দর্পহরন #পর্ব-১৬

0
241

#দর্পহরন
#পর্ব-১৬

পরের দিন অফিসে যাওয়ার সময় জলি রণর সামনে এলো না। জীবনে প্রথমবারের মতো এমন হলো যে রণ বাইরে যাচ্ছে আর জলি তাকে বিদায় দিতে আসেনি। রণ সারাটাদিন অফিসে অন্যমনস্ক হয়ে রইলো। গুরুত্বপূর্ণ কাজের ফাঁকে ফাঁকে কেবল মায়ের কথাগুলো কানে বাজছে। রণর মনটা ভীষণ ভার হয়ে রইলো। মা কেন এরকম অন্যায় জেদ করছে সে কিছুতেই বুঝতে পারছে না। মা কি জানে না ওরা কেমন? কতটা নির্দয় হতে পারে। ভেবে ভেবে মনটা অশান্ত হয়ে গেলো রণর। ওর সহকারী রাজিবকে ডেকে পাঠালো।
“ভাই, ডেকেছেন?”
রাজিব এসে দাঁড়ায়। রণকে ভীষণ গম্ভীর দেখা গেলো-“গতকাল মায়ের সাথে দেখা করতে বাসায় কেউ এসেছিল?”
রাজিব অবাক হলো-“হ্যা এসেছিল একজন মহিলা বোরকা পরে।”
“চেহারা দেখেছিস?”
“নাহ ভাই। মুখে নেকাব ছিল। আম্মা বলে রাখছিল, কোন মহিলা আসলে যেন তাকে বাসায় পাঠায় দেই।”
রণ চিন্তিত হয়ে জানতে চাইলো-“কখন এসেছিল?”
রাজীব ভীত গলায় জানতে চাইলো-“দুপুরের দিকে। কেন ভাই কোন সমস্যা হইছে?”
রণ বিরবির করলো-“সমস্যা মানে বিরাট সমস্যা হইছে।”
“ভাই কিছু বলতেছেন?”
রণ চমকে উঠলো-“নাহ কিছু না। শোন, আমি এখন উঠবো। সন্ধ্যার পর কোথায় যেন যাওয়ার কথা ছিল ওটা মানা করে দে। বলবি আমি অসুস্থ।”
রাজীব বিস্মিত হয়ে বললো-“আচ্ছা। কিন্তু হইছে কি?”
“পরে বলবো। এখন চল আগে বাসায় যাই।”
রাজীব ঘাড় হেলিয়ে বেরিয়ে গেলো।

বাসায় ফিরে সেই সুনসান নিরবতা। রণ মায়ের ঘরের সামনে এসে কয়েকবার মাকে ডাকলো কিন্তু কোন সাড়া পেলো না। বাধ্য হয়ে বোনদের রুমে এলো। হইচই করে পুরো বাড়ি মাতিয়ে রাখা হাসিখুশিও আজ নিরব। রণ মনখারাপ করে এসে ওদের বিছানায় বসলো। দুইবোন চুপচাপ পড়ার টেবিলের সামনে বসে ছিলো। ভাইকে দেখে বললো-“ভাইয়া, মা আজ সারাদিন খায়নি। রুম থেকেও বেরোয়নি। এরকম করলে তো মা অসুস্থ হয়ে যাবে।”
রণ চমকে গেলো-“সারাদিন খায়নি?”
“উহু। অনেকবার ডেকেছি বলেছে খাবে না।”
রণ কি বলবে ভেবে পেলো না। তার নিজেকে বড্ড অপরাধী মনেহচ্ছে। কিন্তু মায়ের অন্যায় আবদার মেনে নেওয়াও অসম্ভব তার পক্ষে। সে চুপ করে বসে রইলো। হাসিখুশি উসখুস করছে ভাইকে কিছু বলবে বলে। রণ সেটা বুঝে তাকায় ওদের দিকে-“কিছু বলবি তোরা?”
দু’জনই মাথা দুলায়-“কাল একটা মেয়ে এসেছিল বাসায়। মায়ের সাথে চুপিচুপি কি সব আলাপ করলো। মেয়েটা যাওয়ার পর থেকেই মা গম্ভীর।”
রণ কি মনে করে হুট করে নিজের মোবাইল থেকে একটা ছবি বের করে দেখালো-“এই মেয়েটা নাকি দেখতো?”
দুই বোন মন দিয়ে ছবিটা দেখলো। তারপর চেচিয়ে উঠে বললো-“হ্যা ভাইয়া, উনিই এসেছিল। কে বলো তো?”
“তোরা চিনবি না।” রণ ভীষণ চিন্তিত হলো।
“ভাইয়া, মেয়েটা কিন্তু বেশ সুন্দরী। তাই না হাসি?”
রণ অন্যমনস্ত হয়ে বোনদের দেখলো। তার মাথায় তখন শুভ্রার চিন্তা। এই মেয়ে কি উদ্দেশ্য নিয়ে মায়ের কাছে এসেছিল? মাকে পটিয়ে কোনভাবে তার বউ হতে? তারপর তাকে ব্যবহার করে ভাইকে জেল থেকে মুক্ত করা? পুরো চাল নিশ্চয়ই ইব্রাহিম সালিমের মাথা থেকে এসেছে? এই লোক এতেটাই নিচু মনের যে নিজের স্বার্থে মেয়েকে ব্যবহার করতে কুন্ঠিত হবে না। রণর চোয়াল শক্ত হলো, হাত মুষ্টিবদ্ধ। শুভ্রা কতোটা ঘাড়ত্যাড়া সেটা তার মা জানে না। দু’টো মাস রণকে জ্বালানোর হেন চেষ্টা নাই করেনি। শুধু মেয়েটার জেদের কারণে রণকে তার সাথে অভদ্রতা করতে হয়েছে। জেনেবুঝে এই মেয়েকে বিয়ে করা মানে নিজের মৃত্যুসনদে সাক্ষ্য দেওয়া। মা কেন বুঝতে পারছে না এসব ওদের চাল? রণ ছটফটিয়ে উঠলো। যে কোন ভাবে মায়ের সাথে কথা বলতে হবে। মাকে বোঝাতে হবে এসব কথা। রণ পুনরায় মায়ের ঘরের সামনে এলো। নরম গলায় মাকে ডাকলো-“মা, বিয়ের ব্যাপারে কথা বলবো তোমার সাথে। দরজাটা খুলবে? মা প্লিজ দরজাটা খোল।”
পাঁচ মিনিট পরে খট করে দরজা খোলার আওয়াজ এলো।
“ভেতরে এসো রণ।”
রণর বুকটা হুহু করে উঠলো। মা কাল থেকে তাকে তুমি সম্বোধন করেই যাচ্ছে। একটা মেয়ের জন্য মা তাকে কত দূরের মানুষ বানিয়ে দিয়েছে। নিজেকে সামলে নিয়ে মায়ের বিছানায় এসে বসলো রণ। জলি একটু দূরত্বে বসেছে। সে অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। মায়ের মুখ ঘুরিয়ে রাখা টের পেয়ে খারাপ লাগা বাড়লো রণর। সে বলেই ফেললো-“মা, আমি কি এতই খারাপ যে আমার মুখ দেখতে চাও না এখন?”
জলি জবাব দিলো না। রণ অপেক্ষা করলো এবার হয়তো মা তাকাবে তার দিকে।
“মা, তুমি সারাদিন খাওনি কেন? শরীর খারাপ করবে তো?”
জলি এবার মেজাজ দেখিয়ে বললো-“সে চিন্তা কি তোমার আছে? মাকে নিয়ে কতটা ভাবো তা দেখা হয়েছে আমার।”
“মা! এভাবে বলতে পারলে? আমি কবে তোমার চাওয়ার বিপরীতে কাজ করেছি মা?” রণ আর্তনাদ করে উঠলো।
“চাওয়া!” জলি তাচ্ছিল্যের সাথে হাসলো-“তুমি আমার ভাবনার অনেক বাইরে কাজ করেছ। যদি একটাবার মায়ের কথা ভাবতে তাহলে কোনদিন এমন কিছু করতে না যাতে তোমার মায়ের মাথা হেট হয়। কেউ তার দিকে আঙুল তুলতে পারে। কেউ এটা বলার সাহস পেতো না যে আমার ছেলের কারণে তার জীবন নষ্ট হয়েছে। ”
রণর হাসফাস লাগে। মাকে আর কতবার বুঝিয়ে বললে মা বুঝবে? সে অসহায় চাহুনি দিয়ে বললো-“তুমি কি একটুও বুঝতে পারছ না আমি কেন এমন করেছি?”
জলি এবার ছেলের দিকে তাকালো-“তুমি কি বুঝতে পারছ না আমি কেন এমন বলছি?তুমি ভাবছো আমি খুব শখ করে তোমাকে এই কাজ করতে বলছি? আমি শুধু ওই মেয়েটার জায়গায় নিজের সন্তানকে দেখছি। আর তোমাকে কিছুতেই মাফ করতে পারছি না। আমি জীবনে কোনদিন ভাবিনি আমার রণর দিকে কেউ আঙুল তুলবে। কেউ বলবে, এই ছেলেটা মেয়েদের সন্মান করে না।”
“তুমি অন্যায় জেদ করছো মা। ওই মেয়েটাকে এই বাড়িতে আনলে আমাদের সবার জীবন নরক হয়ে যাবে। ও যেনতেন কোন মেয়ে নয় মা। প্লিজ তুমি তোমার জেদ থেকে সরে এসো। চলো খেতে যাই।”
রণ উঠে জলির হাত ধরতে গেলে সে ঝাঁটকা দিয়ে হাত সরিয়ে দিলো-“আমাকে বুঝ দিতে হবে না রণ। আমি কোন বাচ্চা মেয়ে নই। সব বুঝে ভেবে ডিসিশন নিয়েছি। তুমি হয় আমার সিদ্ধান্ত মানো নয়তো আমাকে আমার হালে ছেড়ে দাও। যা হওয়ার হোক।”
রণ এবার মেজাজ হারালো-“মা তুমি কেন বুঝতে পারছো না এটা ইব্রাহিম সালিমের চাল। ওর ছেলেকে হত্যা মামলায় গ্রেফতার করা হয়েছে। সেইজন্য আমার পেছনে লেগেছে। এখন ওনার সাথে আত্মীয়তা করা মানে নিজের ক্যারিয়ারে কুড়াল মারা। দলের প্রান্তিক শ্রেনী, এলাকার লোকজন সবাই আমাকে বিশ্বাস করে মা। ওদের বিশ্বাসের খেলাপ করা হবে। ওরা আর ভরসা করবে না আমাকে। তাছাড়া ফুপি কি বলবে?”
জলির ভ্রু কুঁচকে এলো-“ফুপি! ফুপি কি বলবে? তার বলা না বলায় কি এসে যায়। তোমার বাবা এতো গুলো বছর হয় নিখোঁজ সে কি কোন খবর বের করতে পেরেছে? নাকি আমাদের দু’বেলা ভাত খাইয়েছে? আর রইলো এলাকার লোকের কথা। আমি তোমাকে ইব্রাহিম সালিমের পা চাটা গোলাম হতে বলিনি। মেয়ে জামাই হওয়ার পর ওরাই বরং তোমার কাছে ঠেকে থাকবে মেয়ের সুখের কথা ভেবে।”
রণ হাসলো-“এরকম কিছুই হবে না। না তুমি ইব্রাহিম সালিমকে চিনেছ না ওর মেয়েকে। ওরা বরং আমাকে গোলাম হতে বাধ্য করবে।”
“আমার আর চেনার দরকার নেই। শোন রণ, আমার চুলগুলো এমনি এমনি পাকেনি। অবশ্যই তোমার চাইতে বেশি বুঝি আমি। আমার দুটো মেয়ে আছে, ওদের বিয়ে দিতে হবে। তুমি আছো। আমি চাই না আমার এই ছোট পরিবারে কারো নজর লাগুক। আর তুমি রাজনীতির মাঠে নেমেছ এতো ভয় পেলে চলবে কেন? ওরা যদি তোমাকে বশ করতে চায় তাহলে তুমি থেমে থাকবে কেন? তুমি ওদের হাত থেকে নিজেকে বাঁচাতে পারলেই না বোঝা যাবে কিছু শিখেছ। এরপরও যদি তুমি না মানো তাহলে আর কিছু করার নেই আমার। তোমাদের নিজেদের হালে ছেড়ে আমি নিজেকে মৃত্যুর হাতে সপে দেব।”
“মা! আমাদের এতিম করে দেওয়ার কথা তোমার মাথায় এলো কি করে?” রণর হুঙ্কার শুনে কেঁপে উঠলো জলি। কথাগুলো বলতে তারও যে বুক কেঁপেছে ভীষণ। জলির চোখদুটো জ্বলছে।
“তুমি বুঝলে না দূরের শত্রুর সাথে যুদ্ধ করা আর শত্রুকে ঘরে টেনে আনার মধ্যে পার্থক্য কতটা। বেশ, মেনে নিলাম তোমার জেদ। তবে তোমারও একটা কথা মেনে নিতে হবে। এরপর আমি বউয়ের সাথে কিভাবে জীবন কাটাবো সে বিষয়ে কিছু বলতে পারবেনা তুমি। কোন ধরনের নাক গলাবে না আমার বিবাহিত জীবনে। যদি কথা দিতে পারো তাহলে যেদিন বলবে বিয়ে করবো।”
জলি কিছু বলতে যেয়েও নিজেকে সামলে নিলো-“আমি কথা বলে নিচ্ছি ওদের সাথে। পরশু যাবো ওদের বাড়িতে। ছোটখাটো আয়োজনে বিয়ে সারবো। পরে বড় করে রিসিপশন করা যাবে।”
রণর মুখেচোখে ঘোর আমাবস্যা। সে হেরে যাওয়া মানুষের মতো ফ্যাসফ্যাসে গলায় বললো-“ওসব নিয়ে যা খুশি করো। আপাতত খেতে এসো। তোমার কারণে কাল থেকে কিছু খাওয়া হয়নি আমার। দয়া করে খেতে দাও আমাকে।”
“তুই শাওয়ার নিয়ে আয় আমি খাবার রেডি করছি।”
রণ অবসন্ন ভাবে উঠে দাঁড়ায়। পায়ে কোন জোর পাচ্ছে না সে। টলতে টলতে মায়ের ঘর ছাড়ে। কোনরকমে নিজের ঘরে ফিরে বিছানায় গড়িয়ে পড়ে। এতকিছু করে শেষ পর্যন্ত সে কিনা নিজের ঘরেই হেরে গেলো? এই অনুভূতি তাকে হেরে যাওয়ার চাইতেও বাজে অনুভূতি দিচ্ছে যা তার কাছে ভীষণ পীড়াদায়ক লাগলো। শুভ্রা তার মাকে দখল করে নিলো? এরপর মেয়েটা কিকি করবে ভাবতেই মাথা দুলে উঠছে তার। যতটা স্বপ্ন নিয়ে রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শুরু করেছিল তার সবটাই যেন ধুলোয় মিলিয়ে গেলো। ঘরের মধ্যে শত্রু বসে থাকলে সে কিভাবে শত্রুর বিনাশ করবে?

চলবে—
©Farhana_Yesmin

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here