#তোর_অপেক্ষায়
#সামান্তা_সিমি
#পর্ব_২
সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখতে পেলাম আকাশ ঝকঝকে পরিষ্কার।সাদা মেঘের ভেলা দল বেঁধে ভেসে বেড়াচ্ছে। কাল রাতে যে ঝুম বৃষ্টির তান্ডব চলছিল সেটা বুঝাই যাচ্ছে না।কি সুন্দর চকচকে সোনালি রোদ্দুর ছুঁয়ে দিচ্ছে আমার রুমের প্রতিটা আসবাবপত্রকে।থাই গ্লাস সরিয়ে চলে এলাম বারান্দায়। বারান্দার কোনায় ফুলের টবে পুতে রাখা চারাগুলোর নাজেহাল অবস্থা। কাল রাতের ঝড়ের ফলাফল এসব।
টবগুলোর পাশে ফ্লোরে ছেলেদের কর্দমাক্ত বুট জুতার পায়ের ছাপ।এটা দেখেই বুকটা ছ্যাত করে উঠল আমার।কালরাতের সেই ঘটনাটা স্বচ্ছ পানির মত চোখের সামনে ভেসে উঠল।নিজের সাহসের তারিফ না করে পারছি না।কিভাবে পারলাম সেই ক্রিমিনালটার সাথে কথা বলতে?জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়িনি এটাই ভাবার বিষয়।
না না সবচেয়ে বড় বিষয় হলো লোকটি আমার কোনো ক্ষতি করে দেয়নি হাতে ছুড়ি থাকা সত্ত্বেও। আল্লাহ্ কালকে জোর বাঁচা বাঁচিয়েছো আমায়।এখন চটজলদি এই জুতোর দাগগুলো ক্লিন করে ফেলতে হবে।যদি ঘূর্ণাক্ষরেও কেউ দেখে ফেলে সর্বনাশ হয়ে যাবে।হাজারটা প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে আমায়।
ফ্রেশ হয়ে জামা পাল্টে একেবারে কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে রুম থেকে বের হলাম।ঘড়ির কাটা আটের ঘর বরাবর।ক্লাস শুরু হবে নটায়।অনেকটা সময় বাকি আছে।
নিচতলায় নেমে এসে দেখি ডাইনিং টেবিলে বসে সুহানা আপু ঝিমাচ্ছে। আপুর এই এক সমস্যা। সকালে ঘুম থেকে উঠতেই চায় না।নিশ্চয়ই বড়মা ঠেলেঠুলে উঠিয়ে ভার্সিটি পাঠাচ্ছে।আপুর পাশে চেয়ারে বসে ফিসফিস করে বললাম,
‘ আর কত ঝিমাবে আপু?সোজা হয়ে বসো।জরুরি কথা আছে।’
আপু নড়েচড়ে বসলেন।কিন্তু জরুরি কথা শোনার জন্য তাঁর চেহারায় কোনো সিরিয়াস ভাব নেই।তাই কোনো ভনিতা না করে গতকাল রাতের সব ঘটনা মুখস্থের মত বলে গেলাম।আমার বক্তব্য শেষ হতেই আপু বড়বড় চোখ নিয়ে তাকালেন।চোখের তন্দ্রাচ্ছন্ন ভাবটা হঠাৎই কর্পূরের মত কোথাও উড়ে গেল মনে হয়।
উদ্বিগ্ন হয়ে বললেন,
‘ এসব কি বলছিস বোন?তোর যে কোনো ক্ষতি হয়নি সেটাই সৌভাগ্যের ব্যাপার।এমন একটা ভয়ানক ঘটনা বাড়ির সবাইকে জানাতে হবে তো।তুই দাঁড়া আম্মু আর চাচীর কাছে আগে বলি।’
আপু উঠতে নিলেই তাঁকে টেনে চেয়ারে বসিয়ে দিলাম।ক্রিমিনাল সম্পর্কিত ইন্সিডেন্টটা পাঁচকান করলে হবে না।
‘ আপু ভেবে দেখো ওই লোক কিন্তু বলেছে পুলিশ তাড়া করে বেড়াচ্ছে তাই সে আমার বারান্দায় উঠে এসেছে।সে এখন পালিয়ে কোথায় না কোথায় চলে গেছে।তাই বলছি কি বাড়ির কাউকে না জানানোয় ভালো।নাহলে সবাই একটা আতঙ্কের মধ্যে থাকবে।জানোই তো মা আমাকে নিয়ে একটু অতিরিক্ত টেনশন করে।’
সুহানা আপু কিছুক্ষণ বড়দের মত মাথা দুলালেন।এরপর বিজ্ঞস্বরে বললেন,
‘ তোর কথার যুক্তি আছে।শোন এখন থেকে রাতে তোর সাথে আমি ঘুমাব।রাতে দরজা জানালা ভালো করে আটকে ঘুমালেই হবে। বুঝতে পারছিস?’
এই কথা শুনে আমার মুখ চুপসে গেল।আপুর সাথে ঘুমানোর চেয়ে ভালো ওই ক্রিমিনালের হাতে জীবন সমর্পন করা।এখন কি করি?
‘ কিরে আমি ঘুমানোর কথা বলাতে চেহারার রঙ পাল্টে গেল কেনো?’
আমি কিছু বলার আগেই হাজির হলেন ইমন ভাইয়া।গায়ে ফিটফাট পোশাক হাতে অফিসের ব্যাগ।কলার ঠিক করতে করতে এসে বললেন,
‘ চেহারার রঙ না পাল্টে কি করবে।তুই ঘুমালে যেভাবে মহিষের মত নাক ডাকিস মাই গড!শোন পূর্ণী তোর রুমে ওকে ভুলেও জায়গা দিস না।হার্ট অ্যাটাক করে মারা যাবি রাতে।’
‘ সাট আপ ইমইন্না।আমি যেভাবে মন চায় সেভাবে ঘুমাব।তোর সমস্যা কই?সকাল সকাল মুডটাই খারাপ করে দিলি।যা নাস্তা খেতে হবে না তোর।’
‘ নাস্তা কি তুই বানিয়েছিস যে অর্ডার করছিস?জমিদারনীর মত ঘুম থেকে উঠিস দশটা বাজে।আগামী একমাসের মধ্যে বিয়ে দিয়ে তোকে বিদায় না করেছি তাহলে আমার নাম বদলে ফেলব আমি।’
দুই ভাইবোন ছোটখাটো একটা তর্ক যুদ্ধে নেমে গেল।এটা আজকের ঘটনা নয়।এরা প্রতিদিন সকালে নাস্তা খেতে বসে এমন অহরহ লেগে যায়।যাই হোক ক্রিমিনালের ব্যপারটা চাপা পড়ে গেছে যুদ্ধের চক্করে।সুহানা আপুর উপর বিশ্বাস আছে কাউকেই কথাটা বলবে না।
আম্মু এসে তিনজনকে নাস্তা দিয়ে চলে গেল কিচেনে।কিছুক্ষণের মধ্যে আমার একমাত্র ছোট ভাই ফারাজও বসে পড়ল টেবিলে।ফারাজ এবার ক্লাস ফোরে। এ বাড়িতে সে সবচেয়ে ছোট সদস্য। ভীষণ চঞ্চল। বাতাসের আগেও দৌড়াতে সক্ষম। অন্যদিকে সুহানা আপু অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে ফিজিক্স নিয়ে পড়াশোনা করছে।ইমন ভাইয়া এখন প্রতিষ্ঠিত। পড়াশোনা শেষ করে ভালো কোম্পানিতে জব করছে।কয়েকদিনের মধ্যে ভাইয়ার জন্য মেয়ে দেখার হুড়োহুড়ি পড়ে যাবে আশা করি।বাকি রইলাম আমি।এবার সুহানা আপুর এক ক্লাশ জুনিয়র।ইংলিশ নিয়ে শহরের একটি নামীদামী প্রাইভেট ভার্সিটিতে অধ্যয়নরত।
ইমন ভাইয়া এবং সুহানা আপু এরা দুজন বড়মা বড়আব্বুর ছেলেমেয়ে। সম্পূর্ণ বাড়ি মাতিয়ে রাখতে আমরা ভাইবোন চারজনই যথেষ্ট।
নাস্তা শেষ হতে সকলে দল বেঁধে বাইরে বেরিয়ে আসলাম।ইমন ভাইয়া তাঁর বাইক নিয়ে চলে যাচ্ছে অফিসের পথে।যাওয়ার সময় ফারাজকে স্কুলে নামিয়ে দিয়ে যাবে।
সুহানা আপু বলল,
‘ আব্বু আর চাচ্চু আজ গাড়ি নিয়ে চলে গেছে অফিসে।আজ আমার এমনিতেই একটু তাড়া ছিল।ভেবেছিলাম গাড়ি নিয়ে তাড়াতাড়ি পৌঁছে যাব।তা আর হলো কই।এখন অটো নিয়ে যেতে হবে।আমি তাহলে গেলাম পূর্ণী।তুই সাবধানে যাস।টাটা।’
আমাকে বিদায় দিয়ে আপু চলে গেল।বাসা থেকে আমার ভার্সিটি কাছে হওয়ায় প্রতিদিন পায়ে হেঁটেই আসা যাওয়া করি।
রাস্তায় নেমে কয়েকপা এগিয়ে আবার পেছনে ফিরে তাকালাম।এখান থেকে আমাদের ছোট-খাটো ডুপ্লেক্স বাড়িটা দেখা যাচ্ছে। এই তো সবে দুবছর হলো বড়আব্বু আর আমার আব্বু মিলে তৈরি করেছিলেন এটা। এই বাড়িতে আমরা আট জন সদস্যের যৌথ পরিবার।বিপদেআপদে সবাই মিলেমিশে থাকি।বাড়িতে সারাক্ষণ আমাদের ভাইবোনেদের হৈ হল্লা চলতেই থাকে।
হঠাৎই আমার নজর গেল মেইন গেইটের দিকে।রাতে গেইট বন্ধ থাকে।তাহলে সেই লোকটি বাড়ির এরিয়ায় কিভাবে ঢুকল।নিশ্চয়ই দেয়াল টপকে উঠেছে।ব্যাটার সাহস আছে খুব।এমন উঁচু দেয়াল কি করে টপকালো কে জানে।আমাদের বাড়ির চারপাশে তো আরো বাড়িঘর আছে।ওদের এরিয়ায় না ঢুকে হতচ্ছাড়া আমার বারান্দায় হানা দিতে গেছে।হাহ্!ব্যাটাকে যেন পুলিশ খুব দ্রুত ধরে জেলে ঢুকিয়ে দেয় এটাই প্রার্থনা করি।
হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে গেলাম কলেজের কাছাকাছি। তখনই একটা পিচ্চি ছেলে এসে আমার দিকে এক গুচ্ছ গোলাপের তোড়া বাড়িয়ে দিয়ে বলে,
‘ এটা নাও আপু।’
আমি অবাক হয়ে মিষ্টি চেহারার বাচ্চাটির দিকে তাকালাম।এতদিন ধরে এই রাস্তা দিয়ে আসা-যাওয়া করি কখনো তো এমন ঘটনা ঘটেনি।যাই হোক ছেলেটা এত সুন্দরভাবে ফুল সাধছে না নিলে খারাপ দেখায়।
‘ অনেক ধন্যবাদ বাচ্চা! এত মানুষ থাকতে আমাকেই কেনো ফুল দিতে গেলে শুনি?’
‘ এগুলো আমি দিইনি তো।ওই যে গাড়িটা দেখছো ওটার ভেতর একজন আঙ্কেল দিয়েছে।’
ছেলেটা আঙুল উঁচিয়ে কয়েক গজ দূরে দাঁড়িয়ে থাকা একটা গাড়ির দিকে দেখাল।কালো রঙের একটি চকচকে গাড়ি।আমি ভ্রু কুঁচকে দেখার চেষ্টা করলাম।কিন্তু গাড়ির জানালা দরজা সব বন্ধ। কে এই ব্যক্তি!আমাকে ফুল দেওয়ার কি উদ্দেশ্য?
বাচ্চাটি যেভাবে ফুড়ুৎ করে এসেছিল সেভাবেই চলে গেল।আমি ফুলগুলো মুঠোয় চেপে এগিয়ে চললাম গাড়ির দিকে।কে না কে একজন বিনাকারণে ফুল দিবে তা আবার হয় নাকি?
বুক ফুলিয়ে সাহস নিয়ে গাড়ির কাছে যেতেই গাড়ি স্টার্ট হয়ে গেল। কি হলো কিছুই বুঝতে পারলাম না।বোকার মত দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুধু দেখলাম ধুলাবালি উড়িয়ে গাড়িটি নিজের রাস্তায় চলে যাচ্ছে। গাড়ির মালিক কোনো পাগলাগারদ থেকে ছুটে এসেছে বোধ হয়।যত্তসব পাগলের কারখানা।রাগে আমার শরীর জ্বলছে।হাতে থাকা গোলাপ ছুড়ে ফেললাম পাশের ডাস্টবিনে।এসব কি আজব কান্ড কারখানা হচ্ছে আমার সাথে কিছুই বুঝতে পারছি না।
.
ক্লাশ শেষ হতে হতে প্রায় একটা বেজে গেল।ক্ষিদের জ্বালায় পেটে গুড়ুম গুড়ুম শব্দ হচ্ছে। ব্যাগে টাকা আছে ক্যান্টিন থেকে ইচ্ছে করলেই খাওয়া যায়।কিন্তু এই কাজ করলে মা আমাকে বাড়িতে আজ ঢুকতেই দেবে না।তাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পা চালিয়ে বাসায় যেতে হবে।ফ্রেন্ডসরা যে যার যার রাস্তায় হাঁটা দিল।আমিও আর দেরি না করে পা বাড়ালাম।কিন্তু কিছুদূর যেতেই হঠাৎ দেখতে পেলাম ঝলমলে আকাশে কালো মেঘের আনাগোনা। ধুলো উড়িয়ে বাতাস বইছে।জোরালো বৃষ্টি হওয়ার পূর্ব লক্ষণ।আজ ছাতাও আনিনি।বৃষ্টি নামলে নাজেহাল অবস্থা হবে আমার।তাই কোনোদিকে না তাকিয়ে বড় বড় কদম ফেলে হাঁটতে লাগলাম।কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না।মাঝরাস্তাতেই ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি শুরু হলো।রাস্তায় চলমান মানুষজনেরা নিজেদের বাঁচাতে সুরক্ষিত জায়গায় চলে গেল।আমিও কোনো উপায় না পেয়ে দৌড়ে আশ্রয় নিলাম রাস্তার পাশে একটা বন্ধ দোকানের ছাউনির নিচে।গায়ের ড্রেস অনেকটাই ভিজে গেছে।কি এক মুসিবতে আটকে গেলাম!এখন থেকে সবসময় ব্যাগে ছাতা রাখতে হবে।
দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে প্রায় পাঁচমিনিট কেটে গেল।কিন্তু বৃষ্টি থামার কোনো লক্ষণ নেই।বিরক্ত হয়ে চশমা খুলে গ্লাসে লেগে থাকা বিন্দু বিন্দু বৃষ্টির পানি মুছতে লাগলাম।তখনই ঝাপসাভাবে দেখলাম কালো রঙের একটা প্রাইভেট কার এসে থামল আমার থেকে কিছুটা দূরে।মুহূর্তেই সকালের ঘটনার কথা মনে পড়ে গেল।এটা সেই গাড়িটা নয় তো! ধুর সকালের ওই গাড়িটা কেমন ছিল সেটা মনে করতে পারছি না।কালো গাড়ি তো অনেকেরই থাকতে পারে।
মনের কৌতুহল মেটানোর জন্য জলদি চশমা চোখে দিলাম।এতক্ষণ ঝাপসাভাবে দেখা দৃশ্য এবার স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি।স্যুট বুট পড়া একজন লোক নেমে আসল গাড়ি থেকে।লোকটিকে দেখে কিছুক্ষণের জন্য আমি হারিয়ে গেলাম অন্যজগতে।অত্যন্ত সুঠাম দেহের লম্বা একজন সুপুরুষ। গায়ে নীল ব্লেজার।পরনে ব্লেজারের সাথে মিল রেখে ডেনিম প্যান্ট।চুল এবং দাড়ির কাট দেখার মত।হাতে সিলভার কালারের ঘড়ি।এমন সুদর্শন ছেলে এ পর্যন্ত এই এলাকায় কখনো দেখেছি বলে মনে পড়ছে না।কয়েক সেকেন্ড হা হয়ে তাকিয়ে রইলাম চশমার কাঁচের উপারে দাঁড়ানো লোকটির দিকে।আরো অবাক হলাম যখন দেখলাম লোকটি এমন ঝড় তুফানের মধ্যেও চোখে সানগ্লাস দিয়ে রেখেছে।
লোকটি দাঁড়ানোর সাথে সাথে গোবেচারা ধরনের আরো একজন বেরিয়ে এসে ছাতা ধরল।গোবেচারা লোকটি ফিসফিস করে কি যেন বলছে।
আমি এখনো বিস্ময় নিয়ে ওদের দুজনের দিকে তাকিয়ে রইলাম।হঠাৎই বুকের হৃৎপিণ্ডটা যেন ধক করে উঠল।অস্থিরতায় বশবর্তী হয়ে দুইহাত কচলে যাচ্ছি। কপালে চিন্তার রেখা ফুটে উঠছে।কারণ নীল ব্লেজার পড়া ছেলেটি ছাতা হাতে আমারই দিকে এগিয়ে আসছে।
চলবে…