তোর অপেক্ষায় পর্ব-২৮

0
1034

#তোর_অপেক্ষায়
#সামান্তা_সিমি
#পর্ব_২৮

পড়ন্ত বিকেলের রৌদ্রের তেজে উদ্ভট এক গরম এসে হানা দিচ্ছে। পরিবেশ কেমন যেন থম মেরে আছে।গাছের পাতারা সব নিজেদের স্থানে অনড় হয়ে নিদর্য়তার পরিচয় দিচ্ছে। বাতাসের ছিটেফোঁটাও নেই।খোলা মাঠের মত ছোট একটা জায়গায় ছাউনির নিচে দুর্জয় ভাইয়ার সাথে বসে আছি আমি।চারপাশে আরো বেশ কয়েকটি ছাউনি রয়েছে।সেখানেও আমাদের মত গুটিকয়েক ছেলেমেয়ে তাঁদের প্রিয় মানুষদের সাথে একাকী কিছুটা সময় কাটাতে এসেছে।জায়গাটা মূলত একটা রেস্তোরার সামনের অংশ।কয়েক গজ দূরে রেস্তোরাঁর মূল অংশ।সেখান থেকেই কাস্টমারদের অর্ডার কৃত খাবার এখানে এসে হাজির হয়।
গতকালের জেরিন আপু সম্পর্কিত ঘটনা কিছুই বলিনি দুর্জয় ভাইয়াকে।উনার ফুরফুরে চেহারা দেখে আর মুড নষ্ট করতে চাইনি।নিজ থেকেই কত কি রোমান্টিক কথাবার্তা বলে যাচ্ছেন আর আমার ডানহাত নিয়ে তার উপর কিসব আঁকিবুঁকি করছেন।আমি যথাসম্ভব চেষ্টা চালাচ্ছি স্বাভাবিক থাকার।কারণ এখনো চোখের সামনে জেরিন আপুর হিংস্র চাহনি ভেসে উঠছে।
কি করতেন যদি ওই কথাগুলো বলতাম?নিশ্চয়ই রেগে আগুন হয়ে এক্ষুনি গিয়ে জেরিন আপুকে জ্বালিয়ে ছাই করে দিতেন।
দুর্জয় ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ কোথায় যে হারিয়ে গেলাম।উনি আমার দিকে তুড়ি বাজিয়ে বলে উঠলেন,
‘ তোর কি হয়েছে বলতো!কিছু লুকাতে চাইছিস আমার থেকে?’

দুর্জয় ভাইয়ার প্রশ্নে আমি থতমত খেয়ে গেলাম।কৃত্রিম হাসার চেষ্টা করেও চুপসে গেলাম কারণ উনি উনার বুদ্ধিদীপ্ত চোখ দুটো দিয়ে আমাকে স্ক্যান করে ফেলছেন।আমি একপলক উনার দিকে তাকিয়ে বললাম,
‘ কি লুকোবো আপনার থেকে।আমার লুকানোর মত কিছুই নেই।’

‘ একদম পাকা পাকা কথা বলবি না।কি চলছে তোর মনে তা আমি জানতে চাই সেটা এক্ষুনি। তুই কি ভাবছিস আমি এতক্ষণ তোকে খেয়াল করিনি?অপেক্ষা করছিলাম তুই নিজে বলিস কিনা।কিন্তু না তুই সোজা পথে হাঁটার মানুষ না।’

দুর্জয় ভাইয়া ধমক শুনে আমার কেঁদে দেবার উপক্রম হলো।মুখ কালো করে বললাম,
‘ বলব না আপনাকে।যখন তখন এভাবে ঝেড়ে দিবেন আর আমি চুপচাপ শুনব?’

দুর্জয় ভাইয়া কিছু না বলে রাগী চোখে তাকিয়ে আছেন।উনার জ্বলন্ত চাহনি দেখে মৃদু একটা ঢোক গিলে নিজেকে ধাতস্থ করলাম।তারপর দৃষ্টি নামিয়ে গতকালের জেরিন আপু সম্পর্কিত সমস্ত ঘটনা একনাগাড়ে বলে ফেললাম।
দুর্জয় ভাইয়ার চেহারার প্রতিক্রিয়া এখন শূন্য। উনার মুঠোয় রাখা আমার হাত আগের মতই শক্ত করে আঁটা।এতকিছু শোনার পর উনি এমন নীরব আছেন কি করে।আমি হতাশ হলাম।মনের ভেতর জমানো ভয়গুলো আবারো উঁকি দিতে লাগল।
সাথে সাথেই খেয়াল করলাম দুর্জয় ভাইয়ার চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল।উনার ফর্সা নাক ফুলে ফুলে উঠছে।আনমনে কি যেন চিন্তা করলেন কিছুক্ষণ। তারপর হঠাৎ মুচকি হেসে তাকালেন আমার দিকে।আমি এতক্ষণ উৎসুক হয়ে উনাকে পর্যবেক্ষণ করছিলাম।দুর্জয় ভাইয়া হেসে বললেন,

‘ জেরিন কে মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দে।এই ঝামেলা আমি দেখছি।তুই প্যানিক হোস না।ঠিক আছে?’

আমি বাচ্চাদের মত মাথা নাড়লাম।অদ্ভুত এই দুর্জয় ভাইয়ার হাবভাব কেমন যেন অন্যরকম লাগছে আমার।কি করতে চাইছেন উনি।এই মুহূর্তে উনার ফুরফুরে মেজাজ আমার ভালো লাগছে না।উনি যদি রেগে অস্থির হয়ে এখানে হৈচৈ করতেন অথবা টেবিল চেয়ার দুয়েকটা ভাঙতেন তাহলেও স্বাভাবিক ছিল।কিন্তু এখন কিছুই স্বাভাবিক লাগছে না।

দুর্জয় ভাইয়া আমার হাত টেনে দাঁড় করিয়ে বললেন,
‘ চল দেরি হয়ে গেছে অনেক।বাসায় যাওয়া যাক।’

‘ চলুন।’

সারারাস্তা দুর্জয় ভাইয়া এটা সেটা বলে দুষ্টুমি করে গেছেন।তবুও আমার মনে হয়েছে উনার ভেতর বড় কোনো প্ল্যান চলছে।যদিও আমি আর কিছু জিজ্ঞেস করিনি।উনি যেহেতু বলেছে সব ঝামেলা উনি সামলাবেন তাহলে আমার এত ভেবে লাভ কি।

____________________________

ক্লাস শেষ করে আমরা বান্ধবীরা ঠিক করলাম আজ ভালো কোনো এক রেস্টুরেন্ট গিয়ে জমিয়ে লাঞ্চ করব।হিমু,ঈশিতার উৎসাহ বেশি।সুস্মিতার নাকি বাসায় জরুরি কাজ তাই সে আমাদের নিরাশ করে বাসার পথে হাঁটা দিল।অগত্যা আমরা তিনজন হেলেদুলে কলেজ থেকে কিছুটা দূরে একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকে গেলাম।যুতসই একটা টেবিলে বসে মেনু দেখে খাবার অর্ডার দিয়ে দিলাম।এরপর শুরু করে দিলাম গল্প গুজব।সুস্মিতা থাকলে আরো ভালো হত।বেচারি আজকের স্পেশাল লাঞ্চ করে গেল।এরজন্য ওকে পস্তাতে হবে সারাজীবন।
হঠাৎ আমাদের পাশের টেবিলে তিনজন অপরিচিত ছেলের আগমন আমাদের গল্পে ব্যাঘাত ঘটাল।চারদিকে আরো টেবিল ফাঁকা থাকা স্বত্ত্বেও ওরা এসে এখনেই কেনো বসল?প্রথমে ব্যাপারটা স্বাভাবিকভাবে নিলেও কিছুক্ষণের মধ্যে অস্বস্তি এসে ভর করল আমার মাঝে।
ওরা চেয়ারে বসার পর থেকেই কেমন কটু দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে এবং ওদের দৃষ্টি যে আমার দিকেই তা নিমিষেই বুঝে গেলাম।হিমু ফিসফিস করে বলল,

‘ দেখেছিস বেকুব তিনটার কান্ড?ইচ্ছে করছে এই কাঁটাচামচ দিয়ে চোখ উপড়ে দিই।’

‘ হিমু!ওরা শুনতে পাবে।দেখ ওদের কিন্তু সুবিধার মনে হচ্ছে না।চল আমরা ওই টেবিলটায় গিয়ে বসি।’

আমার কথায় রাজি হয়ে ঈশিতা হিমু উঠে দাঁড়াল।এমন সময় আচমকা একটা ছেলে এসে পথ আটকে দাঁড়াল একদম আমার মুখোমুখি। হঠাৎ এমন হওয়ায় ভড়কে গেলাম আমি।হিমু ঈশিতা ভয় পেয়ে দুইপাশ থেকে আমাকে আগলে ধরল।ছেলেটা দাঁত চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
‘ একবারে শিক্ষা হয়নি?ভাগ্যক্রমে সেদিন বেঁচে গেছিলি এবার যদি কিছু করি না একেবারে জানে মেরে দেব।ভালোয় ভালোয় দুর্জয় থেকে দূরে সরে যা।অন্য একজনের পছন্দের জিনিসের প্রতি তাক করে বসে আছিস কেনো?’

ছেলেটার এমন দুর্ব্যবহার আর কথার ধরণ শুনে আমি আরেকদফায় চমকে গেলাম।এই ছেলে আমাকে থ্রেট দিচ্ছে! আর প্রথম কথাগুলো কি বলল এসব?কিছুই তো মাথায় ঢুকছে না।কিন্তু এটা ভালোই বুঝতে পারছি ওরা তিনজনই জেরিন আপুর ফ্রেন্ড। আমি যেন স্তব্ধ হয়ে রইলাম।আপু শেষ পর্যন্ত এসব ফালতু ছেলেদের পাঠিয়েছে আমাকে ভয় দেখানোর জন্য! ছিঃ! আপু এটা কিভাবে পারল। একটা মেয়ে হয়ে আপু এমন ডেঞ্জারাস কিভাবে হতে পারে।দিনদিন জেরিন আপুর আসল রূপ যেন খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসছে।
সামনের ছেলেটা এবার চাপা ধমকে উঠে বলল,
‘ এবার শুধু মুখে বলে গেলাম।যদি তুই দুর্জয়কে না ছাড়িস তাহলে মুখের কথা কাজের মাধ্যমে দেখাব।’

আমার নিজেকে খুব অসহায় লাগছে।কান্না পাচ্ছে। রেস্টুরেন্টের ভেতরের মানুষগুলো উৎসুক হয়ে আমার অবস্থা দেখছে অথচ কেউ এসে কিছুই জিজ্ঞাসা করছে না।চোখের পানি আটকানোর প্রাণপণ চেষ্টা করছি।আমি সবার সামনে কাঁদতে পারব না।তখনই ঝাপসা হয়ে আসা চোখ দিয়ে দেখতে পেলাম সেই পরিচিত মুখ। দুর্জয় ভাইয়া।মুহূর্তেই যেন আমার ছন্নছাড়া মস্তিষ্কে চিন্তা-চেতনা ফিরে আসল।কোনোদিকে না তাকিয়ে একছুটে হাজির হলাম উনার সামনে।আমাকে হঠাৎ দেখতে পেয়ে দুর্জয় ভাইয়ার চেহারায় বিস্ময় খেলে গেল।উনার পেছনে ফরমাল ড্রেস পড়া আরো কিছু লোকজন।
দুর্জয় ভাইয়া বিস্ফারিত চোখে প্রশ্ন ছুড়লেন,

‘ কাঁদছিস কেনো?আর এখানে এলি কিভাবে?’

চলবে….

[ অবশেষে আমি একটা পর্ব লিখতে পারছি!🤐]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here