তোর অপেক্ষায় পর্ব-১৬

0
428

#তোর_অপেক্ষায়
#সামান্তা_সিমি
#পর্ব_১৬

পাক্কা চারদিন নানু বাড়ির বেড়ানো শেষে আজ নিজ বাড়িতে পা রাখলাম সকলে।সন্ধ্যার আগ মুহূর্তে রওনা দিয়েছি এখন প্রায় আটটা বাজতে চলল।বাসায় ঢুকতেই মনে হলো কত যুগ যেন এখানে ছিলাম না।
বড়মা তাড়াহুড়ো করে এগিয়ে আসলেন আমাদের কুশলাদি জিজ্ঞেস করতে।আমি কোনোদিকে না তাকিয়ে সোজা চলে এলাম রুমে।কাঁধের ব্যাগ ছুড়ে ফেলে ধপ করে শুয়ে পড়লাম বিছানায়।আহ্ আমার বিছানা না জানি কত মিস করেছে আমায়।তখনই বারান্দা থেকে পরিচিত ডাক শুনতে পেয়ে তড়াক করে লাফিয়ে উঠলাম।ছুটে এলাম বারান্দায়। ওইতো আমার চিনি মিনি।এতদিন ওদের বড়মা’র উপর দায়িত্ব দিয়ে গেছিলাম।আমাকে দেখতে পেয়ে ওরা সমস্বরে চেঁচিয়ে উঠল।অবলা পাখিদুটো বোধ হয় আমার কথা ভেবে ভেবে দানাপানি মুখে তুলেনি।

‘ হ্যালো চিনি, হ্যালো মিনি! আমি এসে গেছি!তোদের সাথে কত কথা বলার বাকি আছে জানিস!নানু বাড়িতে অনেক কিছু ঘটে গেছে।তোরা কি শুনতে চাস?’

চিনি মিনি লম্ফঝম্প শুরু করল।ওদের এই প্রতিক্রিয়া আমি হ্যাঁ বোধক উত্তর ধরে নিয়ে বলতে শুরু করলাম,

‘ দুর্জয় ভাইয়াকে চিনিস তো!যিনি তোদেরকে আমার কাছে পাঠিয়েছে। লোকটা আমাকে তাঁর মনের কথা জানিয়েছে গতকাল বিকেলে।’

এটুকু বলতে গিয়ে লজ্জায় মরি মরি অবস্থা আমার।মনে হচ্ছে আমার সামনেই দুর্জয় ভাইয়া দাঁড়িয়ে আছেন আর হাসছেন মুচকি মুচকি।ওই লোক তো দেখি আমায় পুরো দিওয়ানা বানিয়ে ফেলছে ধীরে ধীরে।আমি কি হেলুসিনেশন দেখা শুরু করেছি নাকি?
চিনি মিনি ঘাড় ঘুরিয়ে দেখছে আমাকে।বোধহয় এরপরের কথাগুলো শোনার অপেক্ষায় আছে।

‘ আসলে কি বল্ তো উনাকে আমারও বেশ ভালো লাগে কিন্তু তাও উত্তর জানাতে পারিনি।এত জলদি কিভাবে জানাই বল! তাড়াহুড়োর তো কিছু নেই।আগে উনাকে একটু যাচাই-বাছাই করে নিই তারপর না হয়..হিহিহি। ঠিক করেছি না?’

পাখিদুটো এখন চুপচাপ। তারমানে আমার সিদ্ধান্ত ওদের পছন্দ হয়নি?
এমন সময় দরজা খোলার আওয়াজ পেতে রুমে উঁকি দিলাম।জেরিন আপু এসেছে।আমাকে দেখতে পেয়ে বলল,
‘ কি করছো পূর্ণী?আরে বাহ্ পাখি দুটো দারুণ তো!কবে কিনলে?’

‘ এইতো কিছুদিন হবে।তুমি আজ আর বাসায় যেও না আপু।রাতটা থেকে যাও।’

‘ থাকব তো। আমি ভেবেছিলাম দুর্জয় ভাইয়াকে বলব আমাকে পৌঁছে দিতে কিন্তু আন্টিরা আমাকে যেতে দিল না।’

আমি মাথা নেড়ে মৃদু হাসলাম।প্রায়ই খেয়াল করি জেরিন আপু দুর্জয় ভাইয়াকে নিয়ে একটু বেশিই মেতে থাকেন।কারণটা কি?আপু কি ভাইয়ার প্রতি দুর্বল?কিন্তু জেরিন আপু তো দুর্জয় ভাইয়ার দুচোখের বিষ।আমার মস্তিষ্ক বলছে এসবের পেছনে গোপন কোনো ঘটনা আছে।সুযোগ এবং সময় বুঝে দুর্জয় ভাইয়াকে একদিন জিজ্ঞেস করে ফেলব।

_______________________________

ক্লাস শেষে ভার্সিটির গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে আছি রিকশার জন্য। কিন্তু রিকশার দেখা নেই।প্রায় পনেরো মিনিট ধরে এখানে ঠায় দাঁড়িয়ে। এজন্য যতটুকু না বিরক্ত লাগছে তারচেয়েও মাথা গরম হচ্ছে আমার থেকে কিছু দূরে বাইকে বসে থাকা তিনটে ছেলেকে দেখে।সেই কখন থেকে আমার উপর চোখ ঘুরিয়ে যাচ্ছে। পোশাক আশাক দেখে তো ভালো ঘরের ছেলে মনে হয় কিন্তু আমার উপর এভাবে নজরদারি করছে কেনো!ছেলেগুলো ভদ্রলোক সেজে আবার ছিনতাই করার মতলব করছে নাতো!ছিনতাইয়ের কথা মনে হতেই কাঁধের ব্যাগটাকে চেপে ধরলাম।ব্যাগে মোটামুটি অনেকগুলো টাকা যত্নে রাখা আছে।আমার জমানো টাকা হারালে আমি উন্মাদ হয়ে রাস্তায় গড়াগড়ি খাব।

আমার ভয়সূচক চিন্তায় চিড় ধরিয়ে পরিচিত একটি গাড়ি ফুল স্পিডে এসে থামল বাইকে বসা ছেলেগুলোর সামনে।এটা তো দুর্জয় ভাইয়ার গাড়ি।
দুর্জয় ভাইয়াকে দেখে ছেলে তিনোটার মুখে বিস্তৃত হাসি ফুটে উঠল।উনারা পরস্পর হ্যান্ডশেক করে হালকা হাগ করলেন।আচ্ছা এই ব্যাপার তাহলে।বাউণ্ডুলে ছেলেগুলো উনার দোস্ত!

ছেলেদের বিদায় দিয়ে দুর্জয় ভাইয়া এবার আমার দিকে ফিরলেন।চোখ থেকে সানগ্লাস নামিয়ে আঙুলের ইশারায় ডাকলেন আমাকে।এহ্ ভাব এমন যেন কোনো সিনেমার হিরো শ্যুটিং করার জন্য ল্যান্ড করেছে।তবে এটা মানতেই হবে উনি হিরো হোক আর ভিলেন হোক উনাকে দেখলে এখনো আমার গলা শুকিয়ে আসে।উনার সামনে যাওয়া মানেই উনার বুদ্ধিদীপ্ত দুটি চোখ আমাকে অস্থির করে তুলবে।
গুটিগুটি পায়ে হেঁটে গেলাম গাড়ির কাছে।অন্যদিকে দৃষ্টি দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
‘ আপনি এখানে যে?কোনো দরকার ছিল?’

দুর্জয় ভাইয়া নিজের চুলের ভেতর আঙুল চালিয়ে বললেন,
‘ জ্বি।হবু বউকে নিতে এসেছি।’

হবু বউ শব্দ দুটো শুনে নিম্নমাত্রার শক খেলাম।এই ব্যক্তি সামনে থাকলে আমাকে সবসময় ছোট থেকে বড় মানের শক এবং ভিমড়ি খেতে হবেই হবে এটা আমি ভুলে যাই।শক খাওয়ার সাথে সাথে আবার কানদুটো গরম হয়ে উঠেছে।হবু বউ কথাটা কি উনি আমাকেই বললেন?

ঢোক গিলে বললাম,
‘ কি আশ্চর্য এখানে কে আপনার হবু বউ?’

‘ কেনো?তোর কোনো আপত্তি আছে আমার হবু বউ হতে?’

‘ আমার তো বয়েই গেছে আপনার বউ হতে।’

আমি মুখ ঝামটা দিয়ে গাড়িতে বসে পড়লাম।উনার সাথে কথা বলা মানে কথার প্যাঁচে জড়িয়ে পড়া।
দুর্জয় ভাইয়া হাসতে হাসতে বললেন,
‘ আমি কিন্তু হবু বউ বলেছিলাম।তুই তো একধাপ এগিয়ে গেছিস!’

আমি চোখমুখ খিঁচে চুপ করে রইলাম।একবারো ফিরে তাকাচ্ছি না উনার দিকে।জানি তাকালেই উনার মোহনীয় হাসি ঘায়েল করে ফেলবে আমায়।তবে বেশিক্ষণ চুপ করে থাকতে পারলাম না।মাথায় একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন জন্ম হতেই দুর্জয় ভাইয়াকে সোজাসাপ্টা জিজ্ঞেস করলাম,

‘ তখনের ছেলেগুলো তো আপনার বন্ধু তাই না!আপনি জানেন আপনি আসার আগে ওরা আমার দিকে বারবার সন্দেহজনক চোখে তাকাচ্ছিল!সত্যি করে বলুন তো এরা আপনার কেমন বন্ধু? ‘

‘ যখন রাজনীতি করতাম তখনকার বন্ধু এরা।আমিই ওদের বলেছিলাম ভার্সিটিতে তোর উপর সর্বক্ষণ নজর রাখতে তাই ওভাবে তাকাচ্ছিল।’

আমি এবার তেতে উঠলাম।
‘ এসব ঠিক নয় ভাইয়া! আমি কোনো ক্রিমিনাল যে আমার পেছনে লোক লাগিয়ে রাখবেন?আর যাই হোক এটা কিন্তু ঠিক করছেন না।আমার একটা স্বাধীনতা আছে তাই না!আমি তো আর ছোট বাচ্চা নই যে আমাকে রাস্তাঘাটে দেখে দেখে রাখতে হবে।’

‘ প্রথমত আমার সামনে আমাকে ভাইয়া বলে ডাকবি না।দ্বিতীয়ত আমি কি ঠিক করছি না করছি সেটা আমাকে বুঝতে দে।আর কি যেন বললি স্বাধীনতা! যতদিন তোকে আমার নিজের করে না পাচ্ছি ততদিন স্বাধীনতা শব্দটা ভুলে থাক।তোর এই স্বাধীনতার জন্য আমি কোনো রিস্ক নিতে চাই না।গট ইট?’

দুর্জয় ভাইয়ার ধমক শুনে চুপসে গেলাম।আস্ত জল্লাদ একটা।আমি একটু জোর গলায় কথা বলতে গেলেই হুঙ্কার দিয়ে উঠে।আমি কি ভুল কিছু বলেছি?অনার্সে পড়ুয়া একজন মেয়ের পেছনে নজরদারি করার জন্য লোক ফিট করে রাখবে এটা কেমন কথা?আর কথাই বলব না এই লোকের সাথে। আমার মান-মর্যাদা বলতে কিছু নেই নাকি!বাকি রইল ভাইয়া ডাক! ভাইয়াকে ভাইয়া না বলে কি বোন বলে ডাকব?অবশ্য এই ভাইয়া নামক জল্লাদ টাই তো আমাকে বউ বানানোর জন্য ওত পেতে আছে।হাহ্ তিনি তো আর জানেন না আমি এত সহজে উনার জালে ধরা দিচ্ছি না।আমাকে পেতে হলে উনাকে প্রচুর কাঠখড় পোড়াতে হবে যে।

দুর্জয় ভাইয়ার গাড়ি আমার বাড়ির রাস্তা ছেড়ে অন্যদিকে মোড় নিতে সচকিত হয়ে উঠলাম।বলা কওয়া ছাড়া এই লোক আমাকে কোথায় নিয়ে যাওয়ার ফন্দি আঁটছে।উনার ভাব-গতিক তো ঠিক লাগছে না।প্রপোজ করেছে বলে কি মাথা কিনে নিয়েছে?আমার স্বাধীনতা হরণ করে এখন আমার উপর খবরদারী করার প্ল্যান।দেখতে হ্যান্ডসাম বলে উনাকে একটু ভালো লাগে তাই কোনো প্রতিবাদ করি না হুহ্ নাহলে দেখিয়ে দিতাম আমার গলায় কত জোর।

আপাতত গলার জোর নিয়ে না ভেবে দুর্জয় ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করলাম,
‘ এই যে মিস্টার ডিজে! আমাকে আপনি কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন জানতে পারি কি?এটুকু অন্তত জানি এটা আমার বাড়ির রাস্তা না। ‘

দুর্জয় ভাইয়া প্রচন্ড শব্দে ব্রেক কষলেন।আচমকা এমন হওয়ায় ভয় পেয়ে আমি মাথা নিচু করে ফেললাম।ভাগ্যিস রাস্তায় তেমন যানবাহন ছিল না নাহলে বড়সড় এক্সিডেন্ট হয়ে যেত।
দুর্জয় ভাইয়া অদ্ভুত মুখভঙ্গি করে বলে উঠলেন,

‘ কি বললি তুই?ডিজে?’

আমি এবার সোজা হয়ে বসলাম।মনে মনে দমফাটা হাসি পাচ্ছে। ডিজে নাম শুনে ঝটকা খেয়েছে বুঝতেই পারছি।একদম ঠিক হয়েছে।সবসময় আমি কেনো ঝটকা খাব উনাকেও খেতে হবে।
হাসি চেপে বললাম,

‘ আপনিই তখন বললেন আপনার সামনে যেন ভাইয়া বলে না ডাকি।তো এখন নাম ধরে ডাকলে ভালো শোনায় না।তাই হঠাৎ ডিজে নামটা মাথায় চলে এল।ইংরেজিতে Durjoy কে সংক্ষিপ্ত করলে Dj হয়ে যায়।পছন্দ হয়নি নাম?’

দুর্জয় ভাইয়া কিছুক্ষণ মুখ ভার করে তাকিয়ে থেকে হেসে দিলেন।আমার মাথায় আস্তে চাটি মেরে বললেন,

‘ এসব নাম তোর মাথাতেই আসবে।’

আমি আড়চোখে দুর্জয় ভাইয়ার হাসি দেখছি।মানুষটাকে হাসলে সুন্দর লাগে।
পাঁচ মিনিটের মধ্যে গাড়ি খালামণিদের বাড়ির বিশাল গেইটের সামনে থামল।আমি চুপচাপ ভাইয়ার পিছু পিছু ভেতরে ঢুকলাম।উনাদের বাড়িতে কি জন্য নিয়ে এসেছে সেটা তো ভেতরে গেলেই জানা যাবে।

ড্রয়িংরুমে যেতেই দারুণ চমক খেলাম।ইমন ভাইয়া,সুহানা আপু,ফারাজ এবং অহনা আপু সোফায় একসাথে বসে জমিয়ে গল্প করছে।তাঁদের সাথে আরো দুজন অচেনা ব্যক্তি।
আপুরা আমাকে দেখতে পেয়ে খুশিতে চিল্লিয়ে বলে উঠল,
‘ যাক বাবা আমাদের গ্রুপের বাকি দুজনও এসে গেল।’

এতক্ষণে আমি কাহিনী বুঝতে পারলাম।আজ বোধহয় খালামণি ভাইবোন সকলকে লাঞ্চে ইনভাইট করেছে।আমি খালামণির সাথে দেখা করে আপুদের কাছে গিয়ে বসলাম।দুর্জয় ভাইয়া অচেনা অতিথি দুজনের সাথে কথা বলে দোতলায় চলে গেলেন।
অতিথি দুজনের মধ্যে একজন আমাকে হেসে জিজ্ঞেস করল,

‘ কেমন আছো পূর্ণতা?’

আমি সৌজন্যের সাথে উত্তর দিলাম,
‘ জ্বি ভালো।আপনি কেমন?’

‘ আমি তো ভাল।আমাকে চিনতে পারোনি তাই না!আমি তুষার।দুর্জয়ের কাজিন।আপন না হলেও দুজন ছোট থেকে একই স্কুল, ভার্সিটিতে পড়েছি।আর এ হচ্ছে নীলাশা আমার ওয়াইফ।’

আমি এবার তুষার ভাইয়ার পাশে বসে থাকা অতিমাত্রার সুন্দরী মেয়েটির দিকে নজর দিলাম।
মেয়েটিও আমাকে কুশলাদি জিজ্ঞেস করল।আগেই বুঝতে পেরেছিলাম ওরা দুজন দম্পতি। বেশ মানিয়েছে ওদের।তুষার ভাইয়া দেখতে যেমন সুদর্শন তেমনি তাঁর স্ত্রী!

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here