তোর অপেক্ষায় পর্ব-২২

0
495

#তোর_অপেক্ষায়
#সামান্তা_সিমি
#পর্ব_২২

ফোনের এলার্মের মিহি একটা সুরে ঘুম ভাঙলো আমার।অন্যদিন হলে অলসতার বশবর্তী হয়ে বিছানায় শুয়ে আরো কিছুক্ষণ গড়াগড়ি খেতাম।আজ তা হবে না।চটজলদি উঠে বিছানা পরিপাটি করে নিলাম।বারান্দায় এসে দেখি সূর্য উঠি উঠি করছে তবে চারপাশ পরিষ্কার হয়ে এসেছে।
ওয়াশরুমে গিয়ে ঝটপট গোসল শেষ করে এসে মেলে দিলাম ভেজা চুলগুলো।এখন ড্রেস চুজ করার পালা।কাবার্ডের দরজা টানতেই নজরে আসলো সারিসারি হ্যাঙারে ঝুলানো জামাকাপড়। প্রত্যেকটা তাক গোছগাছ করা।কেউ দেখলে হয়তোবা ভাবতে পারে আমার মতো পরিপাটি মেয়ে খুঁজে পাওয়া বিরল। আসলে এগুলো সব মায়ের হাতে গুছানো।আমি তো বরাবরই এলেমেলো। কাবার্ড থেকে একটা কুর্তি এবং জিন্স বের করে নিলাম।পিকনিকে যাওয়ার জন্য এগুলো পারফেক্ট। সকাল সাড়ে সাতটায় ভার্সিটির গেইটে সকলের উপস্থিত থাকার জন্য বলা হয়েছে।এখন ঘড়ির কাঁটা ছ’য়ের ঘরে।
দ্রুত ড্রেস পাল্টে ভেজা চুলগুলো হালকা আঁচড়ে নিলাম।চোখে গাঢ় কাজল টেনে কানে ঝুলিয়ে দিলাম ছোট সাইজের একজোড়া ঝুমকা।ঠোঁটে গোলাপী ম্যাট লিপস্টিক ঘষে তীক্ষ্ণ চোখে নিজের আপাদমস্তক দেখতে লাগলাম।একটা জিনিসের কমতি লাগছে।ড্রয়ার খুলে চমশাটা বের করে চোখে গলিয়ে দিলাম।যদিও চশমা সবসময় ব্যবহার করি না। বেশিরভাগ বাইরে গেলেই পড়া হয়।
নিজেকে আয়নায় দেখে প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে বললাম,
‘ চাশমিস পূর্ণী! নাউ ইউ আর লুকিং পারফেক্ট।’

ড্রয়িংরুমে পৌঁছাতে দেখি মা আমার জন্য টেবিলে নাস্তা সাজাচ্ছে। অন্যদিকে বড়মা সিড়ি ঝাড়ু দেওয়ায় ব্যস্ত।আমাকে দেখতে পেয়ে হাসল সামান্য। বিনিময়ে আমিও একটা হাসি উপহার দিয়ে বসে পড়লাম টেবিলে।এবার মা খুলে বসল তাঁর উপদেশ বাণীর ঝুড়ি।

‘ শোন পানিতে বেশিক্ষণ থাকবি না।ভেজা জামাকাপড় খুব তাড়াতাড়ি বদলে ফেলবি।এক্সট্রা জামা নিয়েছিস তো?বাকি মেয়েদের ছেড়ে একা কোথাও পা বাড়াবি না।দুপুরের লাঞ্চ কিন্তু টাইমলি করতে হবে।আমি দুর্জয়কে…….’

মা আচমকা থেমে গেলেন।আমি চোখ সরু করে তাকালাম মায়ের দিকে।এতক্ষণ মাথা হেলিয়ে সবগুলো বাণী হজম করছিলাম আর মেসেঞ্জারে বান্ধবীদের খোঁজখবর নিচ্ছিলাম।হঠাৎ দুর্জয় নামটা শুনে থেমে যেতে হলো।মা উনাকে নিয়ে কি বলতে যাচ্ছিল?ডাল মে কুচ তো কালা হ্যায়!
আমার সন্দেহজনক দৃষ্টি উপেক্ষা করে মা বলে উঠলেন,
‘ আসল কথা তো বলাই হয় নি।মেডিসিন গুলো সাথে নিয়েছিস তো?’

আমি স্যান্ডউইচে গভীর করে কামড় দিয়ে বললাম,
‘ সব নিয়েছি। কিন্তু দুর্জয় ভাইয়াকে নিয়ে কি বলতে যাচ্ছিলে?বাক্যটা সম্পূর্ণ না করে থেমে গেলে কেনো?’

‘ বলছিলাম যে বাসে উঠে দুর্জয়কে একটা ফোন দিয়ে দিস।সে জিজ্ঞেস করেছিল আর কি কখন যাবি, বাস কখন ছাড়বে।আচ্ছা থাক আমিই না হয় ওকে বলে দেব।’

আমার সন্দেহ এখনো কাটেনি।কাহিনী কি!ওই লোক আবার খিচুড়ি পাকাতে ব্যস্ত হয়ে যায়নি তো!উনাকে নিয়ে অলওয়েজ আমাকে তটস্থ থাকতে হয়।বিনা নোটিশে খিচুড়ি পাকানো শুরু করে দেয় যখনতখন। আমার জীবনে আসার পর থেকে উনাকে শুধু এই একটা কাজ করতেই দেখি।তবে গত দুদিন তো উনার সাথে কথা হয়েছে টুকটাক। কই তেমন কিছু গড়বড় মনে হয় নি।
নাস্তা শেষ করতে করতে বাড়ির সবাই উঠে গেল।বড়আব্বু, আব্বু এবং ইমন ভাইয়া একসাথে জগিং করতে যাচ্ছে। আমি সবাইকে গুডমর্নিং জানিয়ে টেবিল ছেড়ে উঠলাম।ইমন ভাইয়া হাই তুলতে তুলতে বলল,

‘ পতেঙ্গা জায়গাটা সুন্দর। ভালো করে ইনজয় করিস।বিচের কাছাকাছি একটা পার্ক আছে না কি যেন নাম এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না।দেখলি সকাল সকাল আমার ব্রেইন কমজোর হয়ে পড়ে।বয়স-টয়স বেড়ে যাচ্ছে বোধ হয়।যাইহোক ওই পার্কটায় ঘুরতে যেতে পারিস। খুব সুন্দর জায়গা।’

সবার থেকে বিদায় নিয়ে একটা অটো ধরে চলে এলাম ভার্সিটি গেইটে।এখনো সাড়ে সাতটা বাজেনি।এরমধ্যেই গেইটে অনেকেই জড়ো হয়ে গেছে।হিমু আমাকে দেখতে পেয়ে হাত উঁচিয়ে ডাকল।আমার ঠোঁটে প্রশান্তির হাসি ফুটল।এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না আমি পিকনিকে যাচ্ছি।মনে মনে দুর্জয় ভাইয়াকে অসংখ্য ধন্যবাদ জানিয়ে দিলাম।

‘ কিরে গ্রুপের বাকিরা কোথায়?শেষ সময়ে এসে না যাওয়ার জন্য বেঁকে বসেনি তো!’

হিমু ঠোঁট উল্টিয়ে বলল,
‘ না গেলে ওদের আমি থাবড়াতে থাবড়াতে বাঁকিয়ে ফেলব।আমার মনে হয় সব কটা মেকাপ কিট নিয়ে মুখে ঘষাঘষি করছে।ছেলে ভুলানোর ধান্দা নিয়ে ঘুরে সব।’

‘ কি যে বলিস।ওরা শুনতে পেলে তোর হাড্ডি মুচড়িয়ে চুরচুর করে দেবে।বিশেষ করে ঈশিতা!’

‘ আরে ধুর।ও উপর দিয়েই যা মেজাজ দেখায় আসলে ভেতরে কিচ্ছু নেই। একটা ধমক দিলেই টিস্যু দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে বাড়ি যাবে।’

‘ হয়েছে।তোর আর এমন বীরমহিলার মত ভাষণ দিতে হবে না।চল ওরা আসার আগেই আমরা ভালো সিট বেছে বসে পড়ি।’

‘ দ্যাটস্ অ্যা গুড আইডিয়া বেবি!লেটস্ গো! ‘

দুনম্বর বাসে উঠে আমরা পুরোটা দেখেশুনে যুতসই সিট খুঁজে পেয়ে গেলাম।হিমু কিছু বলার আগেই আমি বলে বসলাম,
‘ জানালার পাশের সিট কিন্তু আমার।জানালার সাথে বসে বাস জার্নি আমার কাছে সেই লাগে!আহা!’

হিমু ভীষণ অনিচ্ছায় বলে উঠল,
‘ যা যা বোস।রোগী মানুষের কথা না শুনলে পাপ হতে পারে।’

আমি হিমুর মাথায় একটা গাট্টা মেরে সিটে আরাম করে বসলাম।
আধাঘন্টার ভেতরই সমস্ত বাস ছেলেমেয়েদের ভিড়ে পরিপূর্ণ হয়ে গেল।আমাদের গ্রুপের সবগুলোই হাজির।সবার সাথে হাসিঠাট্টার মাঝেই বাস ছেড়ে দিল।পুরো বাসে ছেলেদের থেকে মেয়েদের সংখ্যাই বেশি।কিছুক্ষণের মধ্যেই মিডিয়াম ভলিউমে ডিজে গান বেজে উঠল বাসে।গানের উৎস কোথায় সেটা খুঁজে বের করতে ব্যর্থ হলাম কিন্তু গানের তালে কেউ কেউ সিটে বসে থেকেই হাত উঠানামা করে নাচছে এটা দেখে হাসি থামাতে পারছি না।আমি তো আর ভালো করে নাচতে পারি না তাই একটু আফসোসও হচ্ছে। আজ নাচতে পারলে ওদের মত হাত-পা ছুড়াছুড়ি করে লাফাতে পারতাম।কিন্তু হাততালি তো দিতে পারি।হাততালিও একপ্রকার নাচের মধ্যেই পড়ে।অনেক জায়গাতেই দেখেছি যারা নাচতে পারে না তারা হাততলি দিয়ে সিচুয়েশন হ্যান্ডেল করে ফেলে।আমারও এখন এই অবস্থা। 🥴

হঠাৎ হিমু আমাকে ধাক্কা দিয়ে বলে উঠল,
‘ এই জানালা দিয়ে একটু বাইরে তাকা।দু দুটো হ্যান্ডসাম হিরো।আমাদেরকেই দেখছে মনে হচ্ছে। ‘

আমি হিমুর কথা অগ্রাহ্য করে একপলকের জন্যও বাইরে দেখলাম না।জানি বখাটে ছেলে হবে যারা বাসে মেয়ে দেখে উঁকিঝুঁকি মারার চেষ্টা করছে।হাড়ে হাড়ে চিনি এসব ছেলেদের।

‘ এই তুই না বাসে উঠার আগে বলেছিলি বাকি মেয়েরা ছেলে ভুলানোর ধান্দায় থাকে।এখন তাহলে তুই বাইরে ছেলেদের কেনো দেখছিস?’

‘ আরে ছেলে ভুলানো আর হ্যান্ডসাম ছেলে দর্শন করা এক হলো নাকি?দেখ না একবার কি সুন্দর বাইকে উড়ে উড়ে বাসের সাথে চলছে।তুই এবার আমার সিটে বোস প্লিজ! আমার এখন জানালার পাশে বসতে শখ জেগেছে।’

‘ রাগ উঠাস না হিমু! তোর শখ জাগার উদ্দেশ্য যে কি তা আমি ভালো করেই জানি।এবার দেখ কি করি!’

আমি তিক্ত বিরক্ত হয়ে জানালার গ্লাস লাগাতে উদ্যত হলাম।তখনই নিজের অজান্তে বাইকে বসা দুজন ব্যক্তির দিকে চোখ চলে গেল।উনাদের দেখে ভিড়মি খাবার জোগাড়।গ্লাস লাগানোর কথা ভুলে গিয়ে থমথমে মুখে তাকিয়ে রইলাম বাইরে।বাইকে বসা দুজন হলেন দুর্জয় ভাইয়া এবং তুষার ভাইয়া।দুর্জয় ভাইয়া ঠোঁটে মনভুলানো হাসি ঝুলিয়ে রেখে বাইকের ড্রাইভারের দায়িত্ব পালন করছেন।উনার চোখে কালো সানগ্লাস।গায়ের ব্রাউন কালারের শার্ট বাতাসের কারণে শরীরে সেঁটে আছে।তুষার ভাইয়া আমাকে দেখতে পেয়ে হাত উঁচিয়ে ডাকলেন।আমি অপ্রস্তুতের মত কিছুটা হাসলাম।উনাকেও দেখতে দুর্জয় ভাইয়ার মত লাগছে যেন মেলায় হারিয়ে যাওয়া দুই ভাই বহুদিন পর একত্র হয়েছে।মানতে হবে হিমুর হ্যান্ডসাম বলার যথেষ্ট কারণ আছে। কিন্তু উনারা কোথায় যাচ্ছেন? আমাকে আবার ফলো করছে না তো!

পাশ থেকে হিমু উত্তেজিত হয়ে বলল,
‘ কিরে কিরে পেছনের জন তোকে ইশারা করল যে?চিনিস উনাকে?’

আমি বিরসমুখে বললাম,
‘ চিনি।তুষার ভাইয়া।উনার দিকে তোর নজর দিয়ে লাভ নেই।উনার সুন্দর ফুটফুটে একটা বউ আছে।’

হিমুর মুখ ঝুলে পড়ল।কিন্তু পরক্ষণেই আনন্দিত হয়ে বলতে লাগল,
‘ সামনের জন?উনাকে চিনিস তো?উনি তো সিংগেল নাকি?’

‘কে? দুর্জয় ভাইয়া?ওই লোক তো আরো একধাপ উপরে।দু’দুটো বিয়ে করে বসে আছে।শুনেছি আসছে বছর আরো একটা বিয়ে করার অপেক্ষায় আছে।’

‘ মাই গড! আজকালকার ছেলেরা এমন কেন বলতো!বাইরে দিয়ে তামিল মুভির হিরোদের লুক নিয়ে ঘুরে বেড়ায় অথচ ভেতরের রেকর্ড জঘন্য! এসব ছেলেরা মেয়ে ভুলানোর ধান্দা নিয়ে সারাক্ষণ ঘুরে বেড়ায়।এই তুই জানালাটা লাগিয়ে দে তো।আমার আর ইন্টারেস্ট নেই।’

হিমু মুখ ঘুরিয়ে গানের তালে অঙ্গভঙ্গি করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।আমি আড়চোখে দুর্জয় ভাইয়াকে দেখতে চেষ্টা করলাম।উনি একবারের জন্যও আমার দিকে তাকাননি।অথচ বাসের সাথে গতি ঠিক রেখে বাইক চালাচ্ছেন। এখন বুঝতে পারছি সেদিন মা কেনো উনার কথায় রাজি হয়েছিল।উনি আমার পেছন পেছন পাহারা দিতে চলে আসবেন এটা সম্পর্কে মাও অবগত।উফ্ এদের নিয়ে আর পারা যায় না।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here