#তোর_অপেক্ষায়
#সামান্তা_সিমি
#পর্ব_৩
সূক্ষ্ণ নজরে আমার থেকে কিছুদূরে দাঁড়িয়ে থাকা সেই লোকটির দিকে বারংবার তাকাচ্ছি। কেমন যেন অদ্ভুত লাগছে আমার কাছে।তখন যেভাবে ছাতা হাতে আমার দিকে ধেয়ে আসছিল ভেবেছিলাম হয়তোবা আমাকে কিছু বলবে।মন বলছিল তিনিই সেই গোলাপ ফুলদাতা।কিন্তু আমার ধারণা ভুল। তিনি আমারই মত বৃষ্টির ঝড়ো হাওয়া থেকে রক্ষা পেতে ছাউনির নিচে এসে দাঁড়িয়েছে।এরপর থেকেই তাঁকে আড়চোখে লক্ষ্য করে যাচ্ছি আমি।কোনো নড়নচড়ন নেই শুধু যান্ত্রিক রোবটের মত স্ট্রেইট হয়ে আছে।এ কি মানুষ নাকি মানুষরূপী কোনো ভূত এটা নিয়ে একটু সন্দেহ জাগছে মনে।
পারিপার্শ্বিক অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে এই ভুতের গাড়ি নষ্ট হয়ে গেছে।ড্রাইভার ভীষণ তোড়জোড় করে মেকানিক খুঁজছে আশেপাশে।
বৃষ্টির তেজ আরো বেড়েছে। প্লিজ থেমে যা বৃষ্টি। এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে আর ভালো লাগছে না।আশেপাশে তেমন লোকজন নেই।ওই হ্যান্ডসাম লোকটাকে কেমন যেন সন্দেহ হচ্ছে।
ক্ষণিকের মধ্যে সেই গোবেচারা লোকটাকে আবার দেখতে পেলাম।উনি ভুতটার সাথে কি যেন আলাপ আলোচনা করছেন আর আমার দিকে তাকাচ্ছেন।এবার বেশ ভয় লাগল আমার।হঠাৎ লোকটি আমার সামনে এসে বিনয়ের সাথে বলতে লাগল,
‘ ম্যাডাম আপনার কাছে একটা কলম হবে?একটু দরকার ছিল।’
ও এই তাহলে কাহিনী।এরজন্যই আমাকে এভাবে ঘুরে ঘুরে দেখছিল।আমি মৃদু হেসে ব্যাগ থেকে কলম বের করে দিলাম।লোকটি থ্যাংক ইউ বলে আগের জায়গায় ফিরে গেল।সাথে সাথেই নীল ব্লেজারের মানুষটি ফাইলে কি যেন লেখালেখি শুরু করে দিল।
আমি চোখ ঘুরিয়ে আবারো বৃষ্টির দিকে নজর দিলাম।আকাশ ধীরে ধীরে পরিষ্কার হয়ে আসছে।বৃষ্টির বেগও কম।এখন বাসায় চলে যেতে হবে।তখনই পাশে তাকিয়ে দেখি আরো একটি কালো গাড়ি এসে থেমেছে।আমাকে হতবাক করে দিয়ে নীল ব্লেজার এবং গোবেচারা লোক দুজন নিজেদের মত করে সেই গাড়িতে উঠে বসছে।হতবাক এই কারণে ওরা আমার কলম ফেরত না দিয়েই ভেগে যাচ্ছে। এরা কি আমার কলম চুরি করার জন্যই এখানে এসেছিল?ভদ্র লোকদের এটা কেমন ব্যবহার?গতমাসে ফ্রেন্ডশিপ ডে তে এই দামী কলম আমার ফ্রেন্ড দিয়া গিফট করেছিল।ভীষণ পছন্দের ছিল আমার।সবসময় যত্ন করে রেখে দিতাম ব্যাগে।একটু আগে ব্যাগে হাত দেওয়াতে এই কলমটাই উঠে এসেছে তাই তখন লোকটাকে দিয়েছিলাম।
আমার বিস্ময় ভাব কাটার আগেই গাড়ি শব্দ তুলে চলে গেল।রাগের চোটে দাঁত কটমট করে উঠল আমার।মনে মনে বলতে লাগলাম,
‘ কলম চোরের দল কোথাকার! দিনদুপুরে আমার কলম নিয়ে পালিয়েছে।দু দটো গাড়ির মালিক অথচ তোদের কাছে কলমের অভাব যে আমার কলম নিতে হলো?যত্তসব।দেখতে তো মনে হচ্ছিল হাই সোসাইটির মানুষ কিন্তু ভেতরে ভেতরে চুরির ধান্ধা নিয়ে ঘুরে।হাহ্!’
.
বাড়িতে পৌঁছে রুমে ঢুকতে মায়ের সম্মুখীন হলাম।মাকে আমার রুমে দেখলে মনটা নিমিষেই ভালো হয়ে যায়।মা রুমে ঢোকা মানেই আমার অগোছালো রুমটা মুহূর্তেই পরিপাটি হয়ে সেজে উঠবে।
আমাকে দেখতে পেয়ে বলল,
‘ এসে গেছিস পূর্ণী! শোন আজ সন্ধ্যায় রেডি থাকিস।তোর খালামণিরা নাকি ইউএস থেকে ফিরেছে এক সপ্তাহ হবে।অথচ আমি জানি না।আজ ফোন করে বলল তাঁদের বাড়ি যেতে।কেমন লাগে বলতো!আমি তাঁর একমাত্র ছোট বোন আর সে আমাকে একবারের জন্যও জানালো না যে দেশে ফিরেছে।’
আমি কিছুক্ষণ ভাবুক ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থেকে মাকে প্রশ্ন করলাম,
‘ কোন খালামণি মা?ইউএসে আমার কেনো খালামণি থাকে বুঝি?’
মা বিছানায় চাদর ঠিক করছিল আমার কথা শুনতে পেয়ে তাঁর চলমান হাত দুটো থেমে গেল হঠাৎ। আমার দিকে কেমন যেন করুণ দৃষ্টি দিয়ে তাকাল।কাছে এসে মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
‘ হ্যাঁ।আমার বড় আপা।এইতো দেড় বছরের মত হবে উনারা ইউএস গেছে নিজস্ব ব্যবসার কাজে। কাজ শেষ হতেই আবার চলে এসেছে।আজ তাঁদের বাড়িতে গেলে আমি পরিচয় করিয়ে দেব।এখন হাত মুখ ধুয়ে আয়।আমি খাবার দিচ্ছি। ‘
বাধ্য মেয়ের মত চলে গেলাম ফ্রেস হতে।আমার প্রিয় কলমের কথা মনে পড়তেই মনটা আবার খারাপ হয়ে গেল।ইস কখনো ভালো হবে না ওই নীল ব্লেজারের ভুতটার।আমার কলম চুরির ফল একদিন না একদিন পাবেই।
_______________________________
সন্ধ্যার পর পরই আমরা সকলে খালামণির বাসায় যাওয়ার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লাম।সকলে বলতে আমি,সুহানা আপু,বড়মা আর আম্মু।ফারাজ বাসায় রয়ে গেছে ইমন ভাইয়ার সাথে।বড় আব্বু এবং আব্বু তো এখনো অফিসে।
প্রায় আধাঘন্টার মত রাস্তা পাড়ি দিয়ে আমরা পৌঁছে গেলাম খালামণিদের বাড়ির সামনে।দোতলা ছিমছাম ধরনের বাড়িটি অত্যন্ত আকর্ষণীয়।আমাদেরও তো ডুপ্লেক্স বাড়ি কিন্তু এত বিশাল নয়।খালামণিরা খুব ধনী তা এই বাড়ির নকশাতেই ফুটে উঠছে।
গেইটে ঢোকার পর আপু ফিসফিস করে বলল,
‘ তুই কি সত্যিই তোর খালামণির কথা মনে করতে পারছিস না?আমাদের বাড়িতে কত আসতো!’
‘ না আপু মনে পড়ছে না।আচ্ছা এসব ছাড়ো।দেখো এই বাড়িটা কি দারুণ না?’
‘ হ্যাঁ কিন্তু আগে আসিনি কখনো।উনারা তো চট্টগ্রাম থাকতেন না।উনারা ঢাকা নিজেদের ফ্ল্যাটে থাকতেন।এরপর ইউএস চলে গেছে।ওখানে থাকা অবস্থাতেই শুনেছি এই বাড়িটি বানিয়েছে।’
কথা বলতে বলতে চলে গেলাম ভেতরে।
চাকচিক্যময় আভিজাত্যের ছোঁয়া চারদিকে। এমন বাড়িতে ঢুকলেই মন ভালো হয়ে যায়।শুভ্রতায় ঘেরা ড্রয়িংরুমে ঢুকতে দেখা গেল সোফায় তিনটে মানুষ বসে আছে হাস্যোজ্জ্বল মুখে।আমাদের দেখতে পেয়ে মাঝবয়েসী সুশ্রী মহিলাটি আনন্দিত হয়ে বলতে লাগল,
‘ কতক্ষণ থেকে অপেক্ষা করছি তোমাদের জন্য! ভেতরে এসো। এই যে পূর্ণী কেমন আছিস তুই? ‘
আমি হেসে বললাম,
‘ জ্বি ভালো।’
ভাবছি ইনিই বোধ হয় আমার খালামণি।চেহারায় মায়ের সাথে অনেকটাই মিল।সোফায় বসে থাকা ওই লোকটি বোধ হয় খালু।আর ওই মিষ্টি মেয়েটি কি উনাদের মেয়ে?
আমার কৌতুহল মিটাতে সেই মেয়েটি নিজে থেকে আমার সাথে কথা বলতে শুরু করল।
‘ কিরে পূর্ণী! অহনা আপুকে ভুলে গেছিস তাই না?প্রত্যেক ছুটিতে ঢাকা বেড়াতে যেতি আমাদের বাসায় মনে পড়ছে না?’আমার সাথে কত গল্প করতি?’
আমার ধারণাই তাহলে ঠিক।এ তাহলে আমার খালাতো বোন হবে।হালকা হেসে বললাম,
‘ ভালো আছো আপু?’
তখনই খালামণি অহনা আপুকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠল,
‘ পুরনো বিষয় নিয়ে পূর্ণীর সাথে কথা না বলাই ভালো অহনা।ওর অতীত ওকে ভুলে যেতে দাও।বর্তমানটাই সত্যি।কেনো ওকে সেই দুর্ঘটনার কথা মনে করিয়ে দিচ্ছো?’
আপু দমে গেল।আমার দিকে তাকিয়ে অপরাধী মুখ করে বলল,
‘ স্যরি পূর্ণী!এই টপিক বাদ কেমন?এখন বল তোর পড়াশোনার কি খবর!’
অহনা আপুর সাথে আমি এবং সুহানা আপু খুব সহজেই মিশে গেলাম।একদিকে বড়রা তাঁদের নিজেদের মত আলাপ আলোচনায় মেতে উঠেছে অন্যদিকে আমরা।
এমন সময় সিড়ি দিয়ে নামতে থাকা ব্যক্তিটিকে দেখে কিছুক্ষণের জন্য চমকে উঠলাম আমি।ঝুলে যাওয়া চমশা আরেকটু ঠেলে ভালোমত দেখার চেষ্টা করলাম।না কোনো ভুল নেই।নিজের অজান্তেই বলে বসলাম,
‘ সেই ভুতটা এখানে?’
কথাটা বোধ হয় একটু জোরেই বলে ফেলেছিলাম কারণ সবাই তাঁদের আলোচনা থামিয়ে আমার দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।সেই ব্যক্তিটিও আমার দিকে সন্দেহজনক চাহনি দিয়ে রেখেছেন।বোধ হয় আমার কথা শুনে ফেলেছে।
অহনা আপু আমার কনুইয়ে খোঁচা দিয়ে বলল,
‘ পূর্ণী তুই ভুত কাকে বলছিস? এ তো আমার ভাইয়া।দুর্জয় ভাইয়া!’
এবার যেন আমি আকাশ থেকে পড়লাম।উনি অহনা আপুর ভাই মানে আমারও ভাই।খালামণির ছেলে।আল্লাহ্ আমি উনাকে ভূত, কলমচোর কিসব নামের উপাধি দিয়েছিলাম।কিন্তু আসল প্রশ্ন হচ্ছে আমি না হয় রাস্তায় উনাকে চিনতে পারিনি উনি তো আমাকে চিনতো।তাহলে তখন ইগনোর করল কেনো।ইচ্ছে করেই কথা বলেনি নাকি সত্যিই আমার চেহারা ভুলে গেছিল।
সকলের উৎসুক দৃষ্টি উপেক্ষা করে আমতাআমতা করে বললাম,
‘ হ্যালো দুর্জয় ভ..ভাইয়া!কেমন আছেন?’
দুর্জয় ভাইয়ার কুঞ্চিত ভ্রু এবার সোজা হলো।নির্লিপ্ত গলায় বলে উঠলেন,
‘ আ’ম ফাইন।তোর কি খবর?’
‘ জ্বি ভালো।’
ভাইয়া এসে আমাদের সামনের সোফায় হেলান দিয়ে বসে আম্মু এবং বড়মা’র সাথে কুশল বিনিময় করতে লাগল।হঠাৎ জানি না কি হলো আমার পেটের ভেতর কেমন যেন মোচড় দিয়ে উঠল।অস্থির লাগছে খুব।কিন্তু কেনো?এসির মধ্যে বসে থেকেও কপালে বিন্দু বিন্দু ঘামের উপস্থিতি টের পাচ্ছি। প্রচন্ড হাসফাস লাগছে।আড়চোখে দুর্জয় ভাইয়ার দিকে তাকালাম।উনার শান্ত চোখের চাহনি আমার উপর নিবদ্ধ। এটা দেখে আমার গলা শুকিয়ে উঠার মত অবস্থা। বেশ ভালো বুঝতে পারছি উনি আমার সামনে বসার পর থেকেই আমার এমন লাগছে।কারণটা মিলাতে পারছি না আমি।
অহনা আপুর হাতে চিমটি কেটে ফিসফিস করে বললাম,
‘ আপু তোমার রুমটা দেখাবে না আমাকে ?বাড়িটাও ঘুরে দেখতে চাই।চলো না!’
আমার কথায় সায় দিলেন আপু।সুহানা আপু যাবে না তাই আমিই গেলাম।
উপর তলায় উঠে হাঁফ ছাড়লাম। এতক্ষণ মনে হচ্ছিল কেউ জানটা বের করে নিচ্ছিল আমার।দুর্জয় ভাইয়াকে আমার শুরু থেকেই অদ্ভুত লেগেছিল।এখনোও লাগছে।
আপু আমাকে তাঁর সাজানো গোছানো কামরা দেখাল।সবকিছু কেমন পরিপাটি করে সাজানো।সবচেয়ে ভালো লেগেছে বারান্দাটা দেখে।আমার রুমেও বারান্দা আছে কিন্তু এত বিশাল নয়।
আপুর রুম থেকে বেরিয়ে এবার অন্য একটা রুমে ঢুকলাম।ঢুকতেই সর্বপ্রথম নজর গেল দেয়ালে টাঙানো বিরাট আকৃতির ছবিটির দিকে।ছবিতে দুর্জয় ভাইয়ার প্রতিমূর্তি। গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে পাশ ফিরে তাকিয়ে আছেন।বাহ্যিকভাবে উনি যেমন গম্ভীর ছবিতেও তা স্পষ্ট ফুটে উঠেছে।সাথে স্মার্মনেস এবং হাই লেভেলের এটিটিউড। খারাপ লাগছে না দেখতে।এটা তাহলে উনার রুম।বাহ্ এ তো দেখছি মেয়েদের থেকেও বেশি নিট এন্ড ক্লিন।
অহনা আপু আমার সাথে এটা সেটা নিয়ে কথা বলে চলছে।তখনই নিচ থেকে খালামণির গলা ভেসে আসলো।উনি আপুকে ডাকছেন।আপু বিরস মুখে বলল,
‘ আমার মা সারাদিনে আমাকে ননস্টপ ডাকতেই থাকে।তুই এখানে একটু দাঁড়া বনু।আমি চট করে দেখে আসি কেনো তলব করেছে আম্মিজান।’
আপু পা চালিয়ে বেরিয়ে গেল।আমি ঘুরে ঘুরে দুর্জয় ভাইয়ার রুমের জিনিসপত্র দেখতে লাগলাম।জানালার একপাশে বিশাল বড় বুকসেল্ফ।সেখানে মোটা মোটা বই ঠাসা।আবার একটা তাক ফাইলে ভর্তি হয়ে আছে।কোথাও এক বিন্দুও ধুলো নজরে আসছে না।তারমানে প্রতিদিন এগুলো ঝাড়পোঁছ করা হয়।বাহ্ বাহ্!
হঠাৎই পেছন থেকে কেউ বলে উঠল,
‘ কলম খুঁজতে এসেছো?’
দুর্জয় ভাইয়া ট্রাউজার্সের পকেটে দুহাত ঢুকিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন।কিছুটা চমকে উঠলাম আমি। সাথে কেমন জানি নার্ভাস লাগছে।কি আছে উনার মাঝে যে উনার উপস্থিতি আমাকে এতটা কাহিল করে দেয়!
চলবে…