সেই মুহূর্তে ভাইয়ার ঠোঁটে মুচকি হাসি দেখে বেশ অবাক হয়েছিলাম।আমি তোর হাত ছাড়াতে চাইলে ভাইয়া রাজি হয়নি।এরপর কতক্ষণ ভাইয়া এই রুমে ছিল জানি না।আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।সকালে উঠে আর দেখিনি।’
আপু কথা শুনে লজ্জায় মুখ রাঙা হয়ে উঠল।ঘুম এবং জ্বরের ঘোরে আমি বুঝি এসব করেছি!এতক্ষণ উনাকে একপলক দেখার জন্য মনটা আনচান করছিল কিন্তু এই কথা শুনে মনে হচ্ছে উনার ছায়াও মাড়াতে পারব না।
খাট থেকে নামতে যাব এমন সময় রুমে দুর্জয় ভাইয়ার আগমন।উনাকে দেখে হঠাৎ ভুত দেখার মত চমকে উঠলাম।উনি আমার মুখোমুখি কিছুটা দূরে খাটে ধপ করে বসে পড়লেন।দেখে মনে হচ্ছে সবেমাত্র ঘুম থেকে উঠেছে।
অহনা আপু হেসে বলল,
‘ গুডমর্নিং ভাই!’
‘ গুডমর্নিং! অহনা তুই যা তো মাকে বল আমার জন্য এককাপ চা দিতে।মাথা ধরেছে খুব।’
‘ এখনি যাচ্ছি। ‘
দুর্জয় ভাইয়ার খপ্পরে আমাকে একা করে আপু চলে গেল।মনে মনে ভাবছি আমার কারণেই উনার মাথা ধরেছে।কাল সারারাত নিশ্চয়ই ঘুমাতে পারেনি।কিন্তু এখন একা উনার সামনে আমি কোনোমতেই থাকতে পারব না।খুব লজ্জা লজ্জা লাগছে।
দুর্জয় ভাইয়া বোধ হয় আমার মনের ভাব বুঝে ফেলেছে।ঘুম জড়ানো গলায় বলল,
‘ পালাই পালাই স্বভাব কবে দূর হবে তোর?’
আমি একপলক উনার দিকে তাকিয়ে আস্তে করে বললাম,
‘ কি করব! আপনাকে দেখলেই আমার পালাই পালাই ফিলিংস আসে।’
‘ তাই? কাল বিকেলে যা যা বলেছি এরপরও এমন ফিলিংস?’
এবার যেন লজ্জায় সিঁটিয়ে গেলাম আমি।ঝোপ বোঝে কোপ মারতে চাইছে উনি।কাল উনি আমার কতটা কাছে ছিলেন এটা ভাবতেই মাথা ঘুরছে।আর আমিও নির্বাকের মত দাঁড়িয়ে সব শুনে গেছি।
‘ দ..দেখুন আপনি সকাল সকাল কেনো এখানে এসেছেন!নিজের ঘরে যান দয়া করে।’
‘ যাব না।সারারাত তো আমাকে জাপটে ধরে ঘুমিয়েছিস আর এখন ভাগিয়ে দিচ্ছিস?দিস ইজ নট ফেয়ার।’
দুর্জয় ভাইয়ার কথা শুনে আমি শিহরিত।পাগল লোক কি বলছে এসব!একটু আগেই অহনা আপু বলে গেছে ঘুমের তাড়নায় আমি উনার হাত ধরেছিলাম আর উনি বলছে উনাকে…ছি ছি! জীবনে আজ প্রথম নিজের কানে তিল থেকে কিভাবে তাল হয় তা শুনলাম।
থমথমে গলায় বললাম,
‘ কিসব আবোলতাবোল বকছেন! আমার মত সহজ সরল একটা মেয়ের নামে শুধু শুধু অপবাদ দিচ্ছেন কেনো?’
দুর্জয় ভাইয়া ফিক করে হেসে দুহাতের আঙুল মটমট করে ফোটাতে লাগলেন।কিন্তু কিছুক্ষণ পরই ভাবুক হয়ে বললেন,
‘ তুই সহজ সরল বলেই তোকে নিয়ে আমার চিন্তার শেষ নেই।কে জানে কখন কোনদিক দিয়ে কেউ ক্ষতি করার জন্য বসে থাকে।’
‘ মানে?আমার ক্ষতি কে করবে?’
‘ কেউ না কথার কথা বললাম।তবে আমি যে কাল তোকে আমার মনের কথা জানিয়ে দিলাম তার উত্তরে তুই তো কিছু বললি না।হ্যাঁ অথবা না!’
দুর্জয় ভাইয়া ভ্রু নাচিয়ে বলল কথাগুলো।কিছুক্ষণের জন্য থমকে গিয়ে আমি বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম।বুকের ভেতর ধুকপুক করছে।উনি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বারবার ওই ঘটনা টেনে আনছেন।
আমি তো এখনো নিজের মন থেকেই সঠিক কোনো উত্তর পাইনি তাহলে উনাকে কি জবাব দেব।তবে এটা ঠিক যে উনার মনের কথা জানার পর থেকে অন্যরকম একটা ভালোলাগা ঘিরে রেখেছিল আমায়।আমি অনুভব করেছি যে উনার প্রতি আমার আলাদা একটা টান আছে। কিন্তু এটাকে তো ভালোবাসা বলে চালিয়ে দেওয়া যায় না।আমার আরো সময় দরকার।উনার প্রতি আমার অনুভূতিগুলো আসলে কোন পর্যায়ের তার হদিস আমি পাইনি এখনো।
চোখ বন্ধ করে বললাম,
‘ যদি উত্তর না হয়?’
দুর্জয় ভাইয়া আমার সামনে এসে পথ রোধ করে দাঁড়ালেন।আমার দিকে কিছুটা ঝুঁকে দাঁতে দাঁত পিষে বললেন,
‘ একবার না বলে দেখ্ তোকে দিয়ে হ্যাঁ বলানোর দায়িত্ব আমার।’
চলবে…