তোর অপেক্ষায় পর্ব-৫

0
4466

#তোর_অপেক্ষায়
#সামান্তা_সিমি
#পর্ব_৫

পড়ন্ত বিকেলে রেলিঙ ঘেরা ছাদের কোণায় দাঁড়িয়ে আছি আমি।নিচে রাস্তার পাশের ছোট মাঠে পাড়ার ছেলেপুলেরা হৈ হৈ করে ফুটবল খেলছে।দর্শকের ভীড় মোটামুটি ভালোই জমেছে।কিন্তু এই মুহূর্তে খেলা দেখার প্রতি কোনো আগ্রহ বোধ করছি না।চোখ ঘুরিয়ে পাশের বিল্ডিংগুলোর ছাদের দিকে নজর দিলাম।কোনোটাতে চারপাঁচ জন মহিলা হাসাহাসি করে গল্প গুজব করছে আবার কোনোটাতে ছোট বাচ্চারা লাল নীল কাগজের তৈরি ঘুড়ি উড়ানোর ব্যর্থ চেষ্টা করছে।

আজ কোনো দৃশ্যতেই মন বসছে না আমার।সকালে তৃষা আসার পর ওর সাথে অনেকক্ষণ আড্ডা দিয়েছিলাম।স্কুলের নানা মজার ঘটনা বলছিল সে।ওই মুহূর্তে নিজেকে বড্ড অচেনা লাগছিল।দুর্ঘটনার পরের দিনগুলোর কথা মনে পড়লে এখনো ভয়ে কেঁপে উঠি।চোখ মেললেই যেন চারদিকের সবকিছু অচেনা লাগত,সব ধোঁয়াশার মত।বাড়ির প্রতিটা সদস্যের আদর এবং ভালোবাসায় সেই দুঃসময় কাটিয়ে উঠতে পেরেছি কিন্তু আমার জীবন থেকে হারিয়ে গেছে কিছু স্মৃতি। সুখের হোক আর দুঃখের কিছু স্মৃতি আমার জীবন থেকে চিরদিনের মত হারিয়ে ফেলেছি।
এসব ভাবতে গেলে ভেতর থেকে শুধু চাপা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে।

কাঁধে কারো স্পর্শ পেতে পেছনে ফেরলাম।সুহানা আপু, ইমন ভাইয়া এবং ফারাজ আমার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে।ওরা কখন এল একদম বুঝতে পারিনি।
মনের কষ্টগুলো একপাশে রেখে কৃত্রিম হাসি ফুটিয়ে বললাম,

‘ কি ব্যাপার তাল পাতার সেপাইরা!সবাই একসাথে এলে যে!’

ইমন ভাইয়া আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলতে লাগল,
‘ তোর মন খারাপ?একা একা ছাদে কি করছিস?মনের কথা আমাদের সাথে শেয়ার কর হালকা লাগবে।’

উদাস হয়ে বললাম,

‘ হালকা ভারীর কেনো বিষয় না ভাইয়া।মাঝেমধ্যে আমার ভীষণ আফসোস হয় জানো!ওই এক্সিডেন্টের কারণে না জানি কত স্মৃতি, কতগুলো মানুষকে হারিয়ে ফেলেছি। আজ দেখলে না তৃষাকে আমি চিনতে পারিনি।তৃষার মত এমন আরো কজন আছে কে জানে!’

আপু এবং ভাইয়ার চেহারা মলিন হয়ে গেল।কথাগুলো বলতে বলতে আমার চোখেও প্রায় পানি জমে গেছে।তখনই ফারাজ কোমড়ে দুইহাত রেখে বলতে লাগল,

‘ এটা কি হচ্ছে ইমন ভাইয়া! তোমরা কি ভুলে গেছো ড্রয়িংরুমে দুর্জয় ভাইয়া অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য।আপুকে ডাকতে এসে ওকে কাঁদিয়ে ছাড়লে তো!’

‘ দুর্জয় ভাইয়া আমাদের বাড়িতে কি করছে ফারাজ?’

‘ আমরা সব ভাইবোনেরা ঘুরতে যাব।প্ল্যানটা দুর্জয় ভাইয়ারই।চলো আপু দেরি হয়ে যাচ্ছে। ‘

ফারাজ একপ্রকার টানতে টানতে নিয়ে যাচ্ছে আমায়।হতাশ হলাম আমি।ওই লোক আমার আশেপাশে থাকলেই কেমন অদ্ভুত ফিলিংস হয়।যতই দূরে থাকার চেষ্টা করি ততই যেন কাছে চলে আসে।

বেগুনি এবং সাদার কম্বিনেশনের একটা সিম্পল থ্রি-পিস পড়ে নিলাম।শুক্রবারের দিনগুলোতে বাইরে তেমন কোথাও যাওয়া হয় না।বাড়িতে থেকেই সবাই হৈ হুল্লোড় করি।আজ তো মনে হচ্ছে জবরদস্ত ঘুরাঘুরি সাথে খানাপিনা চলবে।সব ভাইবোন একসাথে কিনা।

সিড়ি দিয়ে নামতে দেখি ইমন ভাইয়া সুহানা আপু আগে থেকেই রেডি হয়ে বসে আছে।দুর্জয় ভাইয়া মুখ গম্ভীর করে আব্বুর সাথে কি যেন গুজগুজ করে চলছে।তাঁর গায়ে সবসময়ের মত ফিটফাট পেশাক এবং যে কাউকে আর্কষণ করার মত এটিটিউড।আমাকে দেখামাত্র সেই অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন।এমন তাকানোতে হার্ট অ্যাটাক হয়েই যেত যদি না ইমন ভাইয়া বলত,
‘ চল দুর্জয় লেট হচ্ছে আমাদের। সুহানা আর পূর্ণী তোরা ফারাজকে নিয়ে আয়।’

ভাইয়ারা বেরিয়ে যেতে আমরাও তাঁদের অনুসরণ করলাম।আমি সবার আগে ঝটপট পেছনের সিটে বসে পড়লাম।আমার পাশে সুহানা আপু আর ফারাজ বসেছে।ভাইয়ারা সামনের সিটে।গাড়ি ছাড়ার পর ইমন ভাইয়া তাঁর স্বভাবসুলভ আচরণে বকবক শুরু করে দিল।তাঁর সাথে তাল মেলাচ্ছে আপু এবং ফারাজ।অন্যদিকে দুর্জয় ভাইয়া একমনে ড্রাইভ করছেন।যখন প্রয়োজন মনে করছেন তখনই মুখ খুলে ইমন ভাইয়ার সাথে কথা লেনদেন করছেন।উনার জন্য আমাকে মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকা লাগছে।উনার সামনে কথা বলতে গেলে এক ধরনের জড়তা আমাকে গ্রাস করে রাখে।ওই লোকটার মাঝে এমন কি আছে কে জানে?উফ্!দিনদিন আমার কাছে এলার্জির মত হয়ে যাচ্ছে উনি। দেখলেই কেমন উসখুস লাগে।

একটা পার্কের সামনে গাড়ি এসে থামল।ততক্ষণে সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে।পার্কের পরিবেশ শান্ত।এদিক সেদিক লাল সবুজ বাতি জ্বলছে।এখানে আগে কখনো আসিনি।ভিউটা দেখতে অপূর্ব।ফারাজ তো আগেভাগেই দৌড়াতে লাগল।সুহানা আপু ছুটছে তার পেছনে।ইমন ভাইয়ার কল আসাতে সে কিছুটা দূরে সরে গেল।এদিকে আমি একা রয়ে গেলাম মিস্টার এলার্জির সাথে।উনি আমার ঠিক পেছনে নিঃশব্দে হাঁটছেন সেটা না তাকিয়েও বুঝতে পারছি।সোজা রাস্তা বরাবর হাঁটতে হাঁটতে একটা লেকের পাশে চলে এলাম।আশেপাশে তেমন লোকজন নেই।লেকের চারদিকে বাহারী ফুলের গাছ।শীতল বাতাস ছুয়ে দিচ্ছে গাছের শাখা-প্রশাখা সাথে আমাকেও।
হঠাৎই মাথাটা কেমন চিনচিন করে উঠল।মনে হচ্ছে কেউ যেন পিন ফোটাচ্ছে।এক্সিডেন্টের পর থেকে মাঝেমাঝেই এই ব্যথাটা উদয় হয়।নিয়মিত মেডিসিন খেয়ে যাচ্ছি কিন্তু হাল একই।ডক্টর বলেছে সারতে সময় লাগবে।দু আঙুল দিয়ে কপালের একপাশ ঘষে যাচ্ছি এমন সময় দুর্জয় ভাইয়া এসে দাঁড়ালেন আমার পাশে।
উৎকন্ঠা নিয়ে বললেন,
‘ মাথায় পেইন হচ্ছে? আজ মেডিসিন নিয়েছিলি তো?’

জানি না কি হলো আমার একদৃষ্টিতে উনার দিকে তাকিয়ে রইলাম।যেন আমার চোখ উনার মাঝে কিছু একটা খুঁজে চলেছে।কিন্তু কিছুই খুঁজে পাচ্ছি না।সব কেমন ধোঁয়াটে।
দুর্জয় ভাইয়া আমার সামনে আঙুলে তুড়ি বাজিয়ে বলে উঠলেন,

‘ আমাকে দেখা শেষ হলে যা জিজ্ঞেস করেছি সেটার আনসার দে।’

উনার কথায় ঘোর কাটল আমার।লেকের টলমলে পানির দিকে তাকিয়ে অগোছালো ভাবে বলতে লাগলাম,

‘ ভাইয়া আমি বোধ হয় এর আগেও এই পার্কে এসেছিলাম।কিন্তু মনে করতে পারছি না।নিশ্চিত এক্সিডেন্টের আগে।ঠিক এই সময়টাতে আ..আমার খুব কষ্ট হয় জানেন মনে হয় কিছু একটা ধরতে গিয়েও ধরতে পারছি না।পুরনো দৃশ্যগুলো চোখের সামনে স্পষ্ট হতে গিয়েও ঝাপসা হয়ে যায়।গোলমেলে লাগে খুব।জানেন এই জায়গাটা অনেক পরিচিত লাগছে অথচ ঢোকার সময়ও মনে হচ্ছিল এখানে কখনো আসিনি আমি।আর ভালো লাগে না আমার।মাথায় এত চাপ নিতে নিতে না জানি কবে শেষ হয়ে যাই আমি।’

বলতে বলতে দুহাতে মাথা চেপে ধরলাম আমি।সব চুল টেনে ছিড়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে।এমন কেনো হলো আমার সাথে।একটা সুস্থ মানুষের মত জীবন চাই আমি।এভাবে তো আর জীবনধারণ করা যায় না।

কাঁধে স্পর্শ পেতে স্বাভাবিক হয়ে তাকালাম আমি।দুর্জয় ভাইয়ার চেহারা দেখে আঁতকে উঠলাম প্রায়।উনার চোখেমুখে অদৃশ্য যন্ত্রণার চিহ্ন।এমন লাগছে যেন উনার মনের ভেতর কোনো ঘূর্ণিঝড় চলছে যেটা বাহ্যিকভাবে দেখা যাচ্ছে না।
আমাকে অবাক করে দিয়ে উনি আমার হাত উনার শক্ত হাতের ভাঁজে নিয়ে নিলেন।ঢোক গিলে বললেন,

‘ পুরনো বিষয় নিয়ে ভাবিস না।যে স্মৃতি তোর থেকে বিদায় নিয়েছে সেগুলো ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করিস না।সেগুলো ফিরে না আসলেও তো কোনো ক্ষতি নেই।সামনের দিকে এগিয়ে যা।আমরা সবাই আছি তোর পাশে।’

কিছুক্ষণ থেমে বাজখাঁই গলায় বলে উঠলেন,
‘ শেষ হয়ে যাই মানে কি! ফার্দার এইসব ফালতু কথা শুনলে তোকে আমি কি করব নিজেও জানি না।’

আমি উনার মুঠোয় রাখা আমার হাতের দিকে তাকিয়ে আছি।এই লোকটাকে আমার আশেপাশে অনুভব করলেই আমার অস্থিরতা বেড়ে যায় অথচ এখন কেমন অবলীলায় দাঁড়িয়ে আছি।মনের ভেতর কেমন যেন উথালপাতাল লাগছে।অচেনা কোনো অনুভূতিরা বাসা বাঁধতে চাইছে।এক পলকের জন্য মনে হয় সবকিছু সরল অঙ্কের মত কত সহজ যা আমি একটু চেষ্টা করতেই বুঝে যাব।আবার মুহূর্তেই সব কঠিন থেকে কঠিনতর লাগে।সেই সরল অঙ্ক উত্তর না মেলে হয়ে যায় খটমটে।

‘ চলুন ভাইয়া! ওরা বোধ হয় খুঁজছে আমাদের।’

দুর্জয় ভাইয়া হাত ছেড়ে দিলেন।লেকের অপর পাশ থেকে সুহানা আপু হাত নেড়ে ডাকছেন আমাদের।সেদিকে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালাম।কিন্তু থেমে যেতে হলো।

‘ দুঃখের বিষয় কি জানিস পূর্ণতা! তুই না চাইলেও কিছু স্মৃতি তোর সামনে আসবে এবং তোকে তা বিনাবাক্য ব্যয়ে এক্সেপ্ট করতে হবে।তুই করতে বাধ্য। এছাড়া উপায় নেই।কারণ সেই স্মৃতির সাথে হয়তোবা কারোর মন, কারোর আশা, ভালোবাসা জড়িয়ে আছে!চাইলেও অবহেলা করতে পারবি না।একটু অপেক্ষা কর। খুব তাড়াতাড়ি সত্যির মুখোমুখি হবি!সেদিনের জন্য তৈরি থাকিস।’

কথাগুলো বলে দুর্জয় ভাইয়া চলে গেলেন।আমার সব মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। এসব কি বলে গেলেন উনি!আল্লাহ্ এই এক মাথা আমার।এরজন্য যন্ত্রণায় সব পাগল পাগল লাগে।উনার কথাগুলোর অর্থোদ্ধার এই মুহূর্তে কোনোভাবেই সম্ভব নয়।চারদিক ভনভন করে ঘুরছে যেন।

.

‘ দুর্জয় তুই বিয়ে করছিস কবে?আমার বিয়ে খেতে ইচ্ছে করছে রে!কতদিন কব্জি ডুবিয়ে খাই না।এই দেখ বিয়ের কথা উঠতেই আমার খাওয়ার কথা মনে পড়ে যায়।সেই আনন্দে আমার জিভে পানি চলে আসে।আহা!’

দুর্জয় ভাইয়ার বিয়ে এবং বিয়ের খানাপিনার কথা কল্পনা করতে করতে হারিয়ে যাচ্ছেন ইমন ভাইয়া।আমি যেখানে বসে আছি তার ঠিক সামনেই একটা গাছের সাথে হেলান দিয়ে দুর্জয় ভাইয়া দাঁড়িয়ে আছেন।চিরাচরিত নিয়ম হচ্ছে কারো বিয়ে নিয়ে কথা উঠলে সেই ব্যক্তির মুখের এক্সপ্রেশন কেমন তা অতিসত্বর লক্ষ্য করতে হবে।আমিও নিয়মের ব্যতিক্রম করলাম না।আড়চোখে তাকিয়ে ফেললাম দুর্জয় ভাইয়ার দিকে।
একি উনি তো আকাশের দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছেন।ওরেব্বাস্ বিয়ের নাম শুনতেই আনন্দে আটখানা!

ইমন ভাইয়ার সুখের কল্পনায় বা হাঁত ঢুকিয়ে সুহানা আপু বলে বসল,
‘ তোর বয়স কম হয়েছে নাকি?আটাশ পেরিয়ে উনত্রিশে পা দিতে চলেছিস এখনো ঢ্যাং ঢ্যাং করে ঘুরে বেড়াস।আগে নিজের জন্য মেয়ে খুঁজ তারপর অন্যের বিয়ে নিয়ে জল্পনা কল্পনা করিস।’

ইমন ভাইয়া মুখ ফুলিয়ে কিছু বলার আগেই আমি বলে ফেললাম,
‘ আপু আমার মনে হয় ইমন ভাইয়া বিয়ে করতে আগ্রহী কিন্তু লজ্জায় বলার হিম্মত পাচ্ছে না।যেহেতু সে আর দুর্জয় ভাইয়া সেইম এজ তাই দুর্জয় ভাইয়ার বিয়ের কথা বলে নিজেরটা বুঝিয়ে দিলেন।ঠিক তো ইমন ভাইয়া?’

সুহানা আপু দুইপাটি দাঁত বের হাসতে লাগল।পিচ্চি ফারাজও আইসক্রিম খাওয়া বাদ দিয়ে হাসার চেষ্টা করছে।যদিও কিছু বুঝতে পারেনি সে।
দুর্জয় ভাইয়ার দিকে চোখ পড়তেই আমার হাসি মিলিয়ে গেল।উনি ভ্রু কুঁচকে আমারই দিকে তাকিয়ে। উনার কি আমার লজিক পছন্দ হয়নি নাকি!নাকি উনারই বিয়ে করতে মাথায় বায়ু চড়ে আছে।তখন যেভাবে হাসছিলেন বাপরে!

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here