#দর্পহরন
#পর্ব-১১
শুভ্রা শুয়ে এপাশ ওপাশ করছে। তার ঘুম আসছে না। না ঘুমাতে ঘুমাতে তার অভ্যাস পরিবর্তন হয়ে গেছে। সামান্য শব্দ পেলে চমকে উঠছে, ভয় পেয়ে উঠে বসে থাকছে। সবচেয়ে আজব ব্যাপার খাটে শুয়ে ভালো লাগছে না তার। সে কিছুক্ষণ মেঝেতে শুয়ে রইলো। কিছুক্ষণ চেয়ারে বসে রইলো। তারপর আবার বিছানায় এলো। ঘুম নেই তবুও শুভ্রা চুপচাপ শুয়ে রইলো। তার দরজার বাইরে অস্থির পায়চারীর আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। শুভ্রা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে পাশ ফিরলো। সে জানে তার সাথে কথা বলার জন্য সবাই ব্যাকুল হয়ে আছে। কিন্তু সে কারো সাথেই কথা বলতে চায় না। পরিবারের মানুষের হাজারো প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার ইচ্ছে তার নেই। এইজন্য দরজার সিটকিনি আঁটকে আছে। তা না হলে দেখা যেত তার ঘরে একের পর এক লোক আসছে তো আসছে, প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে যাচ্ছে। নিজেকে বাঁচাতে তাই শুভ্রা রুমের দরজা আঁটকে আছে।
শুভ্রা আসলে কথা বলার মতো অবস্থায় নেই৷ একা থাকতে থাকতে এখন এতো মানুষ দেখে কেমন যেন অসস্তি হচ্ছে। তারউপর সবার অতি উৎসাহী চোখ শুভ্রাকে আরও বেশি মিইয়ে দিচ্ছে। শুভ্রা চোখ বুঁজে তার বন্দী জীবনের কথা ভাবলো। বন্দী জীবনে পালানোর চেষ্টা করাটা কি বিশাল ভুল ছিলো তা ধীরে ধীরে টের পেয়েছে শুভ্রা। এই চেষ্টা করার ফলে তার বন্দী জীবনটা ট্রমার মতো কেটেছে। রণ নামের মানুষটা সেইদিনের পর আর একদিনও যায়নি ওর কাছে। না খাবার দিয়েছে না ঘুমাতে দিয়েছে। ঘুমালেই পুরো বাড়ি অন্ধকার করে দিত। ফলে শুভ্রা ভয়ে জেগে উঠতো। একা একা অন্ধকারে বসে থেকে মনে হতো আশেপাশে কেউ আছে। চিৎকার করে কাঁদতো দিনের পর দিন। আর খাবারের কথা মনে এলেই গা শিউরে ওঠে শুভ্রার৷ উফফ! কী নিদারুণ কষ্ট। শুভ্রা গুঙিয়ে উঠলো। বালিশ চেপে ধরলো পেটের উপর। ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো। অনেকক্ষণ পরে বিরবির করে বললো-“আপনাকে মাফ করবো না কিছুতেই। নিজ হাতে কঠিন সাজা দেব আপনাকে।”
★★★
সকালে ঘুমিয়েছিল রণ। কিন্তু এতো এতো মানুষের ফোন পাচ্ছে যে ঘুমিয়ে থাকার উপায় নেই। বারবার ঘুমের ব্যাঘাত হওয়াতে বিরক্ত হয়ে দু’তিন ঘন্টা পরেই উঠে পড়লো। চোখ দুটো এখন ব্যাথা করছে রণর। উঠে ডাইনিং এ এলো রণ। ওকে দেখে জলি এগিয়ে এলো-“কিরে উঠে পড়লি যে?”
রণ হাই আঁটকালো-“ঘনঘন ফোন আসছে মা ঘুমাব কি করে?”
“তা তো আসবেই। নিজে পছন্দ করে এই পথ বেছে নিয়েছিস এখন বোঝ।”
রণ মায়ের দিকে তাকালো। জলির চেহারায় চাপা একটা খুশির আভা আছে। চোখ দুটো উজ্জ্বল হয়ে আছে। রণ মুচকি হেসে বললো-“তোমার কি হয়েছে মা? তুমি তো সারারাত আমার সাথে জেগে ছিলে এখনও দেখছি জেগেই আছো। তারপরও চেহারায় কোন ক্লান্তি নেই। কি ঘটনা বলোতো মা?”
জলি মুখটা গম্ভীর করার চেষ্টা করলো-“কি আবার ঘটনা হবে? তোর দুনিয়ার গেস্ট আসছে তাদের আপ্যায়ন দেখতে হচ্ছে। কাজের মেয়ে দু’টো কি এসব বোঝে? ওদের পেছনে লেগে থাকতে হচ্ছে, সব দেখিয়ে দিতে হচ্ছে। একটু আগেই মিহির এসে বললো এলাকার গন্যমান্য কেউ এসেছে। ভালো আপ্যায়নের ব্যাবস্থা করতে।”
রণ এগিয়ে এসে জলিকে জড়িয়ে ধরে-“আমার এই এচিভমেন্টে তুমি খুব খুশি তাই না মা?”
জলির চোখের কোনে খুশির বারিধারা চিকচিক করছে। সে আপ্লূত হয়ে মাথা নাড়লো-“এবার কিন্তু বিয়ে করতে হবে রণ। তুই ব্যস্ত হয়ে যাবি আমার সঙ্গী লাগবে। এতোদিন নানা টালবাহানা করেছিস তবে এখন আর শুনবো না।”
রণ হেসে দিয়ে পিছিয়ে গেল-“তুমি পারোও বটে মা। কেবল নতুন করে সব শুরু করছি। তুমি আমাকে পিছুটান দিয়ে বাঁধতে চাইছো এখনই? সব আগে একটু গুছিয়ে নেই। সবচেয়ে বড় কথা ওই বাঁদর দুটো বিদায় না করে আমার কি বিয়ে করা ঠিক হবে মা? দুটো মিলে তো শুধু আমার বউকে হেনস্তা করবে। ভেবেই হবু বউয়ের জন্য চিন্তা হচ্ছে আমার।”
শেষের দিকে কথা বলতে বলতে খানিকটা গম্ভীর হলো রণ। জলি রেগেমেগে এগিয়ে এসে রণর কান মলে দিলেন-“খবরদার আমার মেয়েদের কথা বলবি না। ওরা অনেক লক্ষী। তুই বিয়ে করার আগেই বউকে নিয়ে ভাবছিস? বোনদের শত্রুর আসনে বসিয়ে দিচ্ছিস?”
“উফফ মা! দেখলে অবস্থা? শুধু বউয়ের কথা একটু ভেবেছি তাতেই তুমি কেমন তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলে। তাহলে ভাবো বিয়ের পর কি করবে। এইজন্যই বিয়ে করতে চাই না মা। এই ভালো আছি।”
জলি অবাক হলো-“আরেহ! আমি কখন তেলেবেগুনে জ্বললাম? বুঝিনা ভেবেছিস? বিয়ে না করার ফন্দি সব। শোন এসব বলে লাভ হবে না এবার। তোর কোন..”
মিহির প্রবেশ করলো-“ভাই, উঠেছেন?”
রণ মিহিরকে দেখলো-“হ্যা, কেবলই উঠলাম। কি হয়েছে?”
“নিচে মাঠ পর্যায়ের কর্মীরা আসছে। আপনি ঘুমিয়ে আছেন বলার পরও যায় না। ওরা আনন্দমিছিল করতে চায আপনাকে নিয়ে।”
“আনন্দমিছিল তো সম্পূর্ণ ফলাফল প্রকাশের পর করার কথা। আচ্ছা ঠিক আছে চল আমি কথা বলছি। মা আমার জন্য কড়া করে একমগ কফি দেবে?”
জলি মুখ গোজ করলো-“পাঠিয়ে দিচ্ছি।”
রণ মিহিরের সাথে চলে গেল। সিড়ি দিয়ে নামতে নামতে ফিসফিস করলো-“কোন আপডেট পেয়েছিস?”
মিহির চাপা গলায় জবাব দিলো-“সব চুপচাপ। কোন আওয়াজ নাই।”
“পৌছেছে ঠিকমতো?”
“হ্যা। আমি নিজে দেখেছি।”
“আচ্ছা।”
রণর মুখেচোখে সস্তি ফুটে উঠলো। মিহির মিনমিন করলো-“কিন্তু ভাই, ওই মেয়ে আপনাকে দেখেছে। ওর বাপকে যদি বলে দেয় তাহলে কি হবে?”
“বলার কথা না। এমনকি ওর বাপেরও কোন উচ্চবাচ্য করার কথা না। করলে কি করবি তাতো জানিস।”
“ভয় করে ভাই। ওর বাপটা কিন্তু সাংঘাতিক।”
রণর চেহারায় অমনিশা নামে। সে ফিসফিস করলো-“মেয়েটাও কম সাংঘাতিক না।”
★★★
“তুমি তো ভারি মিষ্টি দেখতে। কে তুমি? মা, এই মেয়েটা কে?”
শুভ্রা তুলতুলের দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বললো। রিমার মাথায় চারটে সেলাই পড়েছে। তবুও তৃষিত নয়নে মেয়েকে দেখছেন। মাঝে মাঝে চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। শুভ্রা শুয়ে আছে মায়ের কোলে। তুলতুল জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সামনে। রিমা তুলতুলকে দেখে শুভ্রার দিকে তাকায়-“ও সোহেলের বউ তুলতুল।”
শুভ্রা মায়ের কোল থেকে উঠে বসলো। তার চোখে মুখে বিস্ময়-“ভাইয়া বিয়ে করেছে? কবে? আমাকে ছাড়া তোমরা ভাইয়ার বিয়ে দিয়ে দিলে? আমাকে তোমরা জানানোর প্রয়োজন বোধ করোনি?”
রিমাকে খানিকটা ব্যাকুল দেখায়। সোহেলের কীর্তি শুভ্রাকে বলা যাবে না। বাপ ভাইরা মেয়ের কাছে আলাভোলা মানুষ সেজে থাকে। তাছাড়া শুভ্রা এখন এসব ঘটনা শোনার মতো মানসিক স্থিতিতে নেই। তাই কি জবাব দেবেন বুঝে পেলেন না। দ্বিধা জড়িত কন্ঠে বললো-“কাউকেই জানাই নাই। ভাবছি তুই আসলে অনুষ্ঠান করবো।”
শুভ্রা সন্দেহ নিয়ে মাকে দেখলো-“কেন? কাউকে জানাও নাই কেন?”
রিমা কঠিন কন্ঠে বললো-“জানাবো কেমনে? তোর চাচী তো দেশে নাই জানোস। তুই মালিহা, তন্ময়, মুমু কেউ নাই। ওদের খবর দিতে হবে, দেশে আসবো তারপর না অনুষ্ঠান। আমি একা একা সব কাম পারিনা দেইখা তাড়াতাড়ি বিয়ে করাই দিছি।”
শুভ্রা তুলতুলকে দেখলো। মেয়েটা সুন্দরী, তবে চেহারা কেমন যেন ফ্যাকাশে। সবসময় তটস্থ হয়ে থাকছে। ও তুলতুলকে ডাকলো-“ভাবি, তুমি দাঁড়িয়ে আছো কেন? এখানে এসে বসো আমার পাশে।”
তুলতুল রিমার দিকে তাকালো একবার-“না আপা, আপনারা গল্প করেন। আমি বরং একটু রান্নাঘর হয়ে আসি। দেখি আপনার খিচুড়ির কি হাল।”
শুভ্রা আবারও মায়ের কোলে শুয়ে গেলো-“আচ্ছা, দেখো। হলে খানিকটা বাটিতে নিয়ে এসো।গরম গরম খাব।”
তুলতুল মাথা নেড়ে চলে গেলো। শুভ্রা চোখ বুঁজলো। রিমা মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। গালে হাত বুলিয়ে দিলো৷ শুভ্রার ত্বক রুক্ষ হয়ে গেছে, গায়ের রং ময়লা হয়েছে। অথচ শুভ্রার গায়ের রং মিলিয়েই নাম রাখা হয়েছিল। গলার বিউটি বোন একটু বেশিই দৃশ্যমান, শরীর শুকিয়ে কমনীয়তা হারিয়েছে। রিমা ফিসফিস করে ডাকলো-“ও শারমিন, ঘুমাইছোস?”
শুভ্রা ক্লান্ত গলায় জবাব দিলো-“ঘুম আসে না মা। অনেকদিন হলো ঘুমাই না তো।”
রিমা ভয়ে ভয়ে প্রশ্ন করলো-“ঘুমাস না কেন? কই আছিলি তুই? ঘুমাইতে দেয় নাই তোরে?”
“ভয়ে ঘুম আসতো না মা। একা থাকতাম তো।”
বলতে বলতে শুভ্রা কাত হলো। ওর কথাগুলো জড়ানো। ওর জীর্নশীর্ন চুলগুলো একপাশে দিলো রিমা। তখনই ঘায়ের নিচে কালসিটে দাগটা নজরে এলো। রিমা আলতো হাতে সেখানে হাত বুলায়-“এইখানে কি হইছে শারমিন? কেমনে ব্যাথা পাইছোস?”
জবাব এলো না কোন। মৃদু নাক ডাকার শব্দ পাওয়া গেলো। রিমা বিস্মিত হয়ে আবিস্কার করলো শুভ্রা ঘুমিয়ে গেছে তার কোলের মধ্যে। দু’হাতে রিমাক আগলে নিয়ে আছে। অনেকটা ভয় পাওয়া বাচ্চাদের মতো। রিমার কান্না পেয়ে গেল। তার মেয়েটা গত দুই মাস অনেক কষ্টে ছিল বোঝা যাচ্ছে। অথচ মা হয়ে কিছু করতে পারছে না।
“ঘুমাইছে?”
ফিসফিস করলো সালিম সাহেব। এতোক্ষণ দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে মা মেয়েকে দেখছিলেন। রিমাকে চোখ মুছতে দেখে এগিয়ে এলেন। রিমা মাথা দুলায়-“ভয় পায় একা থাকতে। দেখেন কেমনে ঘুমাইতেছে।”
নিচু স্বরে জবাব দিলো রিমা। সালিম সাহেব একদৃষ্টিতে মেয়েকে দেখে চলেছেন। রিমা ছলছল চোখে স্বামীর দিকে তাকালেন-“ওরে মনেহয় মা/র/তো ওরা।”
সালিম সাহেব ভ্রু কুচকে তাকিয়ে স্ত্রীকে দেখলেন-“কেমনে বুঝলা?”
শুভ্রার ঘাড়ের দিকে ইশারা করলো-“এই যে দেখেন কেমন কালা হইয়া আছে। খাইতে দিত না। গায়ের রং কেমুন ময়লা হইছে দেখছেন? শুকায়া গেছে দেখেন না।”
সালিম সাহেবের চোয়াল শক্ত হলো। তার কলিজায় হাত দেওয়া মানুষটাকে কিছুতেই ছাড়বেন তিনি। শুধু জানতে দেরি তাকে সাজা দিতে দেরি করবেন না মোটেও। মনেহয় তাকে জায়গা থেকে সরানোর জন্য বেশ বড়সড় পরিকল্পনা হয়েছিল। এটা কারো একার কাজ হতেই পারে না। তাকে সরিয়ে নতুন কাউকে তার জায়গায় বসানো, তার ক্ষমতা কমানো। এসব কিসের ইঙ্গিত দেয়? তাকে কি এভাবে দমানো যাবে? প্রতিপক্ষ জানেনা কার বিরুদ্ধে নেমেছে তারা। সে দা ইব্রাহিম সালিম, এতো সহজ নয় তাকে সরানো। আর তার সন্মানে আঘাত দেওয়ার চেষ্টা করলে কি হবে তা দেখিয়ে দেবেন শিগগিরই। এতোদিন চুপচাপ বসে ছিলেন কারন মেয়ে কাছে ছিলো না। এখন মেয়ে পেয়ে গেছেন, র/ক্তে/র ব/ন্যা বইয়ে দেবেন দরকার হলে। তবুও মেয়ের অ/প/হ/র/ণ কারীদের চাই তার। অপরাধী স্বয়ং নেত্রী হলেও তার ছাড় হবে না। কারণ, ইব্রাহিম সালিম এই দেশে একজনই। আর তাকে ঘাটালে, তার সন্মান নিয়ে টানাটানি করলে তার ফল যে ভালো হয় না এটা আবার নতুন করে বুঝিয়ে দেওয়ার সময় হয়েছে।
চলবে—
©Farhana_Yesmin