বারের বিশেষ রুমগুলোর একটিতে আমায় জোর করে টেনে নিয়ে সেখানের বিছানায় ফেলে দিল এক যুবক। দেখে মনে হচ্ছেনা সে মাতাল। তবে তার চোখে আমি স্পষ্টভাবে ক্রোধ দেখতে পারছি। আমি সেখানে থেকে উঠে যেতে চাইলে সে আমার হাত বিছানায় জোরে চেপে ধরে বলল,
তোমার সাহস তো কম না তুমি আমার ভাইকে এরোন আহমেদ এর ভাইকে সবার সামনে চর মেরেছ?
বুঝতে পারলাম যে ব্যাক্তিটি আমাকে এখানে জোর করে টেনে নিয়ে এসেছে তার নাম এরোন আহমেদ। কিন্তু আমি কাকে চর মারলাম আবার? তাও আবার সবার সামনে? চর তো আমার এই লোকটিকে মারতে ইচ্ছে করছে আমায় এভাবে নিয়ে আসার জন্যে। আবার ভয়ও হচ্ছে, ইনি যদি আমার সাথে উল্টাপাল্টা কিছু করে বসে? আল্লাহ বাচাও আমাকে। আমি জোরে চিৎকার করা শুরু করলাম।
-বাচাও আমায় কেউ! এই লোকটা আমার ক্ষতি করতে এসেছে। কেউ বাচাও আমায়!
-এই মেয়ে তোমাকে কে বলেছে আমি তোমার ক্ষতি করতে তোমাকে নিয়ে এসেছি?
-তো?
-এর মানে কি তুমি চাও আমি তোমার কোনো ক্ষতি করি?
আমি মাথা নাড়িয়ে না বোধক উত্তর দিলাম। সে আবার বলল,
-নিজেকে কি মুভি এর নায়িকা মনে কর তুমি?
-ঠেকা পড়েনি তো আমার।
-তাহলে তুমি এভাবে বাচাও কেউ আছো করছ কেন?
-যদি আপনি আমার কোনো ক্ষতি করে বসেন তাই নিজেকে রক্ষা করার চেষ্টা করছি।
-তোমার মতো এই দুইটাকার মেয়েকে কি মনে হয় আমি কিছু করতে যাব? কি আছে তোমার?
কথাটায় যথেষ্ট অপমানিত হলাম আমি। কিন্তু এরোন আহমেদ যে আমার কোনো ক্ষতি করবে না তা নিশ্চিত হলাম।আমি বললাম,
– আমায় এভাবে এখানে জোর করে নিয়ে আসার কারণ কি?
– হুম পয়েন্টে এসেছো তাহলে। তোমার সাহস কি করে হয় ব্যাডমিন্টন ক্লাবে এরিককে সবার সামনে আজ চর মারার? আবার তুমি দেখি বারে ওয়েট্রেস এর কাজ কর।
– এই এরিক আবার কে?
– মশকরা কর তুমি আমার সাথে?
– আরে ধ্যাত আমি জানিনা তো এই এরিক মেরিক নামের কোনো মানুষকে। আর আপনি এখনো আমার উপরে এভাবে আমার হাত চেপে ধরে আছেন কেন? ব্যাথা লাগেনা বুঝি আমার?
– ওহ সরি।
এরোন আহমেদ আমার হাত ছেড়ে উঠে বসল। তারপর আমায় সোজা হয়ে বসতে সাহায্য করল। আমি বিরক্তি নিয়ে বললাম,
উফ কি ভারী আপনি!
-সরি, কিন্তু তুমি কি সত্যিই এরিককে চিনো না?
-কেন তিনি কোন মহামানব যে আমায় তাকে চিনতেই হবে?
-তুমিই তো ওকে চর মারলে।
-আচ্ছা বুঝলাম আমি মেরেছি। কিন্তু আপনার ওই ভাই কি করেছিল যে আমার তাকে মারতে হয়েছে?
-সেটা তো জানিনা। এই ঠিক বলেছো তো।
-হুম। আপনি এতো নিশ্চিত কিভাবে যে আমিই আপনার ভাইকে চর মেরেছি?
-কারণ একদিন বিকেলবেলায় সে আমাকে তোমার ছবি দেখিয়েছিল।
-আমার ছবি?
-হ্যাঁ তোমার ছবি।
-আর আপনি কি বলেছিলেন যেন আমি এরিককে ব্যাডমিন্টন ক্লাবে চর মেরেছি তাইতো?
-হুম।
-এরিক নাম বলেছিল যার ছবি আপনাকে দেখিয়েছে?
-হ্যাঁ প্রায় তো ওর মুখে তোমার নাম শুনি আমি।
-কি?
-হুম
-বলেন তো আমার নাম কি?
-রাহি।
-বুঝেছি।
-কি?
-এটা রাহির কাজ।
-হ্যাঁ এটা তোমার কাজ।
-ধ্যাত আমার নাম মিহি। রাহি হল আমার জমজ ছোট বোন।
-ওহ, কি?
-হ্যাঁ রাহি আমার জমজ বোন। এই আপনার সাহস তো কম না আপনি আমার বোনকে এভাবে এখানে মিয়ে আসতে চেয়েছিলেন।
-সরি, আসলে ও আমার ভাইকে চর মেরেছে শুনে আমার মাথায় রক্ত উঠে গিয়েছিল।
-এই খবর আপনাকে দিয়েছে কে?
-এরিকের এক বন্ধু।
-এরিক দেয়নি?
-না। আচ্ছা আমি আজ বাড়িতে গিয়ে রাহিকে প্রশ্ন করব। আপনি গিয়ে আপনার ভাই এরিককে প্রশ্ন কইরেন এই ঘটনার ব্যাপারে।
-ওকে। আপনার বোন কিন্তু খুব ভালো ব্যাডমিন্টন খেলোয়াড়।
-হ্যাঁ জানি, ওর ছোট থেকেই একজন নামকরা ব্যাডমিন্টন খেলোয়াড় হওয়ার খুব ইচ্ছে। আজ ও সফলতার সন্ধানে সেই পথেই অগ্রসর হচ্ছে।
-আপনি এখানে কাজ করেন কেন?
-আমার বোনের স্বপ্নই আমার স্বপ্ন। সেই স্বপ্ন সফলের জন্যেও বারের ওয়েট্রেস এর কাজ করি আমি।
-আপনার মা বাবা?
-নেই।
-ওহ সরি।
-সমস্যা নাই, আমি এখন আসি। আমার কাজ আছে। পরে বার ম্যানেজার আমায় বকবে।
-হুম, এই নিন আমার কার্ড। কোনো প্রয়োজন হলে আমায় জানাবেন প্লিজ। আমি খুব খুশি হব তাহলে। আর আজকের জন্যে মাফ করবেন আমায়।
-ঠিক আছে।
আমি এরোন আহমেদ এর কাছে থেকে কার্ডটি নিয়ে নিলাম। তারপর সেখানে থেকে সোজা কাজে চলে এলাম। মানুষটিকে খারাপ ভেবেছিলাম আমি, কিন্তু তিনি খারাপ নন। ধ্যাৎ আমিও যে কি না কি ভাবি! এখন সব কাজ গুছিয়ে আমায় হোস্টেলে যেতে হবে। রাহি মনে হয় এখনো না খেয়ে বসে আছে আমার জন্যে। কাজ সব শেষ করে বেরিয়ে পড়লাম হোস্টেলের উদ্দেশ্যে। আজ ভাগ্যটা ভালো আমার, তাই খুব জলদি একটা রিকশাও পেয়ে গেলাম। এখন যতক্ষনে আমি পৌছে যাচ্ছি সেই সময়কে অপচয় না করে আপনাদের কাছে আমার আর বোনটার পরিচয় দিয়ে দেই। খুব বেশি বড় না আমাদের পরিচয়। তাই মনে হয়না আপনারা বেশি বিরক্ত হবেন তা জানতে গিয়ে। আমি তাসনিয়া জাহান মিহি। আর আমার চেয়ে ২ মিনিটের ছোট আমার জমজ বোন তাসনিম জাহান রাহি। আমাদের বাবা আমাদের জন্মের ৩ মাস আগেই সমুদ্রে জাহাজডুবিতে মারা যায়। আর আমার মা ৪ বছর আগে আমাদের ছেড়ে বাবা যেই পথে পাড়ি দিয়েছে ঠিক সেই পথে পাড়ি জমান। আমি দিনে টিউশনি আর রাতে বারের ওয়েট্রেস হিসেবে কাজ করে আমাদের দুইজনের খরচ চালাই। দুইজনের তো তাই লেডিস হোস্টেলে বেশি খরচ লাগেনা। চলে যায় আমাদের। রাহিও দুইটা টিউশনি পড়ায়। আর এখন পাশাপাশি ব্যাডমিন্টন ক্লাবে জয়েন হয়েছে তার স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে। দুই বোন মিলে দিন কেটে যাচ্ছে ভালোই। দেখেন আপনাদের কাছে এই পরিচয় দিতে দিতে পৌছেও গিয়েছি আমি। এখন রাহি রাগ না করে থাকলেই হয়। মেয়েটা আবার পাজি বেশি। এইযে একজনকে চর মেরে দিয়ে বসে আছে।আর ওর কাজে ভুক্তভোগী আমি। চাবি দিয়ে গেট খুলে ঢুকে পড়লাম রুমে। আমার ঢুকতে দেরি কিন্তু রাহির ঝারি দিতে দেরি হল না। রাহি বলতে শুরু করল,
এতো সময় লাগে কেন? জানিস তো আমার একা থাকতে ভালো লাগেনা। খিদেও পেয়েছে কত! আর তুই খালি দেরি করিস।
-আমি যে কাজ করি একটু তো দেরি হবেই।
-অন্য কাজ কর না? ভালো লাগেনা আমার একা থাকতে। সময়গুলো পার হতে গিয়ে যে যুদ্ধ শুরু করে দেয়।
-পেট চালাতে হলে এই কাজটা এখন যে করতেই হবে। তুই যখন নামকরা ব্যাডমিন্টন খেলোয়াড় হয়ে যাবি, অনেক টাকা রোজগার করবি, তখন ছেড়ে দিব আমি এসব কাজ। তখন আমি শুধু বোনের টাকায় আয়েশ করব। আহ কি শান্তি!
-হুম জানিস আমি যদি পারতাম তাহলে তোকে কোনো কাজই করতে দিতাম না।
-জানি তো। আমি তো চাই একদিন সেই সময় আসুক। সেদিন তুইও খুশি আর আমিও।
রাহি আর কিছু বলল না। সোজা এসে আমায় জড়িয়ে ধরল। মেয়েটা এমনই, পাগলামি করবে, রাগারাগি করবে, তারপর নিজেই এমন বাচ্চামি করবে। যতই হোক মনটা খুব ভালো ওর। রাহি অন্যের কষ্ট সহ্য করতে পারেনা। আমি রাহিকে বললাম,
-নামাজ পড়েছিস?
-আজ ছুটি।
-কেন?
-আপু??
-ওহ বুঝতে পেরেছি। আমি ফ্রেশ হয়ে আসি তারপর একসাথে খেতে বসব।
-হুম যাও।
রাহি আমায় ছেড়ে দিল। আর আমি চলে গেলাম ফ্রেশ হতে। ফ্রেশ হয়ে খেয়েদেয়ে নামাজ পড়ে ঘুমিয়ে পড়লাম দুইজনে।
অন্যদিকে….
রাতে এরোন বাসায় এসে দেখল এরিক ড্রইংরুমে বসে বসে পপকর্ন খাচ্ছে আর টিভি দেখছে। এরোন যে এসেছে তবুও তার দিকে তাকায়নি। এরোন চুপচাপ নিজের রুমে চলে যেতে লাগলো। তখন এরিক এরোনের দিকে না তাকিয়েই টিভি দেখতে দেকগতে প্রশ্ন করল,
এসেছিল আপনার জিএফ?
এরোন ভ্রু কুচকে এরিকের দিকে তাকালো। এরিক তখনো এরোনের দিকে তাকায়নি। এরোন বলল,
নাহ সে আসেনি আজও। কি জানি কি হয়েছে রিয়ার?
এরিক তখন গানের সুরে বলে উঠলো,
বেদের মেয়ে রিয়া ভাইয়াকে কথা দিয়েছে,
আসি আসি করে ভাইয়াকে ফাঁকি দিয়েছে।
এরোন খুব চটে গেল এরিকের এই কথায়। এরোন টিভির রিমোট কেড়ে নিয়ে টিভি অফ করে এরিকের দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে বলল,
মজা লাগছে তোর? আমি এদিকে চিন্তায় মরে যাচ্ছি, ২ সপ্তাহ ধরে রিয়ার সাথে আমার কোনো যোগাযোগ নাই। আর তুই? একে কি ভাই বলে?
এরিক উঠে দাঁড়ায় আর বলে, আমি বলেছি রিয়া শুধু তোর সাথে টাইম পাস করছে। একদিন তোকে ফাঁকি দিবেই।
-আমার রিয়া এমন করতেই পারেনা।
-হুহ আমার রিয়া। (ভেঙ্গিয়ে)
-ওই তুই কিন্তু?
-আমি ঠিকই করি যখন যা করি।
-তাহলে আজ কি এমন কাজ করে এসেছিলি যার জন্যে সবার সামনে ব্যাডমিন্টন ক্লাবে রাহি তোকে চর মেরেছে?
-মানে?
চলবে…..
তোর_নেশালো_শহরে Part: 01
#Eshika_Khanom
(আসসালামু আলাইকুম।)