তোর_নামের_রোদ্দুর পর্বঃ২৯ লেখনিতে:মিথিলা মাশরেকা

#তোর_নামের_রোদ্দুর
পর্বঃ২৯

লেখনিতে:মিথিলা মাশরেকা

-শুদ্ধ একটা রেপিস্ট!তোমার সো কলড্ বর একজন ধর্ষক ইনসিয়া!আমার বোনের জীবনটা শেষ করে দিয়েছে ও!একটা ধর্ষকের সাথে সংসার করছো তুমি!তোমার হাসবেন্ড ইরহাম আজাদ শুদ্ধ এক্….

সর্বশক্তিতে চড় লাগিয়ে দিলাম আয়ানের গালে।রাগে চোখ দিয়ে পানি পরতে লাগলো আমার।মানুষ কতোটা নিকৃষ্ট হলে নিজের বন্ধুকে নিয়ে তারই বউয়ের কাছে এসব কথা বলতে পারে?এই মানুষটাকে কি করে বেস্টফ্রেন্ড বলেন শুদ্ধ?আয়ান ফুসে উঠে দুহাত চেপে ধরলো আমার।রাগে লাল হয়ে গেছে তার চোখজোড়া।

-হাউ ডেয়ার ইউ?আয়ান চৌধুরীর গায়ে হাত তোলার সাহস কি করে হয় তোমার?হোয়াট ডু ইউ থিংক অফ ইউরসেল্ফ?

-একদম চেচাবেন না!লজ্জা করে না আপনার?নিজে বন্ধুকে‌ নিয়ে এসব কথা বলতে?শুদ্ধকে নিয়ে এসব কথা বলতে?

-সত্যি বলতে কিসের লজ্জা?আর সত্যি এটাই যে…

-শাট আপ!আপনার মতো জঘন্য মানুষের কোনো কথা শোনার ইচ্ছে আমার নেই।ছাড়ুন আমাকে!ছাড়ুন!

-কাকে জঘন্য বলছো ইনসিয়া ভাবি?যে সত্যি বলছে তাকে?তবে যে তোমাকে এতোগুলো দিন মিথ্যে বলে এসেছে,তাকে কি বলবে তুমি?শুদ্ধ ভাইয়াকে কি বলবে তুমি?

-মাহি!

-ঠিকই বলছি আমি।মিথ্যে বলি নি তোমার বরের মতো!

-আমারই ভুল হয়েছে তোমার কল পেয়ে এখানে আসা।ভাবিনি তুমিও এই খারাপ লোকটার কথা বিশ্বাস করে এসবে জরাতে পারো।কাল ওই ম্যাসেজের মতো তোমার কলটাও ইগ্নোর করা উচিত ছিলো আমার।কে জানতো এইমুহুর্তে তোমার সাথে দেখা না করলে সুইসাইড করবে তুমি এতোবড় মিথ্যে বলে আমাকে এইসব কথা শোনানোর জন্য এখানে নিয়ে আসবে তুমি আমাকে।ছি মাহি!ছিহ্!এতোটা অধপতন তোমার মাহি?নিজের ভাইয়াকে নিয়ে এইসব বলতে এতোটুকো বাঝলো না তোমার?কি করে এই লোকটার সঙ্গ দিচ্ছো তুমি?এভাবে ব্রেইনওয়াশ করেছে এই লোক তোমার?

আয়ান ঝাড়া মেরে ছেড়ে দিলেন আমাকে।মাহির দিকে অগ্নিদৃষ্টি ছুড়ে কাপতে কাপতে চলে আসছিলাম।এই মেয়েটা এভাবে আমার জীবনটা নষ্টের জন্য উঠেপরে লাগবে ভাবতে পারি নি।কার জন্য?একদিনে পরিচয় হওয়া একজন অচেনা মানুষের জন্য।আর এই আয়ান?এই লোক তো মানুষ বলারও যোগ্য না।সবটা শুদ্ধকে বলবো আমি।তারই অগোচরে তার বলা বেস্টফ্রেন্ড তাকে কতোটা ঘৃনা কথা বলতে পারে।পথ আগলে দাড়ালো মাহি।দুটো কাগজ সামনে ধরে বললো,

-প্রমান আছে আয়ানের কাছে।

-মাহি!

-চোখ রাঙালে সত্যিটা পাল্টে যাবে না ইনসিয়া ভাবি।আয়ান সবটা বলেছে আমাকে।এতোদিন ও কোনো অফিসিয়াল ট্যুরে ছিলো না।শুদ্ধ ভাইয়াই আটকে রেখেছিলো ওকে।যাতে ও সত্যিটা তোমাকে জানাতে না পারে।

-তোমাদের কাউকে বিশ্বাস করি না আমি।আর সত্যি?এটা তোমাদের মুখে মানায় না।ডু হোয়াটএভার ইউ ওয়ান্ট।যাচ্ছি আমি।

-কোথ্থাও যেতে দেবো না তোমাকে।সবটা জানতে হবে তোমাকে।বলতে হবে,এই কাগজগুলো কি তবে মিথ্যে?শুদ্ধ ভাইয়া কেনো আয়ানকে আটকে রেখেছিলো?আয়ান পালানোর পর বেরোতে দেয়নি কেনো তোমাকে?নিজেও বাসা থেকে বেরোয় নি কেনো?তোমার সিম কেনো পাল্টেছে ভাবি?চৌধুরী ম্যানশন থেকে আয়ানের মা উধাও কেনো তবে?হসপিটালের দুশো ছয় নম্বর কেবিনে মুনিয়া নেই কেনো এখন?মুনিয়ার এই দশার জন্য তবে কে দায়ী?

-মুনিয়া?

-হ্যাঁ।হ্যাঁ।মুনিয়া।আমার বোন মুনিয়া।মেহজাবিন মুনিয়া।আমার জীবন।আমার পৃথিবী।শুদ্ধ যাকে শেষ করে দিয়েছে।

মেহজাবিন মুনিয়া!হসপিটালের বেডে যাকে অতোটা নির্মমভাবে পেয়েছিলাম,সেই মুনিয়া।কতোটা বাজে ঘটনা ঘটেছিলো ওর সাথে তা ওকে সেদিন দেখেই আন্দাজ করা যাচ্ছিলো সেই মুনিয়া।চোখ স্থির হয়ে গেলো আমার মাহির হাতে থাকা কাগজের দিকে।মাহি এগিয়ে এসে কাগজটা ধরিয়ে দিলো আমার হাতে।বড়বড় ফন্টে মুনিয়া রেপ কেইস দেখেই হাতপা কাপতে লাগলো আমার।ফাইলে চোখ বুলাতেই গনধর্ষনের মুল আসামীর নামে শুদ্ধর নামটা জ্বলজ্বল করছে।হাত থেকে পরে গেলো কাগজটা।কি দেখলাম এটা আমি?এরচেয়ে তো মৃত্যু ভালো ছিলো।ধপ করে বসে পরলাম মেঝেতে।টপটপ করে পানি পরছে চোখ দিয়ে।

-কি?এবার মানছো তো ইনসিয়া ভাবি?আমিও ভাবতে পারিনি শুদ্ধ ভাইয়া এমনটা করতে পারে।কিন্তু কাল যখন আয়ান ফোন করেছিলো আমাকে,আজ দেখা করে সবটা বললো,এইসব..এইসব প্রমান দেখালো,মানতে বাধ্য হলাম আমি।তুমিও মানতে বাধ্য।শুদ্ধ ভাইয়ার ওখান থেকে পালিয়ে এ কয়দিনে আয়ান এই কাগজগুলো জোগার করেছে,নিজের মা বোনকে খুজেছে।শুদ্ধ ভাইয়া ওদের জীবনটাকে শেষ করে দিয়েছে।শুদ্ধ ভাইয়াই মুনিয়াকে….

-শুদ্ধকে ভাইয়া ডাকার কোনো অধিকার তোর নেই মাহি!

গলার আওয়াজ শুনেই শ্বাস থেমে গেলো আমার।অতিকষ্টে ঘাড় ঘুরিয়ে দরজায় তাকালাম।শুদ্ধ!হাত মুঠো করে দাড়িয়ে আছেন উনি।পিছনেই কালো পোশাকে আরো সাত আটজন।

-শুদ্ধ?ত্ তুই?

শুদ্ধ একপলক আয়ানের দিকে তাকিয়ে আমার দিকে এগোলেন।আমার চোখ দিয়ে এখনো পানি পরছে।মাথা ফাকা ফাকা লাগছে।শুদ্ধ আমাকে ধরে তুলে পাশের এক চেয়ারে বসিয়ে দিলেন।চোখ মুছিয়ে দিয়ে বললেন,

-কাদিস না সিয়া।আয়ান ছুয়েছে তোকে তাইনা?ওর হাত আজ আমি….

কথা শেষ না করেই শুদ্ধ পিছন ফিরলেন।আমার চোখ মেঝেতে পরে থাকা কাগজেই।ততক্ষনে আয়ানকে তিনজন মিলে ধরে রেখেছে।শুদ্ধ এগিয়ে গিয়ে সোজা কলার ধরলেন আয়ানের।চেচিয়ে বললেন,

-আর কতো ক্ষতি করবি তুই আমার?আর কতো?এতোদিন সবটা মেনে নিয়েছি।কিন্তু আজ না।আজ আমার সিয়াকে স্পর্শ করেছি তুই।জানে মেরে ফেলবো তোকে।খুন করে ফেলবো তোকে আমি আজ!

-তুই কি করে এখানে?কে বলেছে তোকে?

-তোর কি মনে হয়?শুধু তুইই ডাবল গেইম জানিস?শুদ্ধর পিছন থেকে ওকেই ছুড়ি মারা প্রস্তুতি নিবি আর শুদ্ধ শুধু দেখে যাবে সবটা?

-তারমানে তুই সবটা….

-হ্যাঁ।সবটাই জানি আমি।তোকেও জানাবো বলে একটু সময় নিয়েছিলাম।হ্যাঁ।ঠিক ধরেছিস তুই।তোকে আমিই আটকে রেখেছিলাম এতোদিন।ভেবেছিলাম হয়তো শুধুরে দিতে পারবো তোকে।কিন্তু তুই তার যোগ্য নস।আজ সেটা আবারো প্রমান করে দিয়েছিস তুই।আজ সিয়ার দিকে হাত বাড়িয়েছিস তুই।তোর হাত আজ থাকবে না আয়ান।তোর হাত আজ থাকবে না!

-শুদ্ধ ভাইয়া!

শুদ্ধ তীক্ষ্মচোখে তাকালেন মাহির দিকে।সোজা এসে চড় লাগিয়ে দিলেন ওর গালে।মাহি টাল সামলাতে না পেরে মেঝেতে পরে গেলো।উনি হাটু গেরে মাহির সামনে বসে বললেন,

-নিজের বোনের মতো দেখতাম তোকে।আজ তুইই এমন করলি আমার সাথে?অবশ্য শুদ্ধর নিজের বলতে কিছুই নেই।

-শুদ্ধ ভাই্….

-ডোন্ট ইউ ডেয়ার!খবরদার ভাইয়া বলে ডাকবি না আমাকে তুই।তোর মুখে আমার নামটাও শুনতে চাইনা আমি।সজিব?ওকে নিয়ে যাও এখান থেকে।

শুদ্ধ উঠে দাড়ালেন।একজন লোক এসে টানতে লাগলো মাহিকে।শুদ্ধর এই রুপ সহ্য হলো না আমার।উঠে উঠে দাড়িয়ে দৌড়ে গেলাম মাহির কাছে।ওকে ধরে রাখা ব্যক্তিটির হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বললাম,

-খবরদার কেউ ছোবে না মাহিকে!

শুদ্ধ বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে।একটু স্বাভাবিক হয়ে বললেন,

-সিয়া?আচ্ছা।শোন।তুই….

-কিচ্ছু শুনতে চাইনা আমি আর।আপনার কাছ থেকে একবর্ণও শুনতে চাইনা আমি।

-হ্যাঁ।জানি তুই জানতে চাস না।এতোটাই বিশ্বাস করিস আমাকে।কিন্তু আজ….

-বিশ্বাস?কিসের বিশ্বাস?এই কথাটা মানায় না আপনাকে।সেদিন কি বলেছিলেন?আপনাকে যেনো ভুল না বুঝি আমি তাইনা?আজ মনে হচ্ছে এতোদিন যা বুঝেছিলাম সবটাই ভুল।বিশ্বাস করি না আমি আর আপনাকে!শুনতে পাচ্ছেন?আপনাকে বিশ্বাস করি না আমি!

-সিয়া!

-আমাকে ওই নামে ডাকবেন না আপনি।আপনার মতো হিংস্র কারো মুখে আমার নাম শুনতে রুচিতে বাধছে আমার।এতোটা হিংস্র আপনি শুদ্ধ?নেশায় বুদ হয়ে একটা মেয়েকে অসম্মান করেছেন,জীবন্মৃত হয়ে বাচছে মেয়েটা,একজন তার বোনের জন্য জাস্টিস চাইবে সে সুযোগটা যাতে না পায় এজন্য তাকে আটকে রেখেছিলেন,আপনার সত্যিটা বলেছে বলে নিজের বোনকেই গুন্ডাদের দিয়ে সরিয়ে দিচ্ছেন?আর কতো নিচে নামবেন আপনি?

-এসব কি বলছিস টা কি তুই?

-ঠিক বলছি।আপনি যা করেছেন,তার জন্য শাস্তি প্রাপ্য আপনার।মুনিয়ার অপরাধী আপনি।ছিহ্!এতোটা নিচ আপনি শুদ্ধ?এতোটা জঘন্য আপনি?আপনার মতো কাউকে কি করে ভালোবাসলাম আমি?না।বাসি না।ভালোবাসি না আমি আপনাকে।ভালোবাসি না এই হিংস্র মানুষটাকে।ঘৃনা করি আপনাকে শুদ্ধ!ঘৃনা করি!

শুদ্ধ হাত মুঠো করে দাড়িয়ে আছেন।কপালের রগগুলো ফুটে উঠেছে তার।

-তুই এসব মন থেকে বলিস নি সিয়া!তুই ভালোবাসিস আমাকে!

-ভালোবাসা?আপনি বোঝেন ভালোবাসা কি?তবে মুনিয়ার আজ এই দশা কেনো?কোথায়?কোথায় রেখেছেন মুনিয়া আর ওর মাকে?বলুন!উত্তর দিন!আজ বলতেই হবে আপনাকে।আপনার মতো একজন নিকৃষ্ট কাউকে শুধু ঘৃনা করা যায়।ভালোবাসা নয়!ভালোবাসি না আপনাকে আমি!ঘৃনা করি!আই জাস্ট হেইট ইউ!আপনি শুধুই একজন ঘৃনার যোগ্য মানুষ।ভালোবাসি না আপনাকে!ভালোবাসি না!

শুদ্ধ নুইয়ে গেলেন অনেকটাই।নিচদিক তাকিয়ে একপা দুপা করে পেছোচ্ছেন।টাল সামলাতে না পেরে পাশে রাখা আরেকটা চেয়ার ধরে দাড়িয়ে গেলেন।অসহায়ের মতো চারপাশে চোখ বুলিয়ে আস্তেধীরে আবারো পিছিয়ে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বসে পরলেন উনি।একহাটু ভাজ করে তার উপর হাত রেখে ছড়িয়ে রাখা পায়ের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন।শরীর কাপছে আমার।মুনিয়ার কথা মনে পরতেই আবারো চেচিয়ে বললাম,

-বলুন কোথায় রেখেছেন ওকে?নাকি মেয়েটাকে মেরেই….

-অনেক হয়েছে ম্যাম!এবার থামুন!

শুদ্ধর পাশ থেকে একজন মুখোশ খুলে ফেললেন তার।আয়ান বিস্ময় নিয়ে বললো,

-অশোক?তুমি?

-হ্যাঁ।আমি।আমিই মিস্টার চৌধুরী।

-তারমানে তুমিই সবটা শুদ্ধকে….

-হ্যাঁ।এই দেবতাতুল্য মানুষটাকে আপনার পাগলামির সমস্ত খবর আমিই দিতাম মিস্টার চৌধুরী।ইনফ্যাক্ট ইনিই আমাকে পাঠিয়েছিলো আপনার বাসায়।

শুদ্ধ ঠান্ডা গলায় বললেন,

-অশোক,এসব থাক।

-কেনো থাকবে স্যার?কেনো থাকবে বলতে পারেন?আজ পর্যন্ত কেউ বোঝে নি আপনাকে।ম্যামকে ভেবেছিলাম সে হয়তো…ম্যাম?আজ আপনার বিশ্বাস এতোটা ঠুনকো পরলো যে একটা কেইস ফাইল দেখেই স্যারকে অবিশ্বাস করলেন?এই আপনার ভালোবাসা?

-হাহ!আপনার স্যার তার কাজেই আমার বিশ্বাস হারিয়েছে।সে যদি….

-থামুন!আপনি….

-অশোক!ওর সাথে ওই গলায় কথা বলবে না তুমি!আয়ানকে নিয়ে চলো এখান থেকে।

-সরি স্যার।আজ আমি চুপ থাকবো না।আজ আমি বলবো সবটা।সবটা বলবো।

-কি বলবে তুমি?কি?বিশ্বাসঘাতক!আমার কাছে থেকে আমার চিরশত্রুর কাছে সব খবর পাঠিয়েছো তুমি।আজ বুঝতে পারছি।ডায়রিটা ফাইলের সাথে তুমি পাল্টেছিলো,আর আমাকে কিডন্যাপও তুমিই করেছো!সেদিন মনে করতে না পারলেও এখন বুঝছি,ওই মুখোশধারী লোকটা তুমিই ছিলে।

-হ্যাঁ।আমিই ছিলাম।আমিই ডুপ্লিকেট চাবি বানিয়ে আপনার গাড়ির ব্যাকসিটে ছিলাম সেদিন আয়ান চৌধুরী।আমিই পাল্টেছি আপনার ইনসিয়া ম্যামকে দেওয়া উপহার।আর এই সবটা…সবটা করেছি এই ভগবানসম মানুষটার জন্য যে তিনবছর আগে আমার মায়ের প্রান বাচিয়েছিলো।উপার্জনের উপায় করে দিয়েছিলো।আর তার বিনিময়ে যখন আমি তাকে কিছু দিতে চাইলাম,সে কি চেয়েছিলো জানো?আমার অসুস্থ্য বন্ধু আয়ানের পাশে ছায়া হয়ে থাকতে হবে তোমাকে অশোক!

শুদ্ধ ওভাবেই বসে।তার দৃষ্টি মাটিতে স্থির।আমি শ্বাস আটকে দাড়িয়ে আছি মাহিকে ধরে।

-অসুস্থ্য?কে অসুস্থ্য?এটা বলো অশোক!তুমি জানো মুন কোথায়।বলো কোথায় রেখেছে ওকে শুদ্ধ?আমার মাকেও চৌধুরী হাউজ থেকে সরিয়ে দিয়েছে ও।বলো কোথায় ওরা?

-মাকে যদি এতোটাই ভালোবাসতি তবে নিজেকে এতো বাজেভাবে তৈরী করতি না আয়ান!আজ তোর এইসব কাজের জন্য বেচে থেকেও মরে যেতে হতো না আমাকে।

দরজায় সাদা কাপড় পরে দাড়ানো মধ্যবয়স্কা এক মহিলা।আয়ান চেচিয়ে বললেন,

-আম্মু?তুমি?

-খবরদার আম্মু বলবি না আমাকে তুই!মরে গেছে তোর আম্মু!আমিও জানবো আয়ান নামের কোনো ছেলে নেই আমার।যদি কেউ থেকে থাকে তবে সেটা শুদ্ধ।তুই কেউ হোস না আমার!কেউ না!

-আন্টিকে এখানে কেনো এনেছো অশোক?

-ম্যাম নিজেই আসতে চেয়েছিলেন।আজ আপনার অবাধ্য আমরা স্যার।

অশোক সোজা আয়ানের কাছে এগিয়ে গিয়ে একটা কাগজ ধরলেন।আয়ান চোখ বড়বড় করে ওটার দিকে তাকিয়ে ব্যস্ত হয়ে বললেন,

-এ্ এটা তো মুনের হ্যান্ডরাইটিং।

লোকগুলো আয়ানকে ছেড়ে দিলে সে কাগজটা পরতে লাগলো।পড়া শেষে বিস্ময় নিয়ে তাকালো শুদ্ধের দিকে।অশোক বললেন,

-হ্যাঁ।এটা আপনার বোন মুনিয়ার লেখা।তিনবছর আগে মুনিয়ার সাথে হওয়া ঘটনায় শুদ্ধ স্যার দায়ী ছিলেন না তার স্বীকারোক্তি।

-এটা কি করে সম্ভব?

-আজ চারদিন হলো মুনিয়া ওর হাত নাড়াতে পারছে।আজ ওর থাইরয়েড অপারেশনও হয়েছে।হয়তো কিছুদিন পর থেকে কথাও বলতে পারবে ও।আর এই সবটা হয়েছে শুদ্ধ স্যারের জন্য।

বিস্ময় নিয়ে তাকালাম শুদ্ধের দিকে।সে লোকটা যেনো পাথর হয়ে গেছে।একধ্যানে মেঝের দিকেই তাকিয়ে।অশোক আবারো বললেন,

-তিনবছর আগে সে রাতে আপনার বোনকে শুদ্ধ স্যার অসম্মান করতে নয়,বাচাতে গিয়েছিলো মিস্টার চৌধুরী।পিছন থেকে একজন মাথায় আঘাত করায় শেষ রক্ষা করতে পারেননি উনি।ওরাই স্যারের ফোন আর গাড়ি নিয়ে যায়।আর যেগুলো প্রমান ভেবে আপনি স্যারকে দোষী সাব্যস্ত করে নিয়েছিলেন।রাগটা আপনার এতোটাই বেশি ছিলো যে মুনিয়ার বলা ওরা শব্দটাকেও ভুলে যান আপনি।গনধর্ষনের রিপোর্ট বানিয়ে,শুদ্ধ স্যারকে মুলদোষী সাজিয়ে ক্ষোভ মেটাতে পুলিশকে দিয়ে আপনিই ধমকি দিয়েছিলেন শুদ্ধ স্যারকে তাইনা?

শুদ্ধ স্যার বরাবরই আপনাকে বেস্টফ্রেন্ড ভাবতেন।তাই সে রাতের কথা আপনাকে বলতে চেয়েছিলেন।কিন্তু ঠিক তখনই আপনার পরিবর্তনগুলো চোখে পরে তার।নিজের সমস্যাগুলো তাই আর জানাননি আপনাকে।আমাকে আপনার বাসায় চলে যেতে বলেন।ওখানে আমি তার ডায়রির খোজও পাই।আর এটাও জানতে পারি ইনসিয়া ম্যামকে নিয়েও আকাশকুসুম ভাবছেন আপনি।ম্যামের বিষয়ে ইচ্ছে করেই বলি নি শুদ্ধ স্যারকে।হয়তো তখন বললেই ওনাদের জীবন থেকে এই আয়ান নামক অভিশাপটা থাকতো না।ডায়রির কথা শুনে স্যার বলেছিলো যদি আয়ান ওই ডায়রি পরে স্বস্তি পায়,তবে ওটা ওখানেই থাক।অনেক চেষ্টা করেছি স্যারের উপর আপনার রাগের কারন জানতে। পারিনি।সত্যিটা সামনে আসে সেদিন,যেদিন আপনি ইনসিয়া ম্যামকে ওইসব উপহার দিতে যাচ্ছিলেন।শুদ্ধ স্যারের অতীত!

কি বলুনতো?ফাইলগুলো দেখে আমি নিজেই ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।মানুষ কতোটা ঘৃনা পুষে রাখলে তার বন্ধুর সাথেই এমনটা করতে পারে!তাই‌ বদলে দিয়েছিলাম ওগুলো।ফাইলগুলো চলে যায় শুদ্ধ স্যারের হাতে,আর উপহারস্বরুপ ইনসিয়া ম্যামকে পাঠিয়েছিলাম শুদ্ধ স্যারের ডায়রি।যাতে উনি স্যারকে বুঝতে শেখেন।শুদ্ধ স্যার ফাইলগুলো দেখে বুঝতে পারেন সেদিনের মেহজাবিন মুনিয়াই আপনার বোন মুন।বৌভাতের দিন যখন আপনি হসপিটাল গিয়েছিলেন,শুদ্ধ স্যারের কথায় আমি লোকেশন ট্রাকার লাগিয়েছিলাম আপনার গাড়িতে।তারআগেও,শুদ্ধ স্যারের বারন থাকা সত্ত্বেও কয়েকবার ফলো করেছিলাম আপনাকে,লাভ হয় নি।কোনোভাবেই বুঝতে পারিনি মুনিয়া কোথায় আছে।স্যার সবসময় বলতেন,তোমার জন্য যেনো আয়ান এতোটুকো হাইপার না হয়।তাই নিজেকে শক্ত রেখে চলতাম আপনার সাথে।

মুনিয়াকে খুজে পাওয়ার পরপরই আপনাকে অপহরন করানো হয় স্যারের কথাতেই।ডাক্তারের কাছ থেকে জানতে পারি আপনার উপস্থিতিতে মুনিয়া উত্তেজিত হয়ে উঠতো,যা কোনোভাবে সেরে উঠতে দিতো না ওকে।প্রতিবার গিয়ে নিজের প্রতিশোধ,প্রতিহিংসার কথা শুনিয়ে আপনি নিজেই আরো অসুস্থ্য করে দিচ্ছিলেন মুনিয়াকে।অবশ্য যে নিজেই মানসিক ডিসঅর্ডারে ভুগছে তার কাছ থেকে আর কিই বা আশা করা যায়!

আয়ান বিস্ফোরিত চোখে তাকালেন অশোকের দিকে।বললেন,

-হোয়াট ননসেন্স?কি বলছো তুমি
অশোক?

-একবর্ন ভুল বলি নি।মুনিয়ার ঘটনা যে আপনার মনেও বাজেভাবে দাগ কেটেছে তার পরিনামে আপনি মানসিক ডিসঅর্ডারে ভুগছেন।রেগে গেলে হুশ থাকে না আপনার।এজন্যই মুনিয়ার কাছ থেকে সরাতে শুদ্ধ স্যার অপহরন করায় আপনাকে।ওখানে চেকাপও হচ্ছিলো আপনার।স্যার চেয়েছিলেন মুনিয়ার অপারেশনের পর আপনার সাথে দেখা করাবেন।যাতে ভুল বোঝাবুঝিটা মেটাতে সুবিধা হয়।এজন্য মুনিয়ার পাশে ছিলেন উনি সবসময়।ডক্টর ইশিতার সাথে কনসাল্ট করে আপনার অনুপস্থিতে আপনার চেয়েও বেশি দায়িত্ব পালন করেছেন শুদ্ধ স্যার।আপনার মায়ের সাথেও দেখা করিয়েছেন মুনিয়াকে।ইভেন ওর রেপিস্টদের স্কেচ করিয়ে ওদের শাস্তির ব্যবস্থাও করিয়েছেন,তবে তা কোনোরকম পাব্লিসিটি ছাড়াই,যেমনটা আপনি চেয়েছিলেন।এসবের জন্যই মুনিয়ার রেসপন্স বাড়তে থাকে।উনি এখন সুস্থ্য প্রায়।মাঝখান থেকে পালিয়ে এসে সবটা নষ্ট করে দিলেন আপনি।

আয়ান কাদতে শুরু করলেন।কাদতে কাদতেই দেয়ালে সজোড়ে ঘুষি লাগালেন কয়েকটা।মাথার চুল উল্টে দিশেহারার মতো দাড়িয়ে আছেন।মাহি মুখ চেপে ধরে কাদছে।ওকে ছেড়ে পিছিয়ে যেতে লাগলাম আমি।কি করেছি আমি এটা?কি করে করলাম?শুদ্ধকে কি করে অবিশ্বাস করলাম আমি?চোখের পানি নিজের মতো করে বয়ে চলেছে।অশোক এবার আমার দিকে ফিরে বললেন,

-ম্যাম?আপনিও?আপনিও আর বাকি পাঁচটা মানুষদের মতো ভুল বুঝলেন স্যারকে?স্যার যখন আপনাকে বলেছিলো ফিরে এসে সবটা বলবে,আপনি তো সেই কথাটাও একবার ভাবতে পারতেন।মানলাম চাক্ষুস প্রমান দেখেছেন আপনি,তবুও একটাবারও মনে হলো না এই রেইপ কেইস তিনবছর পর কেনো সামনে আসলো আপনার?শুদ্ধ স্যারকে এখনো কেনো কিছু করেননি আয়ান চৌধুরী?মুনিয়া সুস্থ্য হতে লাগলো কিভাবে?তিনবছর তড়পাতে থাকা মানুষটা কিভাবে বৌভাতের দিন থেকে নতুনভাবে আবিস্কার করতে শিখলো নিজেকে?নিজের ভালোবাসার কথা ভেবে এটা মনে আসলো না আপনার এই ফাইলের সত্যতা শুদ্ধ স্যারের কথার চেয়ে বড় নয়?একবারও মনে হলো না একটা ফাইল শুদ্ধ স্যারকে দোষী করে দিতে পারে না?অন্তত আপনার চোখে তো নয়ই!

ওনার একটা একটা কথায় ভেতরটা দুমরে মুচরে যাচ্ছে আমার।চোখ তুলে তাকালাম শুদ্ধের দিকে।ওভাবেই বসে উনি।মাটির দিকে তাকিয়ে।কাদছেন না,তবে ভেতরটাতে কি হচ্ছে তা ভাবতেই কলিজা মোচড় দিয়ে উঠছে আমার।এতোবড় ভুলটা কি করে করলাম আমি?আমিও মাহির মতো দুটো কাগজ আর কথার স্রোতে গা ভাসালাম?একমুহুর্তে ভুল বুঝে এতোবড় কথা গুলো বলে দিলাম?ভালোবাসি না শুদ্ধকে,বিশ্বাস করি না,ঘৃনা করি!এসব কথা কি করে বেরোলো আমার মুখ দিয়ে?কি করে উচ্চারন করলাম এগুলো?শুদ্ধর ভেতরটাতে কি চলছে এখন?কতোটা কষ্ট পেয়েছেন উনি তার আন্দাজ কতোটুকো আমার?এতোবার বলেছিলেন বিশ্বাস করতে।তা সত্ত্বেও যে কথাগুলো বললাম তাতে ক্ষমা করতে পারবেন উনি আমাকে?যা করেছি তা কি ক্ষমার যোগ্য?

#চলবে….

(পাঠকমহলে লক্ষ্যনীয় একঘেয়েমি।বেশী বাড়াবো না আর।ভুলত্রুটি মাফ করবেন)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here