#দর্পহরন
#পর্ব-১২
রণর প্রতিমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহনের দিন আজ। সাংসদ হিসেবে শপথ নিয়েছেন নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার পঞ্চমদিনেই। সংখ্যাগরিষ্ট দল হিসেবে জনতা পার্টি বাংলাদেশ ক্ষমতায় এসেছে দুই সপ্তাহের অধিক হবে। এরমধ্যে রাস্ট্রপতির আমন্ত্রণে নেত্রী নতুন মন্ত্রীসভা গঠন করেছে। এবার তরুনদের অগ্রাধিকার দিয়ে গঠিত মন্ত্রীসভায় রণকে স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে যেটার পূর্ণ ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর অধীনে থাকবে। রণকে তার কাজের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে জবাবদিহিতা করতে হবে। এইরকম অচেনা কাউকে প্রথমবারেই এতো বড় মন্ত্রনালয়ের দাঁয়িত্ব দেওয়াটা আশ্চর্যজনক বইকি। পুরনো নেতাকর্মীদের মধ্যে এ নিয়ে জোর আলোচনা সমালোচনা হচ্ছে। নেত্রী অবশ্য কোন কথাই আমলে নেননি। উনি ওনার সিদ্ধান্তে অটল আছেন।
রণ আনন্দিত হবে নাকি হবে না বুঝতে পারছে না। শুরুতেই এতোবড় দায়িত্ব সে চায়নি কিছুতেই। রাজনীতির র বোঝেনা এখনো। যেখানে অপজিশন পদে স্বয়ং নিজের দলের বর্ষীয়ান নেতা সেখানে এই দায়িত্ব অনেকটা বোঝার মতো লাগছে তার কাছে। নির্বাচনের পর এলাকায় একটা মিটিং হয়েছিল যেখানে সব শ্রেনীর দলীয় কর্মী উপস্থিত ছিল। মিটিং এ রণ কথাই বলতে পারেনি। মিটিংটা মুলত দলীয় নেতাকর্মীদের আশা-আকাঙ্ক্ষার কথা শোনার জন্য আয়োজন করা হয়েছিল। মাঠপর্যায়ের নেতানেত্রীদের নানা দাবিদাওয়া ছিল যার মধ্যে এক নম্বর হলো তাদের জন্য কিছু করা। সরকারের সব কাজ একজনকে করার সু্যোগ না দিয়ে যেন সবার মধ্যে সমানভাবে বন্টন করা হয় যাতে দলের জন্য খেটে যাওয়া মানুষটাও কিছু টাকা উপার্জন করতে পারে। অতীতে এমন দাবী বারবার করা হলেও কেউ কানে নেয়নি। তাই এবার যেন বিশেষ নজর দেওয়া হয় এদিকটায়। এমন দাবী শুনে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠেছিল ইব্রাহিম সালিম। তার দাবী মিটিং এ ডেকে এনে তাকে ইচ্ছাকৃতভাবে অপদস্ত করা হচ্ছে। তার মতো এমন বর্ষীয়ান নেতা, দলের জন্য যার অনেক অবদান তাকে অপমান করা এটা কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না। তিনি মিটিং বয়কট করে চলে গেলেন। দেখা গেলো সমগ্র এলাকার সত্তুরভাগ দলীয় নেতা তার পিছু নিয়ে মিটিং বয়কট করলো। বোকা বনে গেছিল রণ। বুঝতে পারলো, তার প্রতিপক্ষ তার ভাবনার চাইতে কয়েকধাপ এগিয়ে। তার ভাবনার সাথে তাল মিলাতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হবে তাকে। দীর্ঘ শ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ায় রণ।
গায়ে নীল পাঞ্জাবির উপর অফ হোয়াইট কোটি চাপিয়েছে আজ রণ। চুরিদার পায়জামার সাথে কেতাদুরস্ত জুতো খুব মানিয়ে গেছে। চুলগুলোতে জেল লাগিয়ে সেট করে নিলো। জলি হাতে বাটি নিয়ে ঘরে ঢুকলো-“বাবাই, পায়েস রেঁধেছি তোর জন্য। একটু মুখে দে।”
রণ মুখের বিরক্তি কাটিয়ে হাসি আনার চেষ্টা করলো। মাকে সে এসব বুঝতে দিতে চায় না। না হলে মা ভয় পেয়ে যাবে।
“মিষ্টি খেতে ইচ্ছে করছে না মা।”
জলি এক চামচ পায়েস তুলে ছেলের মুখের সামনে ধরলো-“শুভ কাজে যাচ্ছিস মানা করিস না।”
রণ চুপচাপ খেয়ে নিলো। মায়ের পায়ে হাত দিয়ে সালাম করলো-“আসছি মা।”
জলি ছেলের মাথায় হাত রেখে দোয়া করলেন।
★★★
বর্তমানে তুলতুলের প্রধান কাজ শুভ্রার সাথে থাকা। তুলতুল ব্যাপারটায় বেশ আনন্দ পাচ্ছে। এতোদিন তার জীবনটা ছিল আলো আঁধারির গোলকধাঁধা। এখন শুভ্রা আসার পর যেন একটা দিশা খুঁজে পেয়েছে। সোহেলের সাথে তার সম্পর্ক নামকোবাস্তে। বিয়ের পর থেকে সোহেল কেন যেন তাকে সহ্যই করতে পারে না। যেই মেয়েটাকে তুলে এনে রেপ করলো তাকে বিয়ের পর একদিনও কাছে টানেনি। তুলতুল অবাক হয়েছে। সোহেলের প্রতি ঘৃনা ছাড়া আর কিছু ফিল করে না সে। দেখলে কেন যেন প্রথমদিনের স্মৃতি মনে পড়ে যায়। ঘৃনায় তুলতুলের গা কাঁপে, বুক ধরফর করে।
সোহেলের অবশ্য এতোসব দেখার সময় নেই। প্রায় রাতে সে মদ খেয়ে মাতাল অবস্থায় ফিরে আসে। তুলতুল বুঝেছে অন্য মেয়ে মানুষের কাছে যায় সে। এসব বোঝার কিছু ক্ষমতা আল্লাহ মেয়েদের দিয়েছেন। তুলতুলের তাতে কিছু যায় আসে না। সে অবাক হয়ে এ বাড়ির মানুষগুলোকে দেখে। অন্যের মেয়েকে তুলে এনে রে/প করলেও এদের কিছু মনেহয় না। অথচ নিজের কন্যার বেলায় এরা কতটা মানবিক। ভেবেই হাসি পেল তুলতুলের।
এ বাড়িতে রিমাকেই খানিকটা নরম মনের মানুষ মনেহয়। কিন্তু এই মানুষটা কি কিছু জানে না? তার ছেলেটা এমন জঘন্য কাজ করে সে মেনে নেয়? সে নিজেও তো একজন মেয়ে। কি করে মেনে নেয় আরেকটা মেয়ের অসন্মান? তুলতুল অনেকবার ভেবেছে এই বিষয় নিয়ে জিজ্ঞেস করবে রিমাকে। কিন্তু এখনো সাহস করে উঠতে পারেনি। তুলতুল যখন থেকে বুঝেছে এ বাড়িতে সে অনাহুত। অনেকটা বাধ্য হয়ে তাকে বউ বানানো হয়েছে তখন থেকেই তার মধ্যে ভয়টা জাঁকিয়ে বসেছে৷ পারতপক্ষে সোহেলের সামনে যায়না সে। রিমার সাথে মানিয়ে চলছে, চাবি দেওয়া পুতুলের মতো চলছে যাতে আবার পরিবারের কাছে ফিরতে পারে। মা ছোটভাই, চাচা চাচী আর অনেক মিস করে সে। মিস করে পড়ালেখার জীবনটাকে। এভাবে জীবনের মোড় ঘুরবে তা স্বপ্নেও ভাবেনি।
তবে একটা ব্যাপার সে ভেবে রেখেছে, চলে যাওয়ার আগে এ বাড়ির ভিত নড়িয়ে দিয়ে যাবে। কিভাবে কি করবে তা জানে না কিন্তু করবে। বাবার বিভৎস মৃত্যু দৃশ্য এখনো ভোলেনি সে। শীতলক্ষ্যায় ডুবে থাকা দুইদিনের ফুলে যাওয়া মৃ/ত/দে/হ দেখে মায়ের অজ্ঞান হয়ে যাওয়া ভোলেনি। আর নিজের স/ম্ভ্র/ম/হা/নির অপমানই বা কি করে ভুলবে? সব মনে রাখছে। একদম সময় মতো সব হিসাব চুকিয়ে ফেলবে।
★★★
শুভ্রা ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠছে। যদিও এখনও রাতে ঘুমায় না শুভ্রা। অন্ধকার সহ্য করতে পারে না। কোথাও অন্ধকার দেখলেই চেচিয়ে বাড়ি মাথায় করে। তার জন্য বাধ্য হয়ে রাতে বাতি জ্বালিয়ে রাখতে হয়। রাতে তুলতুল শুভ্রার সাথে থাকে। দিনে রিমা আঠার মতো মেয়ের পেছনে লেগে থাকে। সে প্রায়ই হরেকরকম মজাদার খাবার বানিয়ে আনছে, কাছে বসে মেয়েকে খাওয়াচ্ছে। তার জোরজবরদস্তিতেই শুভ্রা ধীরে ধীরে খেতে শুরু করেছে। ভগ্ন স্বাস্থ্য একটু একটু করে ঠিক হতে শুরু করেছে। চেহারার রুক্ষতাও কেটে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। রিমা নিয়মিত অয়েল ম্যাসাজ দিয়ে যাচ্ছে মেয়ের চুলে। চেহারায় নানা রকম প্রাকৃতিক উপাদান মাখিয়ে রাখছে। শুভ্রার বিরক্ত লাগলেও রিমাকে দমানো যাচ্ছে না। সে শুভ্রাকে এক সেকেন্ড চোখের আড়াল করে না।
রিমা আসলে মনে মনে ভীষণ ভয়ে থাকে। মেয়েটা এতোদিন কোথায় ছিল, কেমন ছিল, তার সাথে কিছু হয়েছে কিনা সেসব জানার কোন উপায় নেই। এ নিয়ে কোন প্রশ্ন করলেই শুভ্রা নিজেকে ঘরবন্দী করে ফেলে। তাই সে চেষ্টা বাদ দিয়েছে। কিন্তু মনের কু চিন্তা কিছুতেই দূর করতে পারে না। আচ্ছা, শুভ্রাকে কি… নিজের ভাবনা আগাতে দেয় না রিমা। দুশ্চিন্তায় রাতে ঘুম হয় না। অবশেষে সেদিন যখন মেয়ের পিরিয়ড হলো মনের পাথর সরে গেলো রিমার। নিজের ভাবনায় নিজেই লজ্জা পেলো। নিজের মেয়েকে নিয়ে এরকম ভাবনা ভাবতে কোন মায়েরই ভালো লাগবে না। রিমারও লাগে না কিন্তু সে নিরুপায়। শুভ্রার নিরবতা তাকে এরকম ভাবতে বাধ্য করেছে।
সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো শুভ্রা এখন একদমই কথা বলে না। সারাদিন চুপচাপ বসে থাকে। আবার যখন নিজ থেকে বলতে শুরু করে তাকে থামানো যায় না। বেশি লোকজন দেখলে ভয় পাচ্ছে। সারাদিন নিজের রুমে বই পড়ছে। তুলতুলও চুপচাপ ওর পাশে বসে থাকে। রিমা অবশ্য বলেছে ও যেন শুভ্রার সাথে এটাসেটা গল্প করে। তুলতুল মাঝে মাঝে চেষ্টা করে গল্প করার। কিন্তু ওর নিজের মনই তো ভালো থাকে না। জোর করে কি গল্প করবে?
আজ সালিম সাহেব বাড়িতে বলে পুরো বাড়ি একটু বেশি নিরব। সালিম সাহেবের মনমেজাজ খুব খারাপ থাকে ইদানীং। অকারণে চিৎকার চেচামেচি করে ফেলে মাঝে মাঝে। বাড়ির কাজের লোকেরা খুব তটস্থ থাকে। সালিম সাহেব বাসায় বলে রিমা আজ মেয়ের কাছে বসেনি বেশিক্ষণ। শুভ্রা হঠাৎ বই থেকে মুখ তুলে তুলতুলকে দেখলো-“আজ কি হয়েছে? কারো কোন সারা নেই।”
তুলতুল উদাস হয়ে জানালার ধারে বসে ছিল-“আপনার আব্বা বাসায়। তার খুব মেজাজ খারাপ আজকে। কারন কি জানি না। এখন টিভিতে কি যেন দেখতেছে।”
শুভ্রা উৎসুক হয়ে জানতে চাইলো-“কি দেখছে?”
“আমি দেখি নাই। তবে হলরুমে আপনার চাচারাও আছে।”
শুভ্রা উঠে দাঁড়ায় দেখে তুলতুল অবাক হয়ে তাকায়-“কই যান আপা?”
“মাকে দেখে আসি।”
তুলতুল অনিচ্ছায় দাঁড়াতেই শুভ্রা তাকে থামায়-“তোমার আসতে হবে না। আমি এখনই চলে আসবো।”
তুলতুল হাফ ছেড়ে বাঁচলো। হলরুমে সোহেলকে বসে থাকতে দেখেছে।
শুভ্রা পায়ে পায়ে হলরুমে এলো। সবাই গম্ভীর হয়ে বসে আছে। রিমা শুভাকে দেখে ডাকলো-“কি হইছে? কিছু খাবি? খিদা লাগছে?”
শুভ্রা মাথা নাড়ে। সালিম স্নেহময় দৃষ্টিতে মেয়েকে দেখলেন-“আম্মা, আমার কাছে এসে একটু বসেন। আমার ভালো লাগবে।”
শুভ্রা সংকোচ নিয়ে বাবার পাশে বসলো-“তোমরা সবাই মিলে কি দেখছো টিভিতে?”
মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন সালিম সাহেব-
“তেমন কিছু না আম্মা। আজকে আপার শপথ অনুষ্ঠান হইতেছে তাই দেখতেছি।”
শুভ্রা টিভির দিকে তাকালো-“কিসের শপথ?”
সালিম মেয়ের দিকে তাকায়। শুভ্রাকে কথা বলতে দেখে ভালো লাগছে তার। স্নেহার্দ কন্ঠে বললো-“নির্বাচন হইছে। দল জিতছে এখন প্রধানমন্ত্রী আর মন্ত্রীরা শপথ নিবে।”
“তুমি যাও নাই আব্বা? তোমাকে ছাড়া শপথ অনুষ্ঠান?”
সালিম সাহেবের বুকে লাগলো কথাটা। মেয়ে তার ক্ষমতা দেখে অভ্যস্ত। বুকে রক্তক্ষরন টের পেলেন। গম্ভীর হয়ে জবাব দিলেব-“আমার শরীর ভালো না আম্মা তাই যাই নাই।”
শুভ্রা কথাটা শুনলো কিনা বোঝা গেলো না। সে একদৃষ্টিতে টিভি দেখছে। হঠাৎ টিভির দিকে আঙুল তুললো-“এই ছেলেটা কে? ফুপুর পাশে দাঁড়িয়ে আছে?”
সালিমের চেহারায় বিস্ময়। মেয়ের নজর হঠাৎ রণর উপর কেন গেলো? তাহলে কি রণ সেই ব্যক্তি যে তার মেয়েকে….। সালিমের চোয়াল শক্ত হলো। সে মেয়ের মুখের দিকে তাকায়। শুভ্রার জুলজুলে চাহুনি কি কিছু বলতে চাইছে?
চলবে—
©Farhana_Yesmin
(দাওয়াত খেতে যাচ্ছি। গাড়িতে লেখা শেষ করে পোস্ট করলাম। বেশি বেশি করে লাইক কমেন্ট শেয়ার করে মন ভালো করে দেন😊।)