#দর্পহরন
#পর্ব-১৪
সবাই ড্রয়িংরুমে বসে ছিলো। ছিলো তুলতুল আর শুভ্রাও। সালিম সাহেবকে ঢুকতে দেখে সবাই নড়েচড়ে বসলো। রিমা ছুটে এলো স্বামীর দিকে-“কি হইলো? কি কইলো প্রতিমন্ত্রী? সোহেলরে ছাড়ান দিব?”
সালিম সাহেব জবাব না দিয়ে ক্লান্ত শরীর নিয়ে সোফায় বসলো দপ করে। চোখের উপর হাত রেখে হেলান দিয়ে সোফায় গড়িয়ে গেল। রিমা কি বুঝে চুপ করে গেলো। মোর্শেদ, শরীফ, তাহের দৃষ্টি বিনিময় করলো নিজেদের মধ্যে। গলা খাকরানি দিয়ে মোর্শেদ বললো-“সালিম, চুপ থাকলে কি সমাধান আইবো? কি কইলো ক আমাদের।”
“ভাইজান, কি বললো বলেন না কেন?”
তাহেরের কথায় রেগে গেল সালিম-“কি কইতে পারে বুঝস নাই? সোহেল খু/নি ওরে ছাড়ন যাইব না-এইটা কইলো। মানা কইরা দিলো আমারে। দুইদিনের পোলা এই সালিমরে মানা করলো। চিন্তা করছোস কিছু? ভাবছে আমার ক্ষমতা নাই কোন। হাহাহা।”
শরীফ এগিয়ে এলো-“আব্বা, এতো উত্তেজিত হয়েন না। আপনার শরীর খারাপ করবে।”
“কি কস তুই? আমার পোলা জেলের মধ্যে রইসে আর আমি শান্ত থাকমু? আমি বাপ হয়ে আরামে বসে থাকমু?”
শুভ্রা এগিয়ে এলো-“আব্বা, আপনে শান্ত হন। সোহেল ভাইয়ার কিছু হবে না। আমরা এতোগুলো মানুষ আছি কোন না কোন ব্যবস্থা হবেই আব্বা।”
সালিম জবাব দিলো না। চেচিয়ে তুহিনকে ডাকলো। তুহিন এসে দাঁড়াতেই জানতে চাইলো-“মাইয়াডার খবর বাইর করতে পারছোস?”
তুহিন আড়চোখে তুলতুলকে দেখে নিলো। তুলতুল কাঠের তৈরি পুতুলের মতো বসে আছে।
“খোঁজ পাই নাই। কোথাও নাই, মামলা দিয়া গায়েব হইয়া গেছে।”
সালিম ঘুষি মারলো সোফায়-“ওই রণই ওরে লুকাইয়া রাখছে যাতে আমরা খোঁজ না পাই। তুহিন, আমি কিছু জানি না। তুই ওই মাইয়ারে খুঁইজা বাইর কর। এই কামে কে কে আছে দেখ। একজন একজন কইরা সাইজ করুম।”
তুহিন শুনে মাথা নেড়ে বেরিয়ে গেলো। শরীফ বললো-“আব্বা, মাথা গরম কইরেন না। এইসময় মা/রা/মা/রি কা/টা/কা/টির চিন্তা বাদ দেন। যুগ বদলায়ে গেছে। এখন মানুষের হাতে হাতে মোবাইল। আপনি কিছু করবেন কেউ না কেউ ছবি তুলে নিবে। এরচেয়ে আমরা বরং এইটা ভাবি সোহেলকে কেমনে ছাড়ানো যায়। আপনে উকিলকে খবর দেন।”
সালিম রক্তলাল চোখে ছেলের দিকে তাকালেন-“আমার চেয়ে বেশি জানোস তুই? উকিল ধইরা কোন বা/লডাও হইবো না যদি প্রমান না মুছি। যারা সাক্ষ্য দিব তাগোর গায়েব করা লাগবো।”
শরীফ রেগে গেলো হঠাৎ-“এইজন্যই ভালো লাগে দেশে। খালি খু /ন/খা/রা/বির আলাপ। ভদ্র কোন আলাপ জানেই না এরা। বারবার বলতেছি এইসব কইরেন না, শুনবে না। যা খুশি করেন আপনি।”
শরীফ রেগে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলো। তাহের ছুটলো ওর পিছনে। মোর্শেদ শুকনো কন্ঠে বললো-“শরীফ একদম খারাপ কথা কয় নাই রে সালিম। তুই যদি ক্ষমতায় থাকতি তাইলে এক কথা আছিল। এখন নতুন নতুন পোলাপান রাজনীতি করে ওদের ভাবসাব আলাদা। একটু বুইঝা চলতে হইবো। তারপরও দেখ তুই যা ভালো বোঝছ কর আর কি।”
সালিম সাহেবের মেজাজ আরও খারাপ হলো। তার বাড়ির মানুষ তাকে বিশ্বাস করতেছে না। তাহলে বাইরের মানুষ কি বলবে? সেকি তার ছেলের জন্য খারাপ চাইবে? ছেলের ভালোর জন্য সব করবে সে।
তুলতুল চুপচাপ বসে ছিলো শুভ্রার বিছানায়। ওকে দেখে শুভ্রার খুব খারাপ লাগছে। গত দুই মাস ধরে মেয়েটা ওর সাথে ছায়ার মতো লেগে থেকেছে, গল্প করেছে। ওকে স্বাভাবিক জীবনে ফেরানোর চেষ্টা করেছে। এখন ওর নিজেরই বিপদ। অল্পবয়সী মেয়ে, স্বামীর এরকম ঘটনা শুনে মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে হয়তো। কষ্ট তো শুভ্রারও হচ্ছে। সোহেল একটু বদরাগী হলেও তাকে ভীষণ ভালোবাসতো। বোনের ইচ্ছেপূরনে সদা তৎপর থাকতো। এখন এসব শুনে কেমন যেন অবিশ্বাস্য লাগে। শুভ্রা তুলতুলের পাশে বসলো, নরম কন্ঠে জানতে চাইলো-“ভাইয়া চলে আসবে ভাবী। তুমি কিছু চিন্তা করো না। বাবা নিশ্চয়ই কোন ব্যবস্থা করবে।”
তুলতুল মাথা নাড়ে-“আমি চিন্তা করছি না তো।”
শুভ্রা অবাক হলো-“তাহলে? মন খারাপ করছো কেন?”
“এমনিতেই। আপনাদের মন খারাপ দেখে আমারও মন খারাপ হচ্ছে।”
শুভ্রা হেসে দিলো-“তুমি ভাইয়াকে পছন্দ করো না তাই না? তোমাদের কখনো সেভাবে কথা বলতে দেখিনি।”
তুলতুল জবাব দিলো না। শুভ্রা তুলতুলের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। ও বোঝার চেষ্টা করছে তুলতুলের মনে কি চলছে।
★★★
সোহেল হাজতে থেকে ভীষণ হইচই করছিল। এর আগে তাকে কখনোই হাজতে বন্দী থাকতে হয়নি। এবার হুট করে যখন হাতে হাতকড়া পরিয়ে নিয়ে এলো সোহেল বোকা বনে গেলো। ভেবে পাচ্ছিল না কি বলবে কি করবে। তবুও আশায় ছিলো বাবা হয়তো তাকে কোনভাবে ছাড়িয়ে নেবে। কিন্তু রাত হয়ে যাওয়ার পরেও কেউ এলোনা দেখে সে হম্বিতম্বি শুরু করে দিলো। থানার এসআই এলে তাকে গালিগালাজ করলো, দেখে নেওয়ার হুমকি দিলো। ফলাফল হিসেবে তাকে জেলের মধ্যে উত্তম মধ্যম দেওয়া হলো।
একদিন পরে তাকে কোর্টে তোলা হলো। বাবাকে দেখে সোহেল চিৎকার করে-“আব্বা, আমাকে এইখান থিকা বাইর করেন।”
সালিম ছেলেকে আস্বস্ত করলো-“তুই চিন্তা করিস না। আমি ব্যবস্থা করতেছি।”
কিন্তু সালিম সাহেবকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে সোহেলের জামিনের আবেদন নাকচ করে তিনদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করা হলে তার মাথার ঘায়ে কুত্তা পাগল অবস্থা হয়ে গেলো। কারো কাছ থেকে সহযোগিতা না পেয়ে সালিম সাহেব কিছুই করতে পারলেন না। তুহিন দু’জনকে ধরে এনেছিল বটে, তাদেরকে প্রচুর মারাও হলো কিন্তু তারা কিছুই বলতে পারলোনা। অক্ষম আক্রোশে নিজের মাথার চুল নিজে ছিড়ে ফেলার অবস্থা সালিমের। অতি উত্তেজনায় প্রেসার বাড়িয়ে বমি করে ঘর ভাসিয়ে ফেললে তাকে ঘুমের ওষুধ দেওয়া হলো।
পরদিন ঘুম ভাঙার পরেও নিশ্চুপ শুয়ে থাকে সালিম সাহেব। ছেলের জন্য তার বুকের ভিতর ভাঙচুর হয়। সেই দুঃখে তার চোখ থেকে অবিরাম জল বর্ষন হয়। এতোটা অসহায় এর আগে নিজেকে মনে হয়নি তার। কোনদিন দিয়েই কোন সাহায্য পাচ্ছেন না। কেউ সাহায্য করতে চাইছে না। রাতারাতি পরিস্থিতি এতোটা বদলে যাবে ভাবেননি একদমই।
শুভ্রা বাবার কাছে বসবে বলে এসেছিল। কিন্তু বাবা কাঁদছে এটা টের পেয়ে পর্দার ওপাশে ঠায় দাঁড়িয়ে ছিল পাঁচ মিনিট। বাবার অসহায় অবস্থা দেখে তারও কান্না পাচ্ছে। তার জীবনে কোনদিন বাবাকে এরকম অসহায় দেখেনি সে। পরক্ষণেই চোখ মুছে নেয় শুভ্রা। বাবাকে এরকম ভেঙে পড়তে দেবে না সে কিছুতেই। সাহস দেবে বাবাকে, কিছু একটা করবেই বাবা আর ভাইয়ের জন্য, করতেই হবে।
“বাবা, ঘুম ভেঙেছে?”
সালিম সাহেব নিজের চোখের জল মুছে নিলে হাসার চেষ্টা করলো-“আম্মা, আসেন আমার কাছে আসেন।”
সালিম সাহেব মেয়েকে হাতের ইশারায় কাছে ডাকেন। শুভ্রা বাবার মাথার কাছে বসলো। বাবার চুলগুলো হাল্কা টেনে দেয়-“মন কি বেশি খারাপ আব্বা?”
সালিম সাহেব চোখ বুঁজে রইলো, জবাব দিলো না। শুভ্রা ডাকলো-“আব্বা, একটা কাজ করতে তোমার অনুমতি চাই।”
এবার চোখ মেলে তাকিয়ে মেয়েকে দেখলেন। শুভ্রা উশখুশ করে চোখ লুকায়। সালিম সাহেব সন্দেহ নিয়ে বললো-“আম্মা, কি করতে চাইতেছেন বলেন তো?”
“আমাদের সব সমস্যার সমাধান চাইতেছি। যে আমাদের জন্য এতো এতো সমস্যা তৈরি করতেছে তাকে শায়েস্তা করতে চাইতেছি। তুমি শুধু আমাকে একজনার সাথে দেখা করার ব্যবস্থা করে দাও।”
শুভ্রা সংকোচের সাথে মিনমিন করলো। সালিম সাহেব জানতে চাইলো-“কার সাথে দেখা করবেন আম্মা?”
শুভ্রা ফিসফিস করে একটা নাম বললে সালিম সাহেব চোখ বড় বড় করে তাকায়, তার চোখে অবিশ্বাস-“তার সাথে দেখা কইরা কি করবেন?”
শুভ্রা হাসলো-“প্রানভোমরার জীবন চাবি তারই কাছে আব্বা। তাকে হাত করতে পারলেই আমাদের কাজ হবে।”
★★★
সোহেলের ঘটনা ম্যানেজ করতে রণকে দুটো দিন বেশি থাকতে হলো এলাকায়। সোহেলের রিমান্ড মঞ্জুর হওয়ায় খানিকটা সস্তি আসলেও সে জানে সালিম সাহেব চুপ করে থাকার মানুষ না। কিছু না কিছু সে করবেই। আর কি করবে সেটা জানে না বলেই চিন্তা হচ্ছে। সে চায় না তার কারণে কোন নিরীহ মানুষ ভুগুক। এইজন্য সারাক্ষণ ভাবনার মাঝে ডুবে থাকতে হচ্ছে তাকে।
প্রধানমন্ত্রীর সাথে জরুরি মিটিং শেষ করে ফোন হাতে নিতে দিলশাদের ফোন-“ভাই, সোহেল তো কোন কথাই বলে না। চুপ করে থাকে।”
“যেভাবেই হোক ওর কাছ থেকে সীকারোক্তি নিতে হবে দিলশাদ। না হলে সব চেষ্টা ভন্ডুল হয়ে যাবে। কি করবে এখন দেখো।”
“ও কঠিন ছেলে ভাই। মারধোর করে লাভ হবে বলে মনেহয় না।”
“তাহলে অন্য কোন পন্থা অবলম্বন করো। যেটাতে কাজ হবে সেটা।”
চাপা স্বরে আদেশ করলো রণ। দিলশাদ দ্বিধা নিয়ে বললো-“আচ্ছা দেখি। জানাব আপনাকে।”
বাসায় ফিরে সব সুনসান দেখে অবাক হলো রণ। সাধারণত সে বাসায় আসবে জানলে মা আর বোনেরা তার অপেক্ষায় থাকে। আজ মাকে না দেখতে পেয়ে বিস্মিত হলো। হাসিখুশি গম্ভীর মুখে বসে আছে তাদের কামরায়। রণ ওদের মাথায় গাট্টা মারে-“কি খবর হাসিখুশি? আজ তোদের মুখে ঘোর আমাবস্যা কেন? আর মায়ের কি হয়েছে? তাকে দেখছি না যে?”
“মা তার রুমে আছে ভাইয়া। জানি না কি হয়েছে, সন্ধ্যা থেকে দরজা দিয়ে শুয়ে আছে। দুপুরে খাবার খায়নি।”
খুশি জবাব দিলো। রণ চিন্তিত হলো কিন্তু বোনদের বুঝতে দিলো না-“আচ্ছা, তোরা ভাবিস না আমি দেখছি মায়ের কি হয়েছে।”
মায়ের রুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ডাকলো রণ-“মা, আসবো?”
“তুই ফ্রেশ হয়ে টেবিলে আয় রণ। আমি আসছি।”
জলি ঘরের ভেতর থেকে জবাব দিলো। সে এসেছে আর মা দরজা বন্ধ করে শুয়ে আছে মানেই বিরাট ঘাপলা। ভ্রু কুঁচকে গেল রণর। মায়ের গলা অনেক ভারী লাগছে। মা কি কোন কারণে কান্না করছে? রণর চিন্তা বাড়ে। সে তড়িঘড়ি করে শাওয়ার নিয়ে টেবিলে আসতেই মাকে দেখলো। মুখটা ভীষণ গম্ভীর। রণর বুক কাঁপতে লাগলো। কিছু কি হয়েছে? কেউ কিছু বলেছে নাকি সে কোন ভুল করেছে? কোনভাবে মাকে কষ্ট দিয়েছে? এতে গম্ভীর এর আগে মাকে দেখেনি সে। জলি চুপচাপ ভাত বেড়ে দিলো রণর প্লেটে। রণর খেতে ইচ্ছে না করলেও ভাত মাখিয়ে মুখে তুললো। মায়ের মুখ দেখার চেষ্টা করছে কিন্তু জলি সরাসরি তাকাচ্ছে না। রণ হঠাৎ নরম স্বরে মাকে ডাকলো-“মা, কি হয়েছে বলবে? তোমার এমন মুখ দেখে আমার গলা দিয়ে খাবার নামছে না।”
রণর ডাকে জলি যে দৃষ্টি মেলে রণকে দেখলো তাতে রণ একটা ধাক্কা মতো খেল। মায়ের দৃষ্টিতে অবিশ্বাস নাকি ঘৃনা বুঝে পেলো না। তবে এটুকু পরিস্কার বুঝতে পারছে সেই দৃষ্টিতে তার জন্য ভালোবাসাটা আর নেই।
চলবে—
©Farhana_Yesmin